১
'চাঁদটা সুন্দর না?'
'হু'
'আমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে এই চাঁদের সৌন্দর্য দেখার অধিকার তোমার আছে?'
'অবশ্যই নেই।'
'গুড! এখন গান শোনাও আমাকে।'
'কোনটা শুনবে?'
'মাঝে মাঝে তব দেখা পায়, চিরদিন কেন পায় না।'
স্বপ্নের ঠিক এই পর্যায়ে এসে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এক চিলতে রোদ চোখে পড়েছে। আবারো পর্দাটা লাগানো হয়নি রাতে ঘুমানোর সময়। প্রতিদিন ভাবি ঘুমানোর আগে সব পর্দা লাগিয়ে ঘুমাবো। কিন্তু কাজটা করা হয়না কখনোই। উঠতে হলো বিছানা ছেড়ে।
কটা বাজে? ঘড়িটার দিকে তাকাতেই মনে পড়লো গত বেশ কিছুদিন ধরে ঘড়িটার ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। উঠে মুখ হাত ধুয়ে রুমে ঢুকে দেখি মোবাইলে রিং বাজছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাত্রির কন্ঠ।
'সকাল থেকে কতবার ফোন দিয়েছি?'
'ঘুম থেকে উঠলাম মাত্র। ফোনটা কাটো, দেখে বলছি।'
'খবরদার আমি না কাটার আগে ফোন কাটবে না।'
'আচ্ছা কাটবো না। তুমি এত রেগে আছো কেন?'
'এখানে রাগের কি দেখলে?'
'ব্যাপারটা কি বলো।'
'আজ কই তারিখ?'
'একটু দাড়াও। ক্যালেন্ডার দেখে বলছি।'
রাত্রি ফোন কেটে দিল। ভালোই হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ঘুম দেয়া যাবে। বাসায় কোন ক্যালেন্ডার নেই। ফোনের তারিখও ঠিক করা হয়নি। আবার কাঁথাটা ঝাপিয়ে ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
রাত্রির ফোনে ঘুম ভাঙলো আবার।
'বাইরে এসো।'
'বাইরে?'
'জ্বি।'
'তুমি এসেছো নাকি?
'কথা না বাড়িয়ে জলদি যা বলছি করো।'
বাসা থেকে বের হতেই দেখি রাত্রি নীল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। এই তপ্ত দুপুরে তাকে একটুকরো বসন্তের মতো লাগছে। সে কথাও বলছে বেশ আহ্লাদী ভঙ্গীতে।
আমি হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই বলে বসলাম, 'রাত্রি, আজ আমরা সারাদিন ঘুড়বো।'
রাত্রি সব রাগ ঝেড়ে কিশোরীর মতো চোখ বড় বড় করে বললো, 'সত্যি?'
আমার মন একটু খারাপ হয়ে গেল। শেফালির চোখেও এক সময় এতটা বিস্ময় ছিল।
আমরা ঠিক করেছি কিছুক্ষণ হেঁটে একটা রিকশা ঠিক করবো। নেভালের দিকে যাবো। আমি আর শেফালি হাটতে হাটতে মোড়ের দিকে গেলাম। রাস্তার এক পাশে ফুটপাথে একটা শিশু শুয়ে ছিল। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। ছুটে এলো আমার দিকে। সে জানে না আমার পকেটে কোন টাকা নেই।
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও আমার শেফালির কথা মনে পড়ে গেল। সে তার হ্যান্ড ব্যাগে প্রচুর দুই টাকার নোট রাখতো। আমার সাথে বের হলে রাস্তায় যত পথশিশু দেখতো সবাইকে একটা করে দু টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলতো, আমাদের জন্য দোয়া করিস।
আচ্ছা, আমি এখন কোন কারণ ছাড়াই কেন এসব ভাবছি? কোন মানে আছে?
ছেলেটার সাথে দু একটা কথা বলে আমরা আবার হাটা শুরু করলাম। এখন রাত্রির সাথে ঘুড়ার ইচ্ছে একেবারে নেই বললেই চলে। রাত্রিকে সরাসরিই বললাম, 'আজ যাই রাত্রি? খুব মাথা ধরেছে।'
'আচ্ছা।'
'রাগ করছো তুমি?'
'না।'
'চলো, তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি। হেটে যেতে পারবে? নাকি রিক্সা নেব?'
'তোমার ইচ্ছে।'
রাত্রি কে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। গোসল করে শুতে শুতে প্রায় ২ টা বেজে গেল। তবু চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। ঘড়ির টিকটিক শব্দ কানে লাগছে। মাথাটাও ব্যাথা করছে খুব। মানুষ যখন একাকীত্ব বোধ করে কিংবা যখন কিছু করছে না, কোনকিছুতে মনোযোগ নেই; তখন ঘড়ির টিক টিক শব্দটা কানে লাগে। কোন কাজে মগ্ন থাকলে শব্দটা আর কানে আসে না। কেন?
শেফালি স্মৃতির পাতা থেকে মস্তিষ্কে আসার চেষ্টা করছে। তারপর যাবে হৃদয়ের গভীরে। সবই জানা। আমি বাধা দিলাম না।
শেফালি আমার মস্তিষ্কের কোন এক ফাকে ঢুকে মনে করাতে চেষ্টা করছে, একদিন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। খুব কেঁদেছিল।
জীবনের কিছু কিছু সময় এমন হয়, পাহাড়ের মতো ভারী কিছু বুকের গভীরে গেঁথে যায়। চাইলেও ভুলা যায় না, এড়িয়ে থাকা যায় না। সময়ে অসময়ে পাহাড়ের সেই পাথর গুলো নিজের বুকে এসে পড়ে। ক্ষত গুলো ঢেকে দেয় বিষণ্ণ প্রলেপে। বড় তুচ্ছ মনে হয় এই মায়াবী জীবনটাকে। জ্বালিয়ে ছাড়কার করে দিতে ইচ্ছে করে পৃথিবীটা।
শেফালির দেয়া প্রতিটি চিঠি আমি টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। তারপর রাত্রি এলো আমার জীবনে। ভাঙ্গা ঘরটা নতুন করে গড়ে দিল। অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া মানুষদের নাকি আলো দেখানোর জন্য একটি হাতের প্রয়োজন হয়, যা টান দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে আসবে উপরে। রাত্রি তাই করলো। আমাকে নতুন একটি জীবনের স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সে কি জানতো তাকে দেয়ার মতো ভালোবাসা আমার বাকি নেই? সব দেয়া হয়ে গেছে অন্য কাউকে?
রাত্রিকে কি বলা ঠিক হবে আমার অতীতের কথা? সে কষ্ট পাবে হইতো। তবু তার জানাটা প্রয়োজন। আমার এই ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে আমি সুখেই থাকবো। কিন্তু এই মেয়েটার কি হবে? সে কেন অযথা ভুল মানুষটিকে তার নীলপদ্ম গুলো দিয়ে দেবে? জীবন তো একটাই, দুটো তিনটে তো না। অল্পকদিনের এই জীবনে কেন এমন হবে তার? সে তো কোন দোষ করেনি। আমি নিজের স্বার্থের জন্য মেয়েটার সাথে এভাবে প্রতারণা কীভাবে করছি?
কত আশা নিয়ে অল্প কিছু চাওয়া পাওয়ার এই খেলাঘর সাজানো হয়। কত স্বাভাবিক ভাবেই না তা ভেঙ্গে পড়ে, স্বপ্ন গুলো কত সহজেই ভেতরটা তোলপাড় করে দেয়। পরাজিত এক জীবনের বোঝা নিয়ে অর্থহীন বেঁচে থাকা। তবু জীবন বয়ে চলে। নতুন সময় সাথে করে নিয়ে আসে নতুন স্মৃতি। পুরনো মানুষ গুলো চাপা পরে যায় মনের নিষিদ্ধ দপ্তরে।
ঘুমটা কিছুতেই আসছে না। পানি পিপাসা লেগেছে। আমি উঠলাম বিছানা থেকে। কি মনে করে পানি খেতে না যেয়ে টেবিলে একটা খাতা বের করে রাত্রিকে একটা চিঠি লিখতে বসলাম।
রাত্রি,
নিয়তি তোমাকে একটা পরিস্থিতি দাড় করিয়ে বিশ্রীভাবে হাসছে। তুমি নিয়তির দিকে না তাকিয়ে, ভবিষ্যৎ না ভেবে আশায় বুক ভরিয়ে চলেছো।
আচ্ছা তুমি কি জানো, এই বয়সে তোমার যে আবেগের দাম নিজের গোটা পৃথিবীটাই, সে আবেগ অন্যের কাছে হতে পারে স্রেফ কিছু লুতুপুতু ফিল্মি ডাইলোগ?
আমি কি একটু কঠিন ভাবে কথা বলছি?
শোনো রাত্রি, হয়তো তোমার জীবনে এমন একটা সময় আসবে যখন তুমি বাস্তবতা মেনে নিয়ে ফিরে আসতে চেয়েও দেখবে পেছনে কোন রাস্তা নেই। চারপাশে সীমাহীন শূন্যতা, মাঝখানে তুমি। একা।
তোমার কাঁচা আবেগের প্রথম ধাক্কাটা তুমি পুরোপুরি নিজের ভেতর চাপিয়ে রেখে সব মেনে নিতে পারবে না। তোমার কষ্ট হবে। যাকে ভালোবেসে তুমি এই কষ্টটা পাচ্ছো, হয়তো তার জীবনের হিসেবের খাতায় তোমার অনুভূতিটা রাখার মতো জায়গা থাকবে না। কেউ জানবে না কেন তোমার এই অবস্থা, কেউ বুঝবে না তোমার অনুভূতি।
তুমি কোন উপায় না পেয়ে, খুব অসহায় হয়ে তার কাছে ফিরে যেতে চাইবে। সে বাইরে থেকে তোমার কথাটা শুনবে কেবল, আর কিছুই করতে পারবে। তোমার জীবন তোমাকেই গুছিয়ে নিতে হবে। তোমার মতো মেয়েদের জীবনে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তিই বেশি থাকে। প্রাপ্তিটা নিয়ে সুখে থাকো, অপ্রাপ্তিটাকে কাছে আসতে দিবে কেন? প্রেম অদ্ভুত একটা অনুভূতি। এর স্পর্শে মুহূর্তে একটি পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে, মুহূর্তেই একটি ভাঙা পৃথিবী জোড়া লেগে যেতে পারে।
তুমি গভীর রাতেও অস্থিরতা কমাতে ছাদে উঠে বিড়বিড় করে বলবে, 'যা হওয়ার হবে। মেনে নেয়াটা আমার দ্বারা সম্ভব না আর।' তুমি তাকে পাবে না জেনেও চিৎকার করে তোমার ভালবাসার বাক্যহারা বার্তা তার কাছে পৌছুতে চাইবে। ঠিক পরমুহূর্তে তুমি বুঝবে সে আসলে এতটাই দূরে যে তুমি তার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভালোবাসি বলে চিৎকার করলেও তোমার অনুভূতি তার হৃদয় পর্যন্ত পৌছুবে না।
তোমার মনে হবে, জীবন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুই শেষ হয়েও শেষ হয় না, নতুন কিছু একটা শুরু হয়ে যায়। তবু স্মৃতিরা থাকে, মাঝে মাঝে হঠাত অশ্রু হয়ে ঝড়ে পরে।
জীবনটা যেমনই হোক, পাশে কেউ থাকুক, না থাকুক, কিছুই থেমে নেই। অন্ধকার ঘরে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে চুপচাপ বসে থাকো, তবু কাউকে এতটা ভালোবাসবে না যতটুকু ভালবাসলে নিজেকে হারাতে হয়।
এই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি, শেষ কথা। জানি কষ্ট হবে। কিছু করার নেই রাত্রি। পৃথিবীটাই এমনই। তুমিই বলো, অদ্ভুত না নিয়ম গুলো? তুমি আজ যার সাথে সারাজীবন সুখে থাকার স্বপ্ন দেখলে সেই কদিন পর তোমার দুঃখের কারণ হয়ে গেল। তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার ভাষা আমার জানা নেই, আমি নিজেই নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। চিঠিটা পড়া শেষ করে ছিঁড়ে ফেলবে। ভালো থেকো।
ইতি,
...
চিঠিটা লেখা শেষ করেই মনে হলো আমি খুব একা হয়ে গেলাম আবার। ঠিক সে দিনগুলোর মতো, যখন শেফালি আমার স্মৃতির পাতায় রক্ত ঝড়িয়ে অন্যের বাগানের ফুল হয়েছিল।
চিঠিটা লেখা শেষ করে ঠিক কি হল আমি জানি না। রাত্রির কথা ভেবে খুব কাঁদলাম। এই প্রথম শেফালি ছাড়া দ্বিতীয় কোন নারীর জন্য খারাপ লাগছে। আচ্ছা, ইচ্ছে গুলোর কি আলাদা কোন রঙ থাকে, যা ছুঁয়ে দেখা যায় না?
২
রাত ২ টায় যখন তাদের ৫ তলা বিল্ডিং এর ছাদে শেফালি তার স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে জোছনাস্নানে ব্যস্ত, জোছনার চাদর যখন সুখের ঘোরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাদের; তখন আমি রাস্তার ধারে মুহূর্ত গুলো নিঃশব্দে পুড়িয়ে ফেলছি নিকোটিনের ধোঁয়ায়- অদ্ভুত একটা অনুভুতি না?
মাঝেমাঝে মনে হয়, শেফালির কি আমার কথা মনে পড়ে খুব মন খারাপের কোন রাতে? যখন তার স্বামির সাথে তার ঝগড়া হয় তখন? সে আমার সাথে থাকলে যতটা সুখি হতো, এখন কি তারচেয়েও সুখে আছে? এইসব নিয়ে খুব একটা চিন্তা করি না। হঠাৎ যেমন মাথায় আসে, হঠাৎ দূর করে ফেলি। তারা সুখে আছে, সুখে থাকুক।
শেফালির সাথে একদিন দেখা হয়েছিল। সে তার স্বামির হাত ধরে হাটছে। আমি সামনে যেতেই এমন ভঙ্গি করলো যেন চিনতেই পারেনি। আশ্চর্য ব্যাপার, আমার একটুও খারাপ লাগলো না। শুধু মনে হয়েছে শেফালির জায়গায় রাত্রি হলে অন্তত ছুটে এসে একটাবার জিজ্ঞেস করতো, 'কেমন আছো?'
এরকম কিছু মুহূর্তে, কিংবা মাঝে মাঝে কারণে, মাঝে মাঝে অকারণে রাত্রির কথা মনে পড়ে যায়। জীবনটা দিব্যি বাংলা সিনেমা হয়ে গেছে মাইরি। রাত্রির সাথে শেষ দেখা হওয়ার পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। বড় অভিমানী ছিল মেয়েটা। খুব বেশি অভিমান বুকে চেপে সুখে থাকা যায় না। রাত্রির কাছ থেকে সরে আসার পর আমি অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি।
জীবনটা অদ্ভুত। এই অদ্ভূত জীবনে কিছু কিছু সুযোগ শুধু একবারই পাওয়া যায়।