শুধু স্বদেশেই নয়, গোটা বিশ্বজুড়ে তোলপাড় হয়ে গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সম্প্রতি সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মন্দিরে ভাঙচুর ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীকালে এই ঘটনার জের ধরে আরো চার দফায় আগুন লাগানো হয় বিভিন্ন স্থানে।
‘কমিউনাল রায়ট’ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটি ভয়াবহ ঘটনা। কোথাও এই বিষবাষ্প স্পর্শ করলে মুহূর্তেই তা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রলয়ঙ্করী মানবিক বিপর্যয়। বিষয়টি একই সঙ্গে খুবই স্পর্শকাতরও বটে, বিশেষ করে সব প্রকার সংবাদ মাধ্যমের জন্য। কারণ কোনো কোনো সময় সাংবাদিকের কলম প্রচণ্ড অগ্নিগর্ভা হয়ে উঠতে পারে। তাদের একটি বাক্যে, একটি শব্দে ঘটে যেতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন লণ্ডভণ্ড। এ কারণে সাংবাদিকদের সব পরিস্থিতিতেই সংযমী এবং দায়িত্বশীল হতে হয়। মানুষে মানুষে যাতে ভেদাভেদ সৃষ্টি না হয়, অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি না হয় কিংবা মারামারি-হানাহানির সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে কলম সৈনিকদের থাকতে হয় সদা-সজাগ অতন্দ্র্র প্রহরীর মতো। সাদামাটাভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে বুঝায় দুই বা ততোধিক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর লোক প্রবল উত্তেজনাবশত কিংবা ভয়ঙ্কর বিদ্রোহী হয়ে প্রতিহিংসা নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা হত্যা নেশায় লাঠিসোটা, দা-কুড়াল, পিস্তল-বন্দুক প্রভৃতি মারণাস্ত্র নিয়ে উন্মাদের মতো শুরু করে সর্বগ্রাসী ও সর্বনাশী মরণ খেলা। অসহায় মানবতা আর্তনাদ করতে থাকে ভূতলে পড়ে, অকালে জীবন হারায় নির্দোষী-নিরপরাধ মানুষ। মুহূর্তের মধ্যে সোনার সংসার ছারখার হয়ে যায়। আগুনে পুড়ে ঘরবাড়ি, দোকানপাট ভস্মীভূত হয় চোখের নিমিষে। বাস্তুভিটার মায়া ছেড়ে মানুষ পাড়ি জমায় নিরুদ্দেশের ঠিকানায়।
নাসিরনগরের মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যান আমাদের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার শত শত কর্মী। বিপন্ন মানবতার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। এটাই তো মিডিয়া কর্মীদের প্রধান দায়িত্ব, করণীয়। তারা বাস্তব চিত্র গোটা জাতির কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি বুদ্ধি-পরামর্শ ও মতামত ব্যক্ত করেন। ঘটনার বিস্তার রোধ এবং একই সঙ্গে ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সে ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। একই সঙ্গে তারা তাদের লেখনি ও চিত্রের মাধ্যমে প্রশাসনকে সহায়তা করেন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারে সোপর্দ করার স্বার্থে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের রিপোর্টিং ক্লাসে সাংবাদিকতার কিছু এথিক্স পড়ানো হয়। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কঠিনভাবে সতর্ক করা হয় যাতে ধর্ম, বিশ্বাস, সামাজিক ব্যবস্থা প্রভৃতি স্পর্শকাতর বিষয়সমূহের রিপোর্ট করতে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এমন কোনো বাক্য ও শব্দ ব্যবহার না করা হয়, যা সমাজে উত্তেজনা কিংবা জাতিতে জাতিতে বা গোষ্ঠীর সঙ্গে গোষ্ঠীর কোনো দ্ব›দ্ব ও সংঘাতের সৃষ্টি করতে পারে। যেমন হিন্দু সম্প্রদায়ের বিজয়া দশমীর বিসর্জন মিছিল মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুসল্লিদের দ্বারা আক্রান্ত হলো এবং একই দিন একটি রাম মন্দির বা কালী মন্দিরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শিয়া মুসলমানদের একটি তাজিয়া মিছিল উগ্র হিন্দুবাদীদের কোপানলে পড়ে। এই ঘটনাকে রিপোর্ট করতে গেলে একটি সমাজসচেতনতা ও দায়িত্বশীল সাংবাদিক এভাবে রিপোর্ট করেন যে নগরীর অমুক রাস্তা দিয়ে বিজয়া দশমীর বিসর্জন মিছিল আতিক্রমের সময় কিছু দুষ্কৃতকারী আক্রমণ করে এবং একই দিনে নগরীর অপর একটি রাস্তা দিয়ে মহররমের তাজিয়া মিছিল অতিক্রমকালে কিছু দুর্বৃত্ত হামলা চালায়। কোনো অবস্থাতেই মুসলিম, হিন্দু, মসজিদ, মন্দির প্রভৃতি লেখা যাবে না। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার দোহাই দিয়ে অনেকে বলতে চাইবেন ‘যা ঘটেছে তাইতো লিখতে হবে’, না একথা সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। সাংবাদিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ বলেও একটি বিষয় রয়েছে এবং সব বিষয়ের মধ্যে এই উপলব্ধিটাই মুখ্য। সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, মানুষে মানুষে বিভেদ-সংঘর্ষ বাধে এমন লেখা থেকে বিরত থাকতে হবে- এটাই সাংবাদিকতার নীতিমালা অথবা এথিক্স অব জার্নালিজম। এটা মিডিয়া কর্মীদের মনে রাখতে হবে, রিপোর্টিং করার সময় প্রতিটি সাংবাদিককে দায়িত্বশীল ও সংযত হতে হবে। অনেক প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নাসিরনগরের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে এই এথিক্স মানেননি।
সঙ্গত কারণেই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। শুধু বাংলাদেশেই নয়, গভীর অসন্তোষের সঙ্গে লক্ষ করেছি বিশ্বের যেসব স্থানে এই সংগঠনের শাখা রয়েছে সবাই স্ব-স্ব শহরে সভা-সমাবেশ, মিছিল-বিক্ষোভ করে এই ঘটনার প্রতি তীব্র ঘৃণা, ক্ষোভ ও ধিক্কার জানিয়েছে। সাম্প্রদায়িক নিগ্রহ বন্ধ ও তার প্রতিবাদ করা এবং সেইসঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের (রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘু নয়) অধিকার সুরক্ষা ও সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জন্ম হয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে লিপিবদ্ধ করার প্রেক্ষাপটেই এই সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে এবং সংগঠনটি না করে বসে থাকার উপায় ছিল না। এই পবিত্র বাংলাদেশে হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব সম্প্রদায়ের লোকদের।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কর্ণধার এডভোকেট রানা দাসগুপ্ত আমার পরম বন্ধু। চট্টগ্রামে অবস্থানকালে মহান বিজয়মেলা (যা বর্তমানে সারা পৃথিবীতে দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়েছে) সংগঠিত করে জামায়াত-শিবিরের হিংস্র ছোবল থেকে চট্টগ্রাম তথা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক অধ্যাপক আবদুল মান্নান, অধ্যাপক সামসুল ইসলাম বাহাদুর, রাণাদাশ গুপ্তসহ আমরা একত্রে কাজ করছি। সেই সুবাদে রাণাদাশ গুপ্তের আপাদমস্তক আমার চেনা। তার শিরায় শিরায় ও রক্তের কণিকায় প্রবহমান ফল্গুধারার সঙ্গে আমি পরিচিত। তিনি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা ও প্রাগ্রসর মুক্ত চিন্তার অধিকারী একজন প্রশ্নাতীত দেশপ্রেমিক। কদিন আগে তারই একটি সাক্ষাৎকার ভারতের পিটিআই বিকৃতভাবে প্রচার করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে রণেশ দাসগুপ্তকে নিয়ে সমালোচনার ঝড়ে ওঠে। আমি সামাজিক মিডিয়ায় বিষয়টি সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মহলের কাছ থেকে এ প্রসঙ্গে ইতিবাচক ‘ফিডব্যাক’ পেয়েছি।
এ অবস্থায় ডভোকেট রণেশ দাসগুপ্ত তথা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কাছে বিনম্র নিবেদন, শুধু ডালপালা নিয়ে কাটাকুটি ও টানাহেঁচড়া করে কোনো লাভ হবে না। আপনাদের একেবারে মূলে যেতে হবে। রাষ্ট্রধর্ম নামের জাতীয় জীবনের পীত বিষবৃক্ষটি যদি সমূলে উৎপাটন করা না গেলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারময়। কেবল অসাম্প্রদায়িক চেতনাই নয়, এই বিষবৃক্ষিটিকে সমূলে উৎপাটিত করা না গেলে ভবিষ্যতে একদিন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংকটাপন্ন হতে বাধ্য। এই বিতর্কের জের ধরে বিভিন্ন মহল ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে। তবে বিষয়টি খুব সহজও নয়। সম্প্রতি নাসিরনগরের ঘটনার জের ধরে অনেকেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিলোপ চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সদ্য আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ ফোরাম প্রেসিডিয়ামে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন সুযোগমতো রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বিলোপ করা হবে। ড. রাজ্জাক আমাদের রাজনীতিতে একজন মেধাবী মুখ। ড. রাজ্জাক সঠিক মন্তব্য করেছিলেন। তবে রাজনীতিতে জটিল চোরাবালি অতিক্রম করতে গিয়ে অনেক সময় কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। তাই তার মন্তব্যের পরপরই দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পরিবর্তনে আওয়ামী লীগের কোন চিন্তা-ভাবনা বর্তমানে নেই।
কোন পরিপ্রেক্ষিতে এবং কিসের জন্য ওবায়দুল কাদের এই মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক সচেতন প্রত্যেকেই তা অনুধাবন করতে পারেন। হঠাৎ করে ইসলাম শব্দটিকে সংবিধান থেকে মুছে ফেললে তাকে ক্যাপিটাল করে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী রাজনীতির আসর গরম করতে উদ্যত হবে এবং ধর্মীয় উন্মাদনা অনেক সময়ই জাতিকে বিরূপ পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। অতএব সহজ সরলীকরণ করে এখনই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধান থেকে মুছে ফেলতে হবে এমন দাবিও বাস্তবসম্মত নয়। তবে এর একটি সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান রয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধানে অস্পষ্ট রেখেও বিষয়টির একটি শান্তিপূর্ণ সুরাহা করা সম্ভব। এটা করা যায় কেবলমাত্র একটি ছোট্ট সংশোধনীর মাধ্যমে। যেখানে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম’ তার পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। এ ছাড়াও রাষ্ট্র বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও ব্যক্তির স্ব-স্ব ধর্মীয় অনুভূতিকে সমানভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাবে’ এই বাক্যটি দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হলে কারো মনে ক্ষোভ থাকার কথা নয়। আমরা যেমন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান মিলে শান্তিতে পাশাপাশি অবস্থান করে বসবাস করে আসছি তেমনিভাবে আমাদের পবিত্র সংবিধানেও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান একই ফ্রেমে বাঁধা থাকতে পারে। এখানে কারো বা কোনো সম্প্রদায়ের কোনো ওজর আপত্তি থাকার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। আর এভাবে আমরা যদি রাষ্ট্রধর্মের বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারি তবে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও আমরা অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার প্রতিষ্ঠা করতে পারব। তাই আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হলো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অসৎ উদ্দেশ্যপ্রসূত ‘রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম’ বিষয়টি চিরদিনের মতো আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে উৎপাটিত করা।
সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৭ ভোর ৬:২০