একপাতা কাগজ নিয়ে ভাঁজের উপর ভাঁজ বসানোর পর তৈরি হয়ে গেল নৌকা। হতবাক হয়ে আলতো হাতে নৌকার মাঝের পাল ধরে পানিতে ভাসলাম। ঐ নৌকাটা এই পদ্ম পুকুরেই ভাসিয়েছিলাম। আমার বুবু নৌকাটা বানিয়েছিলেন। মোবাইলে সংবাদটা শোনার সময় মা আমার পাশেই ছিলেন। আমি কিছুই বলিনি। তবুও মা বুঝতে পারেন। হতভম্ব হয়ে মাটিতে বসে পড়েন। একটুকু শব্দ না করে মাটির দিয়ে চেয়ে থাকেন। রসুই ঘর থেকে আমার ছোট বোন ইলা দৌড়ে এসে মাকে ঝাপটে ধরে। পুরো ঘরটায় বিষাদের ধোঁয়া ছড়িয়ে আমি বের হয়ে আসলাম। একটু আগে আমার বুবু আত্মহত্যা করেন।
জাদুর হাসি ছিল বুবুর। কৃষ্ণবর্ণের গাত্র কিন্তু গালের ছোট্ট টোল হাসিকে স্নিগ্ধ করে তুলছে। শেষবার শশুর বাড়ির দরজার কড়া নাড়লে বুবু দুয়ার খুললেন। আমাকে দেখেই বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে মুখে সেই জাদুর হাসি টানলেন। বুবুর শশুর বাড়ির নাম ‘দীঘির পাড়ের বাড়ি।’ বেশ বড়সড় দীঘি। প্রায় বিঘা পঞ্চাশের মত হবে। চারপাড়েই মানুষের বসবাস। দীঘিতে মাছের খাবার দেওয়ার জন্য কয়েকটা ডিঙি নৌকা আছে। বুবু দীঘির ঘাটের সিঁড়িতে বসে মাছ কুটতেছিলেন। আমি দীঘিতে খেয়া বেয়ে ঘাটে এসে বুবুর মুখ দেখি। বুবু শত বিষাদ ঢেকে রাখতে জানেন। চোখ তুলে বুবু বললেন, ‘আব্বা কবে আইবো?
-‘এইতো মাস দুয়েকের মইধ্যে।’
-‘এরা খুব জ্বালায়! খুব খোটা মারে! আর....’
বুবু চুপ রেখা টানেন।
বৈঠা ডুবিয়ে দীঘির গভীরে যেতে যেতে জল ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাই – ‘আর গায়ে হাত তোলে’।
সংসারের ঘানি টানতে হিমশিম খাচ্ছিলেন বাবা। নানান জনের কাছে ধার করে মাঝ বয়সে বাবা ওমানে পাড়ি দিয়েছেন। বুবুর বিয়ের সময় কয়েক ভরি স্বর্ণ আর ছেলের বাড়ির দালান তুলতে টাকা দেওয়ার কথা ছিল। এমনিতে ধার দেনায় আমরা প্রায় ডুবু ডুবু। তবুও বুবুর জন্য ওখানে কিছু স্বর্ণ কিনে রাখে বাবা। দেশে আসলেই বিয়ের পণ দিলে বুবুর সংসারে হয়ত একদন্ড শান্তি মিলবে।
জোছনা নেমেছে। থকথকে জোছনা। জোছনার শুভ্র আলোয় কেমন যেন গা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তবুও পদ্ম পুকুর পাড়েই জিম ধরে সারারাত বসে থাকি। সকালে ইলা এসে বলে গেল, ময়না তদন্ত শেষে বুবুকে বাড়িতে আনা হয়েছে। বাদ জোহর জানাজা হবে। বুবুকে শেষ বারের মত দেখতে যেতে আমার ইচ্ছে করছে না। আমার চোখে লেগে আছে হাসি ভরা মায়াবী এক মুখ। নিথর পড়ে থাকা হলদে মুখখানি সারা জীবন আমাকে পোড়াবে। যাবার বেলায় ইলা বলল, ‘ঐ বাড়ির পাশের লোকজন জানালো, বুবুকে প্রহারের পর বালিশ চাপা দিয়ে মারা হয়। এরপর গলায় ওড়না বেঁধে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। শশুর বাড়ির সবাই এখন নিরুদ্দেশ।’
রোজ রাতে চাঁদের বুড়ির গল্প বলতেন বুবু। আর থাকত আমার রাজকুমার ও পঙ্খীরাজ ঘোড়ার গল্প। পঙ্খীরাজ ঘোড়ার জন্য বায়না ধরলে বলতেন, ‘আমার যখন লাখ খানিক টাকা হবে তোকে একটা পঙ্খীরাজ ঘোড়া কিনে দিব।’ রাখালগাছি ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে বসে বাবা এক লাখ টাকা আমার হাতে তুলে দিলেন। একটু আগে বুবু হত্যার বিচার কার্য সম্পন্ন হয়েছে। বিচারক ছিলেন সব দলীয় নেতা কর্তা। তিন লক্ষ টাকা জরিমানা ধার্য হয়। নগদ উশুল এক লাখ। আমি টাকা নিয়ে পদ্ম পুকুর পাড়ে এসে বসি। হাজার টাকার বান্ডেল থেকে একটা নোট বের করে ভাঁজ করি। ভাঁজ বসিয়ে নৌকার বানাই। দুহাতে আলতো করে পুকুরে নৌকা ভাসাই। একে একে অনেকগুলো নৌকা বানিয়ে ফেলি। আর বলতে থাকি, ‘দেখ বুবু! আমি এখন নৌকা বানাতে পারি।’
১৮০৯১৪