somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে মুসলমানঃ উত্থান ও পতন পর্ব-১৬

১৪ ই জুন, ২০১০ রাত ২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জ্ঞানের রাজ্যে উত্থানের কারনঃ দ্বিতীয় পর্ব
জিপি টু সামহ্যোয়ারের এই ইঁদুর-বেড়াল খেলা আর ভাল লাগছে না! রাত দুইটা-আড়াইটার আগে কোনদিন ঢোকা যায় না! নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া প্রক্সি ব্যবহার করতে ভাল লাগে না! বুঝতে পারছি না যে, আমরা আমাদের মাথাটা কার কাছে বেচলাম? জিপির কাছে? নাকি সামহ্যোয়ার কর্তৃপক্ষের কাছে! এরপর হতে আর পোষ্ট দেব কীনা ভাবছি। :(:(


শহরকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চার আলোচনা দিয়েই শেষ হয়েছিল আগের পর্বটি। এ পর্বে থাকছে সেই সব পরমতসহিষ্ণু পৃষ্ঠপোষক, বিশেষ করে খলিফা এবং সম্রাটদের কথা যাঁদের উদারনৈতিক সাহায্য-সহযোগিতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা কেমন করে এক অপরিমেয় গতিবেগ লাভ করে, তার আলোচনা। সে আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে মুহাম্মাদের(স) মৃত্যুর(৬৩২ খৃষ্টাব্দ) পর থেকে চালু হওয়া ইসলামী খেলাফতের দায়িত্বভার একে একে যাঁদের উপর ন্যস্ত হয়েছিল(কিংবা যাঁরা এ গুরুভার নিজ উদ্দ্যোগেই গ্রহন করেছিলেন), তার একটি সংক্ষিপ্ততম ইতিহাস জেনে নেয়া আবশ্যক।

প্রথমেই আবুবকর(রা) এবং তারপর উমর(রা), উসমান(রা) এবং আলীর(রা) উপর একে একে খেলাফতের দায়িত্বভার ন্যস্ত হয়েছিল। এই চারজন একত্রে ‘খোলাফায়ে রাশেদুন’ বা সত্যাশ্রয়ী খলিফাগণ নামে পরিচিত। তাঁদের শাসনকাল ছিল ৬৩২ খৃষ্টাব্দ থেকে ৬৬১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। তাঁদের সময়ে আরব উপদ্বীপে ইসলাম সুসংহত হওয়ার পাশাপাশি আজারবাইজানের সীমানা থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত এ রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তৃত হয়। শুরুতে এর রাজধানী মদীনায় প্রতিষ্ঠিত হলেও শেষদিকে তা কুফায় স্থানান্তরিত হয়।

৬৬১ খৃষ্টাব্দে মুয়াবিয়ার(রা) হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খেলাফত এবং রাজধানী চলে যায় তাঁর ক্ষমতার উৎসভূমি দামেস্কে। সে সময় হতে ৭৫০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এ বংশের শাসন চলে। এ সময়ে রাষ্ট্রের সীমানা ভারতবর্ষের সিন্ধু ও চীন সীমান্ত হতে শুরু হয়ে উত্তর আফ্রিকার আরো গভীরে(আজকের মরক্কো পর্যন্ত) এবং ভূমধ্যসাগরের ওপারে স্পেন(Al-Andalus: الأندلس‎) হয়ে ফ্রান্সের সীমান্ত পর্যন্ত(পীরেনিজ পর্বতমালা) বিস্তৃত হয়। সত্যিকার অর্থে, উমাইয়া খলিফারাই ছিলেন মুসলামানদের অধিকারে থাকা বৃহত্তম সম্রাজ্যের সর্বশেষ একক নেতৃত্বধারী। তাঁদের পরে আর কোন খলিফাই এত বড় সম্রাজ্যের অধিকারী হতে পারেন নি। আয়তনের হিসেবে এ রাষ্ট্রের অধিকৃত ভূমির পরিমান ছিল প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। মোট চৌদ্দ জন খলিফা প্রায় নব্বই বছর ধরে এ বিশাল রাজত্বের ভার সামলান। এদের মাঝে আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান(عبد الملك بن مروان‎; ৬৮৫-৭০৫), আল-ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিক(الوليد بن عبد الملك‎; ৭০৫-৭১৫) এবং উমর ইবন আব্দুল আজিজ(عمر ابن عبد العزيز‎; ৬৮২-৭২০) ছিলেন শ্রেষ্ঠতম।

উমাইয়া সম্রাজ্যঃ তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্রাজ্য(৭৫০)

৭৫০ খৃষ্টাব্দে এক বিদ্রোহের মাধ্যমে দুই ভাই আবুল-আব্বাস আস-সাফ্‌ফাহ এবং আল-মনসুর উমাইয়াদের ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আব্বাসীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমতাচ্যুত উমাইয়া বংশের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়। কেবল মাত্র আবদুর রহমান নামে এক সাহসী যুবক আল-আন্দালুসে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং কয়েক বছর পরে সেখানে উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করেন যার রাজধানী ছিল কর্দোভা নগরীতে। অন্যদিকে, আব্বাসীয়রা তাঁদের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন বাগদাদে এবং সেখান হতেই আন্দালুস বাদে অবশিষ্ট ইসলামী বিশ্ব শাসন করতে থাকেন। মাঝখানের ৫৬ বছরের(৮৩৬-৮৯২) জন্য রাজধানী সামারাতে(Sāmarrā: سامَرّاء‎) সরিয়ে নেয়া হলেও পরবর্তীতে এটিকে আবার বাগদাদে নিয়ে আসা হয় এবং এর পর হতে ১২৫৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে এটিই ছিল আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী। এ বংশের শ্রেষ্ঠতম খলিফা হারুন আল-রশীদৢ(هارون الرشيد; ৭৮৬-৮০৯) এবং আল-মা’মুন(ابوجعفر عبدالله المأمون; ৮১৩-৮৩৩) এখানেই বসেই মুসলমানদের বিজ্ঞানে উৎকর্ষের পেছনের প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন।

উন্নতির চুড়োয় থাকাকালীন আব্বাসীয় সম্রাজ্য(৮০৯)

কিন্তু, আল-মা’মুনের পর থেকেই এই বংশের শক্তি হ্রাস পেতে থাকে এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের উপর নিয়ন্ত্রন হ্রাস পেতে থাকে। বিশেষ করে আল-মুতাওয়াক্কিলের(المتوكل على الله جعفر بن المعتصم; ৮৪৭-৮৬১) পর একদিকে যেমনি আফগানিস্তান, খোরাসান, মিশরে একের পর এক শক্তিশালী স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে আর অন্যদিকে তেমনি সেলজুক(سلجوق :Saljūq) নামে একটি তুর্কী সেনাদলের হাতে খলিফারা জিম্মি হয়ে পড়েন। শুরুতে উক্ত রাজ্যসমূহ খলিফাদের প্রতি নামমাত্র আনুগত্য দেখালেও দিনে দিনে তারা সে বন্ধনও ছিন্ন করে ফেলে। এক পর্যায়ে ৯০৯ খৃষ্টাব্দে মিশরের কায়রোকে রাজধানী করে শী’আ সমর্থিত ফাতেমীয় রাজবংশের আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আল-মাহ্‌দী বিল্লাহ(عبد الله بن الحسين المهدي; ৯০৯-৯৩৪) নিজেকে খলিফা ঘোষনা করেন। ওদিকে, আল-আন্দালুসে আবদুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া রাজবংশও ততদিনে যথেষ্ট শক্তিমত্তার অধিকারী হয়েছে এবং সেখানে ৯২৯ খৃষ্টাব্দে তৃতীয় আবদুর রহমান(عبد الرحمن الثالث; ৯১২-৯৬১) নিজেকে খলিফা ঘোষনা করেন। ১০৩১ খৃষ্টাব্দে এঁদের এবং ১১৭১ খৃষ্টাব্দে ফাতেমীয়দের পতন হলেও সেলজুকদের সাহায্য নিয়ে আব্বাসীয়রা বাগদাদে বসেই খেলাফত পরিচালনা করছিলেন। পরবর্তীতে ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের সেনাবাহিনীর হাতে বাগদাদ নগরী ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর তিন বছর ইসলামী বিশ্ব খলিফাহীন ছিল। ১২৬১ খৃষ্টাব্দে মিশরের ক্ষমতাসীন অপর তুর্কী বংশ মামলুকরা(Mamluk :مملوك) তাঁদের রাজধানী কায়রোতে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত আব্বাসীয়দের মাঝে জীবিত আল-মুন্‌তানসির(১২৬১-১২৬২) কে নিয়ে এসে খলিফা পদে অধিষ্ঠিত করেন। সে সময় হতে ১৫১৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত আব্বাসীয়রা নিয়মতান্ত্রিক এবং পদসর্বস্ব খলিফা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

বিভিন্ন স্বতন্ত্র রাজবংশে বিভক্ত আব্বাসীয় সম্রাজ্য(৯৫০)

ইতিমধ্যে এশিয়া মাইনরে(আনাতোলিয়া) উসমান(১২৯৯-১৩২৫) নামে এক তুর্কী সামন্ত তার অধিকৃত এলাকায় শক্তি সঞ্চয় করে সেলজুক তুর্কের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেন। তিনি এবং তাঁর সন্তানেরা একদিকে প্রাচীন বাইজান্টাইন সম্রাজ্যের শেষ শক্তিটুকু শুষে নিচ্ছিলেন আর অন্যদিকে সেলজুক তুর্কদের কাছ হতে মুসলিম অধিকৃত এলাকা সমূহ দখন করে নিচ্ছিলেন। অবশেষে, ১৫১৭ খৃষ্টাব্দে তাঁর অধ্বস্তন নবম পুরুষ প্রথম সেলিম(سليم اوّل; ১৫১২-১৫২০) মক্কা-মদীনা শহরদ্বয় দখল করে নিজেকে খলিফা ঘোষনা করেন। এর সাথে সাথে ৭৫০ হতে শুরু হয়ে প্রায় সাড়ে সাতশ’ বছরে মোট ৫৪ জন আব্বাসীয় খলিফার(যাঁদের ৩৭ জন ছিলেন বাগদাদে) খেলাফত শেষ হয়। শুরু হয় উসমানীয়(অটোম্যান) খলিফাদের যুগ যার রাজধানী ছিল প্রাচীন বাইজান্টাইন সম্রাজ্যের রাজধানী কন্সট্যান্টিনোপল, মুসলমানদের হাতে আসার পর যার নাম হয় ইস্তাম্বুল। সেসময় হতে শুরু করে ১৯২৪ সালে কামাল আতাতূর্ক কর্তৃক খেলাফত ব্যবস্থার উৎপাটনের আগপর্যন্ত মোট ২৯ জন খলিফা উসমানীয় খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহন করেছিলেন। উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিন-পশ্চিম ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার প্রায় ৭২ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের এই সম্রাজ্য ছাড়াও একই সময়ে পারস্যে সাফাভীদরা এবং ভারতে মুঘলরা প্রবল প্রতাপে শাসন পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন। অবশ্য, ইতিমধ্যে ফ্রাংকো-স্পেনীশ মিলিত বাহিনীর হাতে আল-আন্দালুসে মুসলমানদের শাসনের অবসান(১৪৯২ খৃষ্টাব্দ) ঘটেছে।

মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত সম্রাজ্যসমূহের উত্থান ও পতনের ইতিহাসের এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে, মুসলমানদের একাধিক শক্তিশালী সম্রাজ্য প্রায় এক সহস্রাব্দ সময় ধরে বিশ্বের বুকে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল যদিও প্রথম শতাব্দীটুকু ছাড়া আর কখনোই তাঁরা একক নেতৃত্বের অধীনে ছিলেন না এবং নেতৃত্বের এই চলমান দ্বন্দ্বে অনেক রক্তপাত হয়েছে, সম্রাজ্যের উত্থান ও পতন ঘটেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরণের ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু, বিরল হচ্ছে সেটাই, যে কাজটি এই সব মুসলমান শাসকেরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে করেছিলেন। মুষ্টিমেয় ক’জন ব্যতিক্রম ছাড়া এই শ’খানেক খলিফা, তাঁদের অধিনস্ত কর্মচারী ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাবৃন্দ এবং বিভিন্ন সম্রাজ্যের আমীর-সম্রাটগণের সকলেই ছিলেন বিজ্ঞান, শিল্প, চিত্রকলা প্রভৃতির একান্ত পৃষ্ঠপোষক এবং সমঝদার। ফলে, এ সবের উন্নতিকল্পে তাঁদের উদারতা সারা বিশ্বের জন্যই অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। এক সহস্র বছরের কয়েক সহস্র পৃষ্ঠপোষকের বর্ণনা দেয়া কতটা দুঃসাধ্য- তা সহজেই অনুমেয়। তা সত্ত্বেও, যাঁদের কথা একেবারে না বললেই নয়, তাঁদের অবদান নিয়ে আলোচনা রাখার চেষ্টা করা হবে।

খোলাফায়ে রাশেদুনের মাঝে প্রথম তিনজনের প্রাথমিকযুগের শাসনকেন্দ্রিক ব্যস্ততা এবং শেষদিককার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতিই সম্ভবতঃ বিজ্ঞান এবং এর উন্নয়নের দিকে তাঁদের নজর দেয়ার অবকাশ দেয় নি। তাই বলে, তাঁরা জ্ঞানার্জনের বিরোধী ছিলেন না বরং ইসলাম পূর্ববর্তী আরবের স্বল্প সংখ্যক লেখাপড়া জানা ব্যক্তিদের মাঝে এঁরাও গণ্য হতেন। এরপরেই আসেন চতুর্থজন আলী ইবন্‌ আবুতালিব(রা)। তাঁর সাড়ে পাঁচ বছরের সংঘাতবহুল শাসনামলের জ্ঞানচর্চার অবকাশ কতটা ছিল তা সহজেই অনুমেয়। এর মাঝেও তিনি আরবী ব্যাকরণ, কাব্য, দর্শন এবং আলকেমীর চর্চা করেছেন বলে জানা যায়। তাঁর বক্তৃতা(খুতবা), পত্রাবলী ইত্যাদির সংকলন ‘নাজহুল বালাগা’ তাঁর অসাধারণ জ্ঞানের স্বাক্ষর বহন করে। এছাড়া, তাঁর সময়েই কুফা নগরী ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এতে জ্ঞানী-গুনীদের আগমন ঘটতে শুরু করে, যাঁরা খলিফা আলীর(রা) উদার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।

উমাইয়া আমলের শুরুর দিকে মুয়াবিয়া(রা) এবং তাঁর পরবর্তী ইয়াজিদের উত্তাল শাসনামলে বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতার তেমন কোন নজির দেখা যায় না। এর পরেই মারওয়ান ইবন্‌ আল-হাকাম এবং উমর ইবন আবদুল আজীজ চিকিৎসাবিজ্ঞানের গ্রন্থসমূহ অনুবাদে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। এ সময়েই উমাইয়া রাজপুত্র খালিদ ইবন্‌ ইয়াজিদ(?-৭০৪) আলকেমীর চর্চায় এগিয়ে আসেন। সে হিসেবে খালিদকে মুসলমানদের মাঝে প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবেও অভিহিত করেন কেউ কেউ। এছাড়া শী’আ সম্প্রদায়ের ষষ্ট ইমাম জাফর আল-সাদিক(جعفر بن محمد الصادق‎; ৭০২-৭৬৫)ও এসময় আবির্ভূত হন। শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে ক্ষমতাসীন উমাইয়া এবং আব্বাসীয় উভয়ের বিরোধী হওয়ায় তিনি তেমন কোন পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও ইসলামী আইনশাস্ত্র এবং দর্শনচর্চার পাশাপাশি তিনি আলকেমীরও চর্চা করেন, যা তাঁর ছাত্র জাবির ইবন হাইয়ানকে উদ্বুদ্ধ করে। এই আমলে এর চেয়ে বেশী মুসলমানদের তেমন কোন অবদান সাধারন চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু, একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় যে, পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ব্যাপী মুসলমানরা বিজ্ঞানের জগতে যে প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করেছেন, তার মঞ্চ প্রস্তুতকরনের কাজটিই হয়েছে এ সময়ে। প্রথমতঃ আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান তাঁর শাসনামলে দুইটি দারুন কাজ করেন। সমগ্র রাষ্ট্রের সরকারী ভাষা আরবী হিসেবে নির্ধারন করে দেন, যার ফলশ্রুতিতে এ বিশাল সম্রাজ্যের বিভিন্ন ভাষাগত পার্থক্যের বাঁধ ভেঙে সকলেই আরবী ভাষা শিক্ষায় রত হন এবং কালক্রমে তা অন্ততঃ পাঁচ শতাব্দীব্যাপী বিজ্ঞানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া, তিনি সমগ্র রাষ্ট্রের জন্য একই ধাতব মূদ্রার প্রচলন করেন, যা সন্দেহাতীতভাবেই তৎকালীন বিজ্ঞানীদের ধাতুবিজ্ঞান(Metallurgy) এবং এর ভেতর দিয়ে রসায়ন চর্চার দিকে ঠেলে দেয়। দ্বিতীয়তঃ আব্বাসীয় আমলের শুরুর দিকে যে সকল বিজ্ঞানী অনুবাদ সহ অন্যান্য কাজ করেছেন, তাঁদের জীবন এবং শিক্ষা-দীক্ষার সূচনা উমাইয়া আমলেই হয়েছে। জ্ঞানার্জনের নিষ্কন্টক পথে হেঁটে এ সময়ের শিক্ষার্থীরাই আব্বাসীয় আমলে বিজ্ঞানের শিক্ষকরূপে আবির্ভূত হন।

উমাইয়া শাসনের অবসান এবং আব্বাসীয় শাসনের শুরুর দিক থেকেই মুসলমানদের মাঝে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার এক যুগের সূচনা হয়। খলিফা আল-মনসুর বাগদাদ নগরীকে স্বীয় সম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে নির্মানের সাথে সাথে একে বিশ্বের বুকে এক অনন্য মর্যাদায় তুলে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন। তারই অংশ হিসেবে এ নগরীকে অনুপম স্থাপত্যে সজ্জিত করার পাশাপাশি জ্ঞানীদের বাসস্থান হিসেবে গড়ে তুলতে ‘খিজানাত আল-হিক্বমা’ নামে একটি রাজকীয় লাইব্রেরী(পাঠাগার) প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে বসেই জ্ঞানচর্চা শুরু করেন গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। ইয়াকুব ইবন বাত্‌রিক, ইব্রাহিম আল-ফাজারী, মুহাম্মাদ আল-ফাজারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন আল-মনসুর নিজেই। তাঁর নিজের সেক্রেটারী আল-মুকাফফাও এখানে বসেই একাধিক গ্রীক গ্রন্থের অনুবাদ সম্পন্ন করেন। শুধু তাই নয়। আল-মনসুর নিজ উদ্দ্যোগে জুন্দীশাপুরের চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিখ্যাত একাডেমীর পরিচালক জুরজিস্‌ বখত্‌ইয়াসুকে বাগদাদে নিয়ে এসে ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগের পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানে গ্রীক এবং ফারসী গ্রন্থসমূহের অনুবাদের দায়িত্ব দেন। এর দুই পুরুষ আগে থেকেই বখত্‌ইয়াসু পরিবার চিকিৎসাবিজ্ঞানে অত্যন্ত বিখ্যাত ছিল এবং জুরজিসের পর হতে এ পরিবারের অন্ততঃ দশজনের নাম পাওয়া যায় যাঁরা বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। আগাগোড়া খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী এই পরিবার প্রায় ৩৫০ বছর ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন।

উপরে যা কিছু বর্ণিত হলো তা প্রকৃতপক্ষে পৃষ্ঠপোষকতার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়। সম্পর্কে পিতা-পুত্র দুই আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশীদ এবং আল-মা’মুন একে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে যান, যার তুলনা ইতিহাসেই বিরল। তাঁদের দেখানো পথ অনুসরন করেই বিজ্ঞানের চর্চায় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার ধারা মুসলমানদের একটি জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়। তবে, সে সবই আসছে পরের পর্বে।

চলবে.....
আগের পর্বগুলোঃ
১. ভূমিকা পর্ব
২. বিজ্ঞানের দর্শন
৩. প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাস
৪. মৌলিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৫. ব্যবহারিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান
৬. রসায়নবিজ্ঞানে অবদান
৭. আলোকবিজ্ঞানে অবদান
৮. জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান- প্রথম পর্ব
৯. জ্যোতির্বিজ্ঞানে অবদান- দ্বিতীয় পর্ব
১০. গণিতে অবদান
১১. ইসলামে বিভিন্ন দর্শনের উদ্ভব ও বিকাশ
১২. ইসলামে বিভিন্ন সম্প্রদায়গত দর্শনের সারসংক্ষেপ
১৩. মু’তাজিলা দর্শন এবং স্বাধীন দার্শনিকদের উদ্ভব
১৪. মুসলমান দার্শনিকেরা
১৫. জ্ঞানের রাজ্যে উত্থানের কারনঃ প্রথম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১০ রাত ৮:১২
২৩টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×