রাতে পড়ালেখা শেষ করে বেশ দেরিতে ঘুমিয়েছিলাম। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। ক্লাস শুরু হওয়ার তখন মাত্র ৪০ মিনিট সময় বাকি। তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। বেলা অনেক হয়েছে। ১১টার ক্লাস ধরতেও সমস্যা হচ্ছে ঘুমের জন্য। কি আর করবো! সকালের নাস্তাও করা হয় নি। ক্লাসে গিয়ে হাজির হলাম ঠিক সময়ে। কিন্তু স্যার আসে নি এখনো। বসে বসে অপেক্ষা করছি। কিছু ছেলে মেয়ে বাইরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে গল্প করছে। এরা যে কতো গল্প করতে পারে! গল্পের এতো টপিকস পায় কোথায়! আধ ঘন্টা অপেক্ষা করার পর জানতে পারলাম স্যারের ক্লাস হবে না। এক ত্যাদড় টাইপের ছেলে বলে উঠলো, স্যার মনে হয় উনার বিশেষ কাউকে নিয়ে ঘুরতে গেছে। আমাদের এই ক্লাস টিচারটা অবিবাহিত। তাই উনি ক্লাস না করাতে আসলেই সহপাঠীরা এমনসব প্রেডিকশন করে বসে।
আজকে আর কোন ক্লাস নেই। সহপাঠীদের কেউ কেউ হলে ফিরে যাচ্ছে। কেউ কেউ সেমিনারে গিয়ে পড়তে বসেছে। আমার অবশ্য এতো পড়ালেখার মন নেই যে গিয়ে সেমিনারে বসবো। কয়েকজন যাবে সিনেমা দেখতে। কি একটা নতুন সিনেমা রিলিজ পেয়েছে। কাহিনী নাকি খুবই ভালো। আমাকেও অনুরোধ করলো সঙ্গে যেতে। চিন্তা করলাম এরা সিনেমা দেখতে যাওয়া মানেই শহরের সবচেয়ে ভালো সিনেমা হলে যাওয়া। টিকেটের দাম অনেক বেশি, সঙ্গে পপ কর্ণ খাওয়ার টাকা। সব মিলিয়ে বেশ কিছু টাকা চলে যাবে। একজন অবশ্য বললো নায়িকা খুবই সৌন্দর্য্য। তবে সৌন্দর্য্য নায়িকার বিষয় আমাকে টানলো না। হ্যাংলা টাইপ একটা মেয়ে হাত নেড়ে চেড়ে বললো, তুমি যাবা না কেন? অনেকইতো যাইতাছে?
মেয়েটার কথা বলার ধরণ খেয়াল করলাম। এইসব হচ্ছে নতুন স্টাইল। সহজ ভাবে বললাম, আসলে আমার ভালো লাগছে না।
এরপরে আর কথা থাকে না। চলে আসলাম বাসায়।
ইউনিভার্সিটি থেকে যেহেতু আগে ফিরতে পেরেছি তাই ভাবলাম টিউশনীতে যাওয়ার আগে অবন্তীদের বাসা হয়ে যাই। অবন্তীদের বাসায় ঢুকেই দেখি অবন্তীর বাবা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন। দিনের খবরের কাগজটা উল্টে পাল্টে দেখছেন। আমি কাছে যেতেই চশমা খুলে হাতে নিলেন। বসতে বললেন পাশের চেয়ারটাতে। তারপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-
তোমাকে গত কয়েকদিন দেখি নি। শরীর খারাপ করেছিল নাকি?
আঙ্কেল, আসলে আমি ইদানিং একটু বিজি হয়ে গেছি।
ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়টা আসলেই ঠিক না। আর গত কয়েকদিন না দেখার বিষয়টাও ঠিক না। দুইদিন আগেও দেখা হয়েছে উনার সাথে। তবে এখন এইটা নিয়ে বলতে গেলেই লেকচার শুরু হবে। বয়স হয়ে গেলে কি কি সমস্যা শুরু হয় এই বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। এখন অবন্তীর বাবার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুরু শোনার কোন মুড নেই। আমি এসেছি অবন্তীর সাথে কথাবার্তা বলতে। ইদানিং অবন্তীর সাথে কথাবার্তা বেশ জমে উঠছে। আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। উঠতে যাবো এমন সময় অবন্তীর বাবা বললেন-
বসো, একটা ব্যাপারে তোমার সাথে একটু কথা বলি। দেখি তোমার কি মত?
কি কথা আঙ্কেল? একটু বেশি আগ্রহ দেখলাম। এই বয়সী লোকদের কথায় আগ্রহ দেখালে এরা খুব খুশি হয়।
বিষয়টা অবন্তীর ব্যাপারে।
মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। অবন্তীর ব্যাপারে আবার আমার কাছে কি মত চাইবেন উনি। আমি চুপ করে থাকলাম।
আসলে আমি চাচ্ছিলাম অবন্তী বিদেশে গিয়ে পড়ালেখা করুক। কিন্তু অবন্তী দেশেই পড়ালেখা করতে চায়। তাছাড়া পেইন্টিং বিষয়ে তার খুব বেশি আগ্রহ। কিন্তু আমি চাই সে বিদেশ থেকে আইন বিষয়ে পড়ে আসুক।
আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছিলাম। আমার মনে তখন অন্য চিন্তা। অবন্তীর বিদেশ যাওয়া মানেই তার সাথে আমার বিকালের আড্ডা বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমাদের পরিচয়টা আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে। আলোচনার ক্ষেত্রও বাড়ছে। এখন যদি অবন্তী বিদেশ চলে যায় তাহলে হয়তো তার সাথে পরিচয়ের গাঢ়তা আর বাড়বে না। আমার চুপ করে থাকা দেখে দেখে উনি জিজ্ঞেস করে বসলেন-
কিছু বলছো না যে? তোমার মত কি?
দেখুন আঙ্কেল, আমি আলাদা করে কি আর বলবো। তবে আমার মনে হয় এ ব্যাপারটিতে অবন্তীরই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা তার আছে। সে সিদ্ধান্ত নিলেই মনে হয় তার জন্য ভালো হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও। অবন্তী এখন বাগানে বসে আছে। তোমরা গল্প করো গিয়ে। আমি ভেবে দেখি বিষয়টা।
অবন্তীদের বাগানটা অনেক চমৎকার। সবসময়ই কোন না কোন ফুল ফুটে থাকে। ফুটে থাকা হলুদ ফুল দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। দেখি বাগানের এক কোনে বসে আছে অবন্তী। কাছে গিয়ে দাড়াতেই মুচকি হেসে বললো- বসেন। কেমন আছেন?
ভালো আছি? আপনি?
বুঝতে পারছিনা। এতক্ষণ ধরে চিন্তা করতেছিলাম ঠিক কেমন আছি। আচ্ছা এই যে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই আপনি কোন কিছু না ভেবেই বলে ফেললেন ভালো আছি, এইটা কি শুধু বলার জন্য বলা?
আসলে আমি এতো কিছু ভেবে বলিনি। আপনার কি কোন কারনে মন খারাপ?
আ আমার? নাহ, এমনিতেই বললাম। যাইহোক বসেন গল্প করি। অনেকদিন পর গল্প করার মুড আসছে।
মনে মনে ভাবলাম ব্যাচেলর স্যার ক্লাস না নেওয়ায় ভালোই হলো। অবন্তীর গল্প করার মুড আসছে, এমন একটা দিনে তার সাথে দেখা করতে পেরেছি।
অনেক ধরনের বিক্ষিপ্ত কথাবার্তা হলো। এক পর্যায়ে কিছুক্ষণ থেমে থেকে আমাকে অবাক করে দিয়ে অবন্তী জিজ্ঞেস করে বসলো-
আচ্ছা সম্পর্ক বিষয়ে আপনার কি ধারণা?
খেয়াল করলাম অবন্তী পরিস্কার করে সম্পর্ক কথাটা উচ্চারণ করেছে। ইচ্ছা করলেই সে রিলেশন অথবা অ্যাফেয়ার শব্দটা বলতে পারতো। আজকাল এই দুটি শব্দই বেশি প্রচলিত। স্কুল জীবনে শুনতাম, কারো মধ্যে সম্পর্ক আছে মানেই তাদের মধ্যে লাইন আছে। এখন অবশ্য লাইন শব্দটা তেমন ব্যাবহৃত হতে দেখি না। মনে মনে ভাবলাম আজকে আলোচনা কোন দিকে যাচ্ছে। অনেকটা রক্ষণাত্বক ভঙ্গিতে বললাম-
কোন ধরনের সম্পর্কের কথা বলছেন? বাবা, মা সন্তানের সম্পর্ক? নাকি...।
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু অবন্তী থামিয়ে দিয়ে বললো-
আমি ভালোবাসার সম্পর্কের কথা বলছি।
কেন সন্তান আর বাবা মার মধ্যে কি ভালোবাসার সম্পর্ক হতে পারে না?
হতে পারে অবশ্যই। তবে আমি বিশেষ দুটি মানুষের ভালোবাসার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছিলাম।
ও আচ্ছা! ঠিক আছে বলতাছি..
না থাকা আপনার আর বলতে হবে না। এখন শুনতে ভালোলাগছে না।
আমি চুপ করে গেলাম। বুঝতে পারছি অবন্তী মন খারাপ করে ফেলেছে। সে ভেবেছে আমি বিষয়টা বুঝতে পারিনি। আমি শুরুতেই বুঝতে পেরেছি। কেবল অবন্তীর সঙ্গে মজা করেছি। এই মেয়ে দেখি এইটুকুও বুঝলো না!
অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। একটু পরেই অবন্তী আবার জিজ্ঞেস করে বসলো, আচ্ছা বলেন তো স্বার্থহীন ভালোবাসা কি সম্ভব? যেমন একজন অপরজনকে কোন রকম স্বার্থ ছাড়াই ভালোবেসে যাচ্ছে, ফিরতি কোন কিছুরই প্রত্যাশা নেই, এমন ভালোবাসা কি সম্ভব?
দেখেন, এই বিষয়টি নিয়ে একেকজন একেক ধরনের কথা বলবে। মানুষ তার মনের ভিতর বিভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনা ধারণ করে। একেকজনের হাইপোথিসিস একেকরকম। আমার কি মনে হয় জানেন? এই যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলে একটা টার্ম প্রচলিত এর পুরোটাই মিথ। আমি আমার প্রিয় মানুষটার প্রতি ভালোবেসে যে ধরনের আচরন করবো, এটা দরকার নেই যে তার প্রতিদান হিসাবে প্রিয় মানুষটা ঠিক সে ধরনের আচরন করবে আমার সাথে। তবে আমি কিন্তু চাইবো অন্য কোনভাবে প্রিয় মানুষটা ভালোবাসা প্রকাশ করুক, সে আমাকে নিয়ে একটু হলেও ভাবুক। এটাও কিন্তু একধরনের প্রত্যাশা। যদি ভালোবেসে তোমার প্রতি আমার আমার কোন প্রত্যাশাই না থাকে, তবে এটা তোমার প্রতি আমার এক ধরনের অবহেলা।
এটুকুই বলে থেমে গেলাম। খেয়াল করে আমি তুমি সম্বোধনে কথা বলে ফেলেছি। পাশ কাটানোর জন্য বললাম-
আসলে তুমি সম্বোধন এখানে প্রতীকি।
এবার অবন্তী গম্ভীর হয়ে গেল কিছুটা।বললো- আমি আগেই বুঝতে পারছি। পরে এইভাবে যেচে ব্যাখা না দিলেই পারতেন। আপনার আগের কথাগুলো শুনতেই অনেক ভালো লাগছিলো।
আমি এর জবাবে কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। চুপ করে গেলাম। নীরবতা ভেঙ্গে অবন্তী জিজ্ঞেস করলো-
আচ্ছা! পরশু বিকালে কি আপনার একটু সময় হবে?
কেন?
বিকালে একটু শপিং করতে যাবো, আপনার কাজ না থাকলে সঙ্গে গেলে ভালো হতো।
আমি চেষ্টা করবো পরশু বিকালে ফ্রি থাকার।
আমার আসলে আনন্দে গদমদ হয়ে বলার দরকার ছিল, হ্যা অবশ্যই, পরশু বিকালে আমি ফ্রি আছি। কখন আসতে হবে বলেন। আমি এমন কেউ না যে পরশু বিকালে খুব কাজ পড়ে যাবে! একটু ভাব নিলাম।
অবন্তীদের বাসা থেকে সরাসরি ছাত্রীর বাসায় চলে গেলাম। একবারে টিউশনীটা শেষ করে বাসায় ফিরবো। অন্যান্য দিনের একটু দেরি হলো পৌছাতে। ছাত্রী কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বললো-
স্যার পথে কি আপনার কোন সমস্যা হয়েছে? আপনি তো সাধারণত কখনো দেরি করেন না।
না তেমন কিছুই হয় নি।
ছাত্রী আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল। আমি থামিয়ে দিয়ে পড়াতে বসে গেলাম।পড়ালেখায় আজকে ছাত্রীর মনোযোগ কম দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পরই এইটা সেইটা জিজ্ঞেস করছে। এর বেশিরভাগই পাঠ্যবইয়ের সাথে সম্পর্কিত নয়। এক পর্যায়ে বলে বসলো-
স্যার আমার বার্থডে কবে?
বার্থডে বলতেই খাতায় বড় করে লিখে রাখলো। আমি মনে মনে হাসলাম। ছাত্রীর মনোভাব দেখে মনে হলো সে আমার কাছ থেকে একই ধরনের প্রশ্ন প্রত্যাশা করছে। সে চাচ্ছে আমিও তাকে জিজ্ঞেস করি তার জন্মতারিখের কথা। ইচ্ছা করেই জিজ্ঞেস করলাম না। কিছুটা মন খারাপ করে পড়তে বসলো সে। কিছুক্ষণ পর আবার বললো-
রুটিনে পরশু আপনার পড়াতে আসার কথা না। কিন্তু আপনি কি ওইদিন একটু আসতে পারবেন?
আমি অবাক হলাম মনে মনে। দুইটা তারিখ একই দিন হয়ে গেল কিভাবে! পাশ কাটানোর জন্যই বললাম,
আসলে পরশু আমার কিছু জরুরী কাজ করতে হবে। এজন্য আসতে পারবো না। কেন আসতে হবে সেদিন?
ছাত্রী তার জবাবে কিছুই বললো না। মন খারাপ করে মাথা নিচু করে অংক করতে থাকলো।
(চলবে......)
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:৫০