সারা দেশের ৬৮টি কারাগারে বর্তমানে বন্দি রয়েছে ৮৬ হাজার মানুষ। এই বিপুল সংখ্যক বন্দির জন্য চিকিৎসক আছে মাত্র ১০ জন। অনেক অসুস্থ বন্দি বিনা চিকিৎসায় গাদাগাদি করে কারাগারগুলোতে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। কারাগারে শুধু চিকিৎসক স্বল্পতাই নয় চিকিৎসা দেয়ার কোনো যন্ত্রপাতি নেই। অসুস্থ কারাবন্দিকে দিনরাত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা-নেয়ার কাজে ব্যস্ত কারারক্ষীরা। তারপরও চিকিৎসার অভাবে কারাগারে মারা যাচ্ছে বন্দিরা। অভিযোগ রয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা কারা হাসপাতালে থাকতে হলে কারা কর্তৃপক্ষকে উৎকোচ দিতে হয়। বিত্তবান বন্দি ছাড়া কেউ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারছে না। এদের মধ্যে যাদের টাকা-পয়সা রয়েছে তারা অসুস্থ না হলেও উৎকোচের বিনিময়ে কারা হাসপাতালে মাসের পর মাস অবস্থান করছে। সাধারণ গরীব, অসহায় বন্দিরা অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। এ অবস্থা দেশের সব কারাগারের।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, কারাহাসপাতালে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি নেই। কারা হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন থাকে তারা নামেমাত্র অসুস্থ হয়ে এখানে ভর্তি হয়। বন্দিদের অসুস্থতা পরিলক্ষিত হলেই কারাগারের বাইরের হাসপাতালগুলোতে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। গভীর রাতে কোনো বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। যানবাহন ও কারারক্ষী সঙ্কটের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের অলসতার কারণে এসব রোগীদের সকাল পর্যন্ত বন্দি অবস্থায়ই রাখা হয়। রাতে কারা চিকিৎসকের দেখা মিলে না। ‘জরুরী চিকিৎসা’ শব্দটি অসুস্থ বন্দিদের কাছে স্বপ্নের মতো। যে কোনো সময়ে আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে কোনো বন্দি মারা গেলে কারা কর্তৃপক্ষের কিছুই যায় আসে না। কারা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী গড়ে ৮ হাজার বন্দির জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছে কারাগারগুলোতে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভাগীয় সদরে থাকা কারাগার ও কেন্দ্রীয় কারাগার মিলিয়ে মোট ১০টি কারাগারে চিকিৎসক রয়েছেন। বাকি সব কারাগারগুলোতে বন্দিদের চিকিৎসা দিয়ে থাকে স্বাস্থ্য সহকারী ও ফার্মাসিস্টরা। অধিকাংশ জেলা কারাগারে বন্দিরা এসব ফার্মাসিস্ট ও স্বাস্থ্য সহকারীদের ডাক্তার হিসেবেই চিনে ও জানে। অথচ তারা সামান্য পেট ব্যথা, ডায়রিয়া ও মাথাব্যথা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা দিতে অক্ষম।
বেশিরভাগ কারাগারে দীর্ঘদিন যাবৎ ডাক্তারের পদটি শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া ডাক্তার স্বল্পতার কারণে ৮ বছরেও কাশিমপুর-২ কারাগারের ভেতর স্থাপিত একমাত্র ২০০ শয্যার কারা হাসপাতালটি চালু করা যাচ্ছে না। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৪ ডাক্তারের পদের বিপরীতে ৪ জন থাকলেও সারাদেশের কোনো কারাগারেই পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় ডাক্তার নেই। জেলকোড অনুযায়ী সারাদেশের কারাগারগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী কারা অধিদফতর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ডাক্তারের চাহিদা জানায়। অতঃপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রেষণে নির্দিষ্ট সংখ্যক ডাক্তার কারাগারে নিয়োগ করে। তবে ডাক্তারগণও কারাগারে পোস্টিং নিতে অনাগ্রহী। বিভিন্ন সময়ে প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে অবসর গ্রহণ করেছেন। শূন্য এ সমস্ত পদের বিপরীতে ডাক্তার নিয়োগের জন্য কারা অধিদফতর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনকে উক্ত জেলায় কর্মরত ডাক্তারদের মধ্য থেকে কারাগারে কাজ করতে আগ্রহীদের নামের তালিকা চাওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেউ কারাগারে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারে যে সমস্ত ডাক্তার নিয়োগ করা হয় তারা সবাই বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণ করে কারাগারের জেল সুপার। যারা নন বিসিএস কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডাক্তার জানায়, কারাগারের বাইরের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা অত্যন্ত কম। অসুস্থতায় বা যে কোনো কারণে ডাক্তারদের ছুটি নিতে চাইলে আবেদন করতে হয় সিভিল সার্জনের কাছে কিন্তু চূড়ান্ত অনুমতি প্রদান করে উপ মহাকারা পরিদর্শকগণ। অর্থাৎ কারগারে চাকরি করলেও সিভিল সার্জন হয়ে উপমহা পরিদর্শকদের অনুমতি নিয়ে ছুটি নিতে ৫-৬ দিন চলে যায়। যা জেল সুপারদের বেলায় শুধু উপমহা পরিদর্শকগণই অনুমতি দেয়। ডাক্তারদের জন্য নেই কোনো আবাসিক সুবিধা। কোনো ডাক্তার কারাগারের বাইরে বদলির জন্য মহাপরিদর্শক বরাবর দরখাস্ত করলে উক্ত ডাক্তারকে তার কর্মস্থলে তার পরিবর্তে অন্য কোনো ডাক্তার পোস্টিং দিলে বদলি কার্যকর করা হবে মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান করলেই উক্ত ডাক্তার বাইরে বদলি হতে পারে। এমতাবস্থায় কোনো ডাক্তার কারাগারে পোস্টিং পেতে চান না বলে উক্ত কর্মকর্তাকে সেখানেই থাকতে হয় বছরের পর বছর। এমনও নজির রয়েছে যে, কারাগারে চাকরিতে যোগদানের ২৫ বছরেও বদলির চেষ্টা করে কোনো কাজ না হওয়ায় অবশেষে অবসর গ্রহণ করতে হয়েছে। প্রেষণে নিয়োগ দেয়ার সময় তাদের কোনো প্রকার নির্ধারিত সময়ের উল্লেখ থাকে না। এ অবস্থার কারণে দিন দিন কারাগারে ডাক্তারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো কারাগারে সিভিল সার্জন কর্তৃক একজন ডাক্তার নির্ধারিত কাজের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নির্দিষ্ট দিনের পার্টটাইম বন্দি রোগী দেখে। যেখানে এই ব্যবস্থাও চালু নেই সেখানে ডাক্তারের পরিবর্তে ফার্মাসিস্ট বা হেলথ এ্যাসিসট্যান্ট দিয়েই বন্দিদের চিকিৎসা অব্যাহত রয়েছে। এতে বন্দিদের মানবাধিকার চরমভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে পাশাপাশি সুচিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত হতে হচ্ছে।
মূলত, বাংলাদেশের কারাব্যবস্থা শুধু ইসলামিক আবেদন আর আদর্শই নয়; বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় খুবই নিষ্ঠুর, বর্বর, নির্মম ও পৈশাচিক প্রকৃতির৷ এর প্রকৃত চিত্র একদিকে যেমন সংক্ষেপে দেয়া খুব মুশকিল, তেমনি হৃদয়বান মানুষের পক্ষে যেকোন একটি ঘটনার তথ্য থেকে পুরো পরিস্থিতিই আঁচ করে নেয়া সম্ভব৷
এক্ষেত্রে সরকারের কর্ণকুহরে আওয়াজ না পৌঁছলেও হৃদয়বান মানুষ মাত্রই উচিত, হৃদয়ের টানেই মানবিক কারণেই কারাগারের মানুষদের জন্যও অনুভব করা।
কারাগারে যারা নিরপরাধ তাদের পশুজীবন থেকে মুক্তি তো বটেই যারা অপরাধী রয়েছে তাদের অপরাধ প্রবণতাও যেন সুখের মাধ্যমেই সংশোধন হয়; সে ব্যবস্থা জোরদার করা।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের রাজনীতিক দলের নেতৃবৃন্দ যখনই ক্ষমতার বাইরে থাকে তখনই তারা কারাগারের অমানবিক ব্যবস্থাপনা দূর করার সাথে গভীর একাত্মতা পোষণ করে। কিন্তু যখনই ক্ষমতায় আরোহণ করে তখনই তা বেমালুম ভুলে যায়।