সিঙ্গপুর এয়ারলাইন্সের এ৩৮০-৮০০ এয়ারবাস, অত্যাধুনিক সাজে সাজানো বিমানটি।
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের এ৩৮০ সুবিশাল এয়ারবাসটা যখন সিডনি'র মাটি স্পর্শ করলো, ঘড়িতে তখন স্থানীয় সময় সকাল ছয়টা বেজে সাত মিনিট। কিংসফোর্ড স্মিথ সিডনি এয়ারপোর্টের কাস্টমস-ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ বেল্ট থেকে নিজের মালামালগুলো খুঁজে নিয়ে দীর্ঘ প্রায় ৮ ঘন্টার জার্নি শেষে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা না হলেও শরীর ঝমে যাবার মত ঠান্ডা অনুভব করলাম। সিঙ্গাপুরে যেখানে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা সেখানে সিডনিতে ১৮ ডিগ্রী এর নিচে তাপমাত্র, কোন প্রকার শীতের কাপড় না থাকাতে ভালই কষ্ট পাচ্ছিলাম।
সিডনি এয়ারপোর্টের রানওয়ের ছবি
সিডনি এয়ারপোর্টে স্বাগত জানাচ্ছে
গেইটের বাহিরে আসতেই আমাদের জন্য অপেক্ষমান একঝাক সুন্দরিদের দেখা পেলাম, ইউনিভার্সিটির ট্যুরে প্রায় ১৩টা ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়ে এসেছি। ছেলে মেয়ে বলতে আমরা সবাই পার্ট টাইম লেখা পড়া শুরু করা বুড়ো মানুষ, তবে রেগুলার ষ্টুডেন্টদের দেখতে বেশ চমৎকার লাগছিল। তরুনদের মাঝে একটা "জয়া করার" ভাব থাকবে তাদেরও আছে, হাটা চলা কথা বার্তা হাসি ঠাট্টা। সব মিলিয়ে এরাই সম্পূর্ন উপভোগ করছে, আমরা বুড়োরা শুধু দেখতে এসেছি। ভাবখানা এমন যে, কিছুদিন পরেতো মরেই যাব সুতরাং মরার আগে অষ্ট্রেলিয়াটাকে একটু দেখে নেই।
আলাদা ডিপার্টমেন্টের জন্য আলাদা গাড়ি ছিল, সবাই যার যার ডিপার্টমেন্ট অনুসারে গাড়িতে গিয়ে বসল। এদের আপ্যায়ন বিমান থেকে কম দেখলাম না, কখন কি লাগবে চাওয়ার আগেই দিয়ে দিচ্ছে। আমি কেবল একটা গরম কফি চাইলাম, প্রতিটা গাইডকেই অনেকটা উজ্জেবিত মনে হচ্ছিল যদিও পরে জানলাম এরা জবের ক্ষেত্রে খুব সিরিয়াস তাই তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে কাষ্টমার সেটিসফেকশনের।
আনুমানিক ১০টার সময় আমাদের ক্যাম্পাসে আসলাম, থাকার জায়গা ক্যাম্পাসের পাশেই অসাধারন সুন্দর একটা হোটেলে (Crowne Plaza Newcastle Hotel) দেয়া হল। এই হোটেলের সবচেয়ে মজার বিষয়টাছিল বিছানায় শুয়ে সাগর দেখা যায়, আর সাগর আমার সবচেয়ে প্রিয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন এই হোটেলে আমি কতটা সুখে আছি, তারপরও দুই একজনকে মনমরা হয়ে থাকতে দেখলাম এরা নাকি আরো সন্দর হোটেল চেয়েছিল।
হারবার সাইট সুইট থেকে বাহিরের দৃশ্য
গাইড আমাদের সবাইকে ফ্রেশ হয়ে রেষ্টুরেন্টে আসার জন্য বল্ল, এতক্ষনে বুঝতে পারলামা খিদে পেট চু চু করছে। অতিরিক্ত ফি দিয়ে আগেই সিঙ্গেল রুম কনফার্ম করে রেখেছিলাম, রুমে এসেই গরম ঠান্ডা পানির মিশ্রনে একটা জটিল গোসল দিলাম। কখনোই বাথটবে আমি গোসল করিনা, ঝড়নার পানিতে গোসলটাই আমাার ভাল লাগে কিন্তু আজ কেন জানি মনে হল একটা বড়লোকিও গোসল দেয়ার জন্য তাই পানি পূর্ণ বাথটবে শরিরটা চুবিয়ে রাখলাম অনেকক্ষন।
ঘড়িতে তখন ১২টার উপরে বাজে আমরা সবাই হোটেলের রেষ্টোরেন্টে গিয়ে বসলাম, খাবারের মেন্যু দেখে আমারতো আনন্দফুর্তি সব বন্ধ হয়ে গেছে। কোন খাবারই হালাল না। গাইডকে বিষয়টা বলতেই কয়েক বার সরি বলে আমাকে এবং আরো দুইজন মালয় ফ্রেন্ডকে নিয়ে চল্ল অন্য রেষ্টোরেন্টে। খাবারের মানের দিক থেকে বলতে ১০/৬ দেয়া যাবে তবে এদের আপ্যায়ন ১০/১০ দেয়ার মত।
খাবারের পর্ব শেষ করে যখন হোটেল লবিতে আসলাম তখন ঘড়িতে ২টা ছুই ছুই করছে, অর্থাৎ ২০/২২ ঘন্টার ক্লান্ত একটা শরীর শুধু বিছানা খুজছে।
সবার কান্তিময় ঘুম ঘুম চেহারা দেখে গাইড জানিয়ে গেল, আজকে কোন আউটিং নেই সবাই বিশ্রাম নিতে। তবে বিকালে ইচ্ছে করলে নিজেদের মত করে আশেপাশে ঘুরে দেখা যাবে এবং আইডি কার্ড সাথে নিয়ে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসেও বেড়ানো যাবে। সবার হাতেই দুইটা করে টুকেন দেয়া হল, লিষ্টে থাকা যেকোন রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বিকালের নাস্তা এবং রাতের খাবারের জন্য। যত টোকেনই দেয়া হোক আমার জন্য একটা রেষ্টুরেন্টই আছে সুতরাং খাবারের পর্ব মাথা থেকে ফেলে এবার ঘুমের স্বর্গে যাওয়ার জন্য রুমের দিকে ছুটলাম।
হিম শীতল রুম, তুলতুলে নরম বিছানা। সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে ঘুমিয়ে পরলাম কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন ঘড়িতে ৫টা বেজে ৫০ মিনিটের মত, জটপট বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়েই ছুটলাম বাহিরে। শুনেছি বিকালের নিউক্যাসেল সিটি নাকি মনমুগ্ধকর একটা পরিবেশ তৈরী করে, আমাকে যে তা দেখতেই হবে...............
সিবিক পার্ক, প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে তাকে
হোটেলের বাহিরে আসতেন সিঙ্গাপুর থেকে আমাদের সাথে আসা, লিজা বল্ল নিউক্যাসেল মিউজিয়ামে (Newcastle Museum) যাবে। লিজার কথা ফেলে দেয়ার মত বুকের পাটা আমার কেন দুনিয়ার কোন ছেলেরই হবেনা। অনুগত ছেলের মত লিজার পিছনে পিছনে গেলেম। হাটার দূরত্ব তাই আপত্তি করারও অন কারন খুজে পেলাম না, কিন্তু মেয়েটার দূর্ভাগ্য বিকাল ৫টায় মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে গেছে।
মেয়েটার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেছে, আমি আবার সুন্দরি মেয়েদের মন খারাপ দেখলে কেমন অস্থির হয়ে উঠি। এখানেও ঠিক তাই হল, মেয়েটাকে আস্তে করে বল্লাম "চলুন সাগরের পার ঘেষে হাটি" কেমন লক্ষ্যি মেয়ের মত রাজি হয়ে গেল।
নিউক্যাসেল মিউজিয়ামের প্রবেশ পথ
আমরা দুইজন সিভিক লেন (Civic Ln) ধরে হাটছি সৈমুদ্রের কাছে যাওয়ার জন্য, রাস্তা ভুলে কোথায় গেলাম বুঝতে পারলাম না কিন্তু ডান দিকে বাক নিতেই দেখলাম সমূদ্র আমার দিকে মায়াময় চাহনিতে তাকিয়ে আছে। কি যে আনন্দ লাকছিল, স্বপ্নের অষ্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসেল সিটিতে লিজার মত একটা মেয়েকে পাশে নিয়ে সমুদ্র তীরে বসে থাকব এযে কল্পনারও অনেক উপরে।
স্থানীয় একজনের পরামর্শে প্রাইভেট একটা গাড়ি করে ১০ মিনিটের মধ্যেই দুইজন এসে ইয়ট ক্লাবে (Newcastle Cruising Yacht Club) নামলান, ছিমছাম সুন্দরভাবে সাজানো জায়গাটা বেশ ভালই লাগছিল। তবে এশিয়ান চোখে বড্ড বেমানান লাগছিল সাদা চামড়ার মেয়েদের একেবারে ছোট বিকিনি পরে সাফারিং করা বালুতে শুয়ে থাকা......................
ইয়ট ক্লাবে সারি সারি সাজানো বোট
১৩০ অষ্ট্রেলিয়ান ডলার দিয়ে আমরা দুইজন একটা বোট ভাড়া নিলাম ১ ঘন্টার মত সাগরে বেড়ানোর জন্য, অনেক অভিজ্ঞ চালক আমাদেরকে খুব সুন্দর ভাবেই সাগরের তীর ঘেষে নিয়ে চল্লেন। সাগরের ভিতরে যেতেই মনে হল আমি ভয় পাচ্ছি, ভাবলাম মেয়েটার সাথে টুকটাক কথা বলি তাখলে একটু সাহস পাব কিন্তু মেয়েটা ভয়ে চোখ মুখ বন্ধ করে রেখেছে। দুজনেই চালককে বল্লাম সাগরের তীর ঘেষে চলার জন্য, উনিও তাই করলেন। অনেকটা সময় নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে আমাদের দুইজনকে নবিস লাইট হাউজের (Nobbys Lighthouse) সামনে নামিয়ে দিলেন। যদিও এখানে নামার কোন নিয়ম নেই তারপরও উনি নামিয়ে দিলেন বোটে থাকা লেডারের সাহায্যে।
সন্ধ্যা শেষে রাত্র হয়ে গেছে, লাউট হাউজ থেকে মানুষগুলি প্রায় চলে যাচ্ছে কিন্তু আমরা মাত্র আসলাম। দুইজন লাইট হাউজের উপরে আসলাম, ভালই লাগছিল পরিবেশটা একেবারেই নিরব শুধু সাগরের ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ গুলি একটু একটু শব্দ সৃষ্টি করে যাচ্ছে মাঝে মাঝে ক্যামেরার ক্লিকের শব্দ আসছে।
সামনে তাকালে শুধু পানি আর পানি, পিছনে এব্রু থেব্রু রাস্তা তারই পাশ দিয়ে বালুর মাঝে গজিয়ে উঠা নাম না জানা কিছু সবুজ বৃক্ষ। মন জয় করার মত একটা জায়গা.............
আমি মেয়েটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাম, শুনেছি অন্যরকম সুন্দর যায়গাতে বেড়াতে আসলে নাকি মেয়েরা খুটখাট করে প্রেম নিবেদন করে বসে। যদি এমন একটা সুযোগ আমার কপালে থাকে তাইলে নিউক্যাসল আমাকে সব দিক থেকে পরিপূর্ন করে দিল।
এমনিতেই তাপমাত্রা অনেক কম তারউপরে দুজনেই নরমাল টি-শার্ট পরে এসেছি, সাগরের লোনাপানির বাতাস শরীর জমে আসার অবস্থা হচ্ছিল। রাত্র ১০টার কিছু সময় পর দুজন হোটেলের দিকে যাত্রা করছি, পথে "রক লোবষ্টার রেষ্টুরেন্টে"রে (The Rock Lobster Restaurant) ডিনার করে হোটেলে ফিরি..........
রক লোবষ্টার রেষ্টুরেন্ট
রক লোবষ্টার রেস্টুরেন্টে জ্বিবে জল এনে দেয়ার মত একটা মেন্যু
হোটেলে এসেই গাইডের কাছ থেকে আগামী কালের বিস্তারিত বিবরন নিলাম, সকাল ৮টায় আমাদের যাত্রা শুরু হবে। সারাদিন সিডনিতে থাকব, ওপেরা হাউজ থেকে শুরু করে হার্ভার্ড ব্রিজেই কাটবে একটা দিন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে হার্ভার্ড ব্রিজ ওপেরা হাউজ, অনেকদিনে স্বপ্নটা সত্যি হতে যাচ্ছে।
সিডনির ওপেরা হাউজ
হার্ভার্ড ব্রিজ
সিডনির সারাটা দিন নিয়ে অন্য একদিন লেখব।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৪৬