প্রতিরাতে জানালা বন্ধ করে ঘুমানোর দায়িত্ব বোনটির। সে দায়িত্বে ফাকি দেয় না। মায়ের সাথে সংসারের অনেক কাজই করতে হয় কলেজ পড়ুয়া মেয়েটিকে। রান্নার কাজে সহায়তা, কাপড় চোপড় ধোয়া, থালা বাসন মেজে দেওয়াসহ বেশ কিছু নিত্ত নৈমিত্তিক কাজ। মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধ্য নেই বাসায় আলাদা করে বুয়া রাখার। তাছাড়া বড় ভাইটার ঘর থাকে অগোছালো। দুনিয়ার অলস ছেলেটা। অগোছালো ঘরটা বোনটাকেই গুছিয়ে রাখতে হয়। এ নিয়ে ভাইবোনের তর্কের শেষ নেই। ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া ভাইটি এখন সারাদিনই বাসায় কাটিয়ে দেয়। সন্ধ্যা পেরুলেই গায়ে শার্টটা জড়িয়ে বের হয়ে যায়। কাছেই শাহেদ ভাইয়ের বাসা। সেখানে গিয়ে দুজনে মিলে গল্প করে। ট্রান্সজিস্টরটা দিয়ে খবর শুনে। দুই বন্ধুর আড্ডায় অনেক বিষয়ই উঠে আসে; রাজনীতি, অর্থনীতি , মিছিল মিটিং কতো বিষয়।
জানালায় শব্দ হচ্ছে। ঠক ঠক.....। বোনটা ভাবছে আজ একটু শিক্ষা দেয়া দরকার। রোজ রোজ দেরি করে আসে। কি এতো আড্ডা দিতে হবে! বাড়িঘরের কোন খোঁজখবর নাই। খালি আলাপ আর খবর শোনা। রাগ করে ভাবছে মেয়েটা।
আবারও জানালায় শব্দ। অ্যাই , তাড়াতাড়ি খোল...বাইরে কতোক্ষণ দাড় করিয়ে রাখবি?
উঠে গিয়ে জানালা খুললো প্রথম। রাগ দেখিয়ে বললো- রোজ রোজ বাসায় দেরি করলে ফিরলে বাসায় কাউকে এনে নেও ভাইয়া। সে তোমার জন্য অপেক্ষা করবে। তুমি আসলে দরজা খুলে দিবে।
এতো কথা বলিস নাতো। আমি কি এমনিতেই বাইরে থাকি নাকি? দেশের অবস্থা তেমন ভালো না। কোন দিন কি হয়ে যায় ঠিক আছে? আগে থে্কেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো।
থামো থামো....এ মাঝরাতে তোমার লেকচার শুনতে চাই না।
আরে আস্তে কথা বল। বাবা, মা সজাগ হয়ে যাবে। তা খাবার দাবার কিছু আছে? খুব ক্ষুধা লাগছে।
হাত ধুয়ে আসো। খাবার দিচ্ছি। মৃদু রাগ দেখিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যায় বোনটি।
ভাইকে খাবার দিয়ে বসে আছে সে। এক লোকমা খাবার মুখে দিয়ে ভাইটি বললো- তুই খেয়েছিস?
আমি না খেলে কার কি? কন্ঠে অভিমান পরিস্কার।
আপুরে রাগ করিস না। খেয়াল ছিল না। তাড়াতাড়ি তোর প্লেটে ভাত বাড়। দে আমিই বেড়ে দেই। বলেই বোনটির প্লেটে ভাত বেড়ে দিল সে।
বুঝলি দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। যেকোন মুহুর্তে বড় ধরনের কিছু হয়ে যেতে পারে। এইটুকু বলে পানি খেয়ে নিল। বোনটি তখন খাবার বন্ধ করে তাকিয়ে আছে।আবার বলা শুরু হলো- ঢাকায় এখন খুব মিছিল মিটিং চলতাছো। অবশ্য আমাদের এই মফস্বল শহরে তার আঁচ খুব একটা পড়েনি। শাহেদের সাথে এইসব বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়।
এভাবেই দিন চলছিল। এর মাঝে বোনটি একদিন লুকিয়ে শাহেদদের বাসার ঘরটির পাশে দাড়িয়েছিল। কান পেতে শুনে দুইজনে খবর শুনছে। খবরটা শেষ হতেই ভাইটা বলে উঠলো- বুঝলিরে শাহেদ, বড় ধরনের একটা যুদ্ধ হতে যাচ্ছে শিগগিরই। সেক্ষেত্রে আমাদের দুইজনকে এই এলাকার মানুষজনকে সংঘবদ্ধ করতে হবে। এইটুকু শুনেই চলে আসলো বোনটি। যুদ্ধের গল্প শুনতে ভালো না তার। প্রতিদিন সে একই রুটিন মেনে চলে। খুব রাতে জানালায় শব্দ। তারপর উঠে ভাইকে নিয়ে একসাথে খাওয়া।
একদিন সকালে ঘুম থেকেই উঠে দেখে ভাই ঘরে নেই। কিছুক্ষণ পর হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ফিরলো ছেলেটা। ঘটনার বিস্তারিত বললো- ঢাকায় নিরীহ মানুষজনের উপর হামলা চালিয়েছে বর্বর হানাদার বাহিনী।ইউনিভার্সিটির হলগুলোতে হামলা করা হয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বহু বাড়িঘর। গুলি করে নির্বিচারে মানুষ মেরেছে পাকিস্তানী বাহিনী। রক্ত আর লাশে সয়লাব ঢাকা।
ভাই তখন আরো ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। রাতে জা্নালায় শব্দ অনেক দেরি করে হয়। একদিন শোনা গেল ভাইটি যুদ্ধ করতে যাবে। এজন্য ট্রেনিং নিতে যেতে হবে। শুনে মা বাধা দিলো।
তুই চলে গেলে কিভাবে হবে? দেশে যুদ্ধ, ঘরে তোর বোনটা আছে। আমরা আছি।
দেখো মা এমন আরো হাজারো পরিবার, হাজারো বোনকে বাঁচানোর জন্যই যুদ্ধে যাওয়া প্রয়োজন।
কথা আর বাড়ে না। একরাতে উঠে ঠিকই ট্রেনিং নিতে চলে যায় ভাইটি। তারপর রাতে জানালায় শব্দের রুটিনটা থেমে যায়। বোনটার প্রতি রাতেই কান পেতে থাকে কখন জানালায় শব্দ হবে। শুনতে পায় পাশের বাড়ির শাহেদ ভাইও নাকি ট্রেনিংয়ে গেছে।
আগস্টের শেষ দিকে এক রাতে জানালায় শব্দ হয়। তখন প্রায় শেষ রাত। সেই আগের মতোই শব্দ। শব্দ হতেই জেগে উঠে বোনটি। কান পেতে রাখে। কিছুক্ষণ পর আবার শব্দ।
তাড়াতাড়ি একটু দরজাটা খুলতো। জানালা খুলেই দেখে ভাইটা দাড়িয়ে। সঙ্গে শাহেদ ভাই। কেমন জানি চেনাই যাচ্ছে না তাদের। চুল অনেক লম্বা লম্বা, দাড়িগোফ বেশ বড় হয়ে গেছে। দরজা খুলে ভিতরে নিয়ে আসলো।
ভাইয়া তুমি.....এতোদিন কোথায় ছিলে? কেমন ছিলে? দাড়াও বাবা মাকে ডাকি। বলেই বোনটি ভিতরের রুমে চলে গেলে। তারা দুজন তখন হাতমুখ ধুয়ে নিতে গেল। মা এসে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলো।
তুই অনেক শুকিয়ে গেছিস। তা কি খবর তোদের?
বাবা তখন বলে.. ঢাকার দিকে যুদ্ধ কেমন চলছে রে। শুনতাছি আমাদের এই এলাকায়ও নাকি যেকোন সময় হানাদার বাহিনীরা আসবে। এরইমধ্যে শান্তি কমিটি হয়ে গেছে। খুব চিন্তায় আছি।
বাবা ঢাকার দিকে অনেক যুদ্ধ হচ্ছে। মুক্তিবাহিনী এখন অনেক শক্তিশালী। আমরা জয়ী হবই। তবে তা সময়ের ব্যাপার। একটু সাবধানে থেকো। আমাদের আবার আজ রাতেই চলে যেতে হবে। তোমাদের এক নজর দেখতে আসলাম। কাছেই আমাদের বাহিনী আসছে অপারেশন চালাতে। কিরে ঘরে খাবার দাবার কিছু আছে? বলেই বোনের দিকে তাকালো।
ভাত তেমন নাই। অল্প আছে। মুড়ি আছে। ভাত মুড়ি মিশিয়ে খাও।
খাওয়া শেষে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় দুজনেই। বোনটিকে ধরে ছেলেটি বললো- চিন্তা করিস না। এইবার দেশটাকে স্বাধীন করেই তবে বাড়ি ফিরবো। দোয়া করিস আমাদের জন্য। চলে যাওয়ার সময় শাহেদ বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো বোনটির দিকে।
অক্টোবর মাসের এক রাতেই ঘটনাটা ঘটে যায়। রাজাকারদের সহয়তায় মফস্বল এলাকাটিতে আক্রমণ করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। চোখের সামনে মেয়েটির বাবা মাকে গুলি করে মেরে ফেলে। তাকে গাড়িয়ে উঠিয়ে নিয়ে যায় সেনাদের ক্যাম্পে। গাড়িতে সঙ্গে আরো অনেক মেয়েই ছিল।
ক্যাম্পে চলে অমানবিক অত্যাচার। দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। পরনের কাপড় নিয়ে নেয়া হয়। কয়েকজন পরনের কাপড় জড়িয়ে আত্বহত্যা করে। তারপর থেকে এই অবস্থা। ক্যাম্পের অমানবিক অত্যাচারে কারনে শরীরের অনেক স্থানে ঘা হয়ে গেছে। তারপরও বেচে থাকতে হচ্ছে। চোখে বড় ভাইয়ের দেখানো স্বপ্ন। স্বাধীন দেশে আবার দেখা হবে।
১৬ ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় ক্যাম্পের নির্যাতন থেকে ছাড়া পায় তারা। বোনটি কোনমতন হেটে হেটে চলে সেই চিরচেনা বাড়িটিতে। বাড়িটি একদম খালি। বাবা মার রক্তের দাগ জমাট বেধে শুকিয়ে গেছে। সেই রক্ত পেরিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পরে মেয়েটি। শরীরে নানা স্থানে জখম। নিজের জীবনকে ঘৃণ্য জীবন মনে হতে থাকে তার। তবুও অপেক্ষা কতে হবে। কারণ ভাইটি বলে গিয়েছিল স্বাধীন দেশে দেখা হবে। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এবার তাই ভাইয়ের আসার জন্য অপেক্ষা করছে সে।
প্রতি রাতের শেষ অংশে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনে হয় জানালায় কেউ শব্দ করছে। তারপর আর ঘুমানো হয় না। নিজের শরীরের ঠিকমতো যত্ন নেয়া হচ্ছে না। শরীরের কিছু স্থানে পচন ধরে গেছে। কি হবে এতো যত্ন নিয়ে। ভাইয়ার সাথে যদি একবার দেখা হতো! ভাবে মেয়েটি। কোন রাতে মনে পড়ে শাহেদ ভাইয়ার কথা। শাহেদ ভাইয়া একদিন বলেছিল- শোন তোকে কিছু কথা বলতে চাই। তুই কি কিছু মনে করবি?
ভাইয়ার দেখাদেখি তুই সম্বোধন করতো শাহেদ ভাইয়া।
না ভাইয়া বলেন। অভয় দেয় সে।
না থাক সুন্দর কথাগুলো না হয় স্বাধীন দেশেই বলবো।
শেষ রাতগুলোতে মেয়েটি ভাবে কি বলতো শাহেদ ভাইয়া? তবে কি সেই কথাটা যা শাহেদ ভাইয়ার মুখ থেকে শোনার জন্য অনেক অপেক্ষা করে ছিল সে? ভেবে শেষ করতে পারে না। আরেকটা রাত আসলেই জানালায় শব্দের জন্য অপেক্ষা করে। ঘুম ভেঙ্গে যায় শেষ রাতে।
অনেকদিন পর কোন এক শীতের রাতে বাইরে বেশ বাতাস বইছে। হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হচ্ছে জানালায় শব্দ। সেই আগের মতোই .... ঠক ঠক....।