যে কোন ধর্মের অনুসারীরা ধর্মগ্রন্থে নির্দেশিত আদেশগুলো মেনে চলবে এবং নিষেধগুলো পরিহার করে চলাসহ ধর্ম-প্রবর্তকগণকে অনুসরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। এ কথা সকল ধর্মের ধর্মগ্রন্থেই বলা আছে। তাই তাদেকে উক্ত ধর্ম-প্রবর্তকগণের অনুসারী বা ইংরেজীতে বলা হয় ফলোয়ার। যেমন আমাদের ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা আমাদের নবী গুণী মুহাম্মদকে এতো সুন্দরভাবে অনুসরণ করে থাকে যে তাদের বহিরাবরণ দেখলেই এক নজরে বোঝা যায় এরা সাচ্চা মুসলমান। কারণ নবী পাগড়ী পরতেন, তাই তারা পাগড়ী পরে। তিনি পাগড়ী খুলে রেখে কখনও কখনও টুপি পরতেন, তাই তারা টুপি পরে। তিনি জোব্বা পরতেন বলে জোব্বা পরে। তিনি পায়ের গোড়ালীর উপরে পায়জামা বা তহবন্দ পরতেন বলে তারা সেভাবেই পরে। তিনি আতর লাগাতেন বলে তারাও তা লাগায়ি আতরের খুসবুতে চারিদিক মোহিত করে দেয়। তিনি দাড়ি রাখতেন বলে তারাও তা রাখে। তিনি গোফ রাখতেন না বলে তারা তা রাখে না। আমাদের নবী গুণী মুহাম্মদের বাহ্যিক আকার আকৃতিকে এতো নিখুঁতভাবে আমাদের ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা অনুসরণ করে, কেউ দেখলে বলতে পারবে না এইসব অনুসারীরা সাচ্চা মুসলমান না।
কোরানে আল্লাহ শুধু গুণী মুহাম্মদকেই অনুসরণ করতে বলেছেন তা নয়। গুণী মুহাম্মদের পূর্বে আরও যেসব নবী এ জগতে ধর্ম-প্রবর্তক হিসাবে এসেছিলেন, তাদের সকলকেই আল্লাহ অনুসরণ করতে বলেছেন। কতো জন নবী এ জগতে এসেছিলেন তার কোন সঠিক সংখ্যা জানা নাই। তবে কেউ বলে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার আবার মতান্তরে দুই লক্ষ পঁচিশ হাজার। এ সংখ্যা যাই হোক, বিশিষ্ঠ বিশিষ্ঠ নবীগণের কিছু নাম কোরানে পাওয়া যায়, সে সংখ্যা পঁচিশ। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে গুণী ইব্রাহীমকে। কারণ আল্লাহর হুকুমে ইব্রাহীমকে তার শিশ্নের অগ্রভাগের মাংশপিণ্ডের ছেদন(খাতনা)-এর আদেশ দিলে ইব্রাহীম তা করেছিলেন। কারণ এই খাতনাই হবে তার পরবর্তী অনুসারীদের পরিচিতি দানের চিহ্ণ। তখন আল্লাহ তাঁর নাম পরিবর্তন করে আব্রাম থেকে আব্রাহম রাখেন। আব্রাম শব্দের অর্থ পিতা এবং আব্রাহাম শব্দের অর্থ মহা-পিতা। অর্থাৎ একশত বছরে পিতৃত্বহীনতা ঘুচিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো পিতা হয়েছিলেন তাই তাঁর নাম আব্রাম হয়েছিলো এবং খাতনাকারী বিশাল অনুসারী জনগোষ্ঠির অনুসরণকারীর জনক বলে চিহ্ণিত হবেন বলে নাম রাখা হলো মহা-পিতা। এতো সবের ব্যাখ্যা অবশ্য কোরানে নাই, এসব পাওয়া যায় তাওরাতের ইব্রাহীমের অধ্যায়ে। গুণী ইব্রাহীমকে অন্যান্য সম্প্রদায়ের অনুসারী যেমন ইহুদী বা খ্রীস্টান অনুসরণ করে কি না জানি না। তবে যেহেতু আল্লাহ ইসলাম ধর্মের অনুসারীদেরকে গুণী মুহাম্মদের পূর্বের নবীগণকেও অনুসরণ করতে বলেছেন, তাই খাতনা দেওয়া বা শিশ্নের অগ্রভাগের মাংশপিণ্ড ছেদন করে মুসলমান হওয়ার জন্যে এই প্রথা আজও চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য সম্প্রদায়ের অনুসারীরা গুণী ইব্রাহীমকে জাতির জনর বা পিতা মানুক বা না মানুক, আমাদের ইসলামের অনুসারী মুসলমানেরা মানে। কারণ কথিত মুসলমানের মতো এতো সাচ্ছা দিলের অনুসারী, অন্য কোন সম্প্রদায়ে খুঁজলে পাওয়া খুবই কঠিন হবে।
আবার গুণী ইব্রাহীমের নিকট যখন আল্লাহর আদেশ এলো যে, তুমি তোমার খুব প্রিয় বস্তুকে আমার প্রতি উৎসর্গ করো অর্থাৎ কোরবানী দেও। তিনি এই আদেশ পেয়ে, শত শত ভেড়া ছাগল দুম্বা উট কুরবানী দিলেন, আল্লাহ বললেন, না কুরানী হয় নি। তিনি মহা চিন্তায় পড়লেন, আল্লাহ আমার কাছ থেকে কি চাচ্ছেন? তখন তিনি ভেবে সমাধানে এলেন, পিতা-মাতার নিকট সন্তান ছাড়া আর কি প্রিয় হতে পারে?! তাই তিনি তাঁর পুত্র ইসমাইলকে কোরবানীর জন্য নিয়ে গেলেন দূর পাহাড়ে।
ইসমাইলকে কুরবানী দিতে গিয়ে সেখানে এক দৈব ঘটনা ঘটে। দৈব ঘটনাটি হলো এরূপ, যখন ইসমাইলের গলায় ছুরি চালানো হয়েছিলো, তখন ইসমাইলের কুরবানী না হয়ে একটা পশুর কুরবানী হয়েছিলো। কিন্তু কোন পশু বা পশুর ধরণ বা গঠন সম্পর্কে কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। এই কোরবনীর প্রথা অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজন পালন করে কি না জানি না, তবে আমাদের ইসলামের সাচ্চা অনুসারীরা চন্দ্র মাস আযহার দশ তারিখে লক্ষ লক্ষ পশু গলায় ছুরি চালিয়ে কোরবানী দিয়ে সেই প্রথাকে কঠিনভাবে অনুসরণ করে যাচ্ছে আজও। কারণ তাদের ধারণা ইসমাইলের পরিবর্তে পশুকে কুরবানী দিয়ে এই জগতে কুরবানী প্রথার চালু হয়েছিলো এবং তা অনন্তকাল পর্যন্ত চলবে।
এবার আসি আমার একটা ছোট্ট প্রশ্নের অনুসন্ধানে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের অনুসারীদেরকে খুব সাচ্চা দিলের মনে হয় না। কারণ তারা জীবনটা এক রকম হলেই হলো বলে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের ইসলাম ধর্মের সাচ্চা মুসলমানেরা নবীদের অনুসরণে এক চুল পরিমান এদিক ওদিক হতে দেয় না। দুনিয়ার সকল সম্প্রদায়ের লোকজন একদিকে চলে গেলেও, মুসলমানেরা নবীদের অনুসরণের ক্ষেত্রে একচুল নড়বে না। তাই অনুসরণের আলোকে কুরবানী সম্পর্কে এই ছোট্ট প্রশ্নটি উদিত হয়েছে আমার মনে। যৌক্তিকতার সাথে তারই উত্তর জানবার চেষ্টা করবো।
ইসমাইলের পরিবর্তে কোন পশু গরু, নাকি ভেড়া, নাকি দুম্বা, নাকি উট ইত্যাদি কুরবানী হয়েছিলো ঘটনার বিবরণে তার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। যেহেতু ঘটনার বিবরণে এর বর্ণনা পাওয়া যায় না, সেহেতু ধরে নিলাম কোরানে উল্লেখিত হালাল খাদ্য তালিকার যে কোন একটি পশুর কুরবানী হয়েছিলো। তবে ইসমাইলকে যদি কুরবানীর আসল প্রতীক হিসাবে মনে করি তাহলে কোরবনীর পশুটার ধরণ বা গঠন কেমন হওয়া উচিত? প্রশ্নটা এই কারণেই আমার মনে জাগে, যেহেতু আমরা অনুসরণে এক চুল বিচ্যুত হই না, সেহেতু এক্ষেত্রেও সেই সঠিক অনুসরণ হওয়া উচিত। কারণ কেউ ষাঁড় কুরবানী দেয় তো কেউ বকরী, কেউ খাসী আবার কেউ বলদ, কেউ বাঁঝা গাভী তো কেউ বৃদ্ধ গাই ইত্যাদি। কিন্তু আমার মতে পশু ধরণ বা গঠন নির্বাচনে কেন হের ফের হবে?
যেহেতু ইসমাইল পুরুষ ছিলেন, সেহেতু নারী জাতীয় কোন পশু কুরবানী দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাহলে ধরণ বা গঠনের ক্ষেত্রে একটি সমাধান বা উত্তর পাওয়া গেলো, পশুটি নারী জাতীয় পশু নয়, পশুটি হতে হবে পুরুষ জাতীয়। এখন প্রশ্ন হলো কেমন ধরণের পুরুষ? যেহেতু ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা বলে থাকে তারা ইব্রাহীমের পুত্র ইসমাইলের বংশধর, সেহেতু ইসমাইল পুংসক ছিলেন। অতএব তার অণ্ডকোষ অবশ্যই ছিলো। তাহলে আরও একটি সমাধান বা উত্তর পাওয়া গেলো, অণ্ডকোষ যুক্ত পশু হতে হবে। অর্থাৎ খাসী, বলদ হওয়া যাবে না, হতে হবে ষাঁড় বা পাঁঠা। আবার কুরবানীর বর্ণনায় বোঝা যায়, ইসমাইলের বয়স তখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে প্রারম্ভে পৌঁছে ছিলো। সেহেতু আরও একটি সমাধান বা উত্তর পাওয়া গেলো, পশুটি হতে হবে তাগড়া জোয়ান। অর্থাৎ বীর্যের স্খলন তখনও ঘটে নি এমন জোয়ান পশু। তাহলে মোটের উপর কি দাঁড়ালো? বৃদ্ধ উট, দুম্বা, গাই, বকরী বা বাঁঝা বা খাসী বা বলদ জাতীয় কোন পশুর কুরবানী দেওয়া উচিত হবে না। কুরবানী দিতে হবে বীর্য স্খলনকারী নয় এমন অর্থাৎ বীর্য ধারণকারী পাঁঠা বা ষাঁড় জাতীয় পশু।
কুরবানীর পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদেরকে অবশ্যই ইসমাইলকে প্রতীক হিসাবে ধরেই নির্বাচন করা উচিত। কারণ তারা জাতিরজনক ইব্রাহীমেরও অনুসারী এবং ইব্রাহীম কুরবানীর জন্য সারা বা হাজরাকে বা তার অন্য কোন আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে যান নি। অতএব অনুসারীরা যদি গুণী মুহাম্মদের বাহ্যিক আকার আকৃতির সকল কিছু নিখুঁতভাবে ধারণ করে অনুসরণ করে সাচ্চা মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করে তাহলে কুরবানীর ক্ষেত্রেও একই ভাবে অনুসরণ করে কুরবানীর জন্য নিখুঁত পশু নির্বাচন করা উচিত।
নচেৎ কুরবানটি কিরূপ হবে?
গুণী মুহাম্মদ সত্যবাদী বা আল-আমীন ছিলে, কখনও মিথ্যা কথা বলতেন না, ঘুষখোর ছিলেন না, তিনি দখলদার ছিলেন না, তিনি অত্যাচারী ছিলেন না, তিনি জুলুম করতেন না, তিনি সর্বস্ব বিলিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন; কিন্তু অধিকাংশ (শতকরা হিসাবে নিরানব্বই শতাংশ) অনুসারীরাই তাঁর স্বভাব বা চারিত্রিক আচরণের অনুসারী নয়, তবুও তারা নিজেদেরকে তার অনুসারী সাচ্চা মুসলমান বলে পরিচিতি দিয়ে থাকে শুধু তাঁর বাহ্যিক আকার আকৃতিতে তাঁর বেশ ভুষা ধারণ করে বলে। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সাচ্চা মুসলমান হওয়ার মধ্যেই যদি গলদ থাকে তাহলে তাদের কুরবানী নির্বাচনে গলদ হবে এটাই স্বাভাবিক। এ কথা আমি বলছি না, কোরানের পরিভাষায় বলছি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:১৭