নদীর পানিপ্রবাহের ওপরই বাংলাদেশের জন্ম। নদী বিপন্ন হলে তাই বাংলাদেশের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়। নদী হারানোর সর্বনাশ এক-দুই বছরে, এক-দুই দশকে বোঝা যায় না। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে জিডিপি যে বহুগুণ বেড়েছে তার হিসাব আমাদের কাছে আছে, কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশের প্রাণ এই নদীমালার কতটা জীবনহানি ও জীবনক্ষয় হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। কংক্রিটকেন্দ্রিক তথাকথিত ‘উন্নয়নের’ বড় শিকার দুই দেশেরই নদীমালা। বাংলাদেশ অংশে নদীর বিপন্নতা ঘটেছে তুলনায় অনেক বেশি। একতরফা আক্রমণে বাংলাদেশের অসংখ্য ছোট নদী এখন একেকটি মৃতদেহ। আর বৃহৎ চার নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা এখন বিপর্যস্ত এবং আরও আক্রমণের মুখে।
বাংলাদেশের নদীগুলো যেভাবে খুন হচ্ছে সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: ১. ভারতের অন্যায় একতরফা আগ্রাসী তৎপরতা, ২. বাংলাদেশের নদীবিদ্বেষী উন্নয়ন কৌশল এবং ৩. রাজনৈতিক ক্ষমতায় নদী দখলদারদের আধিপত্য।
প্রথমত, ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪টি নদী। এগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ছোট নদী, শাখা নদীর সংখ্যা বাংলাদেশে আগে ছিল সহস্রাধিক। এখনো দুই শতাধিক নদী কোনোভাবে বেঁচে আছে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারতের যে যাত্রা শুরু, তা গত ৪৩ বছরে এমন স্থানে পৌঁছেছে যে বৃহৎ নদী পদ্মা ও পদ্মাসম্পর্কিত অসংখ্য ছোট নদী, খাল-বিল বিপর্যস্ত। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর বড় অংশ এখন শুকিয়ে গেছে। ভারসাম্যহীন পানিপ্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলের কৃষি। সেচের জন্য চাপ বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর, যা দীর্ঘ মেয়াদে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে।
শুধু তা-ই নয়, পদ্মা নদীর এই ক্ষয় তার সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলোকেও দুর্বল করেছে। এই প্রভাব গিয়ে পড়েছে সুন্দরবন পর্যন্ত। সুন্দরবনের কাছে নদীর প্রবাহ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েছে, তাতে ক্রমাগত ক্ষয়ের শিকার হচ্ছে বনের জীবন। অন্যদিকে, ফারাক্কার বিষক্রিয়া পশ্চিমবঙ্গ ও তার আশপাশেও পড়ছে। বিহারের মানুষ শাবল নিয়ে মিছিল করেছেন ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার দাবিতে।
কিন্তু এসব অভিজ্ঞতা বাঁধকেন্দ্রিক উন্নয়নচিন্তা ও বাঁধের ব্যবসায়ীদের থামাতে পারেনি। উপরন্তু ভারতের শাসকদের চিন্তাপদ্ধতিতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের স্বার্থ ও অধিকারের বিষয়টি একেবারেই অনুপস্থিত। টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তুতি থেমে নেই। এই বাঁধ বাংলাদেশের আরেক বৃহৎ নদী মেঘনার জন্য যে বড় হুমকি হবে তা বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। শুধু সরকারের গলাতেই সমর্থনের সুর।
ম্যাপ দেখলে দেখা যায়, ভারত থেকে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীগুলোর ওপর বিভিন্ন স্থানে কাঁটার মতো সব বাঁধ। তিস্তা নদীর ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। ভাটির দেশকে না জানিয়ে গজলডোবা বাঁধ দিয়ে যেভাবে একতরফা পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এই গ্রীষ্মে তাই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিশাল অঞ্চল পানির অভাবে খা খা করছে। তিস্তা নদীর প্রবাহ এখন শতকরা ১০ ভাগে নেমে এসেছে। ফারাক্কা ও গজলডোবা ছাড়াও মনু নদে নলকাথা বাঁধ, যশোরে কোদলা নদীর ওপর বাঁধ, খোয়াই নদের ওপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলাবান্ধায় মহানন্দা নদীর ওপর বাঁধ, গোমতী নদীর ওপর মহারানি বাঁধ এবং মুহুরী নদীর ওপর কলসি বাঁধসহ আরও ১৫-২০টি অস্থায়ী কাঁচা বাঁধ কার্যকর রয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম নদীসংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি ১৪টি নতুন খননকৃত খালের মাধ্যমে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের দিকে প্রবাহিত করা হবে। এটি কার্যকর হলে অন্যান্য নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের আরেকটি বৃহৎ নদী যমুনা আক্রান্ত হবে। শুকিয়ে যাবে অধিকাংশ নদী-উপনদী।
দ্বিতীয়ত, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের ভেতরের তৎপরতা। বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে পানিপ্রবাহের ওপর ৫০ দশক থেকে ধারাবাহিক আক্রমণ এসেছে ‘উন্নয়ন’ নামক বিভিন্ন প্রকল্পের সুবাদে। এই প্রকল্পগুলো করা হয়েছে বন্যানিয়ন্ত্রণ ও সেচসুবিধা সম্প্রসারণে বাঁধসহ নির্মাণমুখী কর্মসূচি হিসেবে। এখানে একটি দৃষ্টান্ত দিই, যার ফলে বড়াল নামে একটি নদ এখন মৃতপ্রায়। বড়াল নদ বাংলাদেশের দুই প্রধান নদী পদ্মা ও যমুনার সংযোগ নদী। দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০৪ কিলোমিটার, ১২০ মিটার প্রস্থ, এর অববাহিকা ৭৭২ বর্গকিলোমিটার। এর সঙ্গেই চলনবিল। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত এই নদীর মুখে স্লুইস গেট, ক্রসড্যাম, বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। অন্য প্রকল্পগুলোর মতো এ ক্ষেত্রেও সেচব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি, নৌপথ সম্প্রসারণ এসবকে লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রথম তিন বছর উৎপাদন ভালোই দেখা যায়। এরপর শুরু হয় বিপর্যয়। ফারাক্কার কারণে এমনিতেই পদ্মা নদীর প্রবাহ কম ছিল, উপরন্তু বড়াল নদের মুখে স্লুইস গেট বসানোতে পদ্মা থেকে আসা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। স্রোত কমে যায়, বহু জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা যায়। যমুনায় যেখানে বড়াল গিয়ে মেশে, সেখানে পানিপ্রবাহ খুবই নিম্নস্তরে নেমে যাওয়ায় যমুনা নদীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভাঙন বিস্তৃত হয়। অববাহিকার প্রায় এক কোটি লোকের জীবন ও জীবিকা এখন হুমকির মুখে। বড়াল শুকিয়ে যে জমি উঠেছে, তা এখন নানাজনের দখলে।
তাই নদীর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির সুবিধাভোগীও আছে। তাদের প্রধান অংশ সম্পদ ও ক্ষমতায় শক্তিশালী। নদী দুর্বল হয়ে গেলে নদী ক্রমাগত জমিতে রূপান্তরিত হয়। তখন তা দখল করা অনেক লাভজনক। নদী বাঁচলে তার মূল্য টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় না, কিন্তু মরলে তার দাম শত-হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। সে জন্যই যারা এর ভাগীদার, তারা নদীবিধ্বংসী উন্নয়ন ধারা বহাল রাখতে অনেকেই আগ্রহী। তা ছাড়া এসব বাঁধ বা নির্মাণকাজ প্রধানত বিদেশি ঋণের টাকায় হয়। ফলাফল যা-ই হোক, ঋণদাতা, কনসালট্যান্ট, ঠিকাদার, আমলা ও ভূমিদস্যুদের লাভ অনেক।
তৃতীয়ত, এই দখলদারদের জমির ক্ষুধা বাড়ছেই। বাংলাদেশের সীমিত জমি তাদের ক্ষুধা পূরণে সক্ষম নয়। সে জন্য তাদের দখলের আওতায় যাচ্ছে বন, জঙ্গল, পাহাড়, জলাভূমি, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, বিল, খাল এমনকি নদী। সারা দেশেই এই ঘটনা ঘটছে। খোদ রাজধানীতে বুড়িগঙ্গা, পাশে তুরাগ, বালু নদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই দৃশ্য আমাদের সবাইকে জানিয়ে দেয়, এই দেশে হয় সরকার নেই, থাকলে তার কাজ দখলদারদের সমর্থন দেওয়া, জনপ্রতিরোধের মুখে তাকে রক্ষা করা। এ ছাড়া নদীদূষণের মাধ্যমে তাকে মেরে ফেলার হাজার আয়োজন চলছে সরকারি বা ব্যক্তি-গোষ্ঠীর মাধ্যমে।
ভারত যেভাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদীগুলোর জীবন সংশয় ঘটাচ্ছে, তা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের জনগণের এবং সর্বোপরি সমগ্র মানবসমাজের বড় ক্ষতি। বাংলাদেশ যাঁরা চালান, তাঁরা জনগণের স্বার্থ কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ননীতি সাজালে এই নদী ও খাল-বিলগুলোর জীবনও সচল করতেন এবং ভারতের এসব আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা গ্রহণ করতেন। সেসব ভূমিকা নেই। উল্টো তাঁরা নদ-নদী, সুন্দরবন সবই ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ভারতের পণ্য-যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য তিতাস নদের ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে।
দেশি দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতা দান যেমন সরকারের ভূমিকা, অন্যদিকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার না করে, প্রস্তুতি না নিয়ে, বিশেষজ্ঞ মতামত তোয়াক্কা না করে ‘ভারত কোনো ক্ষতি করবে না’ সেটাই বারবার মুখস্থ বলে যাওয়া সরকারের একমাত্র কাজ মনে হচ্ছে। ‘কোনো ক্ষতি হবে না’ এটা যদি বাংলাদেশ সরকারই আগে থেকে বলতে থাকে, তাহলে দর-কষাকষি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, জনগণের উদ্বেগ বিবেচনার আর জায়গা থাকে কোথায়? এটা শুধু তিস্তা চুক্তির বিষয় নয়, সামগ্রিকভাবে অভিন্ন নদী নিয়ে, বিদ্যুৎ করিডর নিয়ে, ট্রানজিট নিয়ে। সব বিষয়েই বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক আইনি অবস্থান গ্রহণের প্রয়োজন আছে। এর জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি দরকার, নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। তা আমাদের আছে কি? নেই। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকারের কোনো প্রস্তুতি আছে? নেই। মন্ত্রণালয়ে কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে? না। দেশি-বিদেশি দখলদারদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের ফলেই এই অক্ষমতা, এই অপ্রস্তুতি, এই মুখস্থ অর্বাচীন কথা।
নদী বিপন্ন হলে মানুষের জীবন কী করে স্বচ্ছন্দ হয়? হয় না বলেই কোটি মানুষ দিশেহারা। যারা নদীর লাশ খেয়ে ফুলেফেঁপে ওঠে, তাদের ওপর ভরসা করার উপায় নাই। অথচ এই নদী বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যতের অস্তিত্বের অবলম্বন। চোখের সামনে খুন হচ্ছে নদী। চোখ বন্ধ করে থাকলেই জীবন বাঁচবে না। এটা কেবল নদী নয়, আমাদের সবার, দেশ ও মানুষের প্রাণ। আমাদের ভূমিকাই আমাদের জীবন বা মরণ নির্ধারণ করবে।
সৌজন্য
(প্রথম আলো)
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।