শফিক রেহমানের গ্রেপ্তার হওয়াটাই এখন টক অব দ্য নেশান। এটাই অামাদের জাতীয় চরিত্র। যখন যেটা সামনে অাসে সেটা নিয়েই মেতে উঠি অামরা। শফিক রেহমানকে চিনি বা চিনতাম অন্য অাদলে। এরশাদ অামলে জামার ভেতর লুকিয়ে নেওয়া ঘামে ভেজা ‘যায় যায় দিন’ ছিল অাগুনের টুকরা। এর এক একটা লেখা, এক একটা ফিচার অার মিলা-মঈনের সংলাপ ছিল অামাদের এরশাদ-হটানো তথা গণতন্ত্র ফিরিয়ে অানার হাতিয়ার। এর জয়-জৌলুস-রমরমার কৃতিত্ব শফিক রেহমান একা ভোগ করলেও নেপথ্যে থাকা ‘বিরস’ মানে বিভুরঞ্জন সরকার অার তারিখ ইব্রাহীম নামের অাড়ালে অধুনা দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক মুনীরুজ্জমানের কথা বলেন না কেউ। এরাই ছিলেন ‘যায় যায় দিন’এর পিলার।
পপুলারিটির অারেকটা কারণ ছিল সীমিত মিডিয়া। তখন কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। অবরুদ্ধ দেশে সামরিক শাসকের একনায়কোচিত কঠিন শাসনে একমাত্র লণ্ঠনই তখন অাশার সূর্য। সে কারণেও তিনি পরে অার পারেননি। যখন টাকা-পয়সা, জমি ও ক্ষমতা হাতে পেলেন, তখন নিদারুণভাবে মার খাওয়া ‘যায় যায় দিন’ যায় যায় রাতের মতো হারিয়ে গেল।
শেষে এমনও হল যে, টাকা-পয়সা দিতে না পারার কারণে অথবা অজুহাতে দেশ ছেড়ে পলায়নের সময় তাঁকে বিমান থেকে নামিয়ে অানা হল। সে খবর, সে ছবিও দেখতে হয়েছে অামাদের। গোখরা সাপ থেকে ঢোরা সাপে পরিণত হওয়া শফিক রেহমানের বিলেতি কায়দা অার সাহেবি বোলচাল বেশি দিন একক বা ইউনিক থাকল না। তবে এটা মানতেই হবে, তিনি একজন অাপদমস্তক অাধুনিক মানুষ।
অাজকাল সাংবাদিকতা বা মিডিয়া পেশায় অনেক ধরনের ঝুটঝামেলা। বস বা মালিকদের কেউ কেউ, বলতে গেলে বেশিরভাগের অনাচারের কথা সবার জানা। এমনও গুজব অাছে যে, এখন কারাগারে থাকা এক চ্যানেল মালিকের রুমে রাতে কোনো নারী সাংবাদিকই যেতে চাইতেন না। এর কাছাকাছি অারও কত কাহিনি। এই সেদিন অামার প্রিয়ভাজন একজন বারবার ঢাকা যাবার কথা বলছিলেন। ইনি বিদুষী। সুন্দরীও বটে। রুচিশীলার এক কথা, ঢাকা এখন বৃন্দাবন। দেখতে অাস।
অাজকাল সাংবাদিকতা বা মিডিয়া পেশায় অনেক ধরনের ঝুটঝামেলা
শফিক রেহমানের ব্যাপারে এমন কোনো অভিযোগ শুনিনি। বরং অামার মেয়েবন্ধু যারা তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন তাদের চোখে তিনি একজন ‘নিরাপদ’ অাধুনিক মানুষ। অাধুনিক না হলে এমন মৌলবাদী সমাজে ভালোবাসার মতো ‘নাপাক’ বিষয় পপুলার করতেন? তাঁর এই কৃতিত্ব খাটো করার নয়।
তাঁর বদলে যাওয়া চরিত্রের পেছনে অাওয়ামী লীগের নিশ্চয়ই ভূমিকা অাছে। এ দলটির হয় প্রভু অাছে নয় অাছে চাকর বা স্তাবক। মাঝখানে কিছু নেই। তাই তারা বন্ধুহীন। শফিক রেহমানের বেলায় কী ঘটেছিল জানি না, তবে তাঁকে দেখলেই অামার জিন্নাহর কথা মনে পড়ে। হ্যাঁ, মোহাম্মদ অালী জিন্নাহ। তিনিও মদ খেতেন। শুয়োর খেতেন। বিলেতি পোশাক পরে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতেন।
এ এক অবাক ব্যাপার! সে ধারাবাহিকতা এখনও আছে। পোশাকে, চলনে-বলনে, অাহারে-মৈথুনে অাধুনিক স্মার্ট মানুষগুলোই কেন যেন বিএনপির রাজনীতি করেন। না এরা অাওয়ামী লীগ, না জামায়াত। অামি চট্টগ্রামের মানুষ, অাজীবন এক বিষয়ে হিসাব মিলাতে পারি না। টুপি-দাড়ি লেবাসহীন সুট-কোট পাজামা- পাঞ্জাবি পরিহিত অামীর খসরু, অাবদুল্লাহ আল নোমান বা মীর নাসিরের বিপরীতে ভোট দিতে হল দাড়ি-টুপির এ বি এম মহিউদ্দীনকে। এখন যে সুজনরা, তারাও একই লেবাসে বা পোশাকে। এ এক রহস্য!
ফরহাদ মজহার, এ কে খন্দকার, এমাজউদ্দীন, অাসিফ নজরুল, তুহিন মালিক, শফিক রেহমান, কারও চেহারা পোশাক চলন বা কথায় জামায়াতি ছাপ নেই। এরা তাদের মতো বিনয়ে মাথা চুলকান না। অাওয়ামী লীগারদের মতো ভুল বাংলায় ‘রক্ত দিছি রক্ত দিব’ জাতীয় কথা বলেন না। কিন্তু এরা জামায়াতের চেয়েও ভয়ংকর হতে পারেন। একা মাহমুদুর রহমানই তার বড় প্রমাণ।
শফিক রেহমান খালেদা জিয়ার ভাষণ লিখতেন এটা বাজারে বেশ চালু। লিখলেই-বা দোষের কী? অামাদের দেশের নেতারা যেসব বাণী দেন, অামি সেগুলোকে বলি ‘মেহেরবানি’। কেউ নিজে লেখেন না। কারও সময় নেই, কারও নেই এলেম। এলেমদার শফিক রেহমান খালেদার রাজনীতিতে মজে এমনই নষ্ট হয়েছিলেন যে, তাঁর লেখা পড়ে মনে হত নব্য মওদুদীর লেখা পড়ছি। ‘জয় বাংলা’ যখন স্লোগান অাকারে বলা হয়, তখন টেনে টেনে সুর করে বলাটাই রেওয়াজ। তাই তিনি এর নাম দিয়েছিলেন, ‘জয় লম্বা বাংলা’। পিতার নীতি, দেশপ্রেম, নিজের অতীত থেকে সরে দাঁড়ানো শফিক রেহমান তাই বলে জয়কে খুনের পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছিলেন এটা অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করতে চাননি। মুশকিলটা বোধহয় অতিকথনের।
এই সেদিনও যে যা জানতে, যার যে বিষয়ে দখল ও পড়াশুনা অাছে, যার যেটুকু অাওতা তা নিয়ে কথা বলত। সে পাঠ ঘুচিয়ে অামরা এখন মুখর প্রগলভ আর বাচাল এক জাতিতে পরিণত হয়েছি। এর রুট বা শেকড়ের কারণ রাজনীতি। রাজনৈতিক নেতারা গোপাল ভাঁড় বীরবলদেরও হার মানতে বাধ্য করেছেন। তাঁরা বলেন বকেন, অাবার বাণীও দেন। যার যা খুশি তাই বলে যারা নেতা হন, তারাই এখন মিডিয়ার খোরাক। যে যত বাজে বকেন, তিনি তত পপুলার।
এক সময় সাকা সুরঞ্জিত হুদা মওদুদের অামল ছিল। তাদের ডাউন করে উঠে এসেছে হাছান, ইনু, রিজভি, অাবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেবরা। এঁদের কথার এমন জোর, এত অাকর্ষণ যে, রাতদুপুরে টিভি খুলে কথা খায় মানুষ। ঘাড় বাঁকিয়ে চোখ রাঙিয়ে গলা চড়িয়ে হাত তুলেও কথার শো হয়। মানুষ সেগুলো গিলে। এই যে কথার বাচালতা সেটাই অামাদের সুশীল নামধারী ও বিখ্যাত জনদের পণ্ড করে দিয়েছে।
এখনকার মতো হট টপিক ইমরান এইচ সরকার। ভালো করে চেয়ে দেখুন অাজ কত দিন কত বছর ইনি মিডিয়ার অালোয়। যতদূর শুনি মানুষ হিসেবে তাকে অনেকেই পছন্দ করেন। তার সুনাম ও যোগ্যতার প্রতি সম্মান জানিয়েই বলি, বিগত বছরগুলোতে গণজাগরণের যে কোনো সমাবেশ বা মিছিলে কি অাসলেই তেমন কোনো সাড়া ছিল? যেসব মিডিয়া কভারেজ দিয়েছে নানা কারণে, এর সঙ্গে থাকাটা জরুরি ভেবেছে, তাদের ক্যামেরাও মিছিলের পেছনের দিকে তাক করতে চাইত না।
ভালো করে চেয়ে দেখুন অাজ কত দিন কত বছর ইনি মিডিয়ার অালোয়
গুটিকয়েক মানুষে গণজাগরণকে সীমিত করেও থামেনি তারা। যে গণজাগরণ মূলত অামাদের মুক্তিযুদ্ধ ও জয় বাংলায় নতুন গতি এনে দিয়েছিল– রাজাকার দালাল মানবতাবিরোধীদের শাস্তি নিশ্চিত করেছিল– তার জৌলুস ও বেগ থেমে গেলেও কথা ফুরোয়নি। ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা একটানা ছুটতে থাকা মিডিয়ার দেশে অত মানুষও নেই যারা শুদ্ধ বাংলা জানেন। তাই তাদের দরকার কেউ না কেউ যাকে সামনে রেখে চললেই হল। এর অাগপাশতলার দরকার নেই।
অারও নানা কারণে ইমরান এইচ সরকার রয়ে গেলেন। গণজাগরণের যাই হোক, তিনি টিকে গেলেন। তার বয়সীরা এখন অার রাজনীতিতে অাসেন না। যারা অাসেন তারা টেন্ডারবাজ, চালবাজ, চাঁদাবাজ বা রাইফেলধারী কিংবা চাপাতিওয়ালা। সে জায়গায় ইমরান সুবেশী। পড়ালেখা জানা যুবক। মুশকিল হল, তিনিও বাচালতা এড়াতে পারলেন না। তনু থেকে শফিক রেহমান, সব বিষয়ে তার কথা অাছে। কেন? তিনি ভাবতে পারতেন, ওগুলো রাজনীতিবিদরা বলুক। মহাশূন্যের সমাজে তিনি হয়ে উঠলেন ‘সব কথার কাজী’।
সব কিছুর একটা নিয়ম অাছে। শফিক রেহমান তাঁর ডিগনিটি হারিয়েছেন অনেক কাল হয়। খালেদা জিয়ার রাজনীতির অাঁচলে মুখ লুকানো লাল গোলাপের কারবারি রাজাকার-দালালদের হয়ে ওকালতি শুরু করলেন যখন তখন থেকেই। এমন সব ভাষায় লিখতে থা্কলেন যা অাসলেই অাপত্তিকর। একটা লেখায় শেখ হাসিনার অপমৃত্যু কামনা করেছেন এমনও দেখেছি।
এসব কারণে মানদণ্ডটা ইমরানেরই হেলে গেছে। ঘামে ভিজে শাহবাগে দাঁড়িয়ে ‘ফাঁসি চাই’ বলিয়ে নেতা কী করে ফাঁসিবিরোধী জামায়াত-বান্ধব সাংবাদিকের জন্য মায়াকান্না কাঁদেন? একদিকে থাকতে না পারা অসংযত জিভ ও কলম বা মাউস এখন বাঘকেই ইঁদুর বানিয়ে ছাড়ছে, সেখানে ইমরান সরকার কোন ছাড়! তিনি জানেন না অামাদের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা কী বলেন। তিনি সিডনি এলে তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি মনে করেন, বিচারের রায় ঘোষণার অাগেই শাস্তির মাত্রা নিয়ে সন্দেহ অার রাজপথে ‘ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই’ বলে নেমে পড়াটা অাইন ও বিচার বিভাগের প্রতি হুমকি।
ভেবে দেখার মতো কথা। একবার গণজাগরণে দেশ জাগিয়ে নিজেদের কথা জানিয়ে দেওয়ার পর থামার বিষয়টা মানেননি ইমরানরা। বলা ও না থামার দায় তো চুকাতেই হবে।
সরকারেরও এতটা যাবার কী দরকার ছিল? গতায়ু শফিক রেহমানের বাড়িতে গোটা কয়েক লাল গোলাপ পাঠিয়ে দুয়ােরে দুজন পুলিশ বসিয়ে রাখলে তিনিও জাফরুল্লাহর মতো বলতেন, ‘অামি অাওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শুভানুধ্যায়ী’।
সবাই খালি বলছে অার বকছে। বকতে বকতে কেউ জেলে, কেউ বিপদে, কেউ-বা সরাসরি গদিতে। তবে এটা ঠিক, কোনো সরকারকেই নিরাপদে দেখি না। ইমরান এইচ সরকারও নন, বাংলাদেশ সরকারও নয়। সরকার কি অামাদের অাসলেই নিশ্চিত করবে? সূত্র