পাগলাটে চরিত্র হিমুর গল্পগুলোতে তার পুরো নাম হিমালয় হলেও আমার মনে হয় এই নামটা হুমায়ূন আহমেদ নিজের নাম থেকেই দিয়েছেন; হুমায়ূন থেকে হিমু। হুমায়ূন আহমেদের লেখাগুলোতে আমি একধরণের উল্টো বিবর্তন দেখতে পাই; এবং ব্যাপারটা নিয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ভেবেছি। দেশের সিরিয়াস সাহিত্যসমালোচকরা বলেন হুমায়ূন আহমেদের লেখা “হালকা” এবং এই কথাটা আসলেই সত্যি কিনা!
প্রথম বয়েসে যখন তিনি নন্দিত নরকে লিখেন, তখন শেষের দিকে চোখে জল আনা বর্ণনা এবং গদ্যশৈলী বারংবার পাঠককে মূর্ছিত করে। তারপর লিখেছেন অনেক অনন্য উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কিছু অসামান্য গান। শিশুদের জন্যে তার একটা নিজস্ব প্যাটার্নে গল্প বলা, ছোট ছোট বাক্য, সহজ সরল দৈনন্দিন ভাষার ব্যবহার তাদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং একসময় বড় হয়ে তারাই এঅভ্যাসের বশে হুমায়ূন আহমেদের প্রেমের উপন্যাস পড়ে চোখে জল আনে, বুকের মাঝে একটা বিবর্ণ হাহাকার সৃষ্টি করে, বর্ষাকে ভালোবাসতে শিখে, জোছনাকে গায়ে মাখতে শিখে।
কিন্তু কালের বিবর্তনে তাঁর গল্পগুলো বদলে যাওয়ার কথা বলছিলাম; হুমায়ূন আহমেদের শেষদিকের গল্পগুলোতে বর্ণনার চাইতে বক্তব্যের পরিমাণ অনেক কম, এবং এই কারণে তাঁর লেখা হিমুর গল্পগুলোতে অদ্ভুত কীর্তিকলাপ পাঠককে সাময়িক আনন্দ দেয়। একটা গল্প পড়ে সেটার রেশ রয়ে যাবার ব্যাপারটি বারংবার উপেক্ষিত হয়েই আসছে এই গল্পগুলোতে। আমরা যদি এর সাথে “নন্দিত নরকে” কিংবা “শঙ্খনীল কারাগার”-এর তুলনা করি তবে দেখতে পাই; বিষয়, বক্তব্য এবং বর্ণনা – সবই অনেক অনেক বেশি সমৃদ্ধ। একজন পাঠক একটা বই পড়লে সেই বইটা যদি তার দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে না দেয়, নতুন করে ভাবতে না শেখায় তাহলে সেই বই পড়ে লাভ কি? হুমায়ূন আহমেদের আমি নিজেও একজন অনেক বড় ভক্ত; মানুষটাকে বেঁচে থাকতে একবারও দেখিনি, এবং এইজন্যে আমার আফসোসের সীমা নেই!
এই উল্টো বিবর্তন একান্তই আমার নিজস্ব তত্ত্ব। কাজেই, এটা কাউকে বিশ্বাস করানোর দরকার নেই। আগ্রহী পাঠকরা একটু সচেতনভাবে পড়লেই ব্যাপারটা ধরতে পারবেন। তবে, আমি মনে করি, সবারই একটু অন্য লেখকদের গল্প পড়া উচিৎ। আজকাল দেখি ছেলেমেয়েরা শুধুই জাফর ইকবাল কিংবা শুধুই হুমায়ূন আহমেদ পড়ছে। কিন্তু এই একধরণের বই নিয়ে পড়ে থাকলেই কি বাংলার সাহিত্য জগৎকে অনুভব করা যায়? বাংলার মানুষের জীবনকে অনুভব করা যায়? একটু মানিক বা শরৎরচনাসমগ্র হাতে নিয়ে দেখুন, রবীন্দ্রনাথের কিশোরদের জন্যে লেখাগুলোই পড়ে দেখুন; বাংলার সাহিত্যজগৎ কত সমৃদ্ধ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।
২৯ জুলাই ২০১৫
জোয়ারসাহারা, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:৩০