অন্ধকারে তার চোখটা ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না। সোহাগের খানিকটা অস্বস্তি হচ্ছে। মুখাবয়বটা আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু, চোখটা ঠিক কোথায় বোঝা যাচ্ছে না। সোহাগ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। ১০০০ ওয়াটের বাল্বটা ঠিক তার চোখের ওপর এসে পড়ছে। চোখ বন্ধ করা রাখা উচিত। ঠিক করে বলতে গেলে চোখ খোলা রাখা অসম্ভব। কিন্তু, সোহাগ একদৃষ্টে লোকটা কিংবা তার অবয়বের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক কী কারণে তাকিয়ে আছে সোহাগ নিজেও জানে না। অবশ্য, এ ধরণের পরিস্থিতিতে কোন কাজের জন্য কারণ খোঁজাটাও হাস্যকর।
লোকটা কিছু বলছে না। বোধ হয় মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। সোহাগ মনে মনে হাসল। সে নিজেও এখন কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। দু’জনের কথা গুছিয়ে নেয়ার লক্ষ্যও এক। প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেয়া।
লোকটা খানিকটা কর্কশ গলায় বলল, ‘তুমি নিশ্চয় আশা কর না, তোমাকে আমরা মেরে ফেলে মুক্তি দেব।’ গলার কর্কশ ভাবটা কৃত্রিম শোনাল।
সোহাগ মাথা নাড়ল। সে আশা করে না। সে জানে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে। সে মরতে চাইবে। কারণ, কখনও কখনও জীবনটা মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। আজকে থেকে সম্ভবত তার জীবনটা তেমন কিছু হয়ে উঠবে।
-তুমি কিন্তু চাইলেই সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেত পার। এমন কি পেত পার তোমার জীবনটাও।
-জানি। কিন্তু, আপাতত আমি যন্ত্রণা এবং মৃত্যুকেই পছন্দ করব।
-আপাতত!
-হুম। এক সময় হয়তো, টর্চার সহ্য করতে না পেরে আমি সবকিছু বলে দেব। কিন্তু, যতক্ষণ পারা যায় আমি চেষ্টা করে যাব কিছু না বলতে। আমার সহ্যের শেষ বিন্দুটুকু দিয়ে।
লোকটা সামনে থেকে উঠে গেল। সাথে সাথে দু’টো টিউব লাইট জ্বলে উঠল। পুরো রুমটা আলোকিত। সোহাগ তাকিয়ে দেখল, ঘরে আরও দু’জন উপস্থিত। সে এতক্ষণ টের পায়নি! তার অনুভূতিগুলো কি ভোতা হতে শুরু করেছে? লোকটা বাকি দু’জনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এর মুখ থেকে কিছু বের করা অসম্ভব।’ মন্তব্যটা শুনে দু’জনের প্রতিক্রিয়া হল দু’রকম। একজন খানিকটা উল্লাসিত হল। কিন্তু, নিয়ন্ত্রিত অনুভূতি। বলল, ‘জ্বী স্যার, এরা যখন এমন একটা কাজে নেমেছে তখন তেমন মানসিকতা নিয়েই নেমেছে। আমাদের মত ইন্দুরের জান হলে তো আর এই পথে আসত না।’ অন্যজন খানিকটা আশাহত হল। বলল, ‘স্যার, আমি কি একটা শেষ চেষ্টা করে দেখব?’ সোহাগ এবং তার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষটার মুখে খানিকটা আতঙ্ক দেখা গেল। স্যার বললেন, ‘দেখ’।
============= ============= ============= =============
সোহাগের মাথাটা ধরে টেবিলের সাথে ঠুকে দেবার সাথে সাথেই, তার ওপরের ঠোটের ডান পাশটা কেঁটে গিয়ে ঝুলতে থাকে বিশ্রিভাবে। একটা দাত নিচে পড়ে আছে। রক্ত এমনভাবে দাতটায় লেগে আছে যে, প্রথম দেখায় যে কেউ মনে করবে, এটা বুঝি একটা লাল রংয়ের দাত। সোহাগ মেঝেতে থুথু ফেলল। থুথু না’কি রক্ত পড়ল ঠিক বোঝা গেল না। সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা। গত তিন ঘণ্টা ওকে মুখে টেপ বেধে পেটানো হয়েছে যেন যন্ত্রণার শব্দটুকুও করতে না পারে। যন্ত্রণায় কাঁদার অধিকারটুকুও ওর ছিল না। এখনও হাতের আঙ্গুল নাড়াতে পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছে। বসার শক্তি নেই বলে, ওকে চেয়ারটার সাথে বেধে রাখা হয়েছে। লোকটার মুখে খানিকটা ধৈর্যচ্যুতি ফুটে আছে।
-বাকিদের নাম বলবি?
-বললাম তো যা করার আমি একাই করেছি।
লোকটার মুখে খানিকটা উল্লাসিত ভাব দেখা গেল। নাম বলে দিলে তো আর টর্চার করা যাবে না। যতক্ষণ বাকিদের নাম না বলে, ততক্ষণই ভাল। ডান কানের পাশে লাঠি দিয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে একটা বাড়ি মারল। কান এবং চোখের পাশের মাংস কেটে গিয়ে লেপ্টে রইল। দেখে মনে হচ্ছে, কানটা বুঝি কেউ নিখুতভাবে সেলাই করে দিয়েছে মুখের সাথে। কিংবা বলা যায়, কানটা গালের সাথে লাগিয়ে কেউ গরম আয়রন চালিয়ে দিয়েছে। কানটা এখন গালের সাথে ওতপ্রোতভাবে লেগে আছে। দু’টি উপমাকেই সমানভাবে সফল মনে হচ্ছে। একটু পরেই অবশ্য কানটা গাল থেকে খুলে এল। এতক্ষণ জায়গাটায় কোন অনুভূতি ছিল না। হঠাৎ, করে যেন নিউরনগুলো সচল হয়ে উঠল। সাথে সাথে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল সোহাগ। লোকটার মুখে খানিকটা হাসি ফুটে উঠল। এতক্ষণ ধরে যা শুনতে চাইছিল, তা শুনতে পেয়েছে। অমানুষিক চিৎকার। সাথে সাথে তার মনে একটা বীভৎস আনন্দ এসে ভর করল।
একটু পরে হঠাৎ করেই চিৎকার থেমে গেল। লোকটা অবাক চোখে সোহাগের দিকে তাকাল। তার মুখে এখন কোন অভিব্যক্তি নেই। থাকল না খানিকক্ষণ। তারপর তার মুখে কোন একটা অনুভূতি ফুটে উঠল। লোকটা ঠিক বুঝতে পারল না, অভিব্যক্তিটা কিসের। কেন যেন তার মনে হল, সোহাগ হাসছে। যদিও রক্তে সয়লাব তার থ্যাতলানো মুখে পড়া এক হাজার ওয়াটের বাল্বের আলোতে তাকে দেখতে প্রেতাত্মার মত লাগছে। কিন্তু তবুও লোকটার মনে হল সোহাগ হাসছে।
বিস্ময়টা গোপন রেখে বলল, ‘হাসছিস?’
সোহাগ হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু, নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারল না। মাথাটা অর্থহীনভাবে দুলল।
লোকটা ঝাঝাল গলায় বলল, ‘মুখে বল, বাইঞ্চোত।’
সোহাগ বলার চেষ্টা করল, ‘হ্যাঁ, হাঁসছি’ কিন্তু, মুখ থেকে কেবল খানিকটা বাতাস বের হয়ে আওয়াজটাকে দীর্ঘশ্বাসের মত শোনাল। উচ্চারণটা ঠিক কী হল, সেটা ঠিকমত বোঝা গেল না।
লোকটা হ্যাঁ’বোধক উত্তরই ধরে নিল। বলল, ‘কারণটা কী জানতে পারি?’ গলায় বিদ্রুপের সুর স্পষ্ট।
-ওরা জাগছে।
-ওরা! কারা?
-মানুষ। ওরা আসছে।
লোকটার মাঝে কথা এগিয়ে নেবার কোন আগ্রহ দেখা গেল না। নিশ্চিত হয়ে গেছে সোহাগের মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। এর মুখ থেকে আর কিছু বেরোবে না। ভোঁতা মুখ করে বেরিয়ে গেল।
প্রায় সাথে সাথে অন্য লোকটা ঢুকল। খানিকক্ষণ সোহাগের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। বোধ হয় খানিকটা মায়া ফুটে উঠল তার চেহারায়। কিন্তু, ইউনিফর্মের রুক্ষতায় সেটা ঢাকা পড়ল। বাল্বটা অফ করে টিউব লাইট দু’টো জ্বালিয়ে দিল। সোহাগের হঠাৎ করে প্রচণ্ড শীত অনুভূত হতে লাগল। চেয়ারের সাথে শরীরটা এলিয়ে দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু, শরীর বাধা থাকার কারণে পারল না। লোকটা এসে বাধন খুলে দিতেই সোহাগ তার গায়ের ওপর এলিয়ে পড়ল। লোকটা আস্তে তাকে মেঝেতে শুইয়ে দিল। সোহাগ বুক ভরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল। খানিকটা বল ফিরে এল শরীরে। লোকটা বলল, এবার ঘুমোও। সোহাগ মাথা নাড়ল। বলল, ‘ওরা আসছে। আমি ওদের কোলে মাথা রেখেই ঘুমোবো। তার আগে নয়।’ লোকটা তীক্ষ্ন চোখে সোহাগের দিকে তাকালেন। বাইরে ওর মুক্তির দাবীতে আন্দোলন হচ্ছে সে খবর ওকে কেউ দেয় নি। তবুও জানল কীভাবে? তারপর নিজের মনেই হাসলেন। এতটা বিশ্বাস না থাকলে এত বড় ঝুকি কেউ কখনও নেয় না।
উঠে বেরিয়ে যেতে গিয়েও কী ভেবে আবার ফিরে আসলেন। বললেন, ‘ক্রাইমটা কেন করলে?’
‘ক্রাইম!’ সোহাগ চিৎকার করে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু, শরীরের দুর্বলতার জন্য সেটা তীব্রতাটা ঠিকভাবে ফুটে উঠল না। ‘টেলিফোনে আড়ি পাতা ক্রাইম হতে পারে। লুকিয়ে অন্যের সেল ফোন ট্যাপ করা অন্যায় হতে পারে। কিন্তু, এম.পি.দের দুর্নীতি জনসমকক্ষে প্রকাশ কখনও অন্যায় হতে পারে না।’
লোকটা হাসার চেষ্টার করল। কিন্তু, তার মাঝেও কোথায় যেন খানিকটা বিষাদ লুকিয়ে রইল। বলল, ‘তাই বলে একসাথে সাইত্রিশ জন এম.পি.র দুর্নীতির প্রমান! এটা বাংলাদেশ ভুলে গেলে কেন?’
সোহাগের মুখে খানিকটা আত্মতৃপ্তি ফুটে উঠল। বলল, ‘বাংলাদেশ বলেই তো এতটা সাহস পেয়েছি। বাংলাদেশ বলেই তো ওরা আসছে।’
লোকটা বলার মত আর কোন কথা খুঁজে পেল না।
============= ============= ============= =============
চীফ হুইপ অবাক চোখে জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত বড় জনসমুদ্র কবে দেখেছিলেন মনে করার চেষ্টা করছেন। একাত্তরের ৭ই মার্চ? নব্বইয়ে? না’কি তের’র ৮ই ফেব্রুয়ারী? বুঝতে পারলেন না। তার সামনে এখন চার তরুণ বসে আছে। তিনি তাদের সাথে খানিকটা ভাব জমানোর চেষ্টা করছেন। যদি কিছু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, আশ্বাস দিয়েই বাড়ি ফেরত পাঠানো যায় সেই আশায়। বললেন, ‘সোহাগ কিন্তু, বলেছে সে সবকিছু একাই করেছে।’
ফর্সা গোলগাল চেহারার একটা ছেলে ঝাঝালো গলায় বলল, ‘এমন একটা কাজ যে কেউ একা করতে পারে না সেটা একটা পাগলেও বোঝে। আপনারা বোঝেন না কেন?’
চীফ হুইপ খানিকটা অপমানিত বোধ করলেন। কিন্তু, সেটা প্রকাশ করলেন না। বললেন, ‘তাহলে ও এমন কেন করল? একাই সব ক্রেডিট নিয়ে নেবার জন্য?’
কবি কবি চেহারার এক ছেলে শান্ত গলায় বলল, ‘আমাদের বাঁচানোর জন্য।’
খানিকক্ষণ কেউ কিছু বলল না। একটু পরে উদ্ধত চেহারার একটা ছেলে বলল, ‘বিপ্লব রক্ত চায়। ও রক্ত দিয়েছে। আর আমাদের দিয়ে গেছে বিপ্লব সফল করার দায়িত্ব।’
চীফ হুইপ বলার মত কিছু খুঁজে পেলেন না।
============= ============= ============= =============
সোহাগের সামনে ওরা চারজন দাড়িয়ে আছে। কেন কোন কথা বলছে না। ঠিক করে বলতে হলে, বলার মত কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। কী বলবে? কীই বা বলা যায় ওকে এখন? ও কি কিছু শুনবে?
থানার আর কেউ আশেপাশে নেই। থাকার মত সাহস করতে পারে নি। বাইরে বিজিবির স্পেশাল ফোর্স অতিকষ্টে জনতাকে আটকে রেখেছে। বিদেশে ভাবমূর্তির কথা ভেবে সরকার সেনাবাহিনী নামাচ্ছে না। তবে জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, সেনাবাহীনিকে নামার হুকুম দেয়া হলেও না’কি তারা সেটা অমান্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিজিবির সদস্যদের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আসছে। তাদের অনেকেই না’কি জনতার সাথে মিশে স্লোগান দিতে শুরু করেছে। একটা ছোট্ট শব্দ লক্ষ কণ্ঠে নিনাদিত হয়ে জলধীর মত গম্ভীর হয়ে উঠছে। প্রতিটি কণ্ঠে একই শব্দ...
স্রেফ সোহাগের কণ্ঠে কোন শব্দ নেই। ওরা চারজন বাইরে গিয়ে দাড়াল। এই আন্দোলনের নেতা এখন একজন মৃত মানুষ। একজন মৃত মানুষ কোন আন্দোলন পরিচালনা করতে পারে শুধু বোধ হয় বাংলাদেশেই। ঊনসত্তরে করেছিল আসাদ। আর এখন করবে সোহাগ। জনসমুদ্রের কোন শেষ দেখা যাচ্ছে না। রোদে পোড়া তামাটে চেহারার ছেলেটা বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘জ-য় বা-ং-লা।’
সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে সেই ধ্বনি উপকূল ভাসিয়ে নিয়ে গেল।