হাসপাতাল জায়গাটা সবসময়ই একটু কেমন যেন ।সত্যি বলতে এই কেমন যেন'র আলাদা সংজ্ঞা দেয়া কঠিন ।প্রতিটা হাসপাতালের সিড়ির রেলিংটা আমার মোটামোটি প্রিয় ।ওয়ার্ড-কেবিনের অসুস্থ গন্ধ থেকে এখানে খানিকটা হলেও ফুরসত মেলে ।মনে পড়ে , গতবছর আব্বুর অপারেশনের সময় বেশ কয়েকটি দুপুরবেলা কুমিল্লা ডায়াবেটিস হাসপাতালে নিরুদবেগ কাটিয়েছিলাম ।আব্বু নেহাত না ডাকলে আমি ওয়ার্ডে থাকতাম না , একটু এগিয়ে সিঁড়ির মুখোমুখি ভিজিটর চেয়ারে বসে থাকতাম ।কেবিন না পাওয়ায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওয়ার্ডে কয়েকটা দিন কাটাতে হয়েছিল আব্বুর ।প্রথম দুদিন ওয়ার্ডের অন্য বেডগুলো ফাঁকাই ছিল ।তবে শেষ দিনটা ছিল যথেষ্ট ভয়াবহ , নতুন দুই বৃদ্ধ রোগীর চিত্কার চেঁচামেচিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল ।সকাল আর রাত আম্মুই থাকতো ডিউটিতে , দুপুরে ওনারা বেশ শান্তই থাকতো ,তাই ওসব আমার খুব একটা সহ্য করা লাগেনি ।
হাসপাতালের প্রবেশমুখে সবসময়ই একটা কমন দৃশ্য আমার চোখে পড়ে ।এমবুলেন্সে লাশ ওঠানো হচ্ছে , আশেপাশে দুঃখী স্বজনদের ভিড় , আর অবিরত কান্নার রোল ।সেদিন নানাকে ডাক্তার দেখাতে অনেকদিন পর হাসপাতালে গিয়েছিলাম ।নানা আর মামা চেম্বারে , আর আমি যথারীতি সিড়ির রেলিংয়ে ।উপরতলা থেকে এক বাবা তার তিন কি চার মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে নিচে নামছে , পিছনে বাচ্চার মা ।বাচ্চার দাদী বা নানী সম্বন্ধীয় কেউ কাঁদতে কাঁদতে সিড়িতেই বসে পড়েছেন ।পেছনে আরো কয়েকজন আত্মীয়ের হাহাকার ধ্বনি ।বাচ্চাটা আসলেই মারা গেছে কিনা বোঝা গেল না ।বাচ্চাটাকে দেখে আমার ২০০০ সালের কথা পড়ে গেল ।সেবার চট্টগ্রামের আন্দরকিলা হাসপাতালে আম্মুর অনেকদিন থাকতে হয়েছিল , অবশ্য সেবার আমার ভাইটা গর্ভেই মারা যায় , বেঁচে থাকলে হয়তো এতোদিনে ক্লাস এইটে পড়তো ।সেই সময়টার স্মৃতি আম্মুর কাছে এখনো দূর্বিষহ ।নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে সেখানে রোগীকে দেখার নিয়ম ছিল না , তাই আব্বু আর আমি হাসপাতাল করিডরের প্লাস্টিক চেয়ারে পুরোটা সময় বসে থাকতাম ।কারণ আগ্রাবাদ থেকে আন্দরকিলা যেতে আসতে অনেকগুলো টাকা গচ্চা যেত ।এ নিয়ম সংক্রান্ত "বিশেষ দ্রষ্টব্য" খানাই কাঠের স্ট্যান্ডে ঝুলে দাড়িয়ে ছিল করিডরের একপাশে ।তখন আমি সংক্ষেপে "বি.দ্র" কথাটার মানে বুঝতাম না , আব্বুকে সেদিন কেন জানি জিজ্ঞেসও করিনি , যার মানেটা আমি বুঝেছিলাম এর প্রায় চার বছর পর ।
সত্যি বলতে , ছোটবেলা থেকে কখনোই আমার নিরুদবেগ আচরনের ব্যাতয় ঘটেনি ।নিতান্ত খারাপ সময়েও আমি সব ভয়-দুঃখ মুছে সুস্থ স্বাভাবিক সুখী মানুষের মত ঘোরাফেরা করি , খুব প্রিয় মানুষদের ছাড়া অন্য কাউকে দূর্বলতার কথা বলি না ।এখনো আমি কিছু না করে কোন জায়গায় ঘন্টার পর ঘন্টা একঠায় বসে থাকতে পারি , স্পষ্টত আমি তখন কিছুই ভাবি না ! এমন নিশ্চুপভাবে সে সময়টা কিভাবে পার করি চঞ্চলতার সময় তা ভাবতেই গা সিউরে ওঠে ।তবে মন খারাপ থাকলে আমার চোখ দুটো শুধু খানিকটা ঝাপসা হয়ে আসে , তখন আকাশটা আর পরিষ্কার দেখতে পাই না , এটুকুই ।
২০১০ এ আমার বড় জ্যাঠা যেদিন মারা গেল তখন আমি বাসে , এসএসসির পর ঢাকা বেড়াতে যাচ্ছি ।সেদিন রওনা দেয়ার আগে আব্বু অনেক মানা করেছিল , আমি শুনিনি ।বাস চান্দিনা না পেরোতেই সংবাদটা পাই ।তখন সত্যিই আমার কোন অনূভুতি হয়নি , বুকের ভেতর একটু খারাপ লেগেছিল শুধু ।মানুশটা জানাজায় থাকা উচিত ছিল ।
৯/১০/১০ তারিখে পিজি হাসপাতালে যেদিন ক্যান্সারে ভুগে মুকুল ভাইয়া মারা গেল , সেদিন কলেজে বসে আমি খবর পেলাম নেছারের মোবাইলে ।গ্রামের বাড়িতে পৌঁছানোর পরপরই ঢাকা থেকে লাশের গাড়ি বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালো ।আমি তখন আমাদের টিনশেডের সামনের রুমে , জানালা দিয়ে লাশের খাটিয়াটা দেখা যাচ্ছে ।তারপাশে সবাই পড়ে পড়ে কাঁদছে , আম্মু , আব্বু , মেঝো জ্যাঠা , সেজো জ্যাঠা , ফুফুরা ।বড় জ্যাঠার মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই তার মেঝো ছেলেও বিদায় নিল , মাত্র ৩০ বছর বয়সে ।মুক্তা ভাবি কেঁদে কেঁদে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন , ছোট্ট নাবিহাকে দেখার জন্য নাবিহার বাবা যে আর রইলো না , তার স্বামীকে আর আগলে রাখা হলো না ।বাসায় এসে আম্মু বলছিল আমি নাকি পাষাণ , সেদিন আমাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি ।তবে সেদিন আমি কেঁদেছিলাম , তবে চোখের পানি হয়তো দু-একফোঁটার বেশি ঝরেনি ।মুকুল ভাইয়া কুমিল্লাতে আমাদের বাসাতেই থাকতেন ।আমরা একখাঁটেই ঘুমাতাম ।আমি এখনো ঘুমাই , মুকুল ভাইয়া নেই শুধু ।খাটে তার গায়ের ঘ্রাণ ঠিক সেঁটে আছে ।
ক্লাস ওয়ানে থাকতে আমার দাদু মারা যায় ।৯৯ এর ফেব্রুয়ারী ।সেদিন আমি ঘরের মাটির পিঁড়ার উপর দাড়িয়ে জানালা দিয়ে খাটের উপর দাদুর নিথর দেহটা দেখছিলাম ।সবাই কাঁদছে , আব্বু , আম্মু , ফুফু , জ্যাঠা , জ্যাঠীরা সবাই ।হঠাত্ একটা লাফ দিয়ে আমি পিঁড়া থেকে নেমে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম ।একলাফে পিঁড়া থেকে আমি যে অনেকদূর পার করেছি তা ভেবেই আত্মতৃপ্তিতে ভুগছিলাম ।এই জরা , মৃত্যু কিংবা বেদনার মিছিলের আমি যেন এক নিরুদবেগ দ্রষ্টা ।এতে আমার হয়তো কিচ্ছু আসে যায় না ।তবে দাদু , বড় জ্যাঠা আর মুকুল ভাইয়া আমাকে বড্ড আদর করতো ।এই মানুষগুলো থেকে গেলে মন্দ হতো না ।