মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের শুরুতেই অনির্ধারিত আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের আনা পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নাকচ করে কানাডার আদালতের দেওয়া রায়ের প্রসঙ্গ উঠে আসে। এ সময় বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ কানাডার
আদালতে খারিজ হয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে একাধিক মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন প্রধানমন্ত্রী 'পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি এবং বিশ্বব্যাংককে এই অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে' বলে যে চ্যালেঞ্জ ও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন, সেই দৃঢ়তাই আজ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করেছে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শক্ত থাকতে পেরেছিলেন বলেই আজ বাংলাদেশ সন্মান ফিরে পেয়েছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ সত্য প্রমাণ হয়েছে।
একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক যে অভিযোগ তুলে এই প্রকল্প থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল তাকে গালগল্প বলেছেন কানাডার বিচারক। পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি_ আমরা প্রথম থেকেই এটি বলে আসছি। সেটিই আজ আদালতে প্রমাণ হলো। তবে মাঝখানে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ পিছিয়ে গেছে। আমরা এতদিনে এই সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করতে পারতাম। এ ছাড়া পদ্মা সেতু হলে ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি আমাদের বেশি হতো। বর্তমানে জিডিপি সাতের ঘরে থাকলেও সেটি এখন আট থেকে নয়-এর ঘরে চলে আসত। সেটা আমরা পারিনি। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরপর এই আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিপরিষদের অভিনন্দনের জবাবে তিনি বলেন, এ অর্জন দেশের জনগণের। পদ্মা সেতুর বিষয়ে অভিযোগে কেবল দেশ ও জনগণের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি, তার পরিবারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল ভুয়া ও আষাঢ়ে গল্পের মতো। কানাডার আদালতের রায়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মানুষের মানমর্যাদা অনেক বেড়েছে।
তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকার জন্য তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে গিয়ে ধর্ণা দিয়েছিলেন। ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে রাখার জন্য হিলারি তাকেও (প্রধানমন্ত্রী) ফোন করেছিলেন। তিনি হিলারিকে বলেছেন, ৬০ বছরের অধিক বয়সের কারোরই গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকার সুযোগ নাই। ড. ইউনূসের তো ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। হিলারিকে দিয়ে ফোন করানোর পরও গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে না পেরে তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর ক্ষুব্ধ হয়েই পদ্মা সেতু ইস্যুতে বাংলাদেশ ও সরকারকে হেয় করার চেষ্টা করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'ক্ষুব্ধ হয়ে তারা আমার ছেলেমেয়েকে ইউএসএর হোম অফিসে ডেকে নিয়েছিল। মোশাররফকে (সাবেক যোগাযোগ সচিব, বর্তমানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব) জেলে যেতে হয়েছিল। এভাবেই তারা একের পর এক শর্ত জুড়ে দিতে লাগলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়কার যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভঁূইয়াকে জেলে দিতে হয়েছিল। এসব ঘটনা ছিল দুঃখজনক। এসব ঘটনা তাদের সমাজে হেয় করেছে।'
তিনি বলেন, তবে আজ সত্য প্রকাশ হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। সত্যের পক্ষে থাকলে একদিন তা ঠিকই প্রমাণ হয়। যখন অভিযোগ করা হলো, তখন তো তারা টাকাই দেয়নি। তাহলে দুর্নীতি হলো কীভাবে? সেদিন তাদের কথায় অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়তো ঠিক হয়নি।
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নাকচ হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকার কোনো মামলা করবে কি-না সে বিষয়ে বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, কানাডার আদালতের রায়ের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠনিক প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দেওয়া হবে।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল, যদি তারা দুর্নীতির কথা বলে সেটা তাদের প্রমাণ করতে হবে। তারা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। এ জন্য মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি-না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আলোচনায় কেবল আমাদের অবস্থানই তুলে ধরা হয়েছে।
'শ্রম খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়েছে' : বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে শ্রম খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে যুক্তরাজ্যের লেবার ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহ্সানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
বৈঠকে যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রী এবং লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভার হুইপ ড্যাপ রোজি উইন্টার টন এমপি লেবার পার্টির সংসদ সদস্য এবং নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত দশ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের কল্যাণে তার সরকার গৃহীত পদক্ষেপের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেন, শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং কলকারখানায় কাজের পরিবেশ উন্নত করা হয়েছে।
প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মধ্যে ছায়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী জোনাথন অ্যাশওয়ার্থ এবং ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. রূপা হকও ছিলেন।
সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৬:১৩