অষ্ট প্রহর যাপিত জীবনের গল্প!
ধরে নিন, সারাদিনের ঝামেলা-অফিস কিংবা ক্লাস শেষ করে আপনি বাসায় পৌঁছেছেন। প্রচন্ড ক্লান্ত-অবসন্ন। এমন সময় সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে উদোম গায়ে একখন্ড গোল করে সেলাই করা বস্ত্রখন্ডের মাঝে কোমর থেকে নিচের অংশকে জড়িয়ে নিলেন। ওহ্, কী আরাম! পুরো শরীরের উপর থেকে নিচ কিংবা নিচ থেকে উপর জুড়ে যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি, এক শান্তির সুবাতাস বয়ে গেলো! জ্বী, হ্যাঁ, আমি লুঙ্গীর কথাই বলছি।
বাঙ্গালীর জীবন, লুঙ্গী ছাড়া অচল! গোটা দুনিয়া চষে বেড়ান, নানান দেশের নানান সংস্কৃতির পোশাক পরেন, কিন্তু আমি লিখিত দিতে পারি, লুঙ্গীর চেয়ে আরামের কোন পোশাকই আপনি পাবেন না। এ জন্য দার্শনিক বা পর্যটক হবার প্রয়োজন নেই; বরং লুঙ্গীপরুয়া যে কোন ব্যক্তিই একবাক্যে এ কথার স্বীকৃতি দেবেন। তারপরেও যদি উদাহরণ চান, তাহলে ব্লগে বহুদিন পূর্বের লুঙ্গী সংক্রান্ত বাঙ্গালীর টনটনে আত্মসম্মানবোধ ও লুঙ্গী শীর্ষক পোষ্টটি দেখে আসুন। অনেক উদাহরণ পেয়ে যাবেন। এছাড়া ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বাসার সেই জাপানী অতিথির অকৃত্রিম লুঙ্গীপ্রেমের গল্প তো বোধ হয় অনেকেই জানেন!
আমার এক পিচ্চি কাজিনের কথা বলি? ওর জন্ম-বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডেই। সাত বছর বয়েসে প্রথম পিতৃভূমি বাংলাদেশে আসে। আমার সাথে সেই রকম খাতির! এক দিন আমাকে লুঙ্গী পরা অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে বলে, "I've never seen a man wearing skirt!" যখন ওকে বললাম যে আমাদের এখানে এটাই নিয়ম, বিশ্বাস করে না। পরে দুপুরবেলায় ওকে নিয়ে গেলাম পুকুরঘাটে। ওখানে লুঙ্গী পরা অনেক মানুষ দেখে তবেই ওর বিশ্বাস হলো। যদিও নতুন প্রশ্ন, "I've never seen a swimming pool with grasses!" যাক, সে অন্য প্রসংগ।
আধুনিক সমাজের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশার চাপে পড়ে এখন আর আগের মত লুঙ্গী পরতে পারি না, শুধু ঘুমানোর সময়টা এর জন্য বরাদ্দ। (কবে যে এ দেশের অফিস-আদালতে লুঙ্গীর প্রচলন হবে!) মনে পড়ে যায় শৈশব-কৈশোরের সেই সব স্বর্নালী দিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা লুঙ্গী পরা। কত বহুমুখী ব্যবহার! বাজারে যাই লুঙ্গী পরে। খেলতে নামি তাও লুঙ্গী! দৌড়াতে অসুবিধা? কোন সমস্যা নাই। হাফপ্যান্টের মত করে বেঁধে নাও (আমাদের দেশীয় ভাষায় একে "গোস্ মারা' বলে)। গাছ বাইতে গেলে একই কারবার! গাছ না বাইতে পারলেও সমস্যা নেই, আম-জাম-বরই যাই পাড়ি সবই তো লুঙ্গীর প্যাঁচে করে নিয়ে যাবো! দাওয়াত খেতে গেলে তো কথাই নেই! গিঁট্ঠু যত আলগা করি ততই পেটে খাওয়ার জায়গা বাড়তে থাকে! আরো কত রকমের ব্যবহার যে করেছি! কিছু কিছু মনে করতে পারছি না, আর অল্প কিছু মনে থাকলে ও জনসমক্ষে বলা যাচ্ছে না; বুদ্ধিমানেরা বুঝে নিন!
আজকাল মনে বড় দুঃখ হয়! এফ.এম-ডিজুস্ প্রগতির ছেলে-ছোকরারা লুঙ্গীর কথা শুনলে নাক সিঁটকায়। হাফপ্যান্ট-থ্রি কোয়ার্টার পরে আর লুঙ্গীকে বলে "গাইঁয়া-খ্যাত-আনস্মার্ট"! মেজাজ গরম হয়ে যায়। আচ্ছা, বলুন তো বাঙ্গালির লুঙ্গির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন কে? ঠিক ধরেছেন; মাওলানা ভাসানী! কী এক নেতা! বেতের টুপি আর লুঙ্গী-পাঞ্জাবী পরা এই মানুষটি ছিলেন অত্যাচারী শাসক-শোষকের সাক্ষাৎ যম। বিশ্বের কোথায় না ঘুরেছেন তিনি! ভারতবর্ষ-চীন-ইউরোপ যেখানেই গিয়েছেন, সবখানেই এক পোশাক- লুঙ্গী! খুব বেশী আনস্মার্ট ছিলেন কি? আমি বলি, "আরে বাবা, গিঁট্ঠু খুলে যাবার ডরে লুঙ্গী পর না; ঠিক আছে, এসো শিখিয়ে দিই। নাহলে এতো ফালাফালি কোর না। প্যান্টের তলা ফাইট্যা যাবে!"
এবার লুঙ্গী বিষয়ক দুই-চারটা জ্ঞানের কথা কই। লুঙ্গী যে শুধু আমাদের দেশের পোশাক, তা কিন্তু না! পাশের দেশ মিয়ানমারের জাতীয় পোশাক এটি। ওরা অবশ্য একে "লোঙ্গৌই (Longyi)" বলে। আমাদের দেশে শুধুমাত্র পুরুষেরা (উপজাতীয় জনগোষ্ঠী অবশ্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লুঙ্গী পরিধান করে) এ পোশাক পরলেও সেখানে নারী-পুরুষ উভয়ই কিন্তু লুঙ্গী পরে। দেখেন না, এক অঙ সাঙ সুকী তো লুঙ্গী পরেই ওদের সামরিক সরকারের কলিজার পানি শুকিয়ে ফেলেছে; ভয়ে তো তাঁকে ঘর থেকেই বের হতে দেয়া হয় না, আজ কত বছর! ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আমাদের মতই লুঙ্গি পরা হয়, যদিও ধুতির দৌরাত্ব্যে এর প্রচলন একটু কম।
আর দক্ষিন ভারতে!? গেলে বুঝবেন লুঙ্গী কারে বলে, কত প্রকার ও কি কি? কত রঙ বেরঙের যে লুঙ্গী হওয়া সম্ভব তা শুধু তামিলনাড়ু, কেরালায় গেলেই দেখা যায়! আচ্ছা, বাদ দেন। অতদুর যেতে হবে না। কখনো এক-আধটা দক্ষিনী চলচ্চিত্র গলঃধরণ করার চেষ্টা (দেখতে কিংবা উপভোগ করতে বলছি না!) করুন! কপাল ভালো হলে এক গানের শুটিঙেই নায়কের পরনে অন্ততঃ এক ডজন বিভিন্ন ডিজাইনের লুঙ্গী দেখতে পাবেন! আর এই লুঙ্গী পরেই তিনি যেভাবে নায়িকা উদ্ধার, ভিলেনের সাথে মারপিট থেকে শুরু করে প্লেন চালনা পর্যন্ত করে ফেলেন, সত্যিই অবিশ্বাস্য। যাক, সে অন্য কথা।
তামিলনাড়ু-কেরালাতে লুঙ্গীকে বলে "মুন্ডু/মান্ডু (Mundu)" আর কর্নাটকে একে ডাকা হয় "কাইলী (Kaili)" নামে। আমাদের আরবদেশীয় ভ্রাতাগণের মধ্যে একমাত্র ইয়েমেনের ভ্রাতাগণ লুঙ্গী পরেন। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন "ফুতাহ্/মা'আয়িজ (Futah/Ma'awis)"। এছাড়া, আফ্রিকার সোমালিয়াতেও এক প্রকার লুঙ্গী পরা হয়। একে বলে "সারং (Sarong)", যদিও জানি না সম্প্রতি যে মহান(!) জলদস্যুবৃন্দ পরাক্রমশালী মার্কিনী জাহাজ বেদখলের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে তাদের পরনেও সারং ছিলো কীনা!
লুঙ্গী বিষয়ক আরো জ্ঞান আহরনের জন্য আপনি উইকিপিড্যার দ্বারস্থ হতে পারেন।
লুঙ্গী সংক্রান্ত বাংলা উইকিপিডিয়ার লিংক
লুঙ্গী সংক্রান্ত ইংরেজী উইকিপিডিয়ার লিংক
সবশেষে,আসুন একপলকে দেখে নিই একটি লুঙ্গী পরিধান পর্ব। যারা নতুন নতুন লুঙ্গী পরিধানে আগ্রহী তাদের জন্য এই কোর্স অতীব জরুরী।
১. লুঙ্গী সংগ্রহঃ প্রথমেই, নিজের পয়সাতে একটি লুঙ্গী কিনে আনুন। ধার করে ও সংগ্রহ করতে পারেন। তবে, কোর্সের পথিমধ্যে লুঙ্গীর মালিক কর্তৃক অহেতুক টানাটানিতে বেইজ্জতি হলে এই লেখক (প্রশিক্ষক) দায়ভার বহন করবে না! অতএব, কেনাই শ্রেয়।
২. পরিধানোপযোগীকরণঃ সংগৃহীত লুঙ্গী আগেকার দিনে সেলাই করতে হোত। কিন্তু, ডিজিটাল হাওয়ার এই যুগে সে প্রয়োজন নেই।; সেলাই করাই থাকে। (আমার এক অতিঘনিষ্ট বিত্লা বন্ধু তার বিবাহ-বাসরে সেলাই ছাড়া লুঙ্গী পরে প্রবেশে ইচ্ছুক; কেন, অভিজ্ঞরা বুঝে নিন।) যাই হোক, সেলাই যুক্ত কী সেলাই ছাড়া, লুঙ্গীটিকে অবশ্যই কড়া মাড়ে ধুয়ে শুকিয়ে নেবেন!
৩. উদ্বোধনঃ এবার, উদ্বোধনের পালা। এক এক করে আপনার দুটি পা'ই লুঙ্গীর ভেতরে গলিয়ে দিয়ে একে কোমর পর্যন্ত তেনে তুলুন। এর নাম বটম্-আপ্ (Bottom-Up) মেথড। টপ্-ডাউন্ (Top-Down) মেথড ও রয়েছে! আর তাহল, মাথার দিক হতে লুঙ্গীটিকে নিচে নামিয়ে দিয়ে কোমর পর্যন্ত আসার পর ধরে ফেলুন!
৪. গিঁট্ঠু প্রদানঃ এবার, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! কোমরের দিক হতে লুঙ্গীটিকে কষে একটি গিঁট্ঠু দিয়ে নিন। সাবধানতাবশতঃ দু’টি গিঁট্ঠুও দিতে পারেন। লুঙ্গীর সৌন্দর্য্যবর্ধণে কুচির ব্যবহারকল্পে অভিজ্ঞদের সহায়তা নিন। এছাড়া অতিরিক্ত সাবধানতা হিসেবে কোমরে একটি বেল্টও পরে দেখতে পারেন!
৫. মজবুতী পরীক্ষণঃ গিঁট্ঠু কতটুকু টেকসই হলো তা জানতে বাসায় আপনার ইবলিশতুল্য ভাগ্নে-ভাতিজাকে এত্তেলা পাঠান এবং তাকে কিছুক্ষনের জন্য আপনার লুঙ্গী ধরে ঝুলাঝুলি করতে বলুন। মজবুতীর বাস্তব প্রমান পেয়ে যাবেন। সাবধান! ভাগ্নে-ভাতিজা যেন বেশী মজা না পেয়ে যায়। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে আশে-পাশের বাসা হতে সে তার বধু-বান্ধব হায়ার করে এনে একযোগে ঝুলাঝুলিতে অংশ নিতে পারে!
৬. চুড়ান্ত পরীক্ষাঃ আর একটা মাত্র পরীক্ষা বাকী। আর সেটা হলো ঘুম-পরীক্ষণ। ঘুমাবার সময় আপনার লুঙ্গী কোথায় অবস্থান করে কোমরে না মাথায় তা সরেজমিনে পরীক্ষার ব্যবস্থা করুন। অপ্রস্তুত অবস্থা এড়াতে কোমরের মত করে লুঙ্গির নিচের দিকে ও একটি গিঁট্ঠু দিয়ে দিন।
৭. উর্ত্তীর্ণ সনদঃ এবার, উপরওয়ালার নাম নিয়ে লুঙ্গী পরা অবস্থাতেই রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ুন। লক্ষ্য করুন, পরিচিত কেউ আপনাকে "আবুল" কিংবা "মফিজ" সম্বোধনে ডাকছে কীনা! ডাকে নি!? যান, আপনি পাস্!**
** লুঙ্গী পরিধান সংক্রান্ত কোর্সটির মূল ধারনা জনৈক ব্লগারের নিকট হতে ধার করা। প্রাসঙ্গিক মনে হওয়াতে তাঁর অনুমতির অপেক্ষা না করেই যোগ করে দিলাম। তিনি আপত্তি জানালে নিঃসংকোচে মুছে ফেলা হবে
পর্যাপ্ত ও প্রাসঙ্গিক চিত্র সহকারে লুঙ্গী পরিধান পর্বটি দিতে পারলে আনন্দিত হতাম। কিন্তু নাফিস ইফতেখারের মত প্রতভাধর আমি নই মোটেও। সুতরাং, হাতে-কলমে জানতে সবসময়ই অভিজ্ঞ লুঙ্গীবিদের পরামর্শ অগ্রগণ্য।
আবোল তাবোল-৩ : (ব্লগীয় নাস্তিকতার স্বরূপ সন্ধান এবং একজন চরম আস্তিকের নাস্তিকতা বিশ্লেষন!)
আবোল-তাবোল-২ : এই নববর্ষে (ভালো লাগলে ভালো, না লাগলে নাই!)
আবোল তাবোল-১ (নোয়াখাইল্লা হোলা!)
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০০৯ ভোর ৪:০৫