বুয়েট নিয়ে প্রতিবেদন পড়ছিলাম পত্রিকাগুলোতে।
বুয়েটে ভর্তি হতে পারা ব্যাপক কষ্ট সাধ্য। দেশ সেরা মেধাবীরা এখানে ভর্তি হয়। দেশ সেরা প্রতিষ্ঠান। ভর্তি হবার পর থেকে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের যেতে হয়, সেটা আর যাই হোক মর্যাদার নয়। অন্তত প্রতিবেদনগুলো তাই বলছে। অপমান বঞ্চনা আর অবদমনের। ধারনা করা যায়, দেশের সব কথিত উচ্চ শিক্ষালয়গুলোর অবস্থা কম বেশি এরকমই। ঢাবি জাবি নিয়েও এরকম বহু প্রতিবেদন আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি।
নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে, পড়াশুনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম দেশের সর্ব উত্তরের একটি মফস্বল জেলা শহরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভূক্ত সরকারি কলেজে। সেখানে আর যাই হোক বুয়েট নিয়ে করা প্রতিবেদনের বর্ণনার মত র্যাগিং বা এতো বেশি মাত্রার অমর্যাদাকর কিছু ছিলো না! সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের সামনেই নিজের ইচ্ছামত শিক্ষা জীবন ও বিরুদ্ধ মতের রাজনীতি করার পরিবেশ পেয়েছিলাম। প্রতিবেদনগুলো বস্তুনিষ্ঠ হলে বলতে হবে, আমি ও আমার সেই সময়ের সহপাঠীরা সৌভাগ্যবান। অজপাড়া গাঁয়ের অ-মেধাবীদের কলেজটিতে প্রতিনিয়ত এমন অপমানিত হতে হয় নি। নিজের কাছে নিজেকে প্রতিনিয়ত এমন ছোট হতে হয়নি। বুয়েট বা ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়তে না পাড়ার হতাশা বা হীনমন্যতা থেকে আজ সুযোগ পেয়ে এভাবে বুয়েট নিয়ে লিখছি, এমনটা ভাবা যেতে পারে। কিন্তু এতে করে প্রতিবেদনগুলো বা আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো মিথ্যে হয়ে যাবে না। বুয়েট এবং অন্যান্য সব বিশ্ববিদ্যালয়েই র্যাগিং নিয়ে আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। র্যাগিং সংস্কৃতি বহু পুরনো ও অবিচ্ছেদ্য। মোহময় অমানবিক অমর্যাদাকর চর্চা। বাসর রাতেই বিড়াল মারার নোংরা ও অসংস্কৃত কথার চর্চার সাথে র্যাগিংয়ের সাযুজ্য আছে। প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়াদের অবধারিতভাবে র্যাগিং সহ্য করতে হবে। র্যাগিংয়ে এর আগেও মরেছে। খবর হয়েছে।
যতদুর জানলাম, বুয়েটের আবরারের বিষয়টি র্যাগিংয়ের না। ক্ষমতা কেন্দ্রিক পেশী শক্তি চর্চার মহড়া ছিলো আবরারের ঘটনাটি। এসবই এক ধরনের ফ্যান্টাসি। মেরে ফেলা উদ্দেশ্য না হলেও ছেলেটিকে মরতে হয়েছে মার খেতে খেতে। অনিক সরকার নামে একজন সম্পর্কে টানা এক ঘন্টা বিরতিহীনভাবে আবরারকে পেটাবার খবর জানা যাচ্ছে পত্রিকাগুলোতে। অনিকের আচরণ অন্তর্ঘাত না অতি উৎসাহের সেটা অভিযুক্ত সংগঠনটিই ভালো বলতে পারবে। বলাবাহুল্য, সব সরকারের আমলেই এমন চর্চা ছিলো। চর্চাটা একই থাকে। আচরণকারীরা পাল্টায়। মাত্রার হেরফের হতে পারে। তবুও আমরা খুশি হই, অমুক গেলো বলে, তমুক এলো বলে! আবরার মরেছে জন্যই এতো কথা, এতো কথিত আন্দোলন! না মরলে কী হত? কেউ টেরও পেত না! এই যে, আজ যারা বুয়েটে সীনা টান টান করে দাড়াচ্ছে তাদের সীনায় তো প্রথম বর্ষেই টান লেগেছিলো। প্রথম বর্ষে যেটা সহ্য করেছে, পরের বছর সেটাই অন্যের সাথে করেছে। র্যাগিংয়ের নামে ভয় আতংক অমানবিকতা পাষবিকতা ছড়াইছে! রাজনীতির মোড়কে নৃশংসতা প্রতিনিয়ত সহ্য করে গেছে বা নৃশংসতা চালাইছে। জ্বি ভাই, হ্যাঁ ভাই করেছে। আবরার মরার দায় তাই বুয়েটের সবারই। প্রশাসনের তো বটেই। শিক্ষকদের। যারা আজ বিচার চাইছে তাদেরও। মারার কারখানা, অমর্যাদার কারখানা, বুয়েটিয়ানরাই জারী রেখেছিলো, রাখতে দিয়েছিলো বা ভবিষ্যতেও রাখবে!
সবচাইতে বড় পরিহাস , আমাদের গর্বের ধন হিসেবে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেমন মানুষ পাচ্ছি আমরা? এখানকার ছাত্ররাই তো গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় বসে, বসবে। অবদমন, অপমান আর অমর্যাদায় বেড়ে উঠা একেকজন, কর্মজীবনে কেমন হয়? কেমন আচরণ করে কর্মস্থলে? পরিবারে? সমাজে? এসব নিয়ে সমীক্ষা বোধহয় জরুরী হয়ে পড়েছে। ফাঁস করা প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে নিশ্চিতভাবেই আপনি স্বস্তি বোধ করবেন না। অবদমন, অপমান আর অমর্যাদায় বেড়ে উঠা প্রকৌশলীর কাছে কোন ভরসায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেবেন? বুয়েট আমাদের কাছে অহংকারের জায়গা। বুয়েট পড়ুয়াদের অহংকার করতেই দেখে আসছি, প্রচ্ছন্নে হলেও। নিজেদের ব্রাহ্মণ ভাবতে দেখে আসছি। খুবই স্বাভাবিক মনে হয়েছে। ঢাবি, জাবিদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ক্যাম্পাস জীবন শুরুই হয় সীমাহীন অপমান ও অবদমনে, এই কারনেই প্রচ্ছন্ন অহং এদের পেয়ে বসে হয়ত!
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে দাবীর মুখে! দাবীটাই কী হাস্যকর। অবিবেচনা প্রসূত। অপরিপক্ক দাবী। বুয়েটের ক্যান্টিনে খাবারে তেলাপোকা পাওয়া গেলে নিশ্চয় কেউ ক্যান্টিন বন্ধ করার দাবী করবে না? ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার দাবীর মধ্য দিয়ে বরং সমস্যাকেই উপেক্ষা করা হয়েছে। সমস্যা ও সমাধান দুটোকেই লঘু করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বরং আবরারকান্ডে জড়িত ছাত্রলীগ এক ধরনের দায় মুক্তি পেলো!
আবরার হত্যাকান্ড ছাত্র রাজনীতির কারনে হয় নি। আবরার মরেছে বুয়েটিয়ানদের আচরনের কারনে। বুয়েটিয়ানদের নির্মমতা নৃশংসতা, একই সাথে সু্বিধাবাদী পলায়নপর ও দায় এড়াবার মানসিকতার কারনে। আবরার কান্ডে চলমান আন্দোলন, বুয়েট বা অপরাপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে র্যাগিং, ক্ষমতার পেশী শক্তির চর্চা বন্ধসহ অমর্যাদাকর সবকিছু চিরতরে বন্ধের নিশ্চয়তা দেয় না। এমনকি অদূর ভবিষ্যতেই ঘটবে না, এই নিশ্চয়তাও দেয় না। এ কথা সারাদেশের কথিত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে সমানভাবে বলা যায়। এরকম আন্দোলন ইতোপূর্বেও দেখেছি আমরা। সাময়িক ও ঠুনকো। সমাধান হয় না। টোটকাতেই খুশি থাকতে হয়। যারা আন্দেলন করে তারাও টোটকাই চায়। তাই বলা যায়, অন্তত ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে এসবের সমাধান হবে না।
হতাশার কালো সময়ে আবরারকে যারা খেলাচ্ছলে মেরে ফেললো, তাদের ফাঁসি পৈশাচিক আনন্দ দেবে দেশবাসীকে। নিঃসন্দেহে। আপাতত এই টোটকা নিদান কার্যকর হলেও আমরা খুশি থাকতে পারি। তবে চিন্তার পরিবর্তন একান্ত জরুরী, টেকসই কিছুর জন্য। কোন সংস্কৃতির চর্চা, কোন যোগসূত্র, র্যাগিং, খেলাচ্ছলে মানুষ মারা শেখাচ্ছে সে জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। সেই চর্চা ও যোগসূত্র নিপাত করতে হবে। সেই দাবী করতে হবে। সেই দাবী আদায় করতে হবে। সেই সময়ের অপেক্ষায় রইলাম।
ছবি সংগৃহীতঃ