১
টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে রয়েছে মৃদু বজ্রপাত। কালো মিশমিশে মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। কেমন যেন একটা বিষাদের ছায়া পুরো শহরে। চারপাশে আলো আধারের খেলা।
আমি প্রকৃতির লীলাখেলা দেখছিলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এমন সময় আসমানি এসে চা দিয়ে গেল। কাপে ছোট ছোট চুমুক দিতে শুরু করলাম। ক্রমশই আমার ভেতরের অনুভূতি এবং বাহিরের এই অসাধারণ পরিবেশ এক সুতই বেধে বন্দী হচ্ছে। এক ঝাক মাতাল হাওয়া কড়া নেড়ে চলছে স্মৃতির জানালায়।
সবকিছু অনুভবের এতই গভীরে স্পর্শ করছিল, মনে হয় যেন কেউ একজন অত্যন্ত যত্নসহকারে রঙ তুলি দিয়ে জোছনার ফুল আঁকছে মনের ক্যানভাসে। একটা হালকা ধাচের রোমান্টিক গান ভূমিষ্ঠ করতে এর চেয়ে নিখুঁত সময় বোধহয় আমরা ৪ জনের ৪ টা জীবনে পাওয়া হবে না। আমার উদাসীন মন ডুব দিল কল্পনার সাগরে। আফসোস লাগতে শুরু করলো এমন চমৎকার মুহূর্তেও।
২
মাঝেমাঝে কিছু কনসার্টের ভিডিওতে দেখা যায় লক্ষ্য কোটি মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে একজন গীটারিস্ট সোলো বাজাচ্ছেন। ঠিক এরকম কিছু একটা করার স্বপ্ন আমার অনেক আগে থেকেই ছিল। আজকে ফিজিক্স বইটা নিয়ে কেবল পড়তে বসলাম। আমার আবার কিছু সমস্যা আছে। গান না শুনলে পড়ায় মন বসে না। পড়ছিলাম, গান শুনছিলাম। হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। আমি পড়ার টেবিল থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেলাম গীটারটা নিয়ে। পড়তে ইচ্ছে করছে না।
যেই বাজাতে শুরু করবো, তখনই মা এসে ঠাস করে চড় মেরে বসলেন। সাথে সাথে আমি কিছু বুঝে উঠার আগে গীটারটা নিয়ে নিলেন। চিৎকার করে বাসায় রীতিমতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিলেন।
"কইদিন পর পরীক্ষা, আর হারামজাদা আছে সারাদিন রঙ তামাশায় ব্যস্ত। তোর গিটার যদি না ভাঙ্গি আমি শেখ আলির মেয়ে না। তোর আব্বা আজকে বাসায় আসুক!"
আমার মন খারাপ হলো একটু। হওয়ারই কথা। আবার কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে এই ভয়ে নিঃশব্দে পড়ার টেবিলে চলে গেলাম।
পড়ায় মনোযোগ বসছে না। যা জোর করে করতে হয়, যেখানে নিজের ইচ্ছের স্বাধীনতা থাকে না, তা করে কি লাভ আজও বুঝে উঠতে পারলাম না। পড়ালেখার সিস্টেমটা কি এমন হওয়া উচিৎ ছিল না, যার মাধ্যমে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো যায়?
৩
তারা আমার চোখের সামনে পুড়িয়ে ফেললো আমার লিরিক্স লেখার খাতা আর আমার স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু,গীটারটা। আগুন জ্বলছে। আগুনের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে বাবার হিংস্র চেহারা।
নির্বাক দাড়িয়ে আমার স্বপ্নের পুড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে হঠাৎ স্থবির হয়ে গেল বুকের ভেতরটা। নিস্তব্ধতা। হাহাকার। কি যেন চিরতরে হারিয়ে ফেলার বেদনা।
৪
বেশ কিছুদিন কেটে গেল সেদিনের পর। মা বাবার সাথে প্রয়োজনের বাইরে কোন কথাবার্তা বলা হয়নি এরপর থেকে। তারা প্রশ্ন করেছে, আমি উত্তর দিয়েছি এটুকুই। মাথায় এলোমেলো সব চিন্তাভাবনার ঘুড়তে থাকে আজকাল। ঠিক গুছিয়ে নেয়া হচ্ছে না খন্ড খন্ড ভাবনা গুলো কোথায় এসে দাঁড়াতে পারে, শেষ ফলাফলটা কি। এতটুক বুঝতে পারছিলাম, খুব বড় কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। শুধুই একটু সময়ের প্রয়োজন।
জীবনে পেছনের অধ্যায়ে পড়ে থাকলে, সামনে আগানো হবে না। আমার স্বপ্ন পূরণ হবে না। অন্যান্য দশ বিশটা ছেলের মতো আমারও একজন ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হয়েই কাটিয়ে দিতে সময়টা। মানুষ চিনবে না আমাকে। মৃত্যুর পর কেউ মনেও রাখবে না আমার কথা। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হলে হয়তো জীবনটা খুব একটা দুঃখে কাটবে না। কিন্তু আমি তো এমন কিছু হতে চাই যে কাজে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে হবে না। এমন কিছু সৃষ্টি করে যেতে চাই যা প্রতিটি মুহূর্তে পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তের একজন মানুষকে হলেও আমার কথা মনে করিয়ে দেবে তখনও, যখন আমার অস্তিত্ব এই পৃথিবী থাকবে না। আফসোস করতে করতে তারা হইতো ভাববে, "মানুষটার আরো কিছুদিন বেঁচে থাকা দরকার ছিল।"
এভাবে আমার স্বপ্নকে কারো হাতে নিজের চোখের সামনে গলা টিপে হত্যা করতে দিতে পারি না আমি। মনস্থির করলাম অবশেষে। বন্দী থেকে পোলাও বিরিয়ানি খাওয়ার দরকার নেই। স্বাধীন থেকে সাদা ভাত, ডাল পেলেই চলবে।
৫
ছোট ভাইয়ের রুমে গেলাম। কেমন অসহায় দৃষ্টিতে দেখছে সে আমাকে। ছোট বোনটাও ছিল তার পাশে। পিচ্চিটা বেশ আদর হচ্ছে দিন দিন। আমাকে দেখা মাত্র অদ্ভুত মায়াভরা কন্ঠে বললো, "ভাইয়া তুমার মন ভাল হইশে?"
রুমে চলে এলাম। ব্যাগে সবকিছু ঢোকানো শেষ। তবু কেবল মনে হচ্ছে কি যেন বাকি থেকে গেল। কি যেন নেয়া হয়নি।
নতুন এবং ভিন্ন এক জীবনের পথে পা দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত নাকি জানি না। যা হওয়ার হবে। সমস্যা নেই।
জিনিসপত্র বেশি কিছু না। একটা ব্যাগ শুধুই। ব্যাগে কাপড়চোপড় আর কিছু টাকা পয়শা। নিচে নামলান। দারোয়ান বসে বসে ঝিমুচ্ছে। গেইট থেকে বেড় হয়ে হেটে চললাম ধীরগতিতে। একটু সামনে যেতেই, দিলাম দৌড়। যতক্ষণ পর্যন্ত পারা যায়, দৌড়ে গেলাম নিজের সবটুকু দিয়ে। তারপর থামলাম হাপাতে হাপাতে।
অদ্ভুত সব অনুভূতি। যেন প্রথমবার এমন অনুভূতি অনুভবের সংস্পর্শে এলো। ভাবতেও অবাক লাগছে জীবনে এখন আর কোন বাধা নেই। আমি কি আসলেই বাস্তবতায় আছি নাকি এসবকিছুই স্বপ্ন? একটু পরে কি ঘুম ভেঙ্গে আবার সেই নিত্যদিনের যান্ত্রিক রুটিনে আবদ্ধ হতে হবে? এই একটা সিদ্ধান্ত না নিতে পারায়, এতদিন বন্দী ছিলাম বাবা মার গড়া নিয়ম নীতির কারাগারে? শুধু এই একটা সিদ্ধান্তের জন্য ধ্বংস হতে যাচ্ছিলো আমার স্বপ্ন?
হাপাতে হাপাতেই দৌড়াতে শুরু করলাম আবার। যতটা পারি দূরে সরে যেতে চাই মা বাবার কাছ থেকে। কি অদ্ভুত। এতিম শিশুরা মা বাবার জন্য সারাটা জীবন বেদনায় ভুগে। আর আমি কিনা তাদেরকে ফেলে দূরে সরে যাচ্ছি।
৬
জীবন যেমন হবে ভেবেছিলাম ঠিক তেমন হল না। গ্রীষ্মের ঠা ঠা রোদ নিভিয়ে দেয়া বর্ষার প্রথম বৃষ্টির মত কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ বদলে গেল জীবনের প্রেক্ষাপট।
কষ্ট হয়তো হবে। তবু আমি সুখে আছি আগের চেয়ে। জীবনের ধূসর রং গুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বহুদিন পর খাঁচায় বন্দী থাকা পাখির মুক্তি পেলে যেমন হয়।
প্রথম পদক্ষেপ জীবনকে যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে পাওয়ার পথে। এক এক করে গ্রহন করা জীবনে নিত্যনতুন ফুটে যাওয়া সব ফুল। মুক্তির ছোঁয়া, প্রতিটি স্পন্দনে। বেঁচে থাকা যত কষ্টই হোক না কেন, মনে হয় যেন জীবনে যা পাওয়ার ছিল সব পেয়ে গেলাম।
হ্যা, মুক্তির আনন্দটাই আসল। বাকি সব বিলাসিতা। না পেলেও খুব একটা সমস্যা বোধহয় হবে না। মুক্তির স্বাদ যখন একবার পেতে শুরু করেছি পরে সময় করে সবকিছু গুছিয়ে নেয়া যাবে নিজ হাতে। নিজের মতো করে বাঁচার সময়টা বোধহয় এসেই গেল। দিনশেষে কোন নদীর তীরে কিংবা কাক ডাকা ভোরে কোন মসজিদের মেঝেতে কিংবা ভয়ানক একা মনটায় বৃষ্টির স্পর্শে, রাস্তার ধারে অথবা নিতান্তই সাধারণ, তুচ্ছ অথচ আমার দৃষ্টিতে আমার জগতের কোন অংশে স্বপ্নবিষ্টের মতো দাঁড়িয়ে ভাবি, কিভাবে মাত্র একটা সিদ্ধান্ত বদলে দিল আমার জীবন!
আসলেই, সেইফ জোন থেকে বেড়িয়ে না আসতে পারলে জীবন কি জিনিস তা বোঝা যায় না। যাদের সেইফ জোন থেকে রিস্ক জোনে পা দেয়ার সাহস আছে তারাই কেবল জীবনের সৌন্দর্যের গভীরতম রূপ দেখার সুযোগ পায়। জীবন টা তো আমারই। তবে কেন অন্যজনের গড়া শিকলে বন্দী থাকতে হবে? কেন আরেকজন আমার জীবন পরিচালনা করবে?
আমিই আমার জীবনের নির্মাতা। আমিই সাজিয়ে নিব আমার জগতের গঠন। আমিই আমার জীবনের লেখক। আমিই লিখবো আমার জীবনের গল্প। আমিই আমার বাস্তবতার রচয়িতা। আমিই বানিয়ে নিবো আমার অজস্র স্বপ্নে গড়া পার্থিব মুহূর্ত।