চীনে নিয়ে চিকিৎসার নামে প্রতারণা জমিয়ে তুলেছে মডার্ন ক্যান্সার হাসপাতাল গুয়াংজৌ’র সাব অফিস। রাজধানীর গুলশান এক নম্বর গোলচত্বরের পাশে নাভানা টাওয়ারের ৯ তলায় বেশ জাঁকিয়ে বসেছে তারা।
এ সাব অফিসে চিকিৎসার জন্য চীনে পাঠানোর নামে থেরাপি দেওয়ার আগেই রোগীর কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে রোগীদের আকৃষ্ট করছে তারা। এসব বিজ্ঞাপনে মাত্র এক সূঁচে বরফের মতো জমিয়ে টিউমার অপারেশনের (ক্রাইওথেরাপি) কথা বলা হলেও এজন্য কতো টাকা নেওয়া হবে তা প্রকাশ করা হচ্ছে না।
তাই বিস্তারিত জানতে এসে তাদের পাতা ফাঁদে ধরা খাচ্ছে অসহায় রোগী ও তাদের অভিভাবকরা। প্রথমে কোন এক নির্দিষ্ট অংকের টাকার কথা বলে শুরু হচ্ছে আলাপ। এরপর নানা অযুহাতে দফায় দফায় টাকার অংক বাড়ানো হচ্ছে। লাখ টাকা বাড়তে বাড়তে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ৩০ লাখের কোটা।
মাত্র এক ঘণ্টায় সফলভাবে এ থেরাপি দেওয়ার কথা বলা হলেও ৩০ দিনের বেডভাড়া আগেই আদায় করা হচ্ছে রোগীর কাছ থেকে। কিন্তু চীনে যাওয়া ও সেখানে থাকা-খাওয়ার কোন নিশ্চয়তাই দেওয়া হচ্ছে না কাউকে।
এমনকি এতো টাকা নেওয়া সত্ত্বেও রোগীর সুস্থ হওয়ার কোন নিশ্চয়তাও দিচ্ছে না তারা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ১৩ ধরনের থেরাপির যে বুলি তারা আওড়াচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তা ১৩ ধরনের প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এরই মধ্যে অনেক পরিবার পথে বসেছে। এমনকি অনেক টাকা খরচের পরও সাব অফিসের মাধ্যমে চীনের মডার্ন ক্যান্সার হাসপাতাল গুয়াংজৌতে নেওয়ার রোগীর মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এমনই এক মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গোপালগঞ্জের চুমুদ্দিতে জন্ম নেওয়া ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেন ফকিরের মৃত্যু হয়েছে গুয়াংজৌতে।
তার স্ত্রী লিনা নাসরিন বলেন, গুলশান এক নাম্বারের নাভানা টাওয়ারের ৯ তলায় অবস্থতি সাব অফিসের মাধ্যমে চীনের মডার্ন ক্যান্সার হাসপাতাল গুয়াংজৌতে নেওয়ার জন্য আমাদের কাছে দশ লাখ টাকা চাওয়া হয়। পরে তারা আমাদের কাছে ৩৫ লাখ টাকা আদায় করে। স্বামীর মৃত্যুর পর এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আমি এখন নিঃস্বপ্রায়।
তিনি বলেন, তারা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। চীনে নিয়ে যাওয়ার পর তারা একের পর এক দাবি তুলতে থাকে। আমার স্বামীর ক্রিটিক্যাল পরিস্থিতির কথা জানিয়ে এতোগুলো টাকা হাতিয়ে নেয়।
লিনা আরও বলেন, তারা প্রথমে ৬ লাখের কথা বলে ৭ দিন যেতে না যেতেই ১০ লাখ টাকা নিয়ে নেয়। তাদের প্রতারণার জালে জড়িয়ে ৪৫ দিনে ৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায় আমাদের। উপরন্তু স্বামীকেও হারাতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাত্র চার মাস বয়স হলেও এরই মধ্যে ২০ জন রোগীকে গুয়াংজৌতে পাঠিয়েছে এই সাব অফিস। প্রত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা রোগীরাই মূলত টার্গেট তাদের।
তবে ৪/৫ জনের সাব অফিসে কোন প্রকার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এমনকি ভিসা প্রসেসিং ও বিমানে টিকিট কাটার কোন আয়োজনও নেই তাদের। তবুও প্রথমে শুধু থেরাপির নামেই প্রতি রোগীর কাছ থেকে ৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দাবি করে শুরু হচ্ছে প্রতারণা পর্ব।
এখানে গাইবান্ধা থেকে আসা এ এস এম ফিরোজ কবির বলেন. আমার পিতার মাথায় টিউমার হয়েছে। আমি বিজ্ঞাপন দেখে এখানে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে দেখি বিজ্ঞাপনের সঙ্গে এদের কথা এবং কাজের কোন মিল নেই।
তিনি বলেন, তারা শুধু থেরাপির কথা বলে আমাদের কাছ থেকে ৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা চায়। অথচ আমার পিতার রোগমুক্তির কোন নিশ্চয়তা দিতে চায় না। থেরাপি ছাড়া আর কিছুরই দায়িত্ব নিতে চায় না। বিমান টিকিট, যাওয়া আসা, কেবিন খরচ সব নাকি আমাদেরই সামলাতে হবে। এমনকি আমার পিতা চীনে মারা গেলে সেই দায়িত্ব নাকি আমার? তা হলে আমার ৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা তারা কি করবে?
তবে টাকা আদায়ের এ প্রতারণার অভিযোগ অস্বীকার করে গুয়াংজৌর অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার রুবেল মেহেদি বলেন, আমাদের এখানে ৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিতে হয় না। যে বলেছে সে আমাদের পদ্ধতি বুঝতে পারেনি।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে টাকা রাখা হয় ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার।
থেরাপির আগে কেন ঢাকাতে সব টাকা পরিশোধ করতে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে সমস্ত টাকা ডিপোজিট রাখা হয় যাতে চীনে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়।
তবে এর আগে তারা যে ২০ জনের চিকিৎসা করিয়েছে তাদের নাম ঠিকানা জানতে চাইলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান তিনি।
উল্লেখ্য, সাব হাসপাতালটি তাদের বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করছে যে, টিউমারকে বরফের মত জমিয়ে ধ্বংস করতে একটি মাত্র সূঁচই যথেষ্ট। এ প্রক্রিয়ায় ক্রাইওথেরাপির মাধ্যমে সার্জারি ছাড়াই টিউমার অপসারণ সম্ভব।
তাদের বিজ্ঞাপনে প্রফেসর পেং সিয়াও সি নামে এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উল্লেখ করছে, ক্রাইওথেরাপির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি শেষ করতে ১ থেকে ২ ঘণ্টা সময় লাগে। টিউমার শনাক্ত করার পর থেকে টিউমারের ভেতরে সূঁচ প্রবেশ করানো এবং এই সূঁচের মধ্যে নল ঢোকানো হয়। এর পর নলের মধ্যে আর্গন গ্যাস প্রবাহিত করে প্রথমে তাপমাত্রা কমানো ও পরে হিলিয়াম গ্যাস প্রবেশ করিয়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে শূণ্য ডিগ্রিতে নিয়ে আসা হয়।
এ চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করলেও টাকা আদায়ের পদ্ধতির সমালোচনা করে খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ডা. হাসান ইমাম চৌধুরী বলেন, রোগীর কাছ থেকে এভাবে টাকা নেওয়া এক ধরনের প্রতারণা ।
এদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।