সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ৩৫ লেক সার্কাস আছিয়া নিবাসের সামনে পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে। আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। ভয়ে অনেকে কথাও বলতে চাচ্ছেন না। নিরাপত্তা কর্মীরা বাইরের কোন ব্যক্তিদের বাসার ভেতরে যেতে দিচ্ছেন না। গেট তালা মেরে রাখা হচ্ছে। পুরো এলাকায় এখন ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। নিহত জুলহাস মান্নান মুমনের লাশ দুপুরে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাসায় আনা হয়। পরে জোহরের নামাজের পর তেঁতুল তলা মাঠে জুলহাস মান্নানের নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে।
কাউন্টার টেরোরিজম (সিটি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম টেলিফোনে সংবাদকে বলেন, জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু তন্ময়কে খুনের পর পালিয়ে যাওয়া সময় স্থানীয় এক যুবক মোবাইলে ভিডিও করেছিলো। ওই ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। এছাড়া আশপাশের কয়েকটি বাসার সিটি টিভির ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব ফুটেজ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আশা করছি ফুটেজ থেকে খুনিদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, হত্যাকান্ডের ধরন দেখে এ হত্যাকান্ডের সাতে উগ্রপন্থি জঙ্গিরাই জড়িত বলে এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে। এরা কোন জঙ্গিগোষ্ঠীর তা বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
জানাজা শেষে জুলহাস মান্নান মুমনের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন সাংবাদিকদের জানান, আমার ভাই জীবনে কোন মানুষের মনে কষ্ট দেয়নি। উপকার ছাড়া কারো ক্ষতি করেনি। আমাদের আশপাশে আমাদের মতের বাইরে লোক থাকতে পারে। প্রত্যেকের মতো তারও মত প্রকাশের, চিন্তা করার অধিকার ছিলো।
তিনি আরও বলেন, একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে তার মত প্রকাশের অধিকার ও স্বাধীনত আছে। একজন মুসলমান হিসেবে উচিত অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়া। আমি চাইবো আইন সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের যথাযথ শাস্তি দেন। যাতে তারা আবার এরকম কোন ঘটনা ঘটতে না পারে। আমি চাই আমার মতো আর যেনো কারো পরিবারের বা কারো সন্তানের এমন পরিণতি না হোক। বড় ভাই ইমন জানান, হত্যার ধরন দেখে মনে হয়েছে, এটি পরিকল্পিত হত্যা, হত্যাকারীরা খুবই প্রশিক্ষিত ও সাহসী। হত্যার পর তাদের কিছু হতে পারে তারা সেটা চিন্তা না করেই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
আছিয়া নিবাসের পাশে মীম ফ্যাশনের এক নারী দর্জি জানান, বিকেল সোয়া ৫টার দিকে তিনি দোকানে আসেন। দোকান খুলে ঝাড়ু দেয়ার সময় তিনি অল্প বয়সী (২০ থেকে ২২ বছর) দুজন যুবককে এক সঙ্গে গল্প করতে করতে তার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেন। তাদের একজনের গায়ে নেভি বস্নু শার্ট অন্য জনের গায়ে কালো টি শার্ট ছিলো। একজনের কোমরে ছোট একটি ব্যাগের মতোও ছিল লক্ষ করেছেন তিনি। এ সময় তার দোকানের ওই বাসারই একজন কাস্টমার আসলে তিনি দোকানে প্রবেশ করেন। ২ মিনিট পর তিনি হঠাৎ করে চিৎকার শুনে বলেন কিসের চিৎকার। এ সময় দোকান থেকে বের হয়ে ওই বাসার দিকে এগুতেই দেখেন দুজন দৌড়াতে দৌড়াতে বলছেন গুলি করবে গুলি করবে। এ সময় তিনি ভয় পেয়ে দ্রুত দোকানে ঢুকে সার্টার আটকে দেন। সে সময় বাইরে গুলির শব্দ শোনেন। এ সময় একসঙ্গে কয়েকজনের কণ্ঠে আল হালাল জিন্দাবাদ আল্লাহু আকবর বলে সেস্নাগান শুনতে পান।
বাসার গেট খোলা থাকায় সহজে ঢুকতে পারে খুনিরা
অন্য সময় আটকানো থাকলেও গতকাল আছরের নামাজের পর আছিয়া ভবনের মূল ফটকটি তালা মারা ছিলো না। কেবল ছিটকানি দেয়া ছিলো। ওই সময় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৩ জন দারোয়াই নিচে অবস্থান করছিলো। তাদের কথাবার্তায় অসংলগ্নতা পাওয়া যায়। খুনিরা যখন বাসায় ঢুকে তখন গেটে দায়িত্বে ছিলো পারভেজ মোল্লা। গার্ড রুমে ঘুমাচ্ছিনের তার মামাতো ভাই সুমন। আর বাথরুমে ছিলেন কেয়ারটেকার আ. রহিম। গতকাল কেন গেট খোলা ছিলো এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তর না দিয়ে চলে যান আ. রহিম ও নিরাত্তাকর্মী সুমন।
কেয়ারটেকার আ. রহিমের ভাষ্য মতে, সে তখন বাথরুমে যায়। হঠাৎ করে পারভেজ মোল্লার চিৎকার শুনে তিনি বাথরুম থেকে দৌড়ে এসেই দেখেন পারভেজ চোখ ধরে চিৎকার দিচ্ছে। তখন ভিতরে একজন চাপাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন পিস্তল নিয়ে মূল ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। ভিতরে থাকা ব্যক্তি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাকে ও সুমনকে গার্ড রুমের মধ্যে আটকে ফেলেন।
আ. রহিম জানান, ছোট বেলা থেকেই তিনি ওই বাসায় কেয়ারটেকারের চাকরি করেন। ৫ তলা ভবনটি হয়েছে ৫ বছর হবে। এর পূর্বে সেটি টিনশেড বাসা ও ছোট বিল্ডিং ছিলো যা পরে ভেঙে ৫ তলা ভবন করা হয়। ৫ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন জুলহাজ স্যার। সেখানে তার মা ও কাজের মেয়ে থাকতো। ওই বাসার আরেক নিরাপত্তা কর্মী পারভেজ মোল্লা ৫ থেকে ৬ মাস আগে নিরাত্তাকর্মীর চাকরি নেয়। তার মামাতো ভাই সুমন ২ মাস আগে আ. রহিমের রেফারেন্সে চাকরি নেয়। তাদের দুজনের বাড়ি খুলনার ১৩ তলার কুলশি এলাকায়। সুমন আগে অন্য একটি কোম্পানিতে চাকরি করতো। পরে সেখান থেকে এখানে এসে দাড়োয়ানের চাকরি নেয়। দুই নিরাপত্তাকর্মীর বায়োডাটা গতকাল পুলিশকে দেয়া হয়েছে।
লেক সার্কাস রোড দিয়ে বের হয় খুনিরা
হত্যার পর পরই অংশগ্রহণকারী ৫ জন লেক সার্কার রোডের ডলফিন গলি দিয়ে বের হয় নিরাপদে। ৩৫ আছিয়া নিবাসে সমকামী আন্দোলন নেতা ও ইউএসএডের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান মুমন ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তম্ময়কে হত্যার পর বাসা থেকে দুশ গজ দূরে কিংডম ভবনের সামনে এসে দাঁড়ায় খুনিরা। সেখানে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন স্থানীয় যুবক খুনিদের ধাওয়া করে ধরার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে ইটপাটকেলও নিক্ষেপ করে খুনিদের। তখন খুনিরা পিস্তল উটিয়ে সেখানে দুই রাউন্ড গুলি করে। গুলির শব্দে স্থানীয়রা পিছু হটলে খুনিরা ডলফিন গলির দিকে এগিয়ে যায়।
কিংডম ভবনে ড্রাইভারের চাকুরী করা মোঃ জাকির হোসেন জানান, তিনি বভনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সময় ৫ জন যুবককে হেটে আসতে দেখেন। তাদের কারো হাতে ধারালো অস্ত্র কারো হাতে পিস্তল। পিছনে যুবক বসয়ী কয়েকজনসহ প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন ব্যক্তি ওই ৫ জনকে ধাওয়া করতে করতে আসছেন। ধাওয়া খাওয়া যুবকরা এসে ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড অবস্থান করে। এ সময় সেখানে দাঁড়িয়ে স্থানীয়দের লক্ষ করে এক রাউন্ড গুলিও ছোড়েন। এরপর তারা আবার অল্প গতিতে দৌড়ে সামনের দিকে এগুতে থাকেন। তখন তাদের পিছনে পিছনে স্থানীয় এক যুবক সাহস করে খুনিদের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করে রাখে।
তিনি জানান, গতকাল তাদের বিল্ডিংয়ের থাকা সিসি টিভির ফুটেজ সংগ্রহের জন্য এসেছিলো পুলিশ। কিন্তু ঝামেলা থাকায় ফুটেজ নিতে পারেনি। তাদের ভবনের নিচতলায় দুটি সিসি ক্যামেরা লাগানো যা গেট পর্যন্ত কভার করে।
ডলফিন গলির আশপাশে বেশ কয়েকটি বাসার সিসি টিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দারা। ডলফিন গলির বিভিন্ন বাসার বেশকিছু নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অস্ত্র হাতে একসঙ্গে ৫ জনকে হেঁটে যেতে দেখেছে তারা। এর মধ্যে সামাদ আজাদের বাসার সামনে পুলিশের একটি টহল টিমের সামনে পড়ে খুনিরা। সেখানে পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তিও হয়। একপর্যায়ে ৫ জনের টিমের ওই টহল পুলিশের মধ্যে এএসআই মমতাজ উদ্দিনকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। সেখানে তারা গুলি করে ডলফিন গলি দিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যায়। একজন পুলিশের এএসআইকে কুপিয়ে জখম করলেও তখন অন্য পুলিশরা কি করেছিলো তা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন উঠেছে।
পুলিশের সাথে খুনিদের ধস্তাধস্তি
লেক সার্কাস রোড দিয়ে হেঁটে যাওয়ার খুনীদের আটকে ফেলার চেষ্টা করেন কলাবাগান থানার পুলিশের একটি দল। টহল টিমের এএসআই মমতাজ উদ্দিন একজনকে ধরে ফেললেও তাকে কুপিয়ে ছুটে যায় ওই দুর্বৃত্ত। এ সময় টহল টিমের এসআই মোহাম্মদ শামীম আহম্মেদ খুনিদের লক্ষ করে পিস্তল থেকে গুলি করলে তাকে পাল্টা গুলি করে খুনিদের একজন। এক পর্যায়ে একটি ব্যাগ ফেলে রেখেই পালিয়ে যায় খুনিরা। এ সংক্রান্তে একটি মামলা করেছে এসআই সামীম। মামলায় বলা হয়, সিরা ২৬ এর ডিউটি পালনের সময় অফিসার ইনচার্জের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশের সিরা ডিউটি টিম ঘটনাস্থল ৩৫ লেক সার্কাসের দিকে রওনা দেয়। আনুমানিক ৫টা ৪০ মিনিটের ৬০ লেক সার্কাস ডলফিন গলির রাশেদ মোশারফের বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে পেঁৗছলে ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী ৫ থেকে ৬ জন যুবককে আসতে দেখে তারা। যাদের প্রত্যেকের কাঁধে ব্যাগ এবং একই রংয়ের টিশার্ট গায়ে ছিলো। এ সময় এসআই শামীম সঙ্গীয় ফোর্সদের আগত যুবকদের ধরতে নির্দেশ দিলে এএসআই মমতাজ গাড়ি থেকে নেমে একজনকে ধরে ফেলেন। এ সময় অন্য একজন এসে এএসআই মমতাজকে কুপিয়ে জখম করে ধরে ফেলা যুবককে ছাড়িয়ে নেন। এসআই শামীম তার পিস্তল থেকে গুলি করলে তাকেও লক্ষ করে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তিনি একজনকে ধরে ফেললে ব্যাগ ফেলে ওই যুবকসহ সবাই দৌড়ে পালিয়ে মানুষের সাথে মিশে যায়। দুস্কৃতকারীদের ধরতে গিয়ে এসআই শামীম রাস্তার পাশে গর্তে পড়ে যান। পরে সেখান থেকে তারা ঘটনাস্থলে যান। দুস্কৃকারীদের ফেলে যাওয় ব্যাগ তল্লাশি করে ৭ পয়েন্ট ৬৫ বোরের ইউএসের তৈরি একটি অটোমেটিক পিস্তল, ৩ রাউন্ড গুলিসহ একটি ম্যাগজিন এবং দুই অংশে ভাগ হওয়া একটি গনাকৃতি আগ্নেয়ান্ত্র, ১৩ ইঞ্চি একটি লোহার চাপতি একটি লাল গামছা, একটি নীল রংয়ের শার্ট এস রংয়ের পুরাতন লুঙ্গি, আরবি ও বাংলা লেখার কিছু কাগজপত্রসহ বেশকিছু মালামাল পাওয়া যায়। যা জব্দ করা হয় আলামত হিসেবে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, খবর পেয়ে পুলিশের একটি টহল টিম লেক সার্কাসের ডরফিন গলিতে যায়। সেখানে খুনিদের ধরার চেষ্টা করা হলে তারা পুলিশের ওপর আক্রমন করে। এক পর্যায়ে টহল ডিউটির এএসআই মমতাজ উদ্দিনকে কুপিয়ে জখম করে তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ওই টহল টিমের কমান্ডিং ছিলেন এসআই শামিম। টিমে দুজন কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও আজগর ছিলেন। টহল টিমের গাড়ি চালক ছিলেন একজন কনস্টেবল। কিন্তু তারা খুনিদের আটকাতে পারেনি। আহত এএসআই মমতাজ উদ্দিন বর্তমানে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
সূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৬ ভোর ৬:৪৩