ইসলাম এমন কিছু উন্নত শিষ্টাচার, সুন্দর স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের উপর মুসলিম সন্তানদের গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করেছে, যেটা মুসলিম প্রজন্মের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, লালন-পালন ও তাদের চরিত্র বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করে থাকে। কথা কাজের ক্ষেত্রে উন্নত পন্থা অবলম্বন, সৎ স্বভাব গ্রহণ ও ঘৃণিত তথা মন্দ স্বভাব পরিত্যাগে নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্য আদব তথা শিষ্টাচারের সকল দিকগুলোই বর্ণনা দিয়েছেন। এমনকি যুদ্ধের ময়দানের শিষ্টাচার কি হবে, তাও বলে দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে যুদ্ধের সময় নারী-শিশু এবং যে সকল বৃদ্ধ যুদ্ধ করে না তাদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। বারণ করেছেন গির্জা ও আশ্রমে আশ্রয়গ্রহণকারী পাদ্রী, ধর্মযাজক ও সন্নাসী এবং শষ্য ক্ষেতে চাষাবাদরত চাষীকে হত্যা করতে। এবং মৃতের দেহ বিকৃত করতেও নিষেধ করেছেন। এমনিভাবে আরো অনেক আদব রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বলে দেয়া শিষ্টাচার তথা আদবের মধ্যে রয়েছে খাদ্য-পানীয় গ্রহণ, পোষাক-পরিচ্ছদ, নিদ্রা, স্ত্রী মিলন ও দাম্পত্য জীবনের আদব ছাড়াও অনেক বিষয়। এমনকি তিনি পায়খানায় প্রবেশের আদবও বলে দিয়েছেন, যেমন: সালমান ফারেসী (রাঃ) থেকে বর্ণনা এসেছে, তিনি বলেন, ‘মুশরিকরা আমাদেরকে বলে, এ কেমন কথা তোমাদের নবী তোমাদেরকে সকল কিছুই শিক্ষা দেন, এমনকি পায়খানা করার নিয়মও?! তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ! তিনি আমাদেরকে পায়খানা -পেশাবের সময় কেবলা মুখী অথবা কেবলাকে পিছন দিয়ে বসতে বারণ করেছেন। ডান হাতে ঢিলা- কুলুখ ব্যবহার, তিনটির কম পাথর ঢিলা হিসাবে ব্যবহার অথবা হাড় কিংবা গোবর দিয়ে ঢিলা ব্যবহার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।’ মুসলিম
ইসলামই হচ্ছে একমাত্র জীবন ব্যবস্থা যা সমগ্র মানব জীবনের জন্য একটি নির্ভুল পদ্ধতি এঁকে দিয়েছে। যার মাঝে রয়েছে জীবনের প্রতিটি স্তর ও বিভাগের সুষ্ঠু সমাধান। এটা মানব রচিত কোন জীবন বিধান নয় যে, তার মাঝে সত্য-মিথ্যার সম্ভাবনা থাকবে, বরং এটা হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান, যা তার অনুসারীদের জন্য দুনিয়ার জীবনে বয়ে নিয়ে আসে কল্যাণ, শান্তি— ও মানুষিক স্বস্তি, আর কিয়ামতের কঠিন দিনে পুরস্কৃত করে তার চিরস্থায়ী সুখের জান্নাত। আল্লাহ বলেন- “আমরা কিতাবে (কুরআনে) কোন কিছুই বাদ দেইনি।” [সূরা আনআম, ৩৮ আয়াত ]
আত্মার সুষ্ঠু গঠন ও পরিশুদ্ধি এবং সুন্দর চরিত্র বিনির্মাণে নবুওয়তী আদবের একটি সুন্দর প্রভাব ও সুদূর প্রসারী ফলাফল রয়েছে। নবুওয়তী আদব তথা ইসলামী শিষ্টাচার জাতির জন্য এমন কিছু ধারাবাহিক প্রজন্ম উপহার দিয়েছে, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক নিষ্কুলুষতা, পবিত্রতা, আদল ইনসাফ, ব্যক্তিত্ব, লজ্জাশীলতা, দয়া দাক্ষিণ্য এবং শক্তি-সামর্থ ও বীরত্বে যাদের তুলনা ইতিহাসে বিরল। হতাশাগ্রস্থ মজলুমের সহযোগিতায় ও তাদের জুড়ি নেই। ইসলামী শিষ্টাচার ও নবুয়তী চরিত্র থেকে দূরে সরে যাওয়াই হচ্ছে বর্তমান মুসলিম উম্মার দুর্বলতার কারণ। মুসলিম উম্মাহ যদি অপর জাতির দাস সূলভ অনুসরণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, যদি ফিরে আসে তাদের সক্বীয়তা এবং সত্যিকার ইসলামী শিষ্টাচারের দিকে, তাহলে অবশ্যই তাদের হারানো গৌরব, সম্মান ও মর্যাদা ফিরে আসবে। মুসলিম জাতি কি এ ব্যাপারটি অনুধাবন করবে?
১. নিয়তের আদবঃ
প্রতিটি মুসলিমই অবগত যে, নিয়তের একটি অসাধারণ গুরুত্ব রয়েছে। নিয়তের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করে কাজের গ্রহণযোগ্যতা। নিয়ত শুদ্ধ না হলে আমল তথা কাজও বাতিল হয়ে যায়। নিয়ত হচ্ছে কোন কাজের জন্য প্রগাঢ় ইচ্ছা পোষণ। যখন এই ইচ্ছাটা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর আদেশ পালনার্থে হয়, তখনই তা হয় বিশুদ্ধ এবং এর থেকে বেরিয়ে আসে উত্তম ও গ্রহণযোগ্য আমল। যখন এই নিয়ত হবে দুনিয়ার জন্য, অথবা মানুষের প্রশংসা ও বাহবা অর্জনের জন্য, অথবা খ্যাতির জন্য অথবা আলোকিত বিশ্বে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অথবা অপর কোন অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য, তখন নিয়তও বাতিল হয়ে যাবে এবং তার ফলে অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল যোগ্য কাজই বের হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“নিশ্চয়ই সকল আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সেটাই রয়েছে যার জন্য সে নিয়ত করেছে।” বুখারী ও মুসলিম
২. আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে শিষ্টাচারঃ
১. একজন মুসলিম এটা ভালভাবে অবগত যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই তাকে রিযিক দিয়েছেন, তিনিই তাকে সকল নিআমাত দিয়েছেন এবং তার উপর থেকে সকল প্রকার কষ্ট বিদূরিত করেছেন। সুতরাং তাকে অবশ্যই তার রবের সাথে সর্বোচ্চ শিষ্টাচার প্রদর্শন করতে হবে।
২. আল্লাহর সাথে শিষ্টাচারের অন্যতম একটি দিক হলো, তাঁর শরীয়তের পরিপূর্ণ অনুসরণ, আর তা হবে আদিষ্ট বিষয়াবলী পালন এবং নিষেধকৃত বিষয়াবলী বর্জনের মাধ্যমে।
৩. আল্লাহর সাথে আদবের মধ্যে শরীয়ত বিধৃত কোন কাজের বিপক্ষে যুক্তি পেশ করা থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ বলেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ
“কোন মুমিন পুরুষ কিংবা নারীর উচিৎ নয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দেয়া ফায়সালার উপর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।” সূরা আল-আহযাব : ৩৬
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন:
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا
“মুমিনদের কথাতো এমনই হবে যে, যখনই তাদের মধ্যকার কোন ফায়সালার জন্য তাদেরকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান করা হবে, তখন তারা বলবে: শুনলাম এবং মানলাম।” সূরা-নূর-৫১
আল্লাহর সাথে আদব রক্ষার অপর একটি দিক হলো- তার নেআমাতের শুকরিয়া আদায় করা এবং তার স্তুতি করা, তাঁকে বেশী বেশী স্মরণ করা এবং অধিক পরিমাণে দোআ করা এবং তাঁর সকল কাজেই তাঁর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করা, তাঁকে ভালবাসা, তাঁর সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করা, তাঁর শাস্তিকে ভয় করা, তাঁর কাছে সওয়াব তথা পূণ্যের আশা করা, তাঁর মহান কিতাব পবিত্র কোরআন অধিক তেলাওয়াত করা, সকল প্রকার কবিরা ও সগীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা।
৩. কোরআনের সাথে আদব বা শিষ্টাচারঃ
একজন মুসলিম আল্লাহ তাআলার কিতাব কোরআনে কারীমের সাথেও আদব রক্ষা করে চলবে, উহাকে সম্মান করবে, সকল কথার উপর এ কালামকে প্রাধান্য দিবে। এমনিভাবে সে কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন আহকাম,আদব ও আখলাক অনুসরণ করে চলবে। কোরআন তেলাওয়াতের সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখবে।
১. পরিপূর্ণ পবিত্রতার সাথে, কিবলার দিকে বসে অত্যন্ত সম্মানের সাথে তেলাওয়াত করা।
২. কোরআনের আয়াত এবং তার অর্থ নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করা।
৩. শুধু জানা বা আমলের জন্য নয় বরং ইবাদতের নিয়তে তেলাওয়াত করা।
৪. অত্যন্ত ধীরে তারতীল সহকারে তেলাওয়াত করা, তাড়াহুড়া না করা।
৫. স্বতন্ত্র আহকাম হিসেবে কোরআন তেলাওয়াতের ও অধ্যয়নের নিয়ম শিক্ষা করা।
৬. সুন্দর স্বরে তেলাওয়াত করা এবং কিতাবের মর্যাদা বিবেচনায় বিনম্র ও ভদ্রভাব তথা খুশু ও খুজু বজায় রাখা।
৪. রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে শিষ্টাচারঃ
একজন মুসলিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথেও যথোচিৎ আদব রক্ষা করবে। কেননা তিনিই হলেন সর্বশেষ নবী, যাকে আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য প্রেরণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে আদব রক্ষা করার দিকগুলো হলোঃ
১. তার আদেশের অনুগত হওয়া, এবং তিনি যে সকল কাজ থেকে নিষধ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন, সেগুলো থেকে বিরত থাকা ।
২. অপরিহার্যভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালবাসা।
৩. তাঁর সুন্নাতের অনুগত হওয়া এবং আদব আখলাক তথা শিষ্টাচারে তাঁরই মত হওয়া।
৪. তাঁর আনিত বিধান জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষ করে যে কোন বিবাদের ক্ষেত্রে। আল্লাহ বলেন:
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
৫. “কক্ষণও নয়, আপনার রবের কসম, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের বিবাদমান বিষয়ে আপনাকে বিচারক মানবে, এবং আপনার দেয়া ফয়সালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোন খুঁত পাবে না, এবং সে ফায়সালা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেবে।” সূরা আন -নিসা: ৬৪
৬. তাঁর অনুগামী, সাহাবী ও বন্ধুদেরকে ভালবাসা এবং তাদের শত্রুদেরকে ঘৃণা করা।
৫. স্বীয় আত্মার সাথে শিষ্টাচারঃ
১. একজন মুসলিম সর্বদা মনে মনে হিতোপদেশ এবং শিষ্টাচারের দিকগুলো স্মরণ করবে, যাতে করে পবিত্র ও উন্নত রাখতে পারে তার নফসকে। নিজ আত্মাকে প্রবৃত্তির ও লালসার পেছনে ছেড়ে দিবে না, যাতে সে স্খলিত হয়ে যায় এবং অন্যায় করে। যারা নিজেদের নফসের হিসাব নিজেরা রাখে এবং নফসের তদারকি করে, তাদের প্রশংসায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا ﴿9﴾ وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ﴿10﴾
“সে-ই সফলকাম যে নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে,আর সেই ক্ষতিগ্রস্ত যে আত্মাকে কলুষিত করেছে।” সূরা- আশ-শামস্ : ৯-১০
২. মুসলিম মা’সুম তথা বেগুনাহ নয়, বরং সে কখনো কখনো ভ্রান্তি ও গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায় কিন্তু মুসলিম হিসেবে তাকে নফসের সাথে জিহাদ করতে হবে, যাতে সে অবাধ্য গুনাহগার হয়ে না যায়। যদিও কখনো তার আত্মা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায়, তাহলে সে মুষড়ে পড়বে না। সে হতাশ হবে না। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবেনা। বরং আল্লাহর দরবারে ফিরে আসবে এবং দ্রুত তওবা করবে এবং গুনাহের জন্য তাঁর নফসকে তিরস্কার করবে। সম্ভব হলে নফসকে অনুমোদিত খাহেশ থেকেও বিরত রাখতে হবে, যাতে করে সে পরবর্তিতে কোন গুনাহের নির্দেশনা দিতে না পারে
মনে রাখা দরকার , তওবা তিনটি জিনিসকে শামিল করে।
গুনাহ থেকে ফিরে আসা।
গুনার কাজের জন্য অনুশোচনা
কৃতগুনাহের দিকে ভবিষ্যতে ফিরে না যাওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত
যখন মুসলিম সত্যিকারার্থে তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন, তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন, তার মন্দ কাজগুলো মিটিয়ে দেন তিনি বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ
“হে মুমিনগণ! তোমরা খালেসভাবে আল্লাহর কাছে তওবা কর সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দিবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।” সূরা আত তাহরীম: ৮
৬. মানুষের সাথে শিষ্টাচারঃ
একজন মুসলিম তার কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচার আচরণে মানুষের সাথে শিষ্টাচার প্রদর্শন করবে। কেননা স্তর বা মর্যাদার বিবেচনায় প্রতি শ্রেণীর মানুষেরই পৃথক আদব তথা শিষ্টাচার রয়েছে। মানুষের সাথে আচার-আচরণে শিষ্টাচার প্রদর্শনের প্রকৃতি ও নমুনা নিম্নরূপ হওয়া উচিৎ:
১) মুসলিম তার পিতা-মাতার সাথে সর্বক্ষেত্রে আনুগত্য প্রদর্শন করবে, তবে আল্লাহর অবাধ্যতায় নয়। সে তাদেরকে সমীহ করবে, মর্যাদা দেবে, এবং তাদের অনুগত থাকবে। কথা-কাজে তাদেরকে সম্মান দেখাবে। তাদের সাথে কর্কশ আওয়াজে কথা বলবে না। তাদের উপরে নিজের আওয়াজকে উচুঁ করবে না। তাদেরকে নাম ধরে ডাকবে না, বরং তাদেরকে সম্বোধন করবে সম্মানজনক শব্দে। তাদের প্রতি যথোচিৎ ইহসান ও সুন্দর আচরণ করবে, এবং তাদের প্রয়োজনে তাদের জন্য অর্থ ব্যয় করবে।
২) মুসলিম মাত্রই একথা জানে যে তার সন্তানদের উপর তার কিছু কর্তব্য রয়েছে যেমন: তাদের জন্য স্ত্রী নির্বাচন করা, যারা তাদের সন্তানদের মা হবে, আর সন্তানদের প্রতি পিতার কর্তব্য হচ্ছে তাদেরকে উওম লালন-পালন, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, এবং তাদের ব্যয়ভার গ্রহণ করা এবং তাদের প্রতি কোমল আচরণ করা, এটা তারা উপযুক্ত হয়ে কর্মক্ষম হওয়া পর্যন্ত।
৩) আর মুসলমান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক শিষ্টাচার এর স্বীকৃতি দিবে।
আর এটা এমন কয়েকটি দায়িত্ব যা প্রত্যেকের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন, আল-কুরআনের বাণীঃ
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ
“নারীদের উপর যেমন পুরুষদের ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে তেমনি অধিকার রয়েছে নারীদের স্বামীদের উপরও। তবে পুরুষদের অধিকার স্ত্রীদের উপর বেশী।” সূরা আল- বাকারাহ ২২৮ আয়াত
আর ইসলাম ধর্ম স্বামীকে তার স্ত্রীর সাথে নিম্নলিখিত শিষ্টাচার বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছে
ক. ধৈর্যশীলতা: এবং কোমল আচরণ। যেমন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা নারীদের কল্যাণ কামনা করবে। কেননা তাদেরকে পাজর থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি পাজরের কোন একটি বেকে যায় তাহলে এটা আরো চওড়া হয়ে যাবে। তুমি এটাকে সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে। আর তুমি এটাকে ছেড়ে দিলে সর্বদাই বাকা থাকবে। সুতরাং মহিলাদের ক্ষেত্রে কল্যাণ কামনা কর।” বুখারী ও মুসলিম
খ. ন্যায়সংগতভাবে তার ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করা। এটা ইসলাম স্বামীর উপর ওয়াজিব করে দিয়েছে।
গ. তার সাথে সদাচরণ করা: যেহেতু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।” আহমাদ এবং তিরমিযী
ঘ. তাকে ভালবাসা এবং ঘৃণা না করা। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: “কোন মুমিন স্বামী যেন কোন মুমিন স্ত্রীকে পৃথক না করে। যদি সে তার কোন একটি আচরণ অপছন্দ করে তাহলে অপর একটি আচরণ তার পছন্দ হবে।” মুসলিম
ঙ. ন্যায় বিচার করা এবং অত্যাচার না করা।
চ. অশ্লীল কর্ম হতে পবিত্রকরণ এবং উপভোগের অধিকার দেয়া।
ছ. তার গোপনীয় কথা প্রকাশ করা হারাম।
জ. তার পদস্খলন ও দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করা হারাম।
ঝ. তাকে শিক্ষা দেয়া এবং সৎকাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা।
ঞ. তার সাথে হাসি-কৌতুক ও খেলাধুলা করা এবং তাকে ভালবাসা।
যেমনিভাবে আয়েশা (রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে কোন এক ভ্রমনে বের হলাম। তখন আমি ছোট বয়সী ছিলাম, মেদবহুল ছিলাম না, ভারী বা মোটা ছিলাম না। অতঃপর তিনি লোকজনকে বললেন, “তোমরা অগ্রসর হও।” অত:পর তারা অগ্রসর হলো। অত:পর আমাকে বললেন: “এদিকে আস। আমি তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করব, আমি তার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করলাম এবং আমি বিজয়ী হলাম। তখন তিনি চুপ হয়ে গেলেন। অত:পর যখন আমার মেদ বেড়ে গেল, আমি মোটা হয়ে গেলাম এবং পূর্বের ঘটনা ভুলে গিয়েছিলাম তখন আমি তাঁর সাথে কোন এক ভ্রমণে বের হলাম। তিনি মানুষকে বললেন, “তোমরা অগ্রসর হও।” তারা অগ্রসর হয়ে গেল। পরে আমাকে বললেন, আয়েশা তুমি এসো আমি তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করবো। দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে তিনি বিজয়ী হলেন। তারপর তিনি হাসতে লাগলেন এবং বললেন, “এটি প্রথমবার তোমার বিজয়ের প্রতিশোধ।” -আহমাদ,আবু দাউদ
ইনিই হচ্ছেন ইসলাম ধর্মের নবী এবং এটাই তার স্ত্রীর সাথে আচরণ।
৪) মুসলিম ব্যক্তি তার নিকটআত্মীয় ও রক্ত সম্পর্কীয় লোকদের সাথে ভদ্রসুলভ আচরণ করবে। তারা আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করলেও সে আত্মীয়তা বজায় রাখবে। তারা তাকে বিরক্ত করলেও সে তাদের সাথে সদাচরণ করবে। তারা তার সাথে দুর্ব্যবহার করলে সে তাদের সাথে সৎ ব্যবহার করবে।
সে তাদের বড়দের সম্মান করবে এবং ছোটদের স্নেহ করবে। তাদের রোগীদের সেবা করবে এবং বিপদগ্রস্থ লোকদেরকে সমবেদনা জানাবে। এবং তাদের বিপদ আপদে এগিয়ে আসবে। কেননা আল্লাহর বাণী:
وَآَتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ
“আত্মীয়কে তার অধিকার দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও পথিককে…. ।” সূরা আল ইসরা : ২৬
৫) ইসলাম প্রতিবেশীদের হক নির্ধারণ করে দিয়েছে যেমনিভাবে নিকটাত্মীয়দের অধিকার আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে।
এগুলো হচ্ছে, তাদের সাথে কথায় কাজে সদাচরণ করা এবং তাদেরকে কষ্ট না দেয়া এবং তাদের ক্ষতি হবে এমন কোন বিষয়ে জড়িত না হওয়া। তাদের সম্মান করা, সাক্ষাতে হাসিমুখে কথা বলা, তাদের খোজ খবর নেয়া, তাদেরকে উপহার দেয়া এবং তাদের মূল্যায়ন করা। ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করা যেমন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “জিবরীল সর্বদাই আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অসিয়ত করতেন এমনকি আমি ধারণা করলাম যে, তিনি অচিরেই তাকে [প্রতিবেশীকে] উত্তরসূরী করে দিবেন।” বুখারী ও মুসলিম
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন তার প্রতিবেশীকে সম্মান করে।” বুখারী ও মুসলিম
৭. একজন মুসলমানের অপর মুসলমানের উপর হক বা অধিকারঃ
এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের প্রতি অনেক অধিকার রয়েছে, যেমন
ক. যখন তার সাথে দেখা করবে তখন তাকে সালাম দিবে এবং সে সালাম দিলে তার সালামের উত্তর দিবে,আর ইসলামের অভিবাদনের নিয়ম হচ্ছে: “আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু”
খ. যখন সে হাঁচি দিবে তখন তার হাঁচির জবাব দিবে, যখন হাঁচি দাতা হাঁচির পরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’(প্রশংসা আল্লাহর) বলবে তখন তার হাঁচির জবাব হচ্ছে, ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ (আল্লাহ আপনাকে দয়া করুন) আবার হাঁচি দাতা তার প্রতি উত্তরে বলবে: ‘ইয়াহদি কুমুল্লাহু ওয়া ইয়ুসলিহু বা-লাকুম’। (আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন ও আপনার বিষয়াদি সুন্দর করে দিন)
গ. অপর ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে।
ঘ. সে তার মুসলমান ভাইয়ের সাহায্য করবে। এবং তাকে লাঞ্ছিত বা অসম্মান করবে না। যেখানে সে তার সাহায্য-সহযোগিতা দরকার সেখানে তাকে সাহায্য করবে।
ঙ. যে কোন ব্যাপারে পরামর্শ চাইলে সুপরামর্শ দিবে।
চ. রুগ্ন হলে তার সেবা করবে বা দেখা করবে এবং মারা গেলে তার দাফন কাফন ও জানাযাতে অংশ গ্রহণ করবে।
ছ. তার সাথে বিনয়ী আচরণ করবে। কখনও অহংকারী হবে না।
জ. তার গীবত বা পিছনে নিন্দা করবে না। তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে না। তাকে উপহাস করবে না। তার দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করবে না। তার প্রতি কোন ধরনের অপবাদ দিবে না। তাকে ধোকা দেবে না, প্রতারণা করবে না। তাকে গালি দেবে না। তাকে হিংসা ও ঘৃণা করবে না। তার প্রতি মন্দ ধারণা করবে না। তার গোপনীয় বিষয় জানার জন্য গোয়েন্দাগীরি করবে না। তার সাথে খিয়ানাত করবে না এবং তিন দিনের বেশী তার সাথে রাগ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখবে না।
ঝ. তার পদস্খলন বা ত্রুটি ক্ষমা করবে। তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে। তার পিছনেও তার সম্মান রক্ষা করবে। তার প্রতি ন্যায় বিচার করবে এবং তার সাথে এমন আচরণই করবে যা সে পছন্দ করে। সে বড় হলে শ্রদ্ধা করবে। ছোট হলে স্নেহ করবে। সাহায্যের প্রয়োজন হলে তাকে সাহায্য করবে।
৮. অমুসলিমদের সাথে শিষ্টাচারঃ
যে আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি কুফুরী করে তাকে মুসলমান ঘৃণা করবে, তার প্রতি বন্ধুত্বপোষণ করবে না তাকে ভালবাসবে না। অনুরূপভাবে তার কুফুরীতে সে সন্তুষ্ট হবে না এবং তার কুফুরী মেনে নেবে না।
এতদসত্বেও সে তার প্রতি অত্যাচার করবে না। বরং তার সাথে ন্যায়পরায়ণতা দেখাবে ও ইনসাফ করবে। তার মাল, জীবন ও সম্মানের ক্ষেত্রে আঘাত হানবে না। তাকে কষ্ট দেবে না, যদি সে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে জড়িত না থাকে।
এমনিভাবে সে তার সাথে সাধারণত: দয়া ও করুণা দেখাবে। যেমন: ক্ষুধার্থ হলে তাকে খাওয়াবে, পিপাসিত হলে পান করাবে, রুগ্ন হলে সেবা করবে, তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে। যেমন রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “করুনাশীলদেরই রাহমান [দয়াময় আল্লাহ] করুনা করেন। তোমরা যমীনবাসীদের উপর করুণা কর। তাহলে আকাশবাসী তোমাদের উপর করুণা করবেন।”-আহমাদ
এমনিভাবে অমুসলিমদের উপঢৌকন দেয়া ও তার উপহার গ্রহণ করা ও তার খাবার গ্রহণ করা জায়েয যদি সে আহলে কিতাব (ইহুদী বা খৃষ্টান) হয়।
এগুলো মুসলমানের চরিত্র এবং শিষ্টাচার তার ধর্ম বিরোধী লোকেদের সাথে। তাহলে তার মুসলমান ভাইয়ের সাথে তার আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ?
৯. জীবজন্তুর অধিকারঃ
জীব-জন্তুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শত শত বৎসর পূর্বেই ইসলাম জীবজন্তুর জন্য অধিকার নিরূপণ করেছে, তম্মধ্যে :
১. ক্ষুধায় ও পিপাসায় খাদ্য ও পানীয় প্রদান।
২. তার প্রতি দয়া ও মহানুভবতা দেখানো এবং তার কষ্ট হয় এমন ব্যবহার না করা।
৩. হত্যা বা যবেহ করার সময় তাকে কষ্ট না দেয়া। কেননা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সকল জিনিসের প্রতি সদাচারণ করাকে ফরয করে দিয়েছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে তখন সুন্দর পন্থায় হত্যা করবে। আর যখন যবেহ করবে কখন সুন্দর করে যবেহ করবে। তোমাদের কেউ যেন তার ছুরিকে ধার দিয়ে নেয় এবং পশুকে প্রশান্তি দেয়।” মুসলিম
৪. তাকে কোন প্রকার শাস্তি দেবে না। চাই তা ক্ষুধার্থ রাখার মাধ্যমে হোক বা প্রহার করে হোক অথবা তার দ্বারা অসম্ভব এমন বোঝা বহন করে হোক অথবা তার অংগচ্ছেদ করে অথবা তাকে আগুনে পুড়িয়ে কষ্ট দেয়া হোক। সবগুলোই ইসলামে নিষিদ্ধ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “এক মহিলা একটা বিড়ালকে কষ্ট দেয়ার কারণে দোযখে প্রবেশ করেছে, সে তাকে আটকিয়ে মেরেছিলো, তাকে খেতে দেয়নি তাকে পানীয় পান করতে দেয়নি, এমনকি তাকে ছেড়েও দেয়নি যাতে সে যমীনের খাবার খেতে পারত।” বুখারী ও মুসলিম
লেখক : আহমদ আল-মাযইয়াদ/আদেল বিন আলী আশ-শিদ্দী
অনুবাদ : সাইফুল্লাহ আহমাদ
সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান।
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব