মোসাদ বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ ও গুপ্তহত্যায় পারদর্শী গোয়েন্দা বাহিনী। মোসাদের মতো পেশাদার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বিএনপি বা আসলাম চৌধুরী নিজে খুব সহজে ও স্বল্প সময়ের মধ্যে যোগাযোগ এবং গুরুত্বপূর্ণ সভা করতে পেরেছেন তেমনটি ভাবার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। অবশ্যই দীর্ঘ দিন ধরে যোগাযোগ ও পারস্পরিক একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আর এসব কাজে সাধারণত দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের জড়িত করা হয় না। আবার একেবারে নিচের স্তরের নেতাদের দিয়েও এসব কাজ হয় না। মধ্যম সারির নেতাদের দিয়ে করানো হয়, যাতে প্রতিপক্ষ গুরুত্ব দেয় এবং বিপদ দেখলে মূল দলের পক্ষ থেকে সহজে অস্বীকার করা যায়, প্রয়োজন হলে দলের স্বার্থে ওই মধ্যম সারির নেতাকে বলির পাঁঠা বানিয়ে কোরবানিও দেওয়া যায়। মোসাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে এখন এই সময়ে বৈঠক, দলের নিচু স্তর থেকে আসলাম চৌধুরীকে একলাফে মধ্যম স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনয়ন এবং দলের সুপ্রিমোর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের যৌক্তিকতায় এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায় না। বিএনপির মহাসচিব যথারীতি এ ঘটনাকে অস্বীকার করেছেন এবং এটাই স্বাভাবিক। আর আসলাম চৌধুরীর মতো একজন মানুষ নিজ দায়িত্বে, পরিকল্পনায় ও স্ব-উদ্যোগে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের এত বড় ঝুঁকি নেবেন—তা কতখানি যৌক্তিক বলে মনে হয়? আর মোসাদের মতো ঝানু গোয়েন্দা সংস্থা শুধু আসলাম চৌধুরীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাড়া দিয়ে একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকানোর জন্য একেবারে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবে, তা-ই বা কতখানি যুক্তিসংগত?
২০১৩ সালে হেফাজতের সরকার উত্খাতের তাণ্ডবে বিএনপির সমর্থন ও যোগদানের ঘোষণা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রবল বিরোধিতা বিএনপির স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিচয় বহন করে না। লেখার শুরুতে বলেছি, মোসাদ গুপ্তহত্যায় পারদর্শী। গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে উত্খাত করার মতো কোনো পরিস্থিতি ও সুযোগ বাংলাদেশে আপাতত নেই। একমাত্র শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলেই শুধু এ সরকারকে উৎপাত করা সম্ভব। সুতরাং এ রকম খবর রাষ্ট্র ও জননিরাপত্তার জন্য ভয়ংকর অশনিসংকেত। রহস্যজনক ঘটনা হলো, ইসরায়েলের মোসাদ কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এ রকম ঘটনার সঙ্গে জড়িত হতে যাবে! বাংলাদেশকে ঘিরে ইসরায়েলের নিজস্ব কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থ নেই। অনুমান বলছে, হতে পারে বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মোসাদ এ ষড়যন্ত্রে জড়িয়েছে। অথবা কান টানলে মাথা আসার ফরমুলায় ইসরায়েলের ‘গ্রেট প্রটেক্টর’ ও ‘গ্রেট ফ্রেন্ডে’র ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার ও খেলার অংশ হিসেবে তারাও মাঠে নেমেছে। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু হত্যাকাণ্ডের জের ধরে ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মুভমেন্ট ও বক্তব্য, সেক্রেটারি অব স্টেট জন কেরির টেলিফোন, এর দুই দিনের মাথায় নিশা দেশাইয়ের ঢাকায় ছুটে আসা ইত্যাদি ঘটনার বিশ্লেষণে কি এটাই মনে হয় না যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে নিজেদের সম্পৃক্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অতীব আগ্রহী। বাংলাদেশ নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না এবং এখানে আইএস আছে—এ ধরনের বক্তব্য কি বিচ্ছিন্ন কিছু, নাকি আগের ও সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলির সঙ্গে এর যোগসূত্র ও ধারাবাহিকতা রয়েছে?
জঙ্গি দমন ও নিয়ন্ত্রণের সার্বিক চিত্রের কথা বলতে গেলে সবাইকে স্বীকার করতে হবে, ২০০১-২০০৬ মেয়াদে যে অবস্থা ছিল তার থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন অনেক গুণ ভালো। যে কথা যুক্তরাষ্ট্রও অফিসিয়ালি স্বীকার করেছে। গত এক বছরে প্রায় ৩৫টি গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটেছে, যা অবশ্যই উদ্বেগ ও চিন্তার বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের সার্বিক নিরাপত্তার কথা বললে এবং যদি তার তুলনামূলক বিচার করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অনেক অনেক ভালো। আইএসের নিজস্ব স্বতন্ত্র কোনো সূত্র থেকে বাংলাদেশের গুপ্ত হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের কোনো প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ও ইসরায়েলের মোসাদের সঙ্গে সংযোগ আছে—এমন একটি পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টেলিজেন্স বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনাকে আইএসের কাজ বলে প্রচার চালাচ্ছে। বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অবস্থান একই সঙ্গে এক জায়গায় এবং একে অন্যের স্বার্থের প্রটেক্টর। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা বাদ দিলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমুখী অংশীদারত্ব ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান দীর্ঘদিন ধরে। এখনো সেটি একইভাবে অটুট। বাংলাদেশ সে সম্পর্ক ধরে রাখতে চায়, সেটিও স্পষ্ট। বাংলাদেশের স্বার্থেও সেটি প্রয়োজন। তবে ২০০১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য ও স্বার্থের বহিঃপ্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ছয়-সাত বছরে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি এবং সেটিকে আরো অগ্রায়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিদেশনীতির সার্বিকতা ও ভূ-রাজনীতির সমীকরণের হিসাব নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য কতখানি পূরণ হয়েছে বা হচ্ছে, সে প্রশ্নটি বারবার সামনে আসছে।
এটা এখন প্রকাশ্য ও ওপেন সিক্রেট যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হলো এতদ্বঞ্চলে চীনকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলা এবং চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিস্তার রোধ ও প্রতিহত করা। কিন্তু বাংলাদেশের মৌলিক নীতি হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। সার্বিক বিচারে এটাই বাংলাদেশের জন্য যথার্থ ও মঙ্গলজনক। গত পাঁচ-সাত বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতা ও দূরদৃষ্টির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপানের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা কতটুকু স্বস্তিদায়ক, তা বাইরে থেকে বুঝে ওঠা আমাদের কাছে কঠিন। নিশা দেশাই যাওয়ার পর পরই সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সফর করে গেছেন। সন্ত্রাস দমন, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের স্বার্থে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করবে এবং ভারত সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্কর। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাস দমনে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কাজ করার বিষয়টি জয়শঙ্কর এক অর্থে নাকচ করে দিয়েছেন। যুগে যুগে সব রাষ্ট্রই নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে—এটাই স্বাভাবিক। তাই শেষ কথা হলো—বিশ্ব অঙ্গনে ভূ-রাজনীতির খেলায় বৃহৎ শক্তির ভূমিকা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র কোনোটাকেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এক বছর ধরে ইহুদি প্রভাবিত সংগঠন সাইট ইন্টেলিজেন্সের ভূমিকা, মোসাদের সঙ্গে বিএনপি নেতার সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্র, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার দৌড়াদৌড়ি, সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য পশ্চিমা বিশ্বে জামায়াত-বিএনপির লবিস্ট নিয়োগ, আইএসের উপস্থিতি প্রমাণের অতি আগ্রহী প্রচেষ্টা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে ঘিরে তাদের আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি কোনো না কোনোভাবে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ বা ষড়ভুজের সমীকরণে ও কৌনিক সম্পর্কে একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত। সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১৬ ভোর ৬:২১