somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেমন যেন

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাসপাতাল জায়গাটা সবসময়ই একটু কেমন যেন ।সত্যি বলতে এই কেমন যেন'র আলাদা সংজ্ঞা দেয়া কঠিন ।প্রতিটা হাসপাতালের সিড়ির রেলিংটা আমার মোটামোটি প্রিয় ।ওয়ার্ড-কেবিনের অসুস্থ গন্ধ থেকে এখানে খানিকটা হলেও ফুরসত মেলে ।মনে পড়ে , গতবছর আব্বুর অপারেশনের সময় বেশ কয়েকটি দুপুরবেলা কুমিল্লা ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিরুদবেগ কাটিয়েছিলাম ।আব্বু নেহাত না ডাকলে আমি ওয়ার্ডে থাকতাম না , একটু এগিয়ে সিঁড়ির মুখোমুখি ভিজিটর চেয়ারে বসে থাকতাম ।কেবিন না পাওয়ায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওয়ার্ডে কয়েকটা দিন কাটাতে হয়েছিল আব্বুর ।প্রথম দুদিন ওয়ার্ডের অন্য বেডগুলো ফাঁকাই ছিল ।তবে শেষ দিনটা ছিল যথেষ্ট ভয়াবহ , নতুন দুই বৃদ্ধ রোগীর চিত্‍কার চেঁচামেচিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল ।সকাল আর রাত আম্মুই থাকতো ডিউটিতে , দুপুরে ওনারা বেশ শান্তই থাকতো ,তাই ওসব আমার খুব একটা সহ্য করা লাগেনি ।

হাসপাতালের প্রবেশমুখে সবসময়ই একটা কমন দৃশ্য আমার চোখে পড়ে ।এমবুলেন্সে লাশ ওঠানো হচ্ছে , আশেপাশে দুঃখী স্বজনদের ভিড় , আর অবিরত কান্নার রোল ।সেদিন নানাকে ডাক্তার দেখাতে অনেকদিন পর হাসপাতালে গিয়েছিলাম ।নানা আর মামা চেম্বারে , আর আমি যথারীতি সিড়ির রেলিংয়ে ।উপরতলা থেকে এক বাবা তার তিন কি চার মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে নিচে নামছে , পিছনে বাচ্চার মা ।বাচ্চার দাদী বা নানী সম্বন্ধীয় কেউ কাঁদতে কাঁদতে সিড়িতেই বসে পড়েছেন ।পেছনে আরো কয়েকজন আত্মীয়ের হাহাকার ধ্বনি ।বাচ্চাটা আসলেই মারা গেছে কিনা বোঝা গেল না ।বাচ্চাটাকে দেখে আমার ২০০০ সালের কথা পড়ে গেল ।সেবার চট্টগ্রামের আন্দরকিলা হাসপাতালে আম্মুর অনেকদিন থাকতে হয়েছিল , অবশ্য সেবার আমার ভাইটা গর্ভেই মারা যায় , বেঁচে থাকলে হয়তো এতোদিনে ক্লাস এইটে পড়তো ।সেই সময়টার স্মৃতি আম্মুর কাছে এখনো দূর্বিষহ ।নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে সেখানে রোগীকে দেখার নিয়ম ছিল না , তাই আব্বু আর আমি হাসপাতাল করিডরের প্লাস্টিক চেয়ারে পুরোটা সময় বসে থাকতাম ।কারণ আগ্রাবাদ থেকে আন্দরকিলা যেতে আসতে অনেকগুলো টাকা গচ্চা যেত ।এ নিয়ম সংক্রান্ত "বিশেষ দ্রষ্টব্য" খানাই কাঠের স্ট্যান্ডে ঝুলে দাড়িয়ে ছিল করিডরের একপাশে ।তখন আমি সংক্ষেপে "বি.দ্র" কথাটার মানে বুঝতাম না , আব্বুকে সেদিন কেন জানি জিজ্ঞেসও করিনি , যার মানেটা আমি বুঝেছিলাম এর প্রায় চার বছর পর ।
সত্যি বলতে , ছোটবেলা থেকে কখনোই আমার নিরুদবেগ আচরনের ব্যাতয় ঘটেনি ।নিতান্ত খারাপ সময়েও আমি সব ভয়-দুঃখ মুছে সুস্থ স্বাভাবিক সুখী মানুষের মত ঘোরাফেরা করি , খুব প্রিয় মানুষদের ছাড়া অন্য কাউকে দূর্বলতার কথা বলি না ।এখনো আমি কিছু না করে কোন জায়গায় ঘন্টার পর ঘন্টা একঠায় বসে থাকতে পারি , স্পষ্টত আমি তখন কিছুই ভাবি না ! এমন নিশ্চুপভাবে সে সময়টা কিভাবে পার করি চঞ্চলতার সময় তা ভাবতেই গা সিউরে ওঠে ।তবে মন খারাপ থাকলে আমার চোখ দুটো শুধু খানিকটা ঝাপসা হয়ে আসে , তখন আকাশটা আর পরিষ্কার দেখতে পাই না , এটুকুই ।
২০১০ এ আমার বড় জ্যাঠা যেদিন মারা গেল তখন আমি বাসে , এসএসসির পর ঢাকা বেড়াতে যাচ্ছি ।সেদিন রওনা দেয়ার আগে আব্বু অনেক মানা করেছিল , আমি শুনিনি ।বাস চান্দিনা না পেরোতেই সংবাদটা পাই ।তখন সত্যিই আমার কোন অনূভুতি হয়নি , বুকের ভেতর একটু খারাপ লেগেছিল শুধু ।মানুশটা জানাজায় থাকা উচিত ছিল ।
৯/১০/১০ তারিখে পিজি হাসপাতালে যেদিন ক্যান্সারে ভুগে মুকুল ভাইয়া মারা গেল , সেদিন কলেজে বসে আমি খবর পেলাম নেছারের মোবাইলে ।গ্রামের বাড়িতে পৌঁছানোর পরপরই ঢাকা থেকে লাশের গাড়ি বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালো ।আমি তখন আমাদের টিনশেডের সামনের রুমে , জানালা দিয়ে লাশের খাটিয়াটা দেখা যাচ্ছে ।তারপাশে সবাই পড়ে পড়ে কাঁদছে , আম্মু , আব্বু , মেঝো জ্যাঠা , সেজো জ্যাঠা , ফুফুরা ।বড় জ্যাঠার মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই তার মেঝো ছেলেও বিদায় নিল , মাত্র ৩০ বছর বয়সে ।মুক্তা ভাবি কেঁদে কেঁদে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন , ছোট্ট নাবিহাকে দেখার জন্য নাবিহার বাবা যে আর রইলো না , তার স্বামীকে আর আগলে রাখা হলো না ।বাসায় এসে আম্মু বলছিল আমি নাকি পাষাণ , সেদিন আমাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি ।তবে সেদিন আমি কেঁদেছিলাম , তবে চোখের পানি হয়তো দু-একফোঁটার বেশি ঝরেনি ।মুকুল ভাইয়া কুমিল্লাতে আমাদের বাসাতেই থাকতেন ।আমরা একখাঁটেই ঘুমাতাম ।আমি এখনো ঘুমাই , মুকুল ভাইয়া নেই শুধু ।খাটে তার গায়ের ঘ্রাণ ঠিক সেঁটে আছে ।

ক্লাস ওয়ানে থাকতে আমার দাদু মারা যায় ।৯৯ এর ফেব্রুয়ারী ।সেদিন আমি ঘরের মাটির পিঁড়ার উপর দাড়িয়ে জানালা দিয়ে খাটের উপর দাদুর নিথর দেহটা দেখছিলাম ।সবাই কাঁদছে , আব্বু , আম্মু , ফুফু , জ্যাঠা , জ্যাঠীরা সবাই ।হঠাত্‍ একটা লাফ দিয়ে আমি পিঁড়া থেকে নেমে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম ।একলাফে পিঁড়া থেকে আমি যে অনেকদূর পার করেছি তা ভেবেই আত্মতৃপ্তিতে ভুগছিলাম ।এই জরা , মৃত্যু কিংবা বেদনার মিছিলের আমি যেন এক নিরুদবেগ দ্রষ্টা ।এতে আমার হয়তো কিচ্ছু আসে যায় না ।তবে দাদু , বড় জ্যাঠা আর মুকুল ভাইয়া আমাকে বড্ড আদর করতো ।এই মানুষগুলো থেকে গেলে মন্দ হতো না ।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×