যুলুম থেকে বাঁচার উপায়:
ক) যুলুম থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা মহাপরাক্রমশালী এবং যালিমের যুলুম থেকে তিনিই একমাত্র রক্ষাকারী। এজন্য বেশী বেশী আল্লাহর নিকট ধর্না দিতে হবে । আল্লাহ বলেন,
﴿ وَقَالَ رَبُّكُمُ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِي سَيَدۡخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ ٦٠ ﴾ [غافر:60]
তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দিব, যারা আমার ইবাদতে অহংকার করে তারা অচিরে জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।’ [আল-মু‘মিন-৬০]
﴿ وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ﴾ [البقرة:186]
আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুত: আমি রয়েছি সন্নিকটে। [আল-বাকারাহ: ১৮৬]
খ ) যুলুম থেকে বাঁচার জন্য ধৈর্যধারণ করতে হবে । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ - رضى الله عنه - أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ « مَثَلُ الْمُؤْمِنِ كَمَثَلِ خَامَةِ الزَّرْعِ ، يَفِىءُ وَرَقُهُ مِنْ حَيْثُ أَتَتْهَا الرِّيحُ تُكَفِّئُهَا ، فَإِذَا سَكَنَتِ اعْتَدَلَتْ ، وَكَذَلِكَ الْمُؤْمِنُ يُكَفَّأُ بِالْبَلاَءِ ، وَمَثَلُ الْكَافِرِ كَمَثَلِ الأَرْزَةِ صَمَّاءَ مُعْتَدِلَةً حَتَّى يَقْصِمَهَا اللَّهُ إِذَا شَاءَ»
‘‘ঈমানদার ব্যক্তির উদাহরণ শস্যের নরম ডগার ন্যায়, বাতাস যে দিকেই বয়ে চলে, সেদিকেই তার পত্র-পল্লব ঝুঁকে পড়ে। বাতাস যখন থেমে যায়, সেও স্থির হয়ে দাঁড়ায়। ইমানদারগণ বালা-মুসিবত দ্বারা এভাবেই পরীক্ষিত হন। কাফেরদের উদাহরণ দেবদারু (শক্ত পাইন) বৃক্ষের ন্যায়, যা একেবারেই কঠিন ও সোজা হয়। আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন, তা মূলসহ উপড়ে ফেলেন।’’ [বুখারী: ৭৪৬৬]
শস্যের শিকড় মাটি আঁকড়ে ধরে। তার সাথে একাকার হয়ে যায়। যদিও বাতাস শস্যকে এদিক-সেদিক দোলায়মান রাখে। কিন্তু ছুঁড়ে মারতে, টুকরা করতে বা নীচে ফেলে দিতে পারে না। তদ্রূপ মুসিবত যদিও মুমিনকে ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত ও চিন্তামগ্ন রাখে, কিন্তু সে তাকে হতবিহবল, নিরাশ কিংবা পরাস্ত করতে পারে না। কারণ, আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তাকে প্রেরণা দেয়, তার মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে, সর্বোপরি তাকে হেফাযত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ﴾ [البقرة:153]
হে মুমিনগণ, ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। সুরা বাকারাহ-১৫৩।
হাদিসে এসেছে ,
«وَلَنْ تُعْطَوْا عَطَاءً خَيْرًا وَأَوْسَعَ مِنَ الصَّبْر»
‘‘ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপকতর কল্যাণ কাউকে প্রদান করা হয় নি।’ [বুখারী:১৪৬৯; মুসলিম:১০৫৩]
সহিহ মুসলিমে বর্ণিত আছে,
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي لَيْلَى عَنْ صُهَيْبٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : «عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ»
‘‘মুমিনের ব্যাপারটি চমৎকার, তার প্রতিটি কাজই কল্যাণের; মুমিন ছাড়া আর কারও জন্য তা হয় না; নেয়ামত অর্জিত হলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, যা তার জন্য মঙ্গলজনক এতে কৃতজ্ঞতার সওয়াব অর্জিত হয়। মুসিবতে পতিত হলে ধৈর্যধারণ করে, তাও তার জন্য কল্যাণকর এতে ধৈর্যের সওয়াব লাভ হয়।’ [মুসলিম:২৯৯৯]
হাসান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন : ‘‘আমাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানীদেরও অভিজ্ঞতা, ধৈর্যের চেয়ে মূল্যবান বস্তু আর পায়নি। ধৈর্যের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা যায়, তবে তার সমাধান সে নিজেই।’’ অর্থাৎ প্রত্যেক জিনিসের জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন, আবার ধৈর্যের জন্যও ধৈর্য প্রয়োজন।
গ ) যালেমের যুলুমকে ভয় না পেয়ে আল্লাহর উপর দৃঢ় আস্থা এবং তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে । দুনিয়ার উত্থান-পতন সুখ-দুঃখ স্বাভাবিক ও নগণ্য মনে করতে হবে। তদুপরি চির-সত্যবাদী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসে বিশ্বাস তো আছেই: ‘‘জেনে রেখ, সমস্ত মানুষ জড়ো হয়ে যদি তোমার উপকার করতে চায়, কোনও উপকার করতে পারবে না, তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আবার তারা সকলে মিলে যদি তোমার ক্ষতি করতে চায়, কোনও ক্ষতি করতে পারবে না, তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার কপালে লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, কিতাব শুকিয়ে গেছে।’’ [সুনান তিরমিযী:২৫১৬]
ঘ ) আল্লাহর রহমাতের প্রশস্ততা ও তার করুণার কথা বেশী বেশী স্মরণ করা । কেননা যুলুমের কষ্টের তুলনায় আল্লাহর রহমাতের প্রশস্ততা অনেক বড় বিষয়। ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‘‘আমার ব্যাপারে আমার বান্দার ধারণা অনুযায়ী, আমি ব্যবহার করি।’’ [বুখারী:৭৪০৫; মুসলিম: ২৬৭৫]
যুলুম দৃশ্যত অসহ্য-কষ্টদায়ক হলেও পশ্চাতে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এরশাদ হচ্ছে : ‘‘এবং হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।’’ [বাকারাহ-১১৬]
ঙ ) মুমিনের কর্তব্য বিপদের মুহূর্তে প্রতিদানের কথা স্মরণ করা। এতে মুসিবত সহনীয় হয়। কারণ কষ্টের পরিমাণ অনুযায়ী সওয়াব অর্জিত হয়। সুখের বিনিময়ে সুখ অর্জন করা যায় না- সাধনার ব্রিজ পার হতে হয়। প্রত্যেককেই পরবর্তী ফলের জন্য নগদ শ্রম দিতে হয়। দুনিয়ার কষ্টের সিঁড়ি পার হয়ে আখেরাতের স্বাদ আস্বাদান করতে হয়।
একদা হজরত আবু বকর রা. ভীত-ত্রস্ত হালতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর কীভাবে অন্তরে স্বস্তি আসে? ‘‘না তোমাদের আশায় এবং না কিতাবীদের আশায় (কাজ হবে)। যে মন্দ কাজ করবে তাকে তার প্রতিফল দেয়া হবে। আর সে তার জন্য আল্লাহ ছাড়া কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।’’ [নিসা-১২৩]।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :‘‘হে আবু বকর, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন, তুমি কি অসুস্থ হও না? তুমি কি বিষণ্ণ হও না? মুসিবত তোমাকে কি পিষ্ট করে না? উত্তর দিলেন, অবশ্যই। বললেন : ‘‘এগুলোই তোমাদের অপরাধের কাফফারা-প্রায়শ্চিত্ত।’’ [মুসনাদ আহমাদ: ১/১১]
চ ) যুলুম থেকে বাঁচার জন্য মাযলুমের পক্ষাবলম্বন করা। কারণ আল্লাহ তা‘আলা মাযলুমের উপর রহমত করেন এবং তার দোয়া কবুল করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهَا لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللَّهِ حِجَابٌ ».
তোমরা মাযলুমের ফরিয়াদ থেকে বেঁচে থাক। কেননা, মাযলুম এবং আল্লাহর মাঝে কোন দেয়াল নেই । [সহিহ বূখারী:২৪৪৮]
ছ ) মাযলুমের ক্রন্দন আকাশ-বাতাস ভারী করে। তাই যুলুমের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা ইমানের দাবী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا لَكُمۡ لَا تُقَٰتِلُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱلۡمُسۡتَضۡعَفِينَ مِنَ ٱلرِّجَالِ وَٱلنِّسَآءِ وَٱلۡوِلۡدَٰنِ ٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَآ أَخۡرِجۡنَا مِنۡ هَٰذِهِ ٱلۡقَرۡيَةِ ٱلظَّالِمِ أَهۡلُهَا وَٱجۡعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ وَلِيّٗا وَٱجۡعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ نَصِيرًا ٧٥﴾ [النساء:75]
আর তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না! অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছে, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে বের করুন এ জনপদ থেকে’ যার অধিবাসীরা যালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন। আর নির্ধারণ করুন আপনার পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী। (সূরা নিসা-৭৫)
জ ) যালিমের পক্ষ ত্যাগ করা এবং তাকে যুলুম করা থেকে বিরত রাখা । আল্লাহ তা‘আলা বলেন, )وَلَا تَرۡكَنُوٓاْ إِلَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ فَتَمَسَّكُمُ ٱلنَّارُ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِنۡ أَوۡلِيَآءَ ثُمَّ لَاتُنصَرُونَ ١١٣﴾ [هود:113)
আর যারা যুলম করেছে তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; অন্যথায় আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক থাকবে না। অতঃপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না। (সূরা হুদ-১১৩)।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, যুলুম একটি পাপকাজ এবং এর জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে সবাইকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। তাই আমাদেরকে মাযলুমের পক্ষাবলম্বন করে যালিমের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا»
তোমার ভাই যালিমকে (যুলুম করা থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে) সাহায্য কর এবং মাযলুমকে (যুলুমের হাত থেকে বাঁচানো মাধ্যমে) সাহায্য কর। (বুখারী: ২৪৪৩)
লেখক : হাবীবুল্লাহ মুহাম্মাদ ইকবাল
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ