কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা ছাড়াই বারবাডোসে নিবন্ধিত অখ্যাত ও অনভিজ্ঞ ক্ষুদ্র কানাডীয় কম্পানি নাইকো রিসোর্সেসের সঙ্গে পেট্রোবাংলা বা বাপেক্সের তথাকথিত জয়েন্ট ভেঞ্চার দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পরিত্যক্ত ও প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের নামে দেশবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে এ দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের ১ দশমিক শূন্য ১৯ ট্রিলিয়ন গ্যাসের নিশ্চিত মজুদের মালিক বনে যায় নাইকো। এতে বাংলাদেশকে এখন নিজস্ব গ্যাসসম্পদ মূল্যবান বৈদেশীক মুদ্রায় কিনতে হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশবিরোধী এই নাইকো চুক্তির দমূল নায়কদ বা দহোতাদ হলেন সাবেক জ্বালানিসচিব এবং বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। সে সময় তিনি নাইকোর পক্ষে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদনের জন্য কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নানা জালজালিয়াতিরও আশ্রয় নেয়া হয়। তবে বিএনপি সরকারের সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বেলায়ও দায়িত্বে না থাকলেও এই তৌফিক-ই-ইলাহীর ছক অনুযায়ীই সব কিছু হয়। জানা গেছে, শুরু থেকেই নাইকোর পক্ষে কাজ করেন তার ভাগ্নে নাইকোর ভাইস প্রেসিডেন্ট (দক্ষিণ এশিয়া) কাশেম শরীফ।
তৌফিক-ই-ইলাহীর জাতীয় স্বার্থবিরোধী ভূমিকার কারণে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় তাদের গ্রেপ্তারও দেখানো হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দাবি করে এ সম্পর্কিত কমিটি তা প্রত্যাহারের সুপারিশ করলেও দুদক প্রত্যাহার করেনি। খালেদা জিয়া ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। তবে দুটি মামলার কার্যক্রমই বর্তমানে স্থগিত আছে। শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী সরকারের সময় নাইকো রিসোর্সেস তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের সেকেন্ড রাউন্ড বিডিংয়ে অংশ নিলেও ৯ ও ১০ নম্বর ব্লকে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া তাল্লো ও শেল/কেয়ার্নের চেয়ে যথাক্রমে ৪২.৯ ও ৫০.৮ নম্বর কম পায়। তাই কোনো ব্লকই বরাদ্দ না পেয়ে নাইকো ভারতে পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে পূর্ব-অভিজ্ঞতার দাবি করে প্রান্তিক ও পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন ও উৎপাদনের একটি প্রস্তাব ১৯৯৯ সালের ২১ জুন তদানীন্তন জ্বালানি সচিব ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর কাছে পেশ করে। পরে ২৮ জুন নাইকো ছাতক, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত ও প্রান্তিক চিহ্নিত করে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করার আগ্রহ দেখায়। ১৯৯৯ সালের ১ জুলাই তৌফিক-ই-ইলাহীর সভাপতিত্বে এক সভায় নাইকোর প্রস্তাব গ্রহণ এবং ছাতক, কামতা ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্রকে প্রান্তিক হিসেবে উন্নয়ন ও উৎপাদন এবং এ জন্য বাপেক্স ও নাইকোর মধ্যে যৌথ অংশীদারি চুক্তির (জেভিএ) সিদ্ধান্ত হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ নাইকোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে ১৯৯৯ সালের ২০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠায়। এতে নাইকোর অযাচিত প্রস্তাব গ্রহণ করে দসুইস চ্যালেঞ্জ- নামের অননুমোদিত নতুন এক পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়, যাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব পাওয়ার ব্যাপারে দরপত্র আহ্বান এবং প্রাপ্ত প্রস্তাব গ্রহণে নাইকোর অগ্রাধিকার থেকে যায়।
১৯৯১ সালের ২৩ আগস্ট বাপেক্স এবং নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেডের যৌথ সহযোগিতায় ছাতক, ফেনী ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রের মূল্যায়নের জন্য ফ্রেমওয়ার্ক অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এফওইউ) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যৌথ সমীক্ষাটি গ্যাস মজুদ নিরূপণ, কূপ খনন পরিকল্পনা এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ও ব্যয় প্রাক্কলনে সীমাবদ্ধ বলে দেখানো হয়। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাপেক্স এবং নাইকোর যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদন সম্পন্ন হলে দেখা যায়, সব প্রক্রিয়াই নাইকোর অনুকূলে চলে গেছে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদিত ‘সুইস চ্যালেঞ্জ’-এর কথা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংশ্লিষ্টরা ভুলে যান। তবে এ সময় আলোচ্য গ্যাসক্ষেত্রগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়নি। এমনকি পরিত্যক্ত ঘোষণার নীতিমালাও তৈরি হয়নি। ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘প্রান্তিক/পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন নীতিমালা’ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালের ৬ জুন অনুমোদন করেন।
পরবর্তীকালে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের আট দিন পর ১৪ জুন এ নীতিমালায় যুক্ত ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৯৯৯ সাল থেকে নাইকোর সঙ্গে সম্পাদিত সব কার্যক্রম অনুমোদিত বলে বিবেচিত হবে। পরবর্তীকালে ঊর্ধ্বতন মহলের অভিপ্রায়ে তিনটি গ্যাসক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত/প্রান্তিক ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়টি উপযুক্ত কারিগরি কর্তৃপক্ষ দ্বারা মূল্যায়ন করা হয়নি বলেও জানা যায়।
২০০১ সালের ৩ জুলাই এক পত্রে নাইকো ছাতক (পূর্ব) গ্যাসক্ষেত্রকে জয়েন্ট ভেঞ্চারের অন্তর্ভুক্ত করা হলে ওই অংশের জন্য আকর্ষণীয় আর্থিক শর্ত প্রদানের ইঙ্গিত দেয়। অবশ্য এর আগে ২০০১ সালের জুনে সরকার ঘোষিত প্রান্তিক/পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন পদ্ধতিতে আলাদা এলাকা সত্ত্বেও ছাতক (পশ্চিম) ও ছাতক (পূর্ব) এলাকাকে একটি গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু যখন নাইকোকে বলা হলো, ছাতক (পশ্চিম) হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র, ছাতক (পূর্ব) নয়, তখন নাইকো তা মানতে অস্বীকার করে।
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় বাপেক্সের সঙ্গে নাইকোর চুক্তির প্রক্রিয়া নাকচ হয়ে যায়। সরকারের প্রভাবশালী মহল, বিশেষ করে হাওয়া ভবনের গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে ম্যানেজ করা হলে সরকারের সব অঙ্গ একযোগে নাইকোর স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীকেও ম্যানেজ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনিই নাইকোকে কাজ উদ্ধারের পদ্ধতি বাতলে দেন। কানাডীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি ছাড়াও নাইকোর স্বার্থরক্ষায় কানাডীয় এক মন্ত্রী ঢাকা সফর করে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকায় কামাল সিদ্দিকীর নাইকোর পক্ষে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের উপর দফায় দফায় চাপ প্রয়োগ সম্ভব হয় বলে জানা যায়।
২০০২ সালের ৮ জুলাই বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে লেখা পত্রে নাইকোর ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ ছাতককে (পূর্ব) অন্তর্ভুক্ত করা না হলে তাদের পক্ষে জয়েন্ট ভেঞ্চার করা সম্ভব হবে না বলে জানান। বাপেক্স নাইকোর এ হুমকির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলে এ বিষয়ে ২০০২ সালের ২৯ জুলাই জ্বালানি সচিব খায়রুজ্জামান চৌধুরী সভা আহ্বান করেন।
এদিকে বাপেক্স-নাইকো জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তির খসড়া সম্পর্কে বাপেক্স ২০০২ সালের ২০ আগস্ট পেট্রোবাংলার কাছে যে মতামত পাঠায় তাতে বলা হয়, জ্বালানি বিভাগের ২০০২ সালের ২৯ জুলাই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে প্রস্তাবিত জয়েন্ট ভেঞ্চারে এখন থেকে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র বলতে ছাতককে (পশ্চিম) বোঝাবে এবং জয়েন্ট ভেঞ্চারের আওতায় ছাতক (পশ্চিম) ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্রকে বোঝাবে। নাইকো সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বদলের জন্য প্রচ- চাপ দেয়।
বাপেক্স তথা পেট্রোবাংলার সিদ্ধান্তে নাইকোর চাহিদা পূরণ না হওয়ায় খায়রুজ্জামান চৌধুরীকে বদলি করে প্রথমে খন্দকার শহীদুল ইসলাম ও পরে নজরুল ইসলামকে সচিব করা হয়। পেট্রোবাংলার উপর প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ থেকে নাইকোর অনুকূলে মতামত দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়। নাইকোর অনুকূলে মতামতদানের জন্য বারবার তাগিদ এবং চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত পেট্রোবাংলা তথা বাপেক্স নাইকোর অভিপ্রায় অনুযায়ী ছাতককে (পূর্ব) ছাতক (পশ্চিম) পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্রের আওতাভুক্ত দেখাতে বাধ্য হয়। চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া শুরুর প্রাথমিক অনুমোদন চাওয়া হলে ২০০৩ সালের ১৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদন করেন। এ অনুমোদনের ভিত্তিতে চুক্তির খসড়া ও কাঠামো তৈরির জন্য পেট্রোবাংলা একটি কমিটি গঠন করে। চুক্তির খসড়া প্রথমে বাপেক্সে ও পরে পেট্রোবাংলার বোর্ড সভায় অনুমোদিত হয়। এরপর মতামতের জন্য অর্থ এবং আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। যাওয়া মাত্রই আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তা অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। আইনমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি ছিলেন নাইকোর আইন উপদেষ্টা। আর নাইকোর ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী মওদুদ আহমদের ভায়রা।
এরপর চূড়ান্ত চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিতে সার-সংক্ষেপ তৈরি হয়। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন চুক্তির খসড়াসহ সার-সংক্ষেপ হাতে করে নিয়ে ২০০৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বাপেক্স এবং নাইকোর মধ্যে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি করার জন্য জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী পেট্রোবাংলাকে যে নির্দেশ দেন তার নোটে প্রতিমন্ত্রী লেখেন, ১৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তিনি চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদন করেছেন। ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন নোটে দাবি করেন, ‘মুখ্য সচিব টেলিফোনে আমাকে এই যৌথ সহযোগিতা চুক্তি (জেভিএ) চূড়ান্তকরণের ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন এবং সেই নির্দেশ অনুযায়ী চুক্তি চূড়ান্ত করার অনুরোধ জানান।’
নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে লিখিত চূড়ান্ত অনুমোদন অপরিহার্য। তাছাড়া তিনি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও ছিলেন বলে ফাইল এবং সার-সংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত চূড়ান্ত অনুমোদন নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সরকারের কার্যবিধিমালায় (রুলস অব বিজনেস) এ ধরনের চুক্তি করার আগে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশের পর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। ২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর বাপেক্স ও নাইকোর মধ্যে প্রান্তিক/পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে জয়েন্ট ভেঞ্চার চুক্তি হয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না থাকায় নাইকোর সঙ্গে বাপেক্সের চুক্তিটি তাই বৈধ নয়।
২০০৪ সালের নভেম্বরে গ্যাস অনুসন্ধানের সময় নাইকোর অদক্ষতায় ছাতকের টেংরাটিলায় বিস্ফোরণ হলে গ্যাসসম্পদ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। নাইকোর পক্ষ থেকে মোশাররফ হোসেনকে দামি গাড়ি ছাড়াও ঘুষ দেয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। তবে এ কেলেঙ্কারির স্থপতি তৌফিক-ই-ইলাহী কী ‘পুরস্কার’ পেয়েছেন তা এখনো অজ্ঞাত রয়ে গেছে। (তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ)
তৌফিকের হটকারি সিদ্ধান্তের জের ॥ কুইক রেন্টালে চলছে হাজার কোটি টাকার লুটপাট :
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহীর স্বপ্নের কুইক রেন্টাল আজ পুরো জাতির জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারকে দাঁড় করিয়েছে অন্ধকারের সামনে। এর মাধ্যমে গুটিকয় মানুষ দুই হাতে কামিয়ে নিলেও দেশের ১৬ কোটি মানুষ আজ বিপাকে। বিদ্যুৎ ছাড়াই শোধ করতে হচ্ছে হাজার কোটি টাকা, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক অর্থনীতিতে। সুকৌশলে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশীক মুদ্রা। সমালোচকেরা বলছেন, কুইক রেন্টালের নামে চলছে কুইক লোপাট কার্যক্রম। আর এতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন- উপদেষ্টা হয়ে পুরো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে একের পর এক দেশের স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কার স্বার্থে? কুইক রেন্টালের নামে বিদ্যুৎ খাতকে ডুবিয়ে দেশের মানুষের কাঁধে চাপালো বিশাল ভর্তুকির বোঝা। যোগ্যতা যাচাই না করে পছন্দের দুটি কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্ব।
গ্যাস সেক্টর তুলে দিলো বিদেশী কোম্পানির হাতে। এ নিয়ে সমালোচনাকারীদেরও এক হাত নিতে ছাড়লো না সে। ক্ষমতাসীন দলের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ দশম সংসদ অধিবেশনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ মন্ত্রণালয় মন্ত্রী চালান, না উপদেষ্টা চালান? মন্ত্রীর কী ক্ষমতা, উপদেষ্টার কী ক্ষমতা, তা আমরা জানি না। উপদেষ্টাকে ফোন করলে তিনি তা ধরেন না। সমালোচনার ঝড় বইছে সর্বত্র। সংসদে দফায় দফায় বিতর্ক। গায়ে মাখে না উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী। গণবিরোধী দায়হীন উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীর দম্ভোক্তি, কুইক রেন্টালের সমালোচনাকারীরা দেশের শত্রু, অজ্ঞ, জ্ঞানপাপী না হয় রাষ্ট্রদ্রোহী। উপদেষ্টার এ বক্তব্য নিয়ে ওই সময় নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি রাজশাহীতে এক সংলাপ অনুষ্ঠানে বলেন, কুইক রেন্টাল নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এর আগে আমাদের দেশপ্রেমকে কটাক্ষ করা হয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছরে যদি এককভাবে কোনো একটি বিষয় সামগ্রিকভাবে বাজেটের শৃঙ্খলাকে বিপন্ন করে, তা হচ্ছে কুইক রেন্টাল। পুরো বিষয়টি নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। এ ছাড়া কুইক রেন্টাল দিয়ে দেশের কোনো উন্নয়নও হয়নি।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক জ্বালানিমন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, কুইক রেন্টাল বিদু্যুৎ উৎপাদনের নামে সরকার জাতীয় অর্থনীতির অপচয় করছে। এখন রাজস্ব খাত থেকে এর ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। দুর্নীতি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার। এ কারণে সরকার সংসদে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ পাস করেছে। এতেই বোঝা যায়, ক্ষমতাসীনরা লুটপাটের জন্যই এ অধ্যাদেশ পাস করেছে। এ ছাড়া বিনা টেন্ডারে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় এ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এটা বিশ্বের কোথাও নেই। সময় হলেই জাতির কাছে বিএনপি তাদের সব দুর্নীতি তুলে ধরবে বলে জানান ড. মোশাররফ।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বর্তমান সরকার উপদেষ্টাশাসিত সরকারে পরিণত হয়েছে। উপদেষ্টারা এসব হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলেও দায় মন্ত্রীদেরই নিতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে তৌফিক-ই-ইলাহী কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানির হাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত তুলে দিচ্ছে। কুইক রেন্টালের কারণে পুরো অর্থনীতি আজ বিপর্যস্ত। কিন্তু কেন এটা করছেন তা আমাদের জানা নেই। তৌফিক-ই-ইলাহী জ্বালানি সচিব থাকাকালে বিদেশী কোম্পানির দ্বারা টেংরাটিলা ও মাগুরছড়া গ্যাসকূপ দুর্ঘটনার ৪৫ হাজার কোটি টাকা জরিমানা আদায়েও বাধা দেয়। অথচ ওই গ্যাস হলে আমাদের দুই বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদনে আর চিন্তা করতে হতো না। উপদেষ্টা এসব করলেও এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। কারণ তাকে প্রধানমন্ত্রীই নিয়োগ দিয়েছেন। এদিকে দেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করলেও কুইক রেন্টালের উচ্চমূল্যের পাওনা পরিশোধ করতে হচ্ছে বৈদেশীক মুদ্রায়। এতে টান পড়ছে বৈদেশীক মুদ্রার রিজার্ভে। এলসি খুলতে গিয়ে আমদানিকারকদের ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিতে হচ্ছে। কেন্দ্রগুলো চালাতে তেল আমদানি করতে গিয়ে দেনায় জর্জরিত বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশনও (বিপিসি)। দেনা কমাতে গত এক বছরেই জ্বালানি তেলের দাম পাঁচ দফা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম সাড়ে তিন বছরে গড়ে আড়াই থেকে বাড়িয়ে প্রায় আট টাকা করা হয়েছে। আবারও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। বার বার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ায় মানুষের জীবনমান সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রচলিত দরপত্র পন্থা অবলম্বন না করে এসব কেন্দ্র নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। বড় অঙ্কের উপরির বিনিময়ে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে দুই হাতে কামিয়ে নিচ্ছেন বিদ্যুৎ খাতের গুটিকয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। আবার ওইসব প্রতিষ্ঠানের ত্রিমুখী লাভ নিশ্চিত করতে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়, কেন্দ্র না চালালেও উচ্চ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং চার্জ নির্ধারণ, ভর্তুকি মূল্যে কেন্দ্রে তেল সরবরাহসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, একই সময়ে সামান্য বিনিয়োগ করে সরকারি কেন্দ্রগুলো মেরামত করে এসব ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। কিন্তু ব্যবসার সুযোগ না থাকায় সেদিকে যাননি সংশ্লিষ্টরা। এখন এ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, যোগ্যতা যাচাই না করে এক সামিট গ্রুপকেই প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট কেন্দ্রের কাজ দেয়া হয়েছে, যার এক হাজার মেগাওয়াটের বড় তিনটি কেন্দ্রই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর অর্থথ রেন্টালগুলোর মেয়াদ আবারও বাড়তে যাচ্ছে।
সূত্রমতে, উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনা ছাড়াও প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং চার্জের নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে প্রতি মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ওপর ৯ হাজার থেকে ৩০ হাজার ডলার ভাড়া দিতে হচ্ছে। এর বাইরেও কেন্দ্রগুলোকে ভর্তুকি মূল্যে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। আবার উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে অধিক দাম দিয়ে। ভাড়াভিত্তিক এসব কেন্দ্রের তিন দিকের লাভ নিশ্চিত করতে গিয়ে ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত হয়েছে বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-দ১১ অর্থবছরে ১২টি রেন্টাল ও ১৫টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে শুধু ভাড়া বাবদ দিতে হয়েছে ৩ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার ২৫১ ডলার। ডলার মূল্য ৭০ টাকা ধরে বাংলাদেশী মুদ্রায় এ পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৯৭ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ৮৪০ টাকা। গেল অর্থবছরে এ পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১২১ কোটি ৩১ লাখ ৮ হাজার টাকা। এ পুরো টাকাটাই শোধ করতে হচ্ছে বৈদেশীক মুদ্রায়। অধিকাংশ ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রে বিদেশী মালিকানা বা বিদেশী অংশীদারিত্ব থাকায় এ টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বৈদেশীক মুদ্রায় দেনা পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে চাপ পড়ছে বৈদেশীক মুদ্রার রিজার্ভে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরের চেয়ে ২০১১-১২ অর্থবছরে বৈদেশীক রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রতি মাসেই সন্তোষজনক পর্যায়ে বেশি ছিল। তার পরও ২০১১-১২ অর্থবছরে ছয় মাসই বৈদেশীক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ হাজার মিলিয়ন ইউএস ডলারের নিচে ছিল। ২০১০-১১ অর্থবছরের মে মাসে যেখানে রিজার্ভ ছিল ১০ হাজার ৪৩১ মিলিয়ন ডলার, সেখানে গেল মে মাসে ১৫৮ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বেশি আসার পরও বৈদেশীক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫২০ মিলিয়ন ডলারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ম. তামিম বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ হলে তাদের দেনা বৈদেশীক মুদ্রায়ই শোধ করতে হবে। আর স্বল্পমেয়াদি হওয়ায় এসব কেন্দ্রের রেটও বেশি। এটা বৈদেশীক রিজার্ভে চাপ ফেলবেই। তাই এগুলো যত তাড়াতাড়ি তুলে দেয়া যায় ততই মঙ্গল।
এদিকে এসব কেন্দ্রের ব্যয়ের বোঝা জাতির কাঁধে চাপলেও এর সুফল মানুষ পাচ্ছে না। অধিকাংশ ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই উৎপাদন ২০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। অথচ, দেখানো হচ্ছে পিডিবির তেল সরবরাহের টাকা নেই বলে উৎপাদন কম হচ্ছে। গত মার্চ-এপ্রিলে তেল বাবদ যেখানে দৈনিক গড়ে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হতো, সেখানে সম্প্রতি ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে দেখা গেছে বেশ কিছু ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না। অথচ, স্থাপনের পর থেকে এসব কেন্দ্রকে পূর্ণ ক্ষমতা ধরে বিল পরিশোধ করে আসছে বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও চুক্তির শর্তানুযায়ী চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রগুলোকে উল্টো জরিমানা গুনতে হবে। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে দিনে গড়ে ৬২৯ মেগাওয়াট। কিন্তু ভাড়া দিতে হয়েছে পুরো দুই হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা ধরে।
এদিকে ভাড়াভিত্তিক এ কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই বিপিসির তেল ভালো না বলে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি তেল ব্যবহার দেখাচ্ছে। বিপিসি থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে চুক্তি অনুযায়ী ভর্তুকি দামে ২১৭ থেকে ২১৮ মি. লি. জ্বালানি তেল লাগার কথা, কিন্তু পিডিবি ইতোমধ্যে ১৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চিহ্নিত করেছে, যারা প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৬০ মি. লি. তেল খরচ দেখাচ্ছে। এ কারণে ওই ১৩টি কোম্পানিকে ১৩০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দুদকও তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে। পিডিবি চেয়ারম্যান আলমগীর কবীর বলেন, বিষয়টি তারা গুরুত্বের সঙ্গে মনিটর করছেন। এ ব্যাপারে তারা শক্ত অবস্থানে। জ্বালানি তেলের মান নিয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান আবুবকর সিদ্দিক বলেন, মান নিশ্চিত হওয়ার পরই সরবরাহ করা হয়।