লেখার শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আমাদের জন্মভূমির রাজধানী ইতিহাসখ্যাত ঢাকার দীর্ঘায়ু কামনা করব। মনে রাখব নানা সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বা অন্য নামে তাকে ডাকার চেষ্টা কিংবা নামকরণ সার্থক হতে পারেনি। কারণ, তার একটা স্বতন্ত্র ও আলাদা ইতিহাস আছে। এখন যা আমাদের জাতীয় গর্ব ও মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত। হঠাৎ কেন এই প্রসঙ্গ? তার আগে আমরা এই শহরের ইতিহাস বা নামকরণের দিকে একটু চোখ রাখি।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মুঘল-পূর্ব যুগে কিছু গুরুত্ব ধারণ করলেও শহরটি ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করে মুঘল যুগে। ঢাকা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে স্পষ্ট করে তেমন কিছু জানা যায় না। এ সম্পর্কে প্রচলিত মতগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ : ক. এক সময় এ অঞ্চলে প্রচুর ঢাকগাছ (বুটি ফুডোসা) ছিল; খ. রাজধানী উদ্বোধনের দিনে ইসলাম খানের নির্দেশে এখানে ঢাক অর্থাৎ ড্রাম বাজানো হয়েছিল; গ. ‘ঢাকাভাষা’ নামে একটি প্রাকৃত ভাষা এখানে প্রচলিত ছিল; ঘ. রাজতরঙ্গিনীতে ঢাক্কা শব্দটি ‘পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে অথবা এলাহাবাদ শিলালিপিতে উল্লিখিত সমুদ্রগুপ্তের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ডবাকই হলো ঢাকা। মুঘল (পূর্ব যুগের পুরাতাত্ত্বি¡ক নিদর্শন হিসেবে ঢাকা শহরে দুটি এবং মিরপুরে একটি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রাচীনতমটির নির্মাণ তারিখ ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দ (জোয়াও দ্য ব্যারোস ঢাকাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে দেখতে পান এবং ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে তার অঙ্কিত মানচিত্রে এর অবস্থান নির্দেশ করেন)।
ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ সব সময় পিছিয়ে। এইদিকে বিএনপি আবার প্রায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এর কারণ তাদের অতীত। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অনুসারীরা সোজাসাপটা কথা বলতেন। তাঁরা ছিলেন মনে ও মুখে অভিন্ন। তাঁদের শক্তি ছিল জনগণ। অন্যদিকে জোর করে বা ছলেবলে শাসনভার দখলের পর যারা দল করেন তাদের শুরুটাই হয় মিথ্যা দিয়ে। তাদের কাজগুলোও মিথ্যা দিয়েই শুরু। তাদের সংবিধান পরিবর্তন করতে হয়। জোর করে আইন বানাতে হয়। মিছেমিছি গণভোট করাতে হয়। দেখাতে হয় তারা কতটা জনপ্রিয়। এভাবে তারা মিথ্যা ও কপটতার জালে বন্দী হয়ে পড়ে। পরে তাদের এটাই হয়ে ওঠে নিয়তি। বাংলাদেশ এগোচ্ছে, মানুষ এগোচ্ছে, পরিবর্তনের স্রোতে দেশ ও সমাজ যতটাই পরিবর্তিত হোক বিএনপি তার স্বভাব বদলায়নি। তার ষড়যন্ত্রের আরেক রূপ বেরিয়ে গেল বিএনপি নেতা শামসুজ্জামান দুদুর মুখ ফসকে।
তার কথাগুলোকে স্বাভাবিক বা হঠাৎ বলা ভাবলে ভুল করা হবে। আমার ধারণা এই জাতীয় চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র আসলে তাদের ভেতর সব সময়ই কাজ করছে। অসতর্ক মুহূর্তে বা অসংলগ্ন কথাবার্তার ফাঁকে তা বেরিয়ে পড়েছে মাত্র। খেয়াল করবেন দুদু কিন্তু একটা প্ল্যানের কথা বলেছেন। যে পরিকল্পনা মাথায় না থাকলে বা নিজেদের ভেতর কাজ না করলে বানিয়ে বলা অসম্ভব। ঢাকা শহরে আমাদের জাতীয় বিমানবন্দরের নামটি জিয়াউর রহমানের নামে প্রায় পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিল। দূরদর্শিতার সঙ্গে সেটি একজন মহান আউলিয়া শাহজালাল বাবার নামে করায় সেটি আর জীবনেও তারা পরিবর্তন করতে পারবে না। তাহলে কি করবে তারা? কিভাবে হজম করবে মুছে যাওয়া জিয়াউর রহমানের নাম?
সরকার চন্দ্রিমা উদ্যান নিয়েও সংবেদনশীল। জিয়াউর রহমানের দাফন ও কবর নিয়ে আছে নানা ধরনের বিতর্ক। এসব বিষয় বিএনপির অজানা নয়। তাই এটা ভাবা ভুল যে, তারা আপাতত হজম করছে বলে এগুলো মেনে নিয়ে রাজনীতি করবে। কি তারা করবে বা করতে পারে তার একটা রূপরেখা বেরিয়ে এসেছে দুদুর মুখ থেকে। কি সাংঘাতিক, বলছেন গোপালগঞ্জের নাম নাকি করবেন মুজিবনগর। আমাদের ইতিহাসে মুজিবনগর নতুন নয়। বৈদ্যনাথতলায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগরের জায়গা ঠিক করা আছে। সে ইতিহাস জানলেও বিএনপি তা মানে না। মানে না বলেই আজ আবার নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছে তারা। প্রথম প্রবাসী সরকারের সেই অম্লান ইতিহাসকে ম্লান করার নতুন অপকৌশলের এই ধাপে তারা সাম্প্রদায়িকতাকেও শানিয়ে নিতে চাইছে। দুদু তো বলেছেনই গোপালকে? তিনি কি বঙ্গবন্ধুর চাইতে বিখ্যাত যে, তার নামে এলাকার নাম হতে হবে? গোপালগঞ্জের ওপর এই আক্রোশের মূল কারণ আসলে গোপাল নামটি। প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলেন তিনি গোপালী আর গোপালীরা হয় কপালি। খালেদা জিয়া বলেন উল্টোটি। আর দুদু? সে তো খালেদা জিয়ারই আপন মানুষ। কাছের মানুষ। বিএনপির এই ঘোর দুর্দিনে নেত্রীর মনে নুনের ছিটা দেয়াটা হয়ত উদ্দেশ্য ছিল না; কিন্তু যেভাবেই হোক আসল কথা বেরিয়ে গেছে।
গোপালগঞ্জকে তারা মুজিবনগর বানাবেন কি বঙ্গবন্ধুর জন্য? মোটেও নয়। সে কাজ আওয়ামী লীগই করতে পারে। তাদের আসল খায়েশও দুদু বলে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগের মাথায় টুপি পরিয়ে নিজেরা কেড়ে নেবেন রাজধানী। ঢাকার নাম নাকি হবে জিয়ার নামে। এই যদি তাদের উদ্দেশ্য হয় এখন থেকেই এর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা ও জনমতের বিষয়টি নীরবে ভাবা উচিত। আওয়ামী লীগ এখন এক ধরনের ভ্রান্তিবিলাসে আছে। তাদের নেতাদের মুখের দিকে তাকালে মনে হবে কোথাও কোন সমস্যা নেই। দেশের শাসনভার হাতে থাকলে চারদিকে এক ধরনের স্তাবকতা গড়ে ওঠে। স্তাবকরা ঘিরে থাকে এমন সব কথা বলে কাজ করে যাতে মনে হয় গদি চিরকালীন। সেটা যে হয় না বা হতে পারে না তা আওয়ামী লীগের চেয়ে ভাল আর কে জানে? তাই তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই দুদুরা কিন্তু আপনাদের চাইতে অনেক বেশি ষড়যন্ত্রে সফল। তারা এ দেশের ইতিহাসে ঘোষক বিতর্ক তুলে জাতিকে বহুকাল বিভ্রান্তিতে রেখেছিল। এখনও তা তুষের আগুনের মতো মুসলিম লীগার ও বিএনপির অন্তরে জ্বলছে। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীনসহ সবাইকে মুছে ফেলার চক্রান্ত সফলতার মুখ দেখতে দেখতে ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাদের অন্তরে বিষ এখন সাপের মতো ফুঁসছে।
দুদুর এই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যম ও মিডিয়ায় ভাইরাল আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ভেতরে বিএনপির ঝিমিয়ে পড়া কর্মী বা সমর্থকদের জন্য আছে নতুন ইন্ধন। তারা ভেবে নিতে পারবে আবার কোনদিন সুযোগ মিললে ঢাকা হবে জিয়ানগর। জিয়াউর রহমানের এই তথাকথিত ইমেজ আমাদের জাতির জন্য এক অভিশাপ। মুক্তিযুদ্ধের এই সেক্টর কমান্ডার কেন, কিভাবে, কোন্ কারণে সর্বাধিনায়ক, এমনকি দেশের জনককে চ্যালেঞ্জ করতে পারে? এসব এত পুরনো কথা আর এত চর্চিত যে, বলাটা এখন ক্লান্তির বিষয়। কে না জানে পরাজিত মুসলিম লীগ রাজাকার পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা এর পেছনে কাজ করেছিল। আজও সেই অপশক্তি সমান সক্রিয়। তারা আপাতত দমে থাকলেও সুযোগের দিন গুনছে। দুদু তারই প্রতিনিধি। শুধু সময়টা ঠিক হয়নি। বিএনপি বসে নেই। তলে তলে তারা যেসব নীলনকশা আঁটছে এটা তার একটা বড় প্রমাণ। ঢাকার কপালে এমন দুর্ভোগ নামার আগেই সতর্কতা জরুরী।
সম্প্রতি আমি ভিয়েতনাম ঘুরে এসেছি। আমাদের মতো ইতিহাস ও যুদ্ধে রক্তাক্ত এক জনপদ এই দেশ। তাদেরও লড়াই ছিল প্রাণঘাতী। বিজয়ের পর তারা সায়গনের নাম পাল্টে রেখেছে হো চি মিন সিটি। বীরযোদ্ধা কমিউনিস্ট দুনিয়ার নেতা হো চি মিনের নামে নামকরণ হওয়ার পরও সে দেশের রাজাকাররা তা মানতে চায় না। আমেরিকা ও দালাল সরকারের তাঁবেদার যেসব ভিয়েতনামী প্রবাসী, যারা আমেরিকা বিলেত অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে পালিয়ে এসে জীবনযাপন করছে তারা বলে সায়গন চিনি, হো চি মিন সিটি চিনি না। এই যে কূটতর্ক বা বিবাদ এর পেছনে আছে বিভক্তির নোংরা রাজনীতি। তেমন এক পরিবেশ বা আবহ তৈরি করতে পারলে বিএনপির রাজনীতি আবার কিছু সময়ের জন্য চাঙ্গা হবে বটে, আমাদের কলঙ্ক রেখা হবে দীর্ঘতর।
দুদুর এই বক্তব্যকে সামনে রাখলে আরও একটা গভীর ষড়যন্ত্রের কথা মনে পড়বে। ঢাকার নাম বদলানোর কথা বলছে বটে, আসলে এক সময় হয়ত দেশের নামও পাল্টে দিতে চাইবে তারা। পাল্টে দেবে পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। এটা তারই পূর্বাভাষ। এই রাজনীতি বহুদিন ধরে তার খায়েশ মেটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অনেকটা পথ পাড়িও দিয়েছে তারা। পাল্টে দিতে পেরেছে আমাদের চিন্তা। মগজের পচন মেধার পতন আর পোশাক আহার চলনের সঙ্কীর্ণতাই তার বড় প্রমাণ। ফলে দুদুর এই কথাকে দুধ-ভাত মনে করার কারণ দেখি না। যে সংস্কৃতি, যে রাজনীতি, যে মেধা আমাদের পথ দেখাতে পারে, যারা সামনে এলে অন্ধকার দূর হয় তারা আজ বড় বেশি নীরব। তাদের নিয়ে আসতে হবে। তারা নেতৃত্ব দিলে তবেই এর অবসান হতে পারে বা এই অপচেষ্টা আঁতুড়ঘরে মারা যেতে পারে।
ঢাকাকে ঢাকার মর্যাদা, দেশকে দেশের জায়গায় রাখার জন্যও কি এক হব না আমরা?সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৯:৩৭