১
রফিক সাহেব তার স্ত্রী জাহানারার সাথে তার ছেলের আচরণে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। আগে তার মাঝে ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল না এমন নয়, তবে এখন যেন তা আরো বেড়েছে। হঠাৎ এ পরিবর্তনের কারণ কী হতে পারে? সে কি কিছু বুঝতে পেরেছে? কিছু আঁচ করতে পেরেছে?
পারার তো কথা নয়। ব্যাপারটি এখনো কাউকে জানানো হয়নি।
হয়তো রফিক সাহেব একটু বেশিই চিন্তা করছেন। এমনও হতে পারে যে, মার অসুস্থতা দেখে মার প্রতি মুহাব্বত বেড়ে গেছে। বা হারিয়ে ফেলার ভয় ঢুকেছে।
দুনিয়ার সবরকম ভয়ই যে নেতিবাচক, তা কিন্তু না। বরং কিছু ক্ষেত্রে তা উল্টো। হারিয়ে ফেলার ভয়টাকে রফিক সাহেব ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখেন। হারিয়ে ফেলার ভয় অন্তরে এলে, এ অনুভূতি থেকে মূল্যায়ন ও গুরুত্বের বোধও জাগ্রত হয়৷ একটু হলেও বুঝে আসে, আমার জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজীবন থেকে যাবে না বলেই তা আরো গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন মাতা-পিতার সাথে সন্তানের সম্পর্কটাই দেখা যাক৷ মাতা পিতার চেয়ে এ দুনিয়ায় সন্তানের জীবনে কাছের মানুষ আর কে হতে পারে? একটা সময় ছিল যখন রফিক সাহেবের তার মা-বাবার সাথে কাটানোর সময় ও সুযোগ ছিল, এখন যা নেই। তখন অন্যান্য অনেক কাজ করারও সুযোগ ছিল, যা এখন আছে।
এত কঠিন কঠিন থিওরী বোঝা সন্তান গুলোও হরহামেশাই যেন বিলকুল ভুলে থাকে এ বিষয়– তারা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকতে পারবে এ নেয়ামতের সাথে।
রফিক সাহেব নানা রকম ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলেন। ইদানীং তিনি প্রায়ই আনমনা হয়ে থাকেন। এমন সময় রাতুল তাকে রাতের খাবার খেতে ডাকলো।
পিতা পুত্র একসাথে খাবার খাচ্ছে৷ শুনশান নীরবতা। কেউ কোন কথা বলছে না৷ কেবল ঘড়ির টিক-টক ধ্বনি ভেসে আসছে৷
রফিক সাহেব নীরবতা ভেঙ্গে ডাকলেন, রাতুল।
ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর এলো, জ্বি আব্বা।
–তোকে একটা কথা বলা হয়নি রে।
–কী কথা আব্বা৷
–তোর মার...
রাতুল প্রায় মিনতির মত উচ্চারণ করলো, কী হয়েছে আব্বা?
রফিক সাহেব চুপ করে রইলেন। শব্দটা যেন তার মুখ থেকে বের করতে পারছেন না।
রাতুল আবার মিনতির মত উচ্চারণ করলো, আব্বা বলো আমাকে।
রফিক সাহেব নির্লিপ্ত স্বরে বললেন, তোর মার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। অবস্থাও সুবিধার না।
রাতুল কিছুক্ষণ স্থব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন রফিক সাহেবের দিকে। তার যেন গোটা দুনিয়া টুকরো টুকরো হয়ে গেল এক নিমিষেই।
ছেলেটা নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে ওঠলো।
রফিক সাহেব বড় অসহায় বোধ করলেন। রাতুলের কান্না দেখে তার নিজেকে সামলানোই বড় মুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। তিনি আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রার্থণা করতে লাগলেন, আল্লাহ তা'আলা যেন তাকে এবং রাতুলকে সবর করার ক্ষমতা দান করেন।
২
জাহানারা বেগম ইন্তেকাল করার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল।
প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়তে যায় রফিক সাহেব ও রাতুল একসাথে। রাতুলকে ডাকতে হয় না৷ সে টুপি পাঞ্জাবি পরে প্রস্তুত হয়ে থাকে। তার লাল চোখ গুলো দেখলে রফিক সাহেবের মনে হয় যেন ছেলেটা সারারাতই কেঁদেছে।
আজ একটু ব্যতিক্রম হল। রফিক সাহেব রাতুলকে ডাকতে তার রুমে এসে দেখলেন রাতুল মাটিতে ঘুমিয়ে আছে জায়নামাজের উপর৷ রফিক সাহেবের বড় মায়া লাগলো তার ভেজা মুখ দেখে। জায়নামাজের একটা অংশও ভেজা।
পাশে একটা নোটবই খোলা পড়ে আছে। তিনি তা হাতে তুলে নিলেন। সেখানে গোট গোট অক্ষরে লেখা–
"মা, নদীর পারে বসে যখন উদাস মেঘ গুলোর ছায়া দেখি তখন বড় ইচ্ছে হয়, তোমাকে যেয়ে বলি, আমার মন ভাল নেই। আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই মা। আর একবার।
দুনিয়ায় কত কিছুই তো আছে, তবু আমার মনে হয় যেন, দুনিয়ায় এমন কী-ই বা আছে?
এই দুনিয়া আমাকে যা কিছুই দিক না কেন, তাতে কী এসে যায় মা? তুমি তো নেই।
মা, এই দুনিয়ায় তোমার সাথে আর দেখা হবে না জানি। জান্নাতে কি হবে?"
রফিক সাহেবের মুখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। তিনি নিজেকে একটু স্বাভাবিক করবার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে কন্ঠ স্বাভাবিক করে ডাকলেন, "রাতুল, নামাজ পড়তে চল।"