আমার (আমাদের,পুরো পরিবারের ছোটদের) শৈশব ছিল অনেকটা ফিলিস্তিনের শিশুদের মত|যদিও উঠানের উত্তর পাশে কোন কাঁটাতারের বেড়া ছিল না তবুও সীমানার ওদিকে এক পা ও যাওয়া হতনা|হ্যাঁ!ওদিক ছিল জমিদারদের এরিয়া|যদিও সরাসরি কোন বাক-বিতন্ডা বা মাঝেমধ্যে রক্তপাত হত না তবুও যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব ওদের অন্তরে সবসময় ছিল|যা চোখে-মুখে প্রস্ফুটিত হত|এই সীমানা নির্ধারণ হয়ে যায় সেই অবুঝ বয়স থেকেই|এ যেমন,একবার আমার বড় আপু আমাদের এখান থেকে চলে যাচ্ছিল নিজ বাড়িতে|আমি তখন আপু’র ছোট বাবুর জন্য কান্না করছিলাম|তাই আমাকে শান্ত করার জন্য ঐ জমিদারদের ওখানে নিয়ে গেল|উল্লেখ্য ওখানে আপু’র বাবুর মত আরেকটা বাবু ছিল|কিন্তু আমি ঐ বাবু’র দিকে ফিরেও তাকায়নি|সে যায়ই হোক|
তখন নূতন নূতন কারেন্ট আসছিল|কত কথা,কত ভয় তখন প্রচলিত|আমি মোম নিয়ে খেলছিলাম|হঠাৎ মোম এসে পড়ল হাতে|চামড়া তখন সয়ছিল না ঐ মোমের তাপ|এদিকে কারেন্ট নিয়ে ভয় কাজ করত সবসময়|তাই আমি মনে করছিলাম কারেন্টে ধরেছে|আমার তখন হতবুদ্ধি অবস্থা|হঠাৎ মাথায় কাজ করল কারেন্ট নিশ্চয়ই কুকুরকে ভয় পাবে|যেই ভাবা সেই কাজ|কুকুরের ডাক আরম্ভ করে দিলাম|ঘেউ,ঘেউ,ঘেউ…!
সে ছোট বয়সেই আমার গঠনমূলক কাজের হাতেখড়ি|তা শুরু হয় বাড়ির বিশাল এক জনশক্তি থেকে কাসারি দখলের মাধ্যমে|যেখানে আগে গরু রাখা হত সে জায়গাকে আমরা কয়েকজনে মিলে মক্তব ও নামাজের জায়গার উপযুক্ত করে গড়ে তুললাম|এবং সে মক্তব থেকেই আমার কুরআন ও নামাজ শিক্ষা লাভ|
ছোটবেলা থেকেই স্কুল/মাদ্রাসা নিয়ে ভয় ছিল|কারণ শিক্ষকের টেবিলে থাকত বেত|তাই প্রথম এক বছর যাওয়ার সময় একটু কান্নাকাটি করতাম|পরে অবশ্য আর করা হয় নি|স্টুডেন্ট ভালও ছিলাম না আবার খারাপ ও না|ক্লাস ফোরে রোল ছিল ৩|মানে ক্লাস ফোর থেকে মোটামুটি স্টুডেন্টের পর্যায়ে পৌঁছলাম|
ক্লাস ফাইভে আরেকটু এগুলাম|এ এ! এখানে একটু ঝামেলা হয়েছে|ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত আর এগুতে পারলাম না|দূর!কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল|সাথে আমার একশ টাকায় ভাগ বসাল|ও!সাথে একটু একটু মানতে বাধ্যও হলাম,ল্যাডিস ফার্স্ট!
টাকার ভাগ বসানোর কথা|সে হচ্ছে এক পুরস্কার|বার্ষিক পরীক্ষার পর আমার ভাইয়া কর্তৃক আমাকে দেওয়া হত|১ হলে ১শ|২ হলে শ’র অর্ধেক|আর তিন হলে শ’র পাঁচ ভাগের এক ভাগ|
দুই হুজুরকে ভয় পেতাম খুব|একজন অবশ্য পরে বন্ধুর মত হয়ে যায়|আর তা সম্ভব হয় উনার কাছে ক্লাস ফাইভ ও এইটে বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং করার কারণে|না!টাকার বিনিময়ে না|উনি জোর করেই কোচিং করাতেন|
ক্লাস ফাইভের বৃত্তি কোচিং’র প্রথম দিন|আমার কোন কারণে মিস হয়|পরে বন্ধুদের মুখে শোনা-
কিছু আগ্রহী ছাত্রকে সিলেক্ট করে উনি কোচিং শুরু করলেন|প্রথম দিনে কিছু পড়িয়ে আবার তা লিখতে দিলেন|তো আমার এক বন্ধু (গ্রামের তো ক্লাসের সবাই-ই বন্ধু) কিছু মিস করলেন|হুজুরের বলে উঠলেন-
এই হোয়ালেকা দি নে তুই বিত্তি হরীক্কা দিবি?লাল বাত্তি ঝ্বইলব!
সে বন্ধুটির কোচিং যাত্রা সে দিন শেষ|আর আসেনি!আর সে হুজুরটিই কিনা আমরা যারা কোচিং চালিয়ে নিচ্ছিলাম তাদের বন্ধু হয়ে গেল?হ্যাঁ!ঠিক তাই-ই|উনি আমাদের বন্ধু হয়ে গেলেন|এ দু’টো ঘটনা থেকে তাই-ই বুঝা যায়-
ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং চলছে|হুজুর কিছু একটা পড়া শিখতে দিয়ে বাইরে গেলেন|আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিলাম|হুজুর পেছন থেকে এসে জিজ্ঞেস করলেন(হেঁসে হেঁসে),
ওদিকে কী?কলা ?ওদিকে কলা নে ?
আরেকবার|আমার কয়দিন কোচিং এ যাওয়া হয়নি|তো একদিন হুজুর আমাদের বাড়ির আরেক ছেলেকে বলল-
ওতে কন্ডেরে ?ওতেরে তোয়ায় (খুঁজে) ধরি লই আনবি !
এদিকে ক্যাপ্টেন (ছেলেদের) হিসেবে কিছু দ্বায়িত্ব ছিল|সে সুযোগে মাদ্রাসার ইতিহাসে প্রথমবারের মত প্রক্সি(হুজুরদেরকে দিয়ে) প্রথা চালু করলাম|কোন হুজুর অনুপস্থিত|সে হুজুরের ঘণ্টায় আরেক হুজুরকে এনে ক্লাসটা করিয়ে নিতাম|সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত আট ঘণ্টার ক্লাসকে সাত ঘণ্টার বানিয়ে ফেললাম|!
ক্লাস এইটের শেষ দিকের কথা|ঐ দুই হুজুরের আরেকজন হঠাৎ ক্লাসে ঢুকে পড়ল|যাকে খুব ভয় পেতাম|ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে|ক্লাস ফোরে থাকতে ওই হুজুরের কাছে দুষ্টুমির জন্য গণদোলাই এর মত উত্তম-মধ্যম খাইছিলাম|সে থেকে আজও ঐ ভয় কাটেনি|ও !কথায় আসি|এসেই পড়ার কথা!তো কি পড়া দিল তা আমার পক্ষ থেকে জানালাম হুজুরকে|হুজুর অন্যদের জিজ্ঞেস করল|আমি ছোট্ট একটা পয়েন্ট বাড়িয়ে বললাম|ছোট্ট একটা বইয়ের তিন লাইনের একটা পয়েন্ট|আহা!আমি ঠিকছিলাম*|কিন্তু পশ্চিম(ছেলে) ও পূর্ব(মেয়ে)দুই দিকই আমার বিপরীত অবস্থান নিল|কি আর করা|হুজুর রুকুর মত করতে বললেন|তারপর আমার হাত দিয়ে ঘাড়ে ঠাস ,ঠাস…ধপাস…!|তারপর আবার পড়া নিলেন|ওই আমি যা বাড়িয়ে বললাম সেখান থেকে|কোনমতে এই যাত্রায় রক্ষা পেলাম|!
বিঃদ্রঃ * আমি ঠিকছিলাম|এইতো কিছু দিন আগে আমার এক বন্ধু বেড়াতে আসল|তো সেদিন নির্ঘুম রাত্রিযাপনের সময় বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম কে ঠিক ছিল ?|সেদিন সে হাঁসতে হাঁসতে বলল যে, আমি-ই ঠিকছিলাম|
এই শেষ ঘটনার রহস্য কোন দিন উদ্ভাবন করা যাবে কি না আল্লায়ই জানে ?তবে এ ঘটনা ওই দিনের সবাইকে মাঝে-মাঝে ফিরিয়ে আনে মনে|হয়ত বা এর কারণেই?!
তারপর এক আকশ্মিক দুর্ঘটনায় শৈশবের ইতি ঘটে|মুখোমুখি হই বাস্তবতার সাথে|বিদায় হয় কান্না-হাঁসি মিশ্রিত আনন্দপ্রধান শৈশবের……|!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪৫