আজ দশ ট্রাক অস্র মামলার রায়ের মাধ্যমে একটা ন্যায় প্রতিষ্ঠা হলো।দেশজুড়ে আলোচিত এ ঘটনার মূল নায়ক ছিলেন সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া ও মো. আলাউদ্দিন।তাদের সাহসিকতায় উদ্ধার হয়েছিল বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। এখন কেমন আছেন তাঁরা। সার্জেন্ট হেলাল বর্তমানে সদর ঘাট ডাম্পিং স্টেশনে ও সার্জেন্ট মো. আলাউদ্দিন ঢাকার স্পেশাল প্রোডাকশন ব্যাটালিয়নে (এসপিবিএন) কর্মরত আছেন।
তাঁরা ভেবেছিলেন পেশাগত দায়িত্বপালনকালে এ ঘটনায় পদোন্নতি ঘটবে। ছড়িয়ে পড়বে সুনাম। সাহসী সার্জেন্ট হিসেবে চিনবে সারা দেশের মানুষ। স্ত্রী সন্তানের মুখ উজ্জ্বল হবে। সন্তানের অসম সাহসিকতায় ভরে যাবে মা-বাবার বুক। সব আশায় গুড়েবালি। বরং এঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের জীবনের ছয়টি বছর হয়েছে কলংকময়। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন করায় যেন কাল হয়েছে সার্জেন্ট হেলালের। জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ছয়টি বছর। তাঁর পরিবারের সদস্যরা সমাজে হয়েছেন হেয়-প্রতিপন্ন।
জীবনের শেষ বয়সে এসে তাঁর ৫৮ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষিকা মাকে শুনতে হয়েছে লোকজনের নানা মন্দ কথা। ন্যায্য পাওনা সরকারি রেশনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন টানা ছয় বছর। পুরস্কারের বদলে লোহার রড দিয়ে ভাঙ্গা হয়েছে হেলালের পা। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করায় যেন তাঁর বড় অপরাধ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সার্জেন্ট হেলাল তখন কয়লার ডিপো পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ছিলেন। সেদিন তাঁর কারণে আটক হয়েছিল বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। দশ বছর পর আজ সেই অস্ত্র মামলার রায় হচ্ছে। অথচ যার সাহসিকতায় ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিলো সেই আলোচিত সার্জেন্ট হেলালের দিন কাটছে চরম নিরাপত্তাহীনতায়। পেশাগত দায়িত্বপালনকালে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে সমাজে হয়েছেন ধিকৃত। হয়েছেন মিথ্যে অস্ত্র মামলার আসামি। ২ বছর ৪ মাস কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে। ফেরারি আসামি হয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে এক বছর।
জানা যায়, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাত আনুমানিক বারোটার সময় তৎকালীন উপ-পুলিশ কমিশনার (বন্দর) আবদুল্লাহ হেল বাকী সিইউএফএল ঘাটে থাকা সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে সহযোগিতা করার নির্দেশ দেন। হেলাল তখন পতেঙ্গা কয়লার ডিপো পুলিশ ফাঁড়িতে দায়িত্বরত ছিলেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে ১৫নং ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে কর্ণফুলী পার হয়ে সিইউএফএল ঘাটে গিয়ে দেখতে পান ঘাটের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সার্জেন্ট আলাউদ্দিন। একটি কার্গো ট্রলার ও একটি ফিশিং ট্রলার থেকে ক্রেন দিয়ে বেশ কিছু বক্স ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকে উঠানো হচ্ছিল। এক কোনায় ৭/৮ জন লোক দাঁড়ানো ছিল। মধ্যরাতে ট্রলার থেকে নামানো বক্সে কি আছে জানতে চাইলে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি নিজেকে হাফিজ নামে পরিচয় দেয়। তার পাশে আর একজন নিজেকে উলফা নেতা আবুল হোসেন (মেজর লিয়াকত) পরিচয় দিয়ে বলেন, এগুলো অস্ত্র। অস্ত্রের কথা শুনে বক্সগুলো আটক করতে চাইলে তারা গালিগালাজ করেন। তখন উপ-পুলিশ কমিশনার (বন্দর) কে ঘটনাটি জানালে তিনি সার্জেন্ট হেলালের কাছে নিরাপদে আছেন কিনা জানতে চান। পরে কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আহাদুর রহমানকে ঘটনাস্থলে যাবার নির্দেশ দেন উপ-কমিশনার (বন্দর)। এ সময় সার্জেন্ট হেলাল ঘাটে থাকা অস্ত্র পাচারকারী দলের পাঁচ সদস্যকে আটক করে হাবিলদার গোলাম রসুলের মাধ্যমে বন্দর পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠিয়ে দেন। ইতিমধ্যে উপ-কমিশনার (বন্দর) আবদুল্লা হেল বাকী ঘটনাস্থলে) গেলে হাফিজ পালিয়ে যায়। উলফা নেতা আবুল হোসেন পরিচয় দানকারী মেজর লিয়াকত উপ-কমিশনার বাকীর সাথে চলে যান। এর মধ্যে ভোর হয়ে যায়। দশটি ট্রাক ভর্তি অস্ত্রগুলো দামপাড়া পুলিশ লাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। যে পাঁচজনকে সিইউএফএল ঘাট থেকে আটক করা হয়েছিল তাদেরকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তোলপাড় করা দশ ট্রাক অস্ত্র আটক ঘটনার নায়ক সার্জেন্ট হেলালকে ২০০৫ সালের মে মসে ঢাকায় বদলি করা হয়। অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার এক বছর তিনমাস পর তার উপর নেমে অমানুষিক নির্যাতন।
হেলালের হারিয়ে যাওয়া ছয় বছর : ২০০৫ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার বাংলা মোটর এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে সার্জেন্ট হেলালকে ওয়াকিটকির মাধ্যমে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা গোয়েন্দা অফিসে। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করা কয়েকজন সিভিল পোশাক পরা লোক অপারেশনের কথা বলে তাকে নিয়ে যায় উত্তরার র্যাব অফিসে। সেখানে একজন র্যাব কর্মকর্তা নিজেকে কর্ণেল গুলজার পরিচয় দেন। তার টেবিলে থাকা দুটি একে-৪৭ রাইফেল দেখিয়ে বললেন, ‘এ অস্ত্র দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান থেকে খোয়া যাওয়া অস্ত্রের দুটি’। এ অস্ত্র সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। হেলাল নেয়ার আগে থেকে সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরদিন (২০ আগস্ট) তাদের দুই জনকে চট্টগ্রাম র্যাব-৭ এর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ভোর আনুমানিক ছয়টায় র্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যাবার পর তৎকালীন র্যাব-৭ এর পরিচালক কর্নেল এমদাদ জিজ্ঞেস করেন হেলাল কার নাম। নাম বলতেই তাকে ধরে বেধড়ক পেটানো শুরু হয়। এক পর্যায়ে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে তার বাম পা ভেঙ্গে দেয়া হয়। পা ভাঙ্গার পর হেলাল তাকে কেন মারা হচ্ছে জানতে চাইলে র্যাব কর্মকর্তা তাকে বলেন, ‘তোর কারণে দেশে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে’। দুই জনকে র্যাব অফিসে নিয়ে যাওয়া হলেও সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে তেমন মারধর করা হয়নি। ১৯ আগস্ট সকাল সাতটায় উদ্ধার করা নোয়াখালীর সুধারাম থানার অস্ত্র মামলার আসামি হিসেবে তাদের দুই জনকে নোয়াখালি কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ তাকে চাকুরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয় ঐ দিন বিকেলে। দীর্ঘ দেড়মাস বিনা চিকিৎসায় নোয়াখালি কারাগারে ভাঙ্গা পা নিয়ে দিন কাটান সার্জেন্ট হেলাল। এর মধ্যে তাকে খুনের দুর্ধর্ষ আসামির মতো ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে স্বাক্ষী দিতে আনা হয়। এ সময় তাকে চট্টগ্রাম কারাগারে বিদেশি বন্দিদের সাথে ২৫নং ওয়ার্ডে রাখা হয়। যেখানে বেশ কয়েকজন ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ উলফা’র সদস্য বন্দী ছিল। যারা তাঁর পাশেই থাকতো। আদালতে সাক্ষী দিতে আনার পর তাকে একটি কাগজ দেয়া হয়। ‘সেখানে যা লিখা ছিল আদালতে তা বলার জন্য তৎকালীন এসি প্রসিকিউশন নির্দেশ দেন’। দুই বছর চারমাস বন্দী থাকার পর ২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিনের আদেশ দিলে ১৩ নভেম্বর নোয়াখালি কারাগার থেকে জামিনে বের হন হেলাল। তিনি নিয়মিত অস্ত্র মামলায় হাজিরা দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ২৪ জুন হেলালকে ডাকা হয় চট্টগ্রাম কারাগারে। কারাগারে টিআই প্যারেডের (শনাক্তকরন মহড়া) মাধ্যমে মেজর লিয়াকতকে চিহ্নিত করেন হেলাল। তিনিই ঘটনার রাতে সিইউএফএল ঘাটে নিজেকে উলফা সদস্য আবুল হোসেন বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। এতে ঘটলো আরেক বিপত্তি। শনাক্তকরন মহড়ার পরপরই হেলালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। আবারো কারাগারে যাবার ভয়ে তিনি পালিয়ে যান। ফেরারি আসামির মতো এক বছর পরিবার পরিজন থেকে তাকে পালিয়ে থাকতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা পুনরায় তদন্ত শুরু হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মনিরুজ্জামান চৌধুরী তার তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেন, ১০ ট্রাক অস্ত্রের মধ্যে কোন একে-৪৭ রাইফেল ছিল না। সার্জেন্ট হেলাল ও সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে একে-৪৭ রাইফেল রাখার দায়ে অস্ত্র মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সিআইডির এ রিপোর্টের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩ তম সভায় দুই সার্জেন্টের নাম অস্ত্র মামলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট সার্জেন্ট হেলাল পুনরায় তার চাকুরিতে যোগদান করেন। কুমিল্লার চান্দিনার মৃত আমীর আলীর সন্তান সার্জেন্ট হেলাল। তার বাবা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার মা হোসনে আরা এখনো চান্দিনার বরকুইট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়ে শিক্ষকতার করেন। কয়দিন পর চাকুরি জীবনের ইতি টানবেন। ২০০৫ সালের ১৯ আগস্ট থেকে ২০১১ সালের ৮আগস্ট পর্যন্ত সার্জেন্ট হেলালের জীবনে ছিল চরম ক্রান্তিকাল। কঠিন এক দুঃসময়ের মধ্যে তার পরিবারের সদস্যরা কালযাপন করেছেন এ ছয়টি বছর। একে-৪৭ রাইফেল হাতে দেয়া তার ছবি যখন পত্রিকায় ছাপানো হয় তখন তার মেয়ে রিফাত তাসমিয়া ভূইয়া ও ছেলে আহনা রাফি ভূইয়া স্কুলে যেতে পরতোনা। তাঁর মা যখন স্কুলে যেতো এলাকার লোকজন মন্দ কথা বলতো। কোন অপরাধ না করেও সামাজিকভাবে হতে হয়েছে হেয় প্রতিপন্ন। চাকুরিতে যোগদানের পর বেতন ভাতা পেলেও ছয় বছরের পরিবারের রেশনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, যা ছিল তার ন্যায্য পাওনা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হারিয়েছেন পায়ের ভারসাম্য। অস্ত্রমামলায় জামিনে নিতে গিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে পৈত্রিক সম্পক্তি। প্রতিনিয়ত চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন নিজে ও পরিবারের সদস্যরা। পা ভাঙ্গার পর বিনা চিকিৎসার কারণে ভাঙ্গা পা ঠিকমতো লাগেনি জোড়া। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না সার্জেন্ট হেলাল। বর্তমানে তিনি সদরঘাট ডাম্পিং স্টেশন ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব পালন করছেন। গতকাল বুধবার সেখানে তাঁকে খোঁজ করা হলে সহকর্মীরা জানান, হেলাল অসুস্থ। তাই বাসায় চলে গেছেন। গতকাল তিনি মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রাখেন।
ঘৃণাই পেয়েছেন আলাউদ্দিন : গতকাল বুধবার বিকেলে মোবাইল ফোনে সার্জেন্ট আলাউদ্দিন বলেন, সব মানুষের কাজের একটি মূল সময় (পিক টাইম) থাকে। আমিতো জীবনের সেই সময় হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমি বৃদ্ধ। ছয়বছর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার শেষে নতুন জীবন পেয়েছি বটে, তবে সে জীবনের কোনও স্বাদ নেই। আমার পুরো জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। সামাজিক জীবনে আমি আর আমার পরিবারের সদস্যরা মানুষের কাছে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই পাইনি। অথচ আমি ছিলাম পুরোপুরি নির্দোষ। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার জীবন তছনছ হয়ে গেছে।
তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৯