মাথা খারাপের দশা। এক অংকেই দিন শেষ!
এরকম পরিস্থিতিতে একজন বিজ্ঞানী আল-খোয়ারিজমি(৭৮০-৮৫০) এসে বদলে দিলেন দৃশ্যপট। বললেন, মাত্র দশটি চিহ্নের সাহয্যে শুন্য হতে অসীম পর্যন্ত সকল সংখ্যাকে সহজে প্রকাশ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে তাঁর লেখা বইটির নাম হলো “অন ক্যালকুলেশন অভ হিন্দু নিউম্যারালস্ (ল্যাটিনঃ Algoritmi de numero Indorum)”; মূল আরবী নামটি আমার জানা নেই । মূল ধারনাটি তিনি নিলেন এরও আগের হাজার বছর ধরে চালু ভারতীয় উপমহাদেশের গাণিতিক সিস্টেম থেকে আর এর সাথে দশমিক সংখ্যার ব্যবহার যোগ করে একে আরো উন্নত করে তুললেন। তারই ফলশ্রুতিতে আজ একটা ছোট্ট বাচ্চাও উপরের যোগটি এভাবে করে।
যাই হোক, আল-খোয়ারিজমির তিরোধানের প্রায় এক শতাব্দী জন্ম নিলেন আল-বিরুনী (৯৭৩-১০৪৮); ভারতবর্ষের ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর লেখা ‘তাহ্কিকে হিন্দ’ গ্রন্থই যাঁকে অমরত্ব দিয়েছে, যদিও কর্মের পরিধি ও প্রভাব হিসেব করলে এটি তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ নয়! হ্যাঁ, তিনি আবু রায়হান মুহাম্মাদ ইবন্ আহমাদ আল বিরুনী (ابوریحان محمد بن احمد بیرونی)।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথে তাঁর আগের পথিকদের চাইতে তিনি একটি সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান করছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্রীক, পার্সি ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থগুলোর এক বিরাট অংশ ততদিনে আরবীতে অনূদিত হয়ে গিয়েছে। আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী বাগদাদকে কেন্দ্র করে আগের দুই শতক ধরে চলা এ বিশাল কর্মযজ্ঞকে ইতিহাসে অনুবাদ আন্দোলন(Translation Movement) নাম দেয়া হয়েছে। যাই হোক, আল-বিরুনীর টেবিলে তখন আক্ষরিক অর্থেই গ্রীক জ্যামিতির ধারনা আর ভারতীয় গাণিতিক পদ্ধতির উপর লেখা ও অনূদিত বইপত্র। তিনি এই দুইয়ের মিশেলে মানবসভ্যতাকে উপহার দিলেন এক যুগান্তকারী আবিষ্কার- "বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে গণিতের প্রয়োগ।"
যেমনঃ তিনি জ্যামিতি ও গণিত ব্যবহার করে প্রায় নিঁখুতভাবে হিসেব করে ফেললেন পৃথিবীর ব্যাসার্ধ। এজন্য তিনি ব্যবহার করলেন একটি সাধারন অ্যাস্ট্রল্যাব (Astrolabe)। এর সাহায্যে সাধারণ দৃষ্টিশক্তি দিয়েই কোণ (Angle) নির্ণয় করা যায়।
এরপর তিনি একটি পাহাড় খুঁজে বের করলেন যার পাদদেশ সমতল। এবার, ঐ অ্যাষ্ট্রল্যাবের সাহায্যে পাহাড়ের পাদদেশের দুইটি সরলরৈখিক বিন্দু হতে পাহাড়ের শীর্ষের উন্নতি কোণ নির্ণয় করলেন। ফলে সহজেই নির্ণীত হলো পাহাড়ের উচ্চতা , h।
এবার তিনি পাহাড়ের শীর্ষে উঠলেন এবং অ্যাস্ট্রল্যাবটির সাহায্যে দিগন্তের (সাধারণ চোখে যেখানে আকাশ মাটিকে স্পর্শ করে) সাথে ঐ শীর্ষের অবণতি কোন হিসেব করলেন।
এবার হিসেব একেবারেই সোজা।
সূত্রে বসিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল পৃথিবীর ব্যাসার্ধ,R। আজকের দিনে ত্রিকোনমিতির নূণ্যতম জ্ঞানের অধিকারীও এ পরীক্ষা এবং হিসেব করে দেখতে পারেন।
আল-বিরুনী অনেকবার এ পরীক্ষা চালান এবং তাঁর নির্নীত মান আসে মোটামুটি ৬৩৩৯ কিলোমটার, যা আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের হিসেবের (৬৩৭১ কিলোমিটার) প্রায় কাছাকাছি; ভুলের পরিমান ১% এর চেয়েও কম! অবিশ্বাস্য!
বিজ্ঞানের উত্তরণে আল-বিরুনীর অবদান অনেক। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, নৃবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস সহ বিজ্ঞানের অনেকগুলো শাখাতেই তাঁকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। তাঁকে বলা হয় নৃবিজ্ঞানের পথিকৃত, ভূ-তত্ত্বের(Geodesy) জনক, প্রথম ভারতবিদ (Indologist)।
কিন্তু, এ সব কিছু ছাড়িয়ে তাঁর যে অবদানটি বিশ্বসভ্যতাকে এগিয়ে দিল অনেক দূর তাহলো, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রমানে এবং সমস্যা সমাধানে গণিতের সফল প্রয়োগ। তিনিই সম্ভবতঃ প্রথম বিজ্ঞানী যিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, গণিতের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বচরাচরকে(Universe) সবচেয়ে ভালভাবে প্রকাশ করতে পারব।
শেষ কথাঃ আল-বিরুনীর মত অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীই বিজ্ঞানের জগতে একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু, এর অনেক কিছুই বিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে। কেন? তার উত্তর দেব, অন্য কোন দিন।
অনুপ্রেরনাঃ -ম্যাভেরিকের এই পোষ্ট
তথ্যসূত্রঃ
১. Science & Islam, A Documentary by BBC.
২. আল-বিরুনী-উইকিপিডিয়া
৩. ভূ-তত্ত্বের ইতিহাস- উইকিপিডিয়া
৪. Muhammad Ibn Musa Al-Khwarizmi – All Experts
৫. আল-বিরুনী- অ্যান্সাইক্লোপিডিয়া ইরানিকা