ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো হজ্জ। হজ্জ ফরজের অন্যতম দুটি শর্ত হলো সুস্থ থাকা এবং সম্পদ থাকা। অনেক সম্পদশালী ব্যক্তি আছেন যাদের ভাগ্যে হজ্জ নসীব হয় না। আবার এমন অনেক লোক আছেন যারা অসুস্থ বা তেমন কোন সামর্থ্য নেই, তবুও তাদের আল্লাহর রহমতে হজ্জ করার সৌভাগ্য হয়ে যায়। একজন হাজী আল্লাহর মেহমান। আল্লাহর মেহমান হয়ে যাওয়া যা তা ব্যাপার না। আল্লাহর মেহমান হয়ে যাওয়ার সময় যাতে কোন ভুল না হয় সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। তাই হজ্জে যাওয়ার আগে ভালো মত হজ্জ সম্পর্কে জেনে বুঝে গেলে ভুল কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে হজ্জ সম্পর্কে কিছু খুটিনাটি বিষয়গুলো জানাতে চাচ্ছি ----
# বেসরকারীভাবে হজ্জে যাওয়ার আগে যে এজেন্সীর মাধ্যমে যাবেন, সেই এজেন্সীর খোজ খবর নিবেন। তারা ‘হাব’ এর সদস্য কিনা, মক্কা মদীনায় কোথায় রাখবে, কতদুর রাখবে, কয় বেলা খাবার দিবে জেনে নিবেন। পারলে ঐ এজেন্সীর মাধ্যমে আগে যারা গিয়েছেন তাদের কাছ থেকে রিপোর্ট নিবেন।
# এজেন্সীর যে মোয়াল্লেম থাকবেন, অবশ্যই তিনি যেনো একজন আলেম হন। দেখা গিয়েছে সেখানে অনেক এজেন্সী তাদের হাজীদের নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেন। হাজীরা জানেনও না কোথায় কি করতে হবে। অনেক মোয়াল্লেম আলেম না হওয়ার কারনে নিজে ভুল করেন এবং হাজীদেরকেও ভুল করিয়ে দেন। অনেক সময় হজ্জের নিয়ম কানুন পালনের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা দেখা দিলে মোয়াল্লেম কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলে দিতে পারবেন। মোয়াল্লেম আলেম না হলে সমস্যা হতে পারে। যেমন ধরা যাক, তাওয়াফ করার সময় যদি ফরয নামায শুরু হয়ে যায় তখন হাজী কি করবেন? তিনি কি নামাজ পড়বেন, নাকি তাওয়াফ করবেন? যদি নামাজ পড়েন তাহলে কি প্রথম থেকে তাওয়াফ শুরু করবেন নাকি তাওয়াফ যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই শুরু করবেন? অথবা সায়ী করার সময় অযু না থাকলে তখন কি হবে? ইত্যাদি এমন ধরনের সমস্যা হতে পারে।
# যখনই আপনি নিয়ত করলেন যে আপনি হজ্জে যাবেন, তখন থেকেই কিন্তু আপনি আল্লাহর মেহমান। তাই হজ্জে যাওয়ার আগে খুব ভালো মত হজ্জের নিয়ম কানুন শিখে নিবেন, প্রশিক্ষন নিবেন এবং তখন থেকেই আপনি আল্লাহর রাস্তায় বের হচ্ছেন সে রকম মন মানসিকতা লালন করতে শুরু করবেন। মাসলা মাসায়েল গুলো ভালো মত জেনে নেয়ার চেষ্টা করবেন।
# খুব ভালো মত জেনে নিন এহরাম অবস্থায় কি কি কাজ করতে পারবেন না। কারণ এহরাম পরার পর থেকেই আপনার সামনে কোন না কোন পরীক্ষা আসবে। যেমন, এহরাম অবস্থায় কোন পশু-পাখি এমনকি কোন পোকা মাকড় মারতে পারবেন না বা কাউকে মারার জন্য দেখিয়ে দিতে পারবেন না। এমন সময় আপনার সামনে মশা চলে আসলো, আপনি অভ্যাশ বশত মশা মেরে ফেললেন।
# এহরাম অবস্থায় অনেক স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া করেন বা একে অন্যের সাথে ঝগড়া করেন। আবার অনেকে গীবত করেন। সাবধান ! এহরাম অবস্থায় এসব নিষিদ্ধ। অবশ্য এটা সবসময় নিষিদ্ধ।
# অন্য হাজীর যেন কোন কষ্ট না হয় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা জরুরী। কারণ আপনার মত তিনিও আল্লাহর মেহমান।
# ভালো মত জেনে নিবেন কোন কোন স্থানে দোয়া কবুল হয়। যেমন, কাবা ঘরের ভিতর, যমযমের নিকট, সাফা-মারওয়ায়, সাফা-মারওয়ার সবুজ বাতির মাঝখানে, মাকামে ইব্রাহীমের কাছে, আরাফাতের ময়দানে, মুযদালিফায়,মিনায়, তিন জামাআরাহ এর পাশে।
# মক্কা-মদিনার দর্শনীয় স্থান গুলো সম্পর্কে জেনে নিবেন। ফলে আপনার এজেন্সী যখন আপনাকে সেখানে ঘুরাতে নিয়ে যাবে তখন মনের মাঝে ফিলিংসটা কাজ করবে।
# নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার দু’ঘন্টা আগে থেকে গিয়ে বসে না থাকলে মসজিদের ভিতর জায়গা পাবেন না। বিশেষ করে জুম্মার নামাজ শুরু হওয়ার তিন ঘন্টা আগে গেলে মসজিদের ভিতর ভালো জায়গা পাবেন।
# অনেক মহিলারা জামাতে নামাজ পড়তে পারেন না। যাওয়ার আগে শিখে নিবেন। ছেলেদের দায়িত্ব তাদের মহিলা আত্মীয়দের শিখিয়ে দেওয়া। কারণ আমাদের দেশের মহিলারা মসজিদে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত নয়।
# সব সময় পরিচয়পত্র, মোয়াল্লেম কার্ড, হোটেলের কার্ড, কব্জী বেল্ট সাথে রাখবেন। মনে রাখবেন আপনি হারিয়ে গেলে এগুলোর মাধ্যমে আপনাকে আপনার এজেন্সীর কাছে পৌছে দেওয়া হবে।
# প্রতি ওয়াক্তে জানাযার নামাজ হয়। অনেক মহিলারাই জানাযার নামাজ পারেন না। শিখে নিবেন।
# হজ্জ এর সময় আপনি সারা দুনিয়ার মানুষকে একসাথে দেখতে পাবেন। যেটা আর কোথাও পাবেন না। দেখতে পারবেন নানান মানুষের নানান রকম মত আর নিয়ম কানুন। যদি কেউ কোন ভুল করে তাহলে তাকে সাবধানে ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝাতে চেষ্টা করুন। কাউকে সরাসরি শুধরানোর চেষ্টা করবেন না। অপর ব্যক্তি না বুঝলে চুপ থাকুন।
# দোয়া কবুল হওয়ার স্থানে মন ভরে দোয়া করুন এবং আগে থেকে ঠিক করে রাখুন কি দোয়া করবেন। অনেক সময় আবেগের কারনে কি দোয়া করবেন তা মনে থাকেনা।
# মন ভরে কাবা ঘর দেখে নিবেন। কারণ আপনি জানেন না যে আপনি আর কোনদিন কাবা দেখতে পারবেন কিনা।
# প্লেনে উঠার আগে থেকেই আপনার হ্যান্ড ব্যাগে পাতলা জায়নামাজ সবসময় সাথে রাখবেন এবং স্প্রে করা যায় এমন পানির বোতল সব সময় সাথে রাখবেন। যাতে অযু করার জায়গা না থাকলে স্প্রে করে হাতের তালুতে পানি নিয়ে অযুর ফরযগুলো আদায় করে অযু করে নিতে পারেন। মালয়শিয়ান ও ইন্দোনেশিয়ানরা এমন করে থাকেন। অযু না থাকলে মসজিদে বসে বা রাস্তা ঘাটে অযু করে নিতে পারেন।
# আপনাকে অনেকক্ষন মসজিদে থাকতে হবে। তাই সাথে খেজুর, বাদাম বা শুকনো খাবার রাখবেন। মনে রাখতে হবে কোন ভাবেই আপনাকে অসুস্থ হওয়া চলবে না। এমন কোন কাজ করবেন না যাতে আপনি অসুস্থ হয়ে যান। যেমন বেশি উমরা করতে গিয়ে অনেকে এমন অসুস্থ হয়ে যায় যে ফরজ কাজ করতে পারেন না।
# প্রচুর পরিমানে পানি ও জুস খেতে হবে।
# কখনোই মসজিদের বাইরে স্যান্ডেল রাখার জায়গায় স্যান্ডেল রাখবেন না। স্যান্ডলের জন্য আলাদা ব্যাগ সাথে রাখবেন।
# আপনি যখন মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান করবেন, তখন চেষ্টা করবেন আপনার ব্যাগের ওজন যেন কম হয়। কারণ অনেক হাটতে হবে।
# জামাআরাহ তে (পাথর মারার জায়গা) বড় ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দিবে না। ব্যাগ নিয়ে ফেলে দেয় অনেক সময়। সেই ক্ষেত্রে সাবধান।
# এহরাম অবস্থায় আপনি কোন সুগন্ধি বা সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না। অনেকেই বিভিন্ন লোশন ও সাবান ব্যবহার করেন যা সুগন্ধি যুক্ত। এ ক্ষেত্রে সুগন্ধি ছাড়া লোশন ও ভেসলিন ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু দেশীয় পেট্রোলিয়াম জেলী গুলোতে লেবুর সুগন্ধ থাকে। দেশে সুগন্ধ ছাড়া বল সাবান পাওয়া যায়। তাছাড়া মক্কাতে হারাম শরীফের আশেপাশের দোকানে এক রিয়েলে সুগন্ধি ছাড়া সাবান পাবেন।
# এহরাম অবস্থায় অনেকেই বাথরুম ব্যবহার করার পর সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। যা স্বাস্থ্য সম্মত না। মিনা, মুজদালিফা ও আরফায় বাথরুমে যাওয়ার সময় আগে থেকেই ছোট করে টুকরো করা সুগন্ধি ছাড়া সাবান ও প্লাস্টিক বা পলিথিন নিবেন। বাথরুমে যে পানির পাইপ থাকে তা প্রায় সময় মাটিতে পড়ে থাকে। পলিথিন দিয়ে পাইপ ধরতে পারেন বা হ্যান্ড গ্লাভস দিয়ে। তবে হ্যান্ড গ্লাভস পরা ও খোলা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই পলিথিনই ভালো। বাথরুমের বাইরে অনেক লোক অপেক্ষা করে থাকে। তাই চেষ্টা করবেন দ্রুত কাজ শেষ করে আসতে।
# আরাফার ময়দানে অনেক নিম গাছ দেখতে পাবেন। এহরাম অবস্থায় আপনি কোন গাছের ডাল ভাংগতে পারবেন না। কিন্তু অনেকেই গাছের ডাল ভেংগে মেসওয়াক করে। এ ব্যাপারে সাবধান।
# প্রয়োজনীয় ঔষধ সাথে রাখবেন। বিশেষ করে মুভ, প্যারাসিটামল, স্যালাইন ইত্যাদি। তাছাড়া নিয়মিত কেউ যদি কোন ঔষধ খায় সেগুলো কত দিনের প্যাকেজের জন্য যাচ্ছেন সেই হিসাবে সাথে রাখবেন।
# মদিনায় যখন মসজিদে কুবায় যাবেন, তখন হোটেল থেকে অযু করে যাবেন। কারণ বাসা থেকে অযু করে মসজিদে কুবায় দু’রাকাত নফল নামাজ পড়লে একটা উমরা হজ্জের সোওয়াব পাওয়া যায়।
# জামাআরাহতে যখন পাথর মারা হয় তখন অনেকেরই একটা জোশ চলে আসে। অনেকেই জুতা, স্যান্ডেল, বোতল ছুড়ে মারেন। এটা করা যাবে না। পাথর মারার সময় দোয়া পড়ে পাথর মারতে হবে এবং মনের ভিতর এমন একটা ফিলিংস আনতে হবে যে, ‘ আমি খুব তাচ্ছিল্যের সাথে পাথরটা ছুড়ে মারছি। কারণ এখানেই ইব্রাহীম (আঃ) শয়তান কে পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন তাচ্ছিল্যের সাথে। কারণ তিনি আল্লাহকেই বড় মনে করেছিলেন শয়তানের থেকে। তাই আমিও আল্লাহকেই সবার চেয়ে বড় মনে করি’।
# মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর রওজা শরীফে মেয়েদের সব সময় ঢুকতে দেয় না। ফযর, যোহর ও এশার নামাজের পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঢুকতে দেয়। মেয়েদের জন্য ২৫ নং গেইট দিয়ে ঢুকলে সব চেয়ে ভালো। বাংলাদেশ সহ সব দেশের মেয়েদের আলাদা আলাদা করে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে দৌড়া-দৌড়ি এবং ধাক্কা ধাক্কি করবেন না। তবে ছেলেদের এমন নিয়ম নেই। সেখানে রিয়াজুল জান্নাহ দোয়া কবুলের জায়গা। শুধু মাত্র সবুজ কার্পেট বিছানো অংশটুকু রিয়াজুল জান্নাহ।
# এবার যারা হজ্জ করতে যাবেন তাদের লাগেজের মাপ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাগেজে বাংলাদেশের পতাকার ছাপ লাগাতে হবে এবং লাগেজের গায়ে বাংলা, ইংরেজী ও আরবীতে বাংলাদেশ লিখতে হবে। তাছাড়া নিজের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, মোয়াল্লেম নম্বর লিখতে হবে।
# দড়ি, টেপ, মার্কার পেন, কেঁচি, সুই-সুতা সাথে রাখবেন।
# আপনি মক্কা বা মদিনা যেখনেই থাকুন না কেন, সেখানে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখবেন। কোন কারনে আপনার সঙ্গি বা আপনি হারিয়ে গেলে সেই জায়গায় চলে আসবেন। সংগীদের ফোন নম্বর সাথে রাখবেন।
# যত পারুন তাওয়াফ করবেন। তাওয়াফ করার সময় খেয়াল রাখবেন যাতে হুইল চেয়ারের ধাক্কা না লাগে। সাধারনত দোতালা ও তিন তালায় হুইল চেয়ার দিয়ে তাওয়াফ করা হয়।
# ফরয তাওয়াফের সময় প্রচন্ড ভিড় হবে। ফরয তাওয়াফ দোতালায় করলে ভিড় একটু কম পাওয়া যায়। কারন সবাই চায় নিচে তাওয়াফ করতে। ফরয তাওয়াফের পর সায়ী করার সময় অনেক ভিড় হবে। তবে চার তালাতে একটা সায়ী করার জায়গা আছে। সেখানে ভিড় কম হয়। জায়গাটা আগে থেকে দেখে রাখবেন। কারণ জায়গাটার সিঁড়ি পেতে কষ্ট হয়। তাই অনেকেই এটার খবর জানেন না।
# মিনা, মুজদালিফা ও আরাফায় চেষ্টা করবেন দলের সাথে থাকা।
আশা করি আমার টিপসগূলো সবার কাজে আসবে ইনশাল্লাহ। সবাই চেষ্টা করুন কম বয়সে হজ্জ করে আসতে। কারণ হজ্জ করতে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়। কম বয়সে হজ্জ করলে কষ্ট কম হয়। আমাদের দেশের ভ্রান্ত ধারনা হলো যে শেষ বয়সে সব গুনাহর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিব,আরো একটু বয়স হোক তারপর যাই, ছেলে মেয়ে ছোট, তারা এখনো মানুষ হয়নি, কার কাছে বাচ্চা রেখে যাবো ইত্যাদি কথা বলে অনেকেই হজ্জে যান না। যারা এসব বলেন তাদের কে বলি, প্লিজ অর্থ সম্পদ ও শরীর ঠিক থাকতে থাকতে হজ্জ করে আসুন। কারণ আপনি জানেন না হয়তো এক সময় আপনার অর্থ থাকলেও আপনার স্বাস্থ্য থাকবে না অথবা স্বাস্থ্য থাকলেও অর্থ নাও থাকতে পারে। আর হজ্জ ফরযের পর হজ্জ না করে মারা গেলে আছে ভয়ানক শাস্তি। আর আপনি যদি ইচ্ছা করেন যে, যত যাই হোক আমি হজ্জে যাবো এবং আল্লাহর সাহায্য চান তাহলে ইনশাল্লাহ আল্লাহ আপনার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে দিয়ে হজ্জ পালনের ব্যবস্থা করে দিবেন।
পরিশেষে আমি সবার কাছে দোয়া চাইছি আল্লাহ যেন প্রতি বছর আমাকে আমার পরিবার পরিজন সহ তাঁর ঘর দেখার সৌভাগ্য দান করেন। আমিন।
ছবি দেখুন