একটা গল্প দিয়ে শুরু করি।
ঢাকার বাইরে কোন এক গন্ডগ্রাম। জীর্ণ কুঁড়েঘর। খোলা রান্নাঘরে ব্যস্ত মায়ের পাশেই ঘ্যানঘ্যান করে চলেছে ছোট্ট মেয়েটি। খিদের জ্বালায় নয় কিন্তু! সে গ্রামে বসা মেলায় যেতে চায়। মাত্র দু'গজ চুল বাঁধার ফিতে কিনবে, টাকা চাই। এক পর্যায়ে মা' অতিষ্ঠ হয়ে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, 'ঠিক মত খাওন-পিন্দন জুটে না; আবার চুল বান্ধনের হাউশ!' এমনি সময় ছেলেটাও এসে একটা বই কেনার জন্য টাকা চাইলে, বদরাগী মা' ওর গালেও একটা চড় বসিয়ে দিলেন। আর বললেন, 'ঐ টেকা দিয়া কয় কেজী চাইল কিনোন যায়, কইতারস?!'
বাদ দিন। বাজে গল্প। গ্রাম্য অশিক্ষিতদের ছেড়ে আসুন শহুরে শিক্ষিত মানুষের কাতারে চলে আসি।
ডিসেম্বর মাস এলেই জাতি হিসেবে আমাদের প্রান চাঞ্চল্য বেড়ে যায়। বিজয়ের মাস আখ্যা দিয়ে শুরু হয় নানা অনুষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ; উপুর্যুপরি গুণীজন সংবর্ধণা, বিজয় মেলা ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা বরণ করে নিই এ মাসকে। জানুয়ারী মাসেও সেই রেশটুকু থেকে যায়। তার উপর পরের মাসে বই মেলা! প্রকাশক-লেখকের তো কথা বলার ও ফুসরত নেই। আমরা অভাজন পাঠকেরা ও উৎসুক হয়ে থাকি; বারে বারে খোঁজ নিই প্রিয় কোন্ কোন্ লেখকের কোন্ কোন্ নতুন বই বাজারে আসছে? পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় মাসব্যাপী একুশে বই মেলা। জাতিগতভাবে আমাদের মাতৃভাষা ও সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা এবং পুস্তক প্রীতির এক অনন্য স্মারক এই মেলা। আমরা পকেট ভর্তি করে টাকা নিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে বই কিনি! এরপরই এসে যায় মার্চ। স্বাধীনতার মাস। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠি আমরা। স্বাধীনতা পদক প্রদান, স্মৃতিচারণ ইত্যাদি নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই মাস।
এতক্ষন যে চিত্রটুকু আমি তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম তাতে ঐ চার মাসের জাতীয়ভাবে পালিত সব কর্মকান্ড পূংখানূপুংখ ভাবে হয়তো চিত্রিত হয় নি, তবে মূল ব্যাপারগুলো তুলে ধরতে পেরেছি বলেই আমার ধারনা। এবং এ দিক থেকে দেখতে গেলে আমরা স্বাধীনতার চেতনাকে বেশ ভালোভাবেই হৃদয়ে ধারন করতে পেরেছি। তথ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে, শিখতে পারছে।
কিন্তু, আসলেই ই তাই? এতটা স্থুলভাবে না দেখে আসুন একটু খানি মুদ্রার ওপিঠটা ও দেখে নিই।
বিজয় মেলাতে যাই। সন্ধ্যাবেলায় বরাদ্দকৃত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটুকু না দেখলে বোঝার উপায় নেই এটি বিজয় মেলা! এদিকে ওদিকে বসে হাউজি খেলার আসর; কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সবাই নির্বিকার। কারন, মেলার পেছনে বিনিয়োগ তো উঠিয়ে আনতে হবে তো!
বই মেলাতে গেলে তাও মন ভালো হয়ে যেতে চায়। এতো ভীড়; ধুলোবালি! তবু ভালো লাগে। যাক, বইয়ের জন্যই তো এতো কষ্ট স্বীকার। কিন্তু একটু লক্ষ্য করুন ভীড়টা কোথায়? যে স্টলে হুমায়ুন-মিলন-ইকবালের বই সেখানে! ছোট ছোট জনসভা যেন! মারামারি করেই তবে বই কেনা যায়। আরে গাধাগুলো কি এটাও বোঝে না, এই বই গুলো তো বই মেলা শেষ হবার পরেও যত্রতত্র পাওয়া যাবে। কিন্তু মননশীল বইগুলো, যে গুলো আমাদের উন্নত করবে, আমাদের দৃষ্টির দিগন্তকে খুলে দেবে, সেগুলোতো বইমেলার পর বাইনোকুলার দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যায় না! হুমায়ুন-মিলন-ইকবালের যে বই গুলোর জন্য এতো মারামারি সেগুলোও এমন (ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে) একবার পরার পর বুকশেলফের শোভাবর্ধণ ছাড়া আর কোন কাজে আসে না! প্রকাশকদেরও পোয়াবারো; জনপ্রিয় লেখক হলেই গলাকাটা দাম; ৭০ পৃষ্ঠা বই- দাম ৭৫ টাকা! (পৃষ্ঠা প্রতি এক টাকা+ মলাটে ৫ টাকা!)। অতএব, আসল কথা, ব্যবসা!
এর পর আসুন ভাষা প্রীতির দিকে। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানের অতি প্রচারে অনেক সময় বিরক্ত হয়ে যাই। কিন্তু, এরপর সারা বছর বিজাতীয় ভাষার গানের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে কখনো এই গানটা শুনতে চাইলে ও খুঁজে পাওয়া যায় না! অন্য ভাষায় গান শোনার বিরোধী আমি নই। কিন্তু, তাই বলে আমরা হিন্দি রপ্ত করে, ইংরেজী শিখে বাংলার সাথে মিশিয়ে জগাখিচুড়ি করে ফেলবো- সেটাতো মোটেই কাম্য নয়। বাংলা মাধ্যমে পড়ুয়া ছাত্রের জন্য ইংরেজী টিউটর থাকে, অথচ ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া ছাত্রের জন্য বাংলা শেখার কোন পথই খোলা থাকে না। মূল কথা হলো, বাংলা শিখে কী হয়? একটা ভালো চাকরিও তো পাওয়া যায় না!
১৩ই ফেব্রুয়ারি আমাদের পয়লা বসন্ত; বসন্ত উৎসব-ভালোবাসার দিন। তবু আমরা ভালোবাসা দিবস পালন করি পরদিন , ১৪ই ফেব্রুয়ারি। সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে স্বাতন্ত্র রক্ষার অনন্য এই সুযোগ থাকার পরও আমরা সুযোগ গ্রহণ করলাম না! প্রকৃত কথা হলো, বেলেল্লাপনা করবার জন্য পরপর দু’দিন আলাদা করে পাওয়া গেলে সে সুযোগ হাতছাড়া করে কোন বেকুব?
এবার, আসি স্বাধীনতার প্রসঙ্গে। একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার জনগনের ইস্পাতদৃঢ় একতা। শক্তিশালী সেনাবাহিনী, উন্নত অর্থনীতি- এসব কোন কিছুই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিতে পারে না; যদি জনগনই বহু মত ও পথে বিভক্ত হয়। বিগত ৩৮ বছরে আমরা কত দিনের জন্য কিংবা কতটি জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলাম? দেশের জন্য একটি স্বয়ংসম্পুর্ণ অর্থনীতির ভীত আমরা এখনো দাঁড় করাতে পারিনি। আমাদের নেই কোন সুনির্দিষ্ট জোরালো বৈদেশিক নীতিমালা! যে যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর মীমাংসা হয়ে যাবার কথা ছিলো (প্রয়োজন ও ছিলো) স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে; হীন স্বার্থ আর দলাদলিতে তা আজো বিষফোঁড়ার মত জাতির ললাটে লেগে আছে। যাঁরা তখন সমস্ত প্রমানাদি সামনে রেখেও বিচার করতে পারেন নি তাঁরাই আজ বিচারের দাবী নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। কেন এই দীর্ঘসূত্রিতা? জাতির কাছে সেজন্য কিন্তু তারাও ক্ষমা চাননি! সে কারনেই ভয় হয়। যাই হোক, আমরা ন্যায়বিচার চাই; কলঙ্কের তিলক মুছে ফেলতে চাই (Better late than never)। অথচ, এর চাইতে ও ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার বারবার আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। আর তাহলো আমাদের জাতীয় পরিচয়ের সংকট। আমরা কি বাংগালী জাতীয়তায় বিশ্বাসী নাকি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে? অমীমাংসিত অবস্থায় এটিও পড়ে আছে বিগত তিন যুগ ধরে। সত্যিকার অর্থে, এর মীমাংসা হয়ে গেলে অনেকেরই মিথ্যে রাজনীতির খেলা বন্ধ হয়ে যেত; ভেংগে যেত যেনতেনভাবে দেশের ক্ষমতালাভের সুখস্বপ্ন। এ নিয়ে কেউই কিন্তু মাথা ঘামাচ্ছে না! কারন, আসল কথা হলো ক্ষমতা।
সব শেষে, প্রাসংগিক বিধায় বৈশাখ নিয়ে দু'টো কথা। পয়লা বৈশাখ আমাদের প্রানের উৎসব। রমনা বটমূলকে ঘিরে সে এক বিরাট যজ্ঞ; বিশাল লোক সমাগম; ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই আসেন এখানে। পান্তা-ইলিশ খান; আড্ডা দেন। বিগত কয়েক বছরে এই হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আশার কথা। কিন্তু, অন্য পিঠটা ও দেখা দরকার। সেদিন ঐ এলাকাতে কী হয়? ভয়াবহ ভীড়; ধুলোবালি; অসহ্য গরম; মোবাইলের নেটওয়ার্ক জ্যাম। এরি মাঝে পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা যে কীনা বাবা- মায়ের হাত ধরে প্রথম এসেছে মেলায়, তার মনস্তত্ব একটু বিশ্লেষণ করুন। দুপুরের গরমে এক বেলা অনভ্যস্ত পেটে পান্তা-ইলিশ খেয়ে অসুস্থ করিয়ে তোলা আর প্রচন্ড ভীড়ে চিঁড়ে-চেপ্টা হয়ে একটা একতারা কিনে দেয়া ছাড়া আমরা তাকে আর কী সংস্কৃতি শেখাতে পারছি? বছরের ৩৬৪ দিনই কিন্তু সে অন্য সংস্কৃতিতে বড় হচ্ছে। ফলে হীতে বিপরীত হয়। বাংগালী সংস্কৃতির প্রান সত্ত্বাকে অনুধাবন করার আগেই সে এর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে; এক দিনের তরে বাংগালী সাজাই হয়ে পড়ে তার নিয়তি। কে ভাববে এ নিয়ে? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে না!
এখন, বলুন সাগর পরিমান রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা কে আমরা কয় পেয়ালা পানির বদলে বিকিয়ে দিচ্ছি?!
(আজ ভয়াল ২৫ মার্চ। সেদিনের ঢাকার রাজপথে 'অপারেশন সার্চলাইটে' নির্বিচার গুলিতে নিহত মানুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই লেখা উৎসর্গীকৃত।)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:৪৩