জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা কিশোরী মায়েরা। তাই বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জনসংখ্যার চাপ কমাতে হলে বাল্যবিবাহ কমাতে হবে।
খবরটির মধ্যে একটি পজিটিভ অর্থ আছে। খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। সেটা হল, দেখুন, খবরে কিন্তু বাল্যবিবাহের হার কমাতে জোর দিয়েছে, পরিবার-পরিকল্পনার কথা বলেনি। কারণ, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে। 'মুখ দিবে যেই আল্লায়, খাওয়াবেও সেই আল্লায়' এবং 'জন্মনিয়ন্ত্রণ এ ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার প্রোপাগান্ডা' থেকে মানুষ অনেকটাই বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। যা সামনে আরও অধিক সাফল্য আনবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে।
বাল্যবিবাহ নিয়ে কঠোর কাগুজে আইন থাকলেও বাস্তবে তার ব্যবহার খুবই কম। পরিবার-পরিকল্পনা, জন্মনিয়ন্ত্রণের মতো বাল্যবিবাহেও ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট এবং কিছু মোল্লাদের তৎপরতা এখনও সক্রিয়। তবে সেগুলোর চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, বাল্যবিবাহের আইনের মধ্যেই কিছু ফুটো আবিস্কৃত হয়েছে। যে ফুটোর মধ্য দিয়ে আইনের মাধ্যমেই বাল্যবিবাহ করে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই বউ নিয়ে গাড়িতে করে চলে যাচ্ছে কনের ডাবল বয়েসী বর!
ভাবছেন গুল মারছি? এমন কয়েকটি ঘটনা চাক্ষুস ঘটতে দেখেছি। একটির গল্প বলছি ......
সিমা (ছদ্মনাম)। তেরো-বছরের মেয়ে। ক্লাস সেভেনে পড়ে। দেখতে সুশ্রী। পরিপূর্ণ নারী অবয়ব এখনও পায়নি। চঞ্চলা কিশোরী। সিমার বাবার আর্থিক অবস্থাও মোটামুটি, একেবারে খারাপ না। এমনই সময়ে সিমার ফুফুর মাধ্যমে এক ছেলে দেখতে আসে সিমাকে। বিদেশী ছেলে। বিদেশী বলতে ভিন দেশের ছেলে নয়, ছেলে বিদেশ করে। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। ছুটি কাটিয়ে আবার যাবে, তাই বিদেশী। ভাল টাকা পয়সা আছে। বয়স যদিও ত্রিশের এদিক ওদিকে তবু দেখতে খারাপ না। ছেলে সিমাকে পছন্দ করে ফেলে। আমার এক ভাবি প্রায়ই বলে, বিদেশী ছেলেরা সাদা চামড়া দেখতে দেখতে এখন দেশে এলে সাদা চামড়া দেখলেই পছন্দ করে ফেলে। অন্যকিছু দেখে না। তবে অনেক অভিভাবকই এখন আর বিদেশী ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে কেন চান না তা অনেকের কাছে রহস্য হলেও সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় আমার কাছে রহস্য নয়।
যাইহোক, ছেলে মেয়ে দেখে পছন্দ করে ফেলে। মোবাইলের কল্যাণে দুইদিন কথা বলায় কিশোরী মেয়েটিও ছেলেটির প্রেমে পড়ে যায়। কারণ হিশেবে কবি আখতারুজ্জামান আজাদের একটি উক্তির কথা বলা যায়। তিনি বলেছেন, 'টিনএজ বালিকার প্রেম চরের মতো, যে আগে গিয়ে দখল করতে পারে।' হয়তো ওই ছেলেটিই সিমার চরে সবার আগে পৌছেছিল।
ছেলে মেয়ে যখন রাজি তখন আর কি করা। কিন্তু তাতেও আতংক এবং দ্বিধাগ্রস্ত হলেন অভিভাবকরা। মেয়ের বয়স কম। কয়েকদিন আগেই পাশের গ্রামের এক বাল্যবিবাহ টিএনও সাহেব ভেঙে দেন। টিএনও সাহেব কড়া মানুষ। জানতে পারলে রক্ষা নেই। তবে এমন টিএনওর সংখ্যা যে খুব বেশি তা নয়। হাজারে একজন। তেমন একজনই আছেন আমাদের থানায়।
সমস্যা যেখানে সমাধানও সেখানে। এলাকায় কাজী ডেকে মেয়ের বিয়ে দেয়া যাবে না। কি করা যায়, কি করা যায়? উপায় আছে। ছেলে মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাবে সোজা কোর্টে। তবে একা একা নয়। দুপক্ষের অভিভাবকদের নিয়েই। কোর্ট তো চিনবে না কে কার অভিভাবক আর কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা।
নির্দিষ্ট দিনে ছেলে মেয়ে সহ অভিভাবকরা চলে যান জেলাশহরের কোর্টে। ছেলেমেয়ে বলে, আমরা পালিয়ে এসেছি বিয়ে করতে চাই। কোর্টও সরল মনে উপায়ান্তর না দেখে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নেয়। জানার চেষ্টাও করে না মেয়ের বয়স আসলেই আঠারো হয়েছে কি না বা যে কথাগুলো ছেলেমেয়ে বলছে তার সত্যতা কতটুকু! ফলে বিদেশী ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে বাড়ি ফেরে। ছেলেমেয়েও খুশি, অভিভাবকরাও খুশি। একেবারে সোনায় সোহাগা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে দারিদ্র্যের জন্য। দরিদ্র বাবা-মা মেয়েকে পার করাতে পারলেই যেন বাঁচেন! আমি বললাম আইনের ফোঁকরের দিকটা। দারিদ্র্যের জন্য তো আছেই, তারওপর যদি আইনের হাতে এমন করে বাল্যবিবাহকে বৈধকরন হয় তাহলে বিষয়টা কোথায় দাঁড়ায়?