প্রতি মিনিটে একটি করে ফ্লাইট ওঠানামা। বছরে কমপক্ষে এক কোটি ২০ লাখ যাত্রীর চেক ইন ও চেক আউট। বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই মাত্র আধা ঘণ্টায় কোন ধরনের যানজট ছাড়াই জিরো পয়েন্টে পৌঁছার সুবিস্তৃত সড়ক। চব্বিশ ঘণ্টা ৪ শ’ যাত্রীবাহী ফ্লাইট ও ২শ’ কার্গোবাহী ফ্লাইট অপারেশন। এমনই অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা বিবেচনায় রেখে বিশ্বমানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিমানবন্দরের সমীক্ষার কাজ চলছে। গত দু’মাস ধরে জাপানের শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ সংস্থা নিপ্পনের দুই ডজন বিশেষজ্ঞ দিনরাত কাজ করছেন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ মেগা প্রকল্পের। দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত
ইনসিওন এয়ারপোর্টের আদলেই তৈরি করা হবে স্বপ্নের এ এয়ারপোর্ট। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই এ প্রকল্প উদ্বোধনের বিষয় বিবেচনায় রেখেই চলছে তাদের কর্মকা-। সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীর নেতৃত্বে
থাকা এক দল মেধাবী প্রকৌশলীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রতিদিন ঢাকার বাইরে ছুটছেন নিপ্পনের বিশেষজ্ঞরা। আগামী এক শ’ বছরের প্রয়োজন বিবেচনায় উপযোগী জমি খুঁজতে ইতোমধ্যে মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিল, পদ্মার ওপারের চরজানাজাতসহ বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন করেছেন তারা। খোঁজ নেয়া হয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকা, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, মানিকগঞ্জের চর ও কুমিল্লার একটি এলাকায়। এর মধ্যে তিনটি স্থান বাছাই করে পাঠানো হবে সরকারের বিবেচনায়। সেখান থেকে একটি চূড়ান্ত করার পর দ্বিতীয় দফা শুরু হবে এ বিমানবন্দরের অত্যাধুনিক ড্রয়িং-ডিজাইন। গত দু’মাসে নিপ্পনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী বলেন, এখন চলছে উপযোগী জমি অনুসন্ধানের কাজ। জমি চূড়ান্ত বাছাইয়ের পর চলবে ড্রয়িং ডিজাইনের কাজ। মোট কথা বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এতদিন ছিল স্বপ্ন। এখন সেই স্বপ্ন পূরণের পথে ডালপালা মেলে বিস্তৃত হচ্ছে। পদ্মা সেতুর অনুপ্রেরণাই বড় উৎস হচ্ছে এ স্বপ্নের বাস্তবতার।
এ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সিভিল এভিয়েশনের বর্তমান চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী, মেম্বার (অপস) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান, পরিচালক উইং কমান্ডার জিয়াউল কবীর চৌধুরী ও প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীর নেতৃত্বে চলছে সার্বিক তদারকি। জাপানীদের নিরাপত্তায় রয়েছে সর্বোচ সতর্কতা।
সিভিল এভিয়েশনের প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে, নিপ্পনের বিশেষজ্ঞরা এখন অবিরাম কাজ করে চলেছেন। এমন একটি বিশাল কাজে সম্পৃক্ত হতে পেরে তারাও গর্বিত। দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজকে তারাও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। প্রকল্পটিকে দু’ভাগে ভাগ করে তারা এগুচ্ছেন। প্রথম দফায় উপযুক্ত জমি বাছাই, দ্বিতীয় দফা ড্রয়িং ডিজাইন তৈরি, সম্ভাব্য ব্যয় ও সময় নির্ধারণ। তবে উপযুক্ত জমি খুঁজে বের করাই হচ্ছে এ প্রকল্পের সবচেয়ে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। বাকিগুলো হবে সময়সাপেক্ষ।
বাংলাদেশে গত দু’ মাস ধরে এ প্রকল্পের সমীক্ষায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে নিপ্পনের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। জমি নির্ধারণ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ প্রকল্পের সমীক্ষা প্রতিবেদনের কাজ দেয়া হয়েছে জাপানী নির্মাণ সংস্থা নিপ্পনকে। ১২০ কোটি টাকার এ সমীক্ষার কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে তিনটি স্থানে জরিপ চালানো কাজ চলছে। যেটা সার্বিক বিচারে উপযোগী হবে সেটাই নির্ধারণ করা হবে। তবে সরকারের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে-পদ্মা সেতুর দক্ষিণপ্রান্তে চরজানাজাত। একটি উপযোগী স্থান বাছাই, নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয়, সময় ও অবকাঠামোগত সুবিধাদি তৈরি করতে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হতে পারে তারও ধারণাপত্র থাকবে সমীক্ষায়। এ সমীক্ষায় চূড়ান্ত করা হবে- বর্তমান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দশটি বিমানবন্দরের সঙ্গে তুলনামূলক অত্যাধুনিক একটি আকর্ষণীয় বিমানবন্দর নির্মাণ করা। সিঙ্গাপুরে চাঙ্খী এয়ারপোর্ট, দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, হিথরো এয়ারপোর্টের মতোই অত্যাধুনিক সব সুযোগ সুবিধা রেখেই ড্রয়িং ডিজাইন তৈরি করা হবে। যাতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শীর্ষ হাব হিসেবে গড়ে তোলা যায় এই বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্টকে।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট শুধু সিভিল এভিয়েশন নয়, গোটা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প। কমপক্ষে দুটো পদ্মা সেতুর সমান ব্যয়ে নির্মিত হবে এ এয়ারপোর্ট। জমি চূড়ান্ত করার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই ড্রয়িং ডিজাইন তৈরি করা হবে। এরপর আগামী ডিসেম্বরে সমীক্ষা প্রতিবেদন হাতে পেলে সরকার খুব দ্রুত গতিতে সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থাৎ ২০১৯ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের আগ্রহ রয়েছে সরকারের।
সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী জনকণ্ঠকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট হবে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বৃহতত্তম ও আকর্ষণীয় এক স্থাপনা। এর নান্দনিক নির্মাণশৈলী হবে অভূতপূর্ব। আগামী এক শ’ বছরের পরিকল্পনা বিবেচনায় নিয়ে সাজানো হবে এর অবকাঠামো। এটির ব্যয় কতটা হবে সেটা অঙ্ক করে আনুমানিক ধারণা দেবে সমীক্ষা প্রতিবেদনের কাজ পাওয়া নিপ্পন কোং।
বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্টের সম্ভাব্য স্থান, নির্মাণ ব্যয়, সময়সীমা ও মডেল কেমন হতে পারে জানতে চাইলে প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী জনকণ্ঠকে বলেছেন, এ সব প্রশ্নের জবাব তৈরির কাজই দেয়া হয়েছে জাপানের শীর্ষ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান নিপ্পনকে। নিপ্পনের সমীক্ষা প্রতিবেদন যত দ্রুত পাওয়া যাবে ততো দ্রুত এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে।
সূত্র জানায়, শিবচরের চরজানাজাত, দোহারের চরবিলাসপুর, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের কেয়াইন ও লতব্দি এলাকাকে রাখা হয়েছে সমীক্ষার শীর্ষে। এ ছাড়া ভালুকা, পদ্মার দক্ষিণের শরীয়তপুর, আড়াইহাজার, মানিকগঞ্জের চর, মাদারীপুর ও মুন্সীগঞ্জের কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেছেন জাপানী বিশেষজ্ঞরা। এগুলো সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পাঠানোর পর একটি চূড়ান্ত করা হবে। এ ক্ষেত্রে অনেক বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা আগামী এক শ’ বছরের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে তৈরি করা হবে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট। ওই এক শ’ বছরে দেশের সম্ভাব্য জনসংখ্যা, যাত্রী পরিসংখ্যান কি হবে, যাতায়াত ব্যবস্থা কতটা উন্নত হবে, বিশেষ করে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে ওঠা অন্যান্য যাতায়াত অবকাঠামো সুবিধার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এয়ারপোর্টের মডেল তৈরি করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্টের জন্য যে পরিমাণ জমির দরকার সেটা বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে সহজে পাওয়া যাবে সেটার উপর নির্ভর করছে সবকিছু।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এই এয়ারপোর্ট হবে পদ্মা সেতু কেন্দ্রিক। যাতে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে ওঠে। আগামী এক শ’ কিংবা পঞ্চাশ বছরে দেশের উন্নয়ন হবে দক্ষিণকেন্দ্রিক। সে হিসেবে পদ্মার দু,পাড়েই বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট নির্মাণের বিষয়ে ইতোমধ্যে সরকারের আগ্রহ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ অবস্থায় এটা নিশ্চিত- পদ্মাকেন্দ্রিক এ প্রকল্পের জমি পাওয়া যতটা দুষ্কর হবে তার চেয়েও বেশি বেগ পেতে হবে জমির স্থায়িত্ব ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে। কারণ উন্মত্ত পদ্মার যে চরিত্র তাতে কোন পাড় কখন ভাঙ্গে, কোন গভীরতায় কখন চর জাগার বিষয়টি দীর্ঘ গবেষণার দাবি রাখে। নদী বিশেষজ্ঞের মতে-পৃথিবীতে পদ্মা একমাত্র নদী যার, কোন চরিত্র গতি প্রকৃতি চরম অনিশ্চিয়তা ও রহস্যে ঘেরা। গত পাঁচ শ’ বছরে পদ্মা নদীর গতিপ্রকৃিতর ইতিহাস বিশ্লেষণ করছে জাপানী নদী বিশেষজ্ঞরা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পদ্মার দক্ষিণ প্রান্তের চরজানাজাতে যে ত্রিশ হাজার একর খাস জমি আছে সেটাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিলেও দেখতে হবে এখানে এয়ারপোর্ট নির্মাণ করা যাবে কিনা। গত পাঁচ শ’ বছর এই পয়েন্টে কিভাবে কতটুুক ক্ষয় বা ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে, আগামী এক শ’ বছর এ পয়েন্টে পদ্মার ভাঙ্গনের আশঙ্কা কতটুকু সেটাই প্রথম বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ বাঁধ দিয়ে পদ্মার ভাঙন কতটা ঠেকানো যাবে, কিংবা আদৌ সেটা সম্ভব কিনা সেটা নিয়েও কাজ করছেন নিপ্পনের হাইড্রোলিক বিশেষজ্ঞরা। তারা বিগত পাঁচ শ’ বছরের পদ্মার ইতিহাস ও গতি প্রকৃতি নিয়েও গবেষণা করছেন। নাদী বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের কোন নদীগবেষকই আজ পর্যন্ত পদ্মার রহস্য বুঝে উঠতে পারেননি। রহস্যে ঘেরা এ নদীর কোন পাড়ে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট নির্মাণ করলে সেটা স্থায়িত্ব পাবে সেটাই সমীক্ষা করছেন নিপ্পনের হাইড্রোলকি বিশেষজ্ঞরা।
সিভিল এভিয়েশন জানিয়েছে, চরজানাজাতেই এখন পর্যন্ত সবার শীর্ষে। কেননা এখানেই রয়েছে প্রায় ত্রিশ হাজার একর খাস জমি, যা দেশের আর কোন এলাকায় নেই। জমি হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। এর আগে মুন্সীগঞ্জের অড়িয়াল বিলে জমি খুঁজতে গিয়ে সরকারকে পশ্চাদপসারণ করতে হয়। কারণ-ওখানে ছিল কৃষি জমি। চরজানাজাতে ত্রিশ হাজার একর খাস জমি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্টের জন্য দরকার হবে বড়জোর ১২ হাজার একর জমি। এ জমি একোয়ার করতে হবে না। এসব বিবেচনায় সবচেয়ে উপযোগী স্থান হতে পারে চরজানাজাত। কিন্তু নিপ্পনের হাইড্রোলিক বিশেষজ্ঞরা যদি এ স্থানের উপর আস্থা রাখতে না পারেন তাহলে অন্য কোন সাইট বিবেচনায় নেয়া হবে। এত খাস জমি একত্রে পদ্মাকেন্দ্রিক না পেলে হয়ত কিছুটা অধিগ্রহণ করে হলেও সেটা বিবেচনায় নেয়া হবে।
সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়- বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট আগামী এক শ’ বছরের পরিকল্পনা বিবেচনায় নেয়া হলেও সেটা হবে ধাপে ধাপে। প্রথম ধাপে আগামী ত্রিশ বছরে দেশের এভিয়েশন সেক্টর কতটা বৃদ্ধি পাবে, কত উড়োজাহাজ ওঠানামা করার প্রয়োজনীয়তা থাকবে সেটা বিবেচনায় রেখে এয়ারপোর্টের নক্সা তৈরি করা হবে। এমনভাবে সেটা করা হবে যাতে এক শ’ বছরের সম্ভাব্য সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও সেটা করা সম্ভব। যেটা বর্তমান শাহজালাল বিমানবন্দরে নেই।
বিশাল এ প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় সম্পর্কে সিভিল এভিয়েশন এখনই তেমন কোন মন্তব্য না করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বর্তমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে সব অবকাঠামোগত সুবিধা আছে-তেমন একটি এয়ারপোর্ট তৈরি করতেও কমপক্ষে ষাট হাজার কোটি টাকা লাগবে। তারপর বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট থেকে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বিশেষ যাতায়াত অবকাঠামো তৈরি করতেই লাগবে আরও প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা। চরজানাজাতে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট নির্মাণ করা হলে-সেখান থেকে গুলিস্তান ও বর্তমান শাহজালাল পর্যন্ত তৈরি করা হবে উড়ন্ত সেতু, বিশেষ রেল ও অন্যান্য সড়ক। যা শুধু বঙ্গবন্ধু এয়ারর্পোর্টকেন্দ্রিকই তৈরি করা হবে। এজন্য এর আনুমানিক ব্যয় কমপক্ষে ষাট হাজার কোটি টাকা ধরেই প্রকল্পে নামতে হবে। ধাপে ধাপে করলেও এ প্রকল্পটি শেষ করতে কমপক্ষে দশ বছর সময় লাগতে পারে। প্রথম ধাপে আগামী পঁচিশ বছরের চাহিদা সামনে রেখে কাজ শুরু হলেও পরের ধাপে পঞ্চাশ বছরের চাহিদা বিবেচনায় রেখে ধাপে ধাপে এ এয়ারপোর্টের কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরুর পর এ ধরনের তথ্য উঠে আসছে।
জানা যায়, সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের (পিপিপি) আওতায় প্রথম প্রকল্প হিসেবে ২০১০ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। পরবর্তীতে পিপিপি থেকে সরে এসে নিজস্ব অর্থায়ন ও দাতা সংস্থার সহায়তায় দেশের সবচেয়ে বড় ও আধুনিক এ বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এখন চলছে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ, যা ২০১৭ সালে শেষ হবে। প্রকল্পের স্থান নির্ধারণে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। যার আওতায় এখন চারটি স্থান চিহ্নিত করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। এ চার স্থান হচ্ছে মাদারীপুরের শিবচরের চরজানাজাত, দোহারের চরবিলাসপুর, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের কেয়াইন ও লতব্দি এলাকা। তবে পদ্মা সেতু থেকে দূরত্ব কম থাকায় চরজানাজাতকে তালিকার প্রথমে রাখা হয়েছে। এ পয়েন্ট যদি ভাঙ্গনের আশঙ্কা না থাকে তাহলে এটাকেই প্রাধান্য দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, পদ্মার ওপারে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামে দেশের বৃহত্তম বিমানবন্দর তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
স্বপ্নের এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গত বছরের ১৯ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীর স্বাক্ষরিত ওই দরপত্রে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসংবলিত আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে আগ্রহপত্র চাওয়া হয়। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের জন্য প্রাক্কলিত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৩৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়, দুটি ধাপে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রথম ধাপে চারটি জায়গা থেকে যেকোন একটি জায়গা নির্বাচন করা হবে এবং দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচিত স্থানের বিস্তারিত সমীক্ষা (ডিএফএস) সম্পাদিত হবে। এ সমীক্ষার মেয়াদ ২০১৭ সালের জুনে শেষ হবে। চারটি স্থান নির্বাচনের বিষয়ে কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নিমিত্ত বেসামরিক পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকার সঙ্গে উত্তম যোগাযোগ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্য সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শনপূর্বক স্থান নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়। উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের লক্ষ্যে মোট ৯টি স্থান সরেজমিন পরিদর্শন করে ঢাকা থেকে দূরত্ব, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা, জমির পর্যাপ্ততা, আন্তর্জাতিক রুট, সড়ক, রেল ও নদীপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের সম্ভাবনা, পুনর্বাসন, যাতায়াত খরচ ইত্যাদি বিবেচনা করে উপরোক্ত চারটি স্থান নির্বাচন করা হয়। মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দেয়াকালে প্রকল্পটির বাস্তাবায়নকাল ধরা হয়েছিল ২০১০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০ হাজার কোটি টাকা। চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এটি নির্মাণ করতে আগ্রহ দেখায়।
বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট সেলের সাবেক প্রধান জয়নাল আবেদীন তালুকদার বলেন, প্রাথমিক নকশা অনুযায়ী এটি তৈরি করা হবে প্রায় দশ হাজার একর জমি নিয়ে। নতুন বিমানবন্দরে সাড়ে ১২ হাজার ফুট করে মোট তিনটি রানওয়ে থাকবে। আধুনিক জাম্বো বিমান তথা এয়ারবাস ৩৮০ চলাচলে সক্ষম রানওয়ে দুটি এবং অবতরণের জন্য অন্য একটি রানওয়ে। চব্বিশ ঘণ্টা ৪শ’ যাত্রী ও ২শ’ কার্গো বাহী ফ্লাইট ওঠানামার সুবিধা থাকবে এখানে। এছাড়া সমান্তরাল ট্যাক্সিওয়ে ও এ্যাপ্রোন, দৈনিক পঁয়ত্রিশ হাজার যাত্রী পরিবহনের সুবিধাসম্পন্ন প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল কমপেক্স, পর্যাপ্ত স্থানবিশিষ্ট ডিউটি ফ্রি শপ, পাঁচ তারকাবিশিষ্ট হোটেল, তিন তারকাবিশিষ্ট ট্রানজিট হোটেল, পর্যাপ্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার, আধুনিক ও সমন্বিত নিরাপত্তা সিস্টেম এবং টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক থাকবে এখানে। থাকবে এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই জিরো পয়েন্ট ও এক ঘণ্টায় বর্তমান শাহজালাল বিমানবন্দরে যোগাযোগের বিশেষ মেট্রোরেল ও সড়ক ব্যবস্থা।
জানা যায়, ১২০ কোটি টাকার সমীক্ষায় কাজ করছেন নিপ্পনের দু’ডজন বিশেষজ্ঞ। এদের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতিবিদ, ভূ তত্ত্ব¡বিদ, নদী গবেষক, এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, রাডার আইকাও মনোনীত এভিয়েশান, রানওয়ে ও স্থাপত্যবিদসহ ১৭ ক্যাটাগরির বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে তারা একযোগে নিজ নিজ এসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত। সিভিল এভিয়েশনের একটি বিশেষ সহায়ক টিম তাদের তত্ত্ব¡াবধান করছে। ঢাকার বাইরে যাওয়ার সময় থাকছে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী। এ টিমের দৃঢ় বিশ্বাস, বর্তমান সরকারের পক্ষেই সম্ভব ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা।
সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ ভোর ৬:৩৬