প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনুস সম্পর্কে বলেছেন, গ্রামীণ ফোনের লাইসেন্স নেওয়ার সময় উনি আমার কাছে এসে বলেছিলেন, এর লভ্যাংশের ৩০ ভাগ গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রাহকরা পাবে। আমি তার কথা বিশ্বাস করে তখন দরপত্রে তৃতীয় হওয়া সত্ত্বেও গ্রামীণ ফোনের অনুমোদন দিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় এর অধিকাংশ শেয়ার বেচে তিনি ব্যক্তিগত প্রপার্টি করেছেন। এটা চিটিং ছাড়া কিছুই না। আমাকে রীতিমতো ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী তার জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরকালে জাতীয় পার্টির (জাপা) সংসদ সদস্য এ কে এম মাঈদুল ইসলামের এক সম্পুরক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন। এ সময় সংসদে সভাপতিত্ব করেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গরিবের হাড়-মাংস ও রক্ত ঝরানো টাকা দিয়ে যিনি বড়লোকিপানা করেন, সেই রক্তচোষাদের আবার দেশপ্রেম থাকবে কিভাবে? গরিব-দুঃখি মানুষের কাছ থেকে সুদ নিয়ে তার এখন অনেক টাকা। কিন্তু সরকারকে কোন ট্যাক্স দেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ ব্যাংকে তার কোটি কোটি টাকা। অথচ একটি টাকা উনি সুদ দেননি। গ্রামীণ ব্যাংক সুদমুক্ত ছিল এটা ঠিক, কিন্তু এই ব্যাংকের নাম ব্যবহার করে উনি যে আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো তো আর সুদমুক্ত না। সেই সুদ কেন সরকার পাবে না? সেসব প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স তারা কেন দেবে না? সেই প্রতিবেদনও আছে এনবিআরের কাছে। আর ফিক্সড ডিপোজিটে থাকা এতো টাকা কোথা থেকে এসেছে সেই হিসেবেও তো দিতে পারেননি। এখানে অর্থমন্ত্রী আছেন, উনিই দেখবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন। আমি বলতে গেলেই তো আমার বিরুদ্ধে নানা কথা শুরু হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এমন কিছু লোক আছে তারা হাজার পাপ করুক, তাদের দোষ যেন দোষই না। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য। অথচ আমাদের পান থেকে চুন খসলে কত কথা, কত লেখা হয়। জানি না তাদের বাচন ভঙ্গি বা কার্যক্রমের মধ্যে কী ম্যাজিক আছে? কিন্তু উনি সেই কথামালা দিয়ে অর্থ-সম্পদ নিজের করে একটা অবস্থান করে নিয়েছেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় একটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদককে সঙ্গে নিয়ে নতুন দল গঠনের কথা বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুদখোরের ডাকে দেশের জনগণ সাড়া দেয়নি। জনগণ তাকে প্রত্যাখান করেছে। তিনি বলেন, ওনাদের এখন অনেক টাকা। এই টাকা আমার গরিব-দুঃখি মানুষের সপ্তাহে সপ্তাহে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত টাকা। তারা (ঋণ গ্রহীতা) ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে টাকা কামাই করেছে, সেখান থেকে বিশাল অংকের সুদ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই মানুষগুলোর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। শেখ হাসিনা বলেন, সরকার থেকে তাকে (ড. ইউনুস) গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরানো হয়নি। উনি নিজেই আদালতে মামলা করে হেরে গিয়ে এমডি পদ খুইয়েছেন। আর মামলায় হেরে যাওয়ার পর তার যত ক্ষোভ যেন আমার ওপর। লবিষ্টের মাধ্যমে বিদেশের অনেকের মাধ্যমে আমাদের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করলেন। এমনকি তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়েও আমাকের ফোন করিয়েছিলেন। তাকে বলেছি, উনি আইন ভঙ্গ করে পদে ছিলেন এবং নিজে মামলা করে পদ খুইয়েছেন। এখানে সরকার কিছু করেনি। ড. ইউনুসকে উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, ‘উনি কী আমাকে এক কাপ চা খাইয়ে গ্রামীন ফোনের লাইসেন্স নিয়েছিলেন, নাকি আমি নিজে তাকে চা খাইয়ে লাইসেন্স দিয়েছিলাম- তা দেশবাসীকে বলুন।’
দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংকের পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, গ্রামীন ব্যাংকের আইনেই রয়েছে ৬০ বছরের বেশি কেউ এমডি পদে থাকতে পারবেন না। উনি (ড. ইউনুস) সত্তর বছর বয়সেও এমডি পদে বহাল ছিলেন। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও আমার উপদেষ্টা ড. গরহর রিজভী তার কাছে গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে যেহেতু বয়সের কারণে এমডি পদে থাকতে পারেন না, তাই ওই পদ ছেড়ে দিন। আমরা আপনাকে ওই ব্যাংকের ‘এ্যাডভাইজার এমিরেটাস’ করবো। উনি না মেনে ড. কামাল হোসেনের পরামর্শে আদালতে গিয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। মামলায় হেরে গিয়ে এমডি পদ হারালেন। আর সেই ক্ষোভ পড়লো আমাদের ওপর, পদ্মা সেতুর ওপর।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ হারানোর পর উনি দেশে-বিদেশে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা শুরু করলেন। একটি স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদককে নিয়ে উনি (ড. ইউনুস) বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করলেন। হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে লবিং করলেন। এরপর কোন অর্থ ছাড় না করেই পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিল। পরে নানাভাবে আমাদের হেনস্থা করার চেষ্টা হলো। মার্কিন গোয়েন্দা দিয়ে আমিসহ আমার ছেলে-মেয়ে, বোন, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের বিষয়ে নানাভাবে তদন্ত করা হলো, এতটুকু দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া যায় কি না। এতো কিছু করেও তারা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি রাজনীতি করি জনগণের কল্যাণের স্বার্থে, ব্যক্তিস্বার্থে নয়। আর জনগণের টাকা লুট করে নিজেদের ভাগ্য গড়বো এ ধরণের আকাঙ্ক্ষা বা মানসিকতা আমাদের নেই। পারলে জনগনকে বিলিয়ে দিয়েছি, সেটাই আমরা শিখেছি। আর আমাদের মনের জোর ও সততা ছিল বলেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংকের টাকায় আর পদ্মা সেতু করবো না। প্রকল্পের টাকা বন্ধ করে দেওয়ায় পদ্মা সেতু বন্ধ হওয়ায় তারা তো মহাখুশি। কিন্তু আমরা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। এখন আমরা নিজের অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের অপর সম্পুরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় ধারণা ছিল ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যবিমোচন করতে পারবে। তিনি নিজেও সেটি বিশ্বাস করতেন বলে ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে অনেক সহযোগিতাও করেছেন। কিন্তু দেখা গেছে, ক্ষুদ্রঋণের সুদ ও চক্রবৃদ্ধি সুদের হার এত বেশি যে, এই চক্রে পড়ে মানুষ স্বাবলম্বী হওয়ার বদলে নিঃস্ব হয়েছে। তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকে সাপ্তাহিক সুদও আবার ঋণ দেওয়ার সময় অগ্রিম কেটে নেওয়া হয়েছে এবং সেটি পরিশোধ করতে গিয়ে আবারও ঋণের জালে গরিব মানুষকে আটকে ফেলা হয়েছে। এর ফলে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ মানুষকে নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনে ঘর-বাড়ি হারিয়ে গ্রামছাড়া হতে হয়েছে, অনেকে আত্মহত্যাও করেছেন।
সরকারি দলের মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এবং জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে সারা বিশ্বের জন্য অনুসরণীয় একটি দেশ। অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এবং নিম্নআয়ের দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী সরকারের গৃহীত ‘বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২০২১)- এর সাতটি প্রধান উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য তুলে ধরেন। এই সাতটি প্রধান লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে- (১) জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। যেখানে মাথাপিছু আয় হবে ২ হাজার মার্কিন ডলার। (২) অভ্যন্তরীন বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ৩৮ শতাংশ অর্জন। (৩) ইতিমধ্যে অর্জিত খাদ্যশস্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে ২০২১ সালের মধ্যে খাদ্যে টেকসই স্বয়ংসম্পূর্নতায় রূপান্তর। (৪) ২০২১ সালের মধ্যে বাণিজ্য (আমদানি ও রফতানি) জিডিপির শতকরা ৬০ ভাগে উন্নীত করা। (৫) ২০২১ সালের মধ্যে মোট ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উত্পাদন ও ২০২১ সালের মধ্যে সকল মানুষকে বিদ্যুত সুবিধা প্রদান করা। (৬) ২০২১ সাল নাগাদ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী লোকসংখ্যা ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ নামিয়ে আনা এবং (৭) ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের জন্য তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা ইত্যাদি। অবশ্য ইতোমধ্যে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
রুস্তম আলী ফরাজীর এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার কোনো পরিকল্পনা নিয়েই বসে থাকেনি। তা বাস্তবায়নের জন্য যা যা পদক্ষেপ নেওয়ার নেওয়া হয়েছে।
জাতীয় পার্টির (জাপা) জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ও কক্সবাজার থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের অগ্রগতি তুলে ধরেন।
সুত্রঃ ড. ইউনূসকে একহাত নিলেন প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:২৯