অষ্টপ্রহরের যাপিত জীবনের গল্প!
প্রতিটি মানুষের জীবনের চলার পথ ও মঞ্জিল নির্ভর করে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নোত্তরের ওপর। চেতনে হোক কিংবা হোক অবচেতনে; সে নিজের জীবনের চলার জন্য এই প্রশ্নের উত্তর সমুহের মুখাপেক্ষী এবং এই উত্তরগুলোর উপরই তার সার্বিক জৈবিক কার্য্যক্রমের ভিত দন্ডায়মান। প্রশ্নগুলো হলো-
১. আমি কে?
২. আমি কোথা হতে এসেছি?
৩. কোথায় যাচ্ছি?
৪. এখানে (পৃথিবীতে) আমার কাজ কী?
প্রশ্নগুলোর উত্তর এক এক মানুষের কাছে এক একভাবে ধরা দেয়। আর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে ও বলা যায় যে, এ উত্তরের ভিন্নতার উপরই প্রাথমিকভাবে তৈরী হয়ে যায় মানবাত্মার ভিন্ন দু'টি পথ-আস্তিকতা আর নাস্তিকতা!
এতো গেলো জীবনাচরনের ওপর ভিত্তি করে আস্তিকতা আর নাস্তিকতার অবস্থান নির্ণয়। এবার, যদি ঐশ্বরিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখি, তাহলে বলা যায় যে, এক মহামহিম শক্তি বা স্বত্তা মানুষ সহ এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা- এই কথার বিরোধিতাকারীই নাস্তিক। আর এই তত্ত্বকে ঘিরে যে ব্যক্তি স্বীয় জীবনকে সাজায় সেই আস্তিক।
তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে নেমে এসে বাস্তবের জগতে পা দেবার আগে এ পর্যায়ে আরো কয়েকটি কথা পরিষ্কার করে নেয়া দরকার।
জন্মগতভাবেই আমি একজন প্রবল আস্তিক মানুষ; জীবনের কঠিন পথে এতোগুলো বছরের পথ চলাচলে আস্তিক-নাস্তিক অনেকের সাথেই ব্যক্তিগত পরিচয়-জানাশোনা বেশ গভীর পর্যন্ত গিয়েছে। আস্তিকতার বাইরে এখন অন্য কোন পথের কথা ভাবতে ও পারি না! তবে, কোন কোন নাস্তিক মানুষকে আমি অনেক আস্তিকের চাইতে ও বেশী পছন্দ করেছি এবং তা করেছি কেবলমাত্র তাঁর/তাঁদের প্রবল ও অনুকরণীয় সত্যানুসন্ধিৎসার জন্যই। মানব ইতিহাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যতটুকু ইতিহাস নিশ্চিত ভাবে জানা যায়, তাতে দেখা যায় যে, নাস্তিকতা সবসময়ই আস্তিকতার চাপে কোনঠাসা ছিলো; যদিও এখন পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
তবে এর কারন ও আছে। নাস্তিকতা সবসময় প্রচলিত সমাজের বিরুদ্ধে একটি উচ্চকিত প্রতিবাদরূপে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো ঠিকই; কিন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শরূপে নিজেকে দাঁড় করাতে পারেনি কখনোই-যতক্ষন পর্যন্ত না একই শতাব্দীতে তিন-তিনজন অসম্ভব প্রতিভাধর মানুষের হাতে তিনটি ভিন্ন তত্ত্বের আবির্ভাব হলো। হ্যাঁ, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব, ডারউইনের বিবর্তনবাদ আর কার্ল মার্ক্সের সমাজতন্ত্র- এর কথাই বলছি। অষ্টাদশ-উনবিংশ-বিংশ শতকে এগুলো একইসাথে মানুষের মনোরাজ্যে হানা দিলো এবং এমন এক পরিবর্তনের ডাক দিলো যে, এর সাথে শুধুমাত্র এর তের শতক পূর্বে আরবের বেদুঈনদের মনোজগতে মুহাম্মাদ (স) যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন তারই তুলনা চলে; যদিও এ দুই পরিবর্তনে মাত্রাগত অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। যে যাই বলে বলুক, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে যত কিছু আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলোর মাঝে (কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক) এ তিনটি তত্ত্বের প্রভাবই সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী। এবং আদিম কাল হতে ভবঘুরের মত চরে বেড়ানো 'নাস্তিকতাবাদ' বিগত শতকেই এ তিনটি তত্ত্বের ভেতর আপন প্রানস্পন্দনকে আবিষ্কার করে ফেললো। আজকের পৃথিবীতে যত জনই নাস্তিকবাদে প্রভাবিত তাদের প্রত্যেকেই আপন মন-মস্তিষ্কে এদের প্রভাব অনুভবে বাধ্য (প্রভাবকে অস্বীকারই করতে পারে না) এবং তাত্ত্বিকভাবে এঁদের কথার উপরেই চরমভাবে নির্ভরশীল।
যাই হোক, বেশীরভাগ আস্তিকের কাছে ‘নাস্তিক’ একটা গালি বিশেষ হলে ও ব্যক্তিগতভাবে একে নিছক একটি আদর্শের বাইরে কিছু ভাবতে রাজি নই।
নাস্তিকতার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। তবে, সহজভাবে দেখতে গেলে, দুই রকমের নাস্তিক মানুষের দেখা পেয়েছি।
এক. যিনি যৌক্তিকভাবে মনে করেন, এমন কোন উচ্চতর সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই যা মহাবিশ্বের সৃষ্টি বা রক্ষনাবেক্ষনে কোন ভূমিকা রাখতে পারে।
দুই. যিনি মনে করেন, কোন সত্ত্বা কর্তৃক মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে কি হয়নি তা বিবেচ্য বিষয় নয়; তবে এর নিয়ন্ত্রনে তাঁর কোন হাত নেই।
এই বাইরে ও অন্য ধাঁছের নাস্তিক থাকতে পারেন। আমার জানা নেই।
উইকিপিডিয়াতে নাস্তিকতা বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে যা পেলাম তা হলো, "নাস্তিকতা এমন একটি দার্শনিক অবস্থান যা দেবত্বকে অস্বীকার করে কিংবা আস্তিকতা বিশ্বাসকে বাতিল করে দেয়। বৃহদার্থে, এটি পরমেশ্বরের অস্তিত্বের অনুপস্থিতি সংক্রান্ত বিশ্বাস।"
একজন প্রকৃত নাস্তিক মুলত একটি খোলা দরজা বিশিষ্ট ঘর। সকলেরই অবাধ প্রবেশাধিকার রয়েছে সে ঘরে। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব মতামত নিয়ে তার ঘরে উপস্থিত হয় এবং সেখানে সাদরে গৃহীত হয়। যেহেতু, নাস্তিক মাত্রই অনুসন্ধিৎসু, সেহেতু তার কাছে সকলেরই মতামত সমান গুরুত্বের দাবীদার। সেখান হতে যুক্তি-তর্ক ও বাস্তবতার মিথস্ক্রিয়ায় বেরিয়ে আসে তার জীবনের চলার পথ।
একজন যথার্থ শিক্ষার্থী মাত্রই বিনয়ী ও মার্জিত। সত্য ও জ্ঞানের অনুসন্ধিৎসা একজন নাস্তিককে ও প্রশ্নাতীত বিনয়ী ও মার্জিত করে তোলার কথা। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে চিনি, যাঁকে আমি দেখছি তাঁর মাটি হতে ছাদ পর্যন্ত উঁচু উঁচু ছয় আলমারি বইয়ের মাঝে সারাক্ষন ডুবে থাকতে! আস্তিকতা-নাস্তিকতাই শুধু নয়, অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর সাথে আমার যোজন যোজন মতানৈক্য। অথচ, সে মতানৈক্য তাঁকে একটিবারের জন্য অমার্জিত করে তোলেনি। আলোচনা বাধাগ্রস্ত হয় নি। বরাবরই তিনি ভূমিস্পর্শী বিনয়ের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন।
কিন্তু, বাস্তবিক জীবনে চলার পথে আমি বেশীরভাগ নাস্তিককে পেয়েছি উদ্ধত ও দূর্বিণীতরূপে যাদের অহমের পারদ সবসময়ই আকাশ স্পর্শ করে থাকে! ব্লগে ও এর বিপরীত নয়। সত্যিকার অর্থে, ব্লগ তো প্রচলিত সমাজেরই প্রতিনিধিত্বকারী একটি শক্তিশালী ইউনিট মাত্র!
যাই হোক, বৈশিষ্ট্যগত দিক হতে নাস্তিকতার এই ঔদ্ধত্য খাপ না খেলে ও আমরা এ রকম দেখেই অভ্যস্ত। আর সেখান হতেই ভাবনার নতুন দিগন্তের সূচনা!
যৌক্তিক মানদন্ডে যারা নাস্তিকতাকে জীবনের পাথেয় হিসেবে নিয়েছেন, তাঁদেরকে বাদ দিলেও একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ অন্যান্য নানামুখী কারনে নাস্তিকতায় প্রবেশ করেছে। সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে গেলে,
এক. ধর্ম বা আস্তিকতার গন্ডীতে আবদ্ধ মানুষের ক্ষেত্রে কিছু প্রবৃত্তিগত বিধিনিষেধ রয়েছে, যা সকলে মেনে নিতে পারে না। ফলে তারা নাস্তিকতার দিকে পা বাড়ায়।
দুই. পরিচিত গন্ডীর আস্তিকতার ধ্বজাধারী ব্যক্তিবর্গের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে বিতৃষ্ণ হয়ে ও কেউ কেউ নাস্তিকতায় প্রবেশ করে।
তিন. অন্তরের অহংবোধ ও কোন ব্যক্তিকে নাস্তিকতায় দৃঢ় অবস্থান নিতে সাহায্য করে। নাস্তিকতা বিষয়ক এবং এমনকি আস্তিকতা ও ধর্মীয় বিষয়ে ন্যূণতম জ্ঞান না রেখেও তারা ঘন্টার পর ঘন্টা বিতর্ক জারি রাখেন! নিজের পথের ভুল বোঝার পর ও সে পথ অবলম্বন করা, 'আমি চলছি বলেই পথটি সঠিক' এ মতেরই নির্লজ্জ্য বহিঃপ্রকাশ। অথচ, সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তি মাত্রই 'পথটি সঠিক মনে করছি বলেই আমি চলছি'- এ মতের অনুসারী হবেন।
উপরোক্ত তিন প্রজাতির নাস্তিকই যুক্তি তর্কের মাঝে আপন ঔদ্ধত্য ও অমার্জিত রূপ দ্রূত বাইরে নিয়ে আসেন; ফলে, আলোচনা আপ্রাসঙ্গিকতার দিকে কিংবা ব্যক্তিগত আক্রমন-প্রতিআক্রমনের দিকে মোড় নেয় (অবশ্য অনেক তথাকথিত আস্তিকও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকেন না; কিন্তু সে আলোচনা আরেক দিন)। বিপরীত মতের ব্যক্তিকে এরা বাক্যের ভারে যেন পিশে মেরে ফেলতে চান; আপন মত প্রতিষ্ঠার পথে আর কিছু না করতে পারলেও নিদেন পক্ষে প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করে আচ্ছা মত সাইজ করার ব্যাপারে এঁদের উৎসাহ দেখার মতো!
এর বাইরে আরো এক ধরনের আবেগী মানুষ ও আছেন যাঁরা নিজেদের মত ও পথকে সত্যি বলে মনে করেই অধৈর্য্য হয়ে অন্যকে ও সে মত ও পথ গ্রহনে বাধ্য করতে চান এবং এক্ষেত্রে কিছুটা ঔদ্ধত্যের পরিচয় ও দিয়ে থাকেন। তবে, এটি তাঁদের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
সবশেষে, সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, যত দিন এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ নিজের ব্যাপারে ততই চিন্তাশীল হয়ে উঠছে। যা' তা' বলে কিংবা 'সাতে পাঁচে চৌদ্দ' করে তাদের আর বোঝানো সম্ভব নয়। ভয় দেখিয়ে- জোর করিয়ে তো আরো অসম্ভব। তাই, এখন প্রাসঙ্গিক যুক্তি-তর্কই পারে একজনকে আপনার মতের অনুসারী করে তুলতে, তিরষ্কার-অবহেলা-ঔদ্ধত্য আর অল্প বিদ্যা দিয়ে যা কখনোই সম্ভব নয়!
বিঃদ্রঃ নাস্তিকতা নিয়ে নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা আর উপলব্ধি হতে এ লেখার উৎপত্তি। কারো প্রতি আক্রোশ প্রদর্শন এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
আবোল তাবোল-১
আবোল-তাবোল-২