সুন্দরবনের অতিনিকটে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের তিনটি চু্িক্ত স্বাক্ষরিত হয়েছে ২০.০৪.২০১৩ তারিখে। চুক্তি তিনটির মধ্যে রয়েছে যৌথ উদ্যোগ চুক্তি, বাস্তবায়ন চুক্তি ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি। ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ২০১২ সালে ২৯ জানুয়ারি ১হাজার ৩শত মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানে স্ব স্ব দেশের পক্ষে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে। সেই চুক্তির ধারাবাহিকতায় আরো তিনটি চুক্তি স¦াক্ষরিত হয়েছে আর তিনটি চুক্তিরই মুল লক্ষ্য দুই দেশের অংশীদারিত্বের ভাগাভাগির রুপরেখা প্রণয়ন।http://www.jugantor.biz/2013/04/25/page0919.htm
সরকার বলছে পরিবেশ ও প্রতিবেশের দিকে লক্ষ্য রেখেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে যাতে পরিবেশের উপর প্রাকৃতিক প্রতিকুলতার প্রভাব প্রশমন করা যায় । কিন্তু,পরিবেশবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবন মারাতœকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু সরকারের কথা ও কাজের মধ্যেও বিস্তর ফারাক রয়েছে। খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের অনুকুলে পরিবেশ ছাড়পত্র ইস্যু করেনি। পরিবেশ অভিঘাত নিরুপন (আইইএ) সার্টিফিকেটও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে দেয়া হয়নি।
আইইএ প্রদান করার আগেই রামপালে প্রকল্পের নির্ধারিত জায়গায় পরিবেশ সংরক্ষন আইনের বিপরীতে উন্নয়ন কাজ শুরু করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে সরকার সারা দেশে পরিবেশের গুরুত্ব নিরুপন করতে গিয়ে তিনটি ক্যাটাগরিতে পুরো দেশকে ভাগ করেছে। লাল, কমলা ও সবুজ। সবুজ ক্যাটাগরির প্রকল্প বা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ বান্ধক বলে বিবেচিত। কমলার অবস্হান না ক্ষতিকর না পরিবেশ বান্ধব মোট কথা মাঝামাঝি একটা অবস্হা কিন্তু লাল ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোকে পরিবেশের জন্য বিপদজনক বলে অভিহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ লাল ক্যাটাগরি প্রকল্পগুলোকে পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান করার আগে উক্ত এলাকার একটা পরিবেশ অভিঘাত নিরুপনের লক্ষ্যে (আই ই এ) সার্টিফিকেট বা ছাড়পত্র নিতে হয় এবং আই ই এ সম্পন্ন করার পর পরিবেশ ব্যবস্হাপনা সম্পর্কিত প্লান ( ইএমপি) উপস্হাপন করে অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করতে হয়। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি লাল ক্যাটাগরির প্রকল্প হওয়া সত্ত্বেও আইইএ ও ইএমপি করা হয়নি। উপরুন্তু রামপাল এলাকার দুরত্ব সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯ কিমি হওয়ায় উক্ত এলাকা পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) অর্ন্তভুক্ত। পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষন আইন অনুযায়ী ইসিএ এলাকায় লাল ক্যাটাগরির কোন প্রকল্পে অধিদপ্তর পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান করতে পারেনা। কিন্তু অধিদপ্তর থেকে লিগ্যাল অনুমোদন ছাড়াও রাষ্ট্রিয় প্রকল্প হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যা দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি অশ্রদ্ধার সমান।
অধিদপ্তর হতে এ প্রকল্পের স্হান নির্বাচন ও পরিবেশ ও প্রতিবেশগত সম্ভাব্য ক্ষয় ক্ষতির তথ্য উপাত্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারকে বুঝালে এ প্রকল্প নিরাপদ কোন স্হানে করা সম্ভব হতো বলেও বিশেষঙ্ঘরা মনে করে । অর্থাৎ অধিদপ্তর থেকে যদি সরকারকে স্হান নির্ধারণে পুর্ণবিবেচনার বৈঙ্ঘানিক যুক্তিগুলোর আলোকে তাদের অবস্হানে অটুট থাকতো তাহলে সরকারের বোধদয় উদয় হতো একথা নিসন্দেহে বলা যায় কিন্তু অধিদপ্তর থেকে তা করা হয়নি।কেন করা হয়নি সেটাও স্পষ্ট।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পরিবেশের কি ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হবে তার তুলনামুলক চিত্র দেয়া যেতে পারে। ১. রামপালে নির্মিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অব¯হান সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯ কিমি অদুরে। কিন্তু সুন্দরবনের গুরুত্ব পরিবেশ ও প্রতিবেশগতভাবেই সর্বাধিক। সুন্দরবনে বসবাস করে এমন জীব জন্তুর প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২৪হাজার। সুন্দরবন পৃথিবীর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ম্যানগ্রোভ বনগুলোর অন্যতম ও জীবন্ত স্বাক্ষি। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনগুলো ইতিমধ্যে অনেকাংশেই বিলুপ্ত হওয়ার পথে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে তবে সুন্দরবনের আকৃতি ও পরিধি সর্ববৃহৎ। এই জন্য সুন্দরবনকে পৃথিবীর বৃহত্তোম ম্যানগ্রোভ বন বলা হয়। এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে যদি সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় তবে তা কি আর্থিক মানদন্ডে পুরণ করা সম্ভব?
২. কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে বাজে দিক ডাস্ট বা কয়লাধূলো ব্যব¯হাপনা । এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে অতি মিহিরাকৃতির বা অতিক্ষুদ্রকার কণার কোল ডাস্ট সৃষ্টি হয় যা অতি সহজেই বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এ ধরনের ডাস্টে সালফার, সিসা, আর্সেনিক ও অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত হওয়ায় সহজেই বাতাসে মিশে বাতাসকে দুষিত করে ফেলে। আর এই দুষিত বাতাস জীববৈচিত্র্য বা বায়োডাইভারসিটির বিপদজনক। ফলে কম সহনশীল প্রাণী ও গাছপালা টিকে থাকার প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়ে। কয়লা পুড়ানোর কারণে পৃথিবীর আভ্যন্তরীন তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে। প্রচুর কার্বন নি:সরণের ফলে বাতাসে সিসাযুক্ত বিষ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য এ বাতাস ব্যবহার করলে নানান ধরনের নিত্যনতুন রোগের উপসর্গ দেখা দিবে। অধিকন্তু বাতাসের কমপোজিশন বিষাক্ত উপাদানে ভারী হয়ে যাওয়ার কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অভাবনীয়হারে হ্রাস পাবে। বৃষ্টিপাতের অভাবে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন ও এর আশ পাশ অঞ্চল ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হবে।
৩. কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিঘন্টায় মিঠা পানির প্রয়োজন হয় ৮০০ গ্যালন। অর্থাৎ ১৩৫০ মেগাওয়াট একটা বিদ্যুৎ প্লান্টে দৈনিক মিঠা পানির প্রয়োজন হবে ৫১ কোটি ৮৪ লাখ লিটার। এখন উপকুলে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হলে মিঠা পানির আধারকে ধ্বংস করতের হবে গভীর নলকূপ বসিয়ে। কারণ উপকুল অঞ্চলজুড়েইতো লবণ পানির আধিক্য।
৪: কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বর্জ্য ব্যব¯হাপনা সত্যিকার অর্থেই দুরুহ। এক মেগাওয়াট বিদ্যুতে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ ২৫০ টন অর্থাৎ বছরে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্জ্য উৎপাদিত হবে ২৫০ মেট্রিক টন। তার মানে ১৩৫০ মেগাওয়াট থেকে উৎপাদিত বর্জ্যরে পরিমাণ হবে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫শত টন। বর্জ্যের পাশাপাশি বাতাসে মিশ্রিত ধূলা ছাড়া পরিগণিত ডাস্টের পরিমাণ দাড়াবে ৫ লাখ ২১ হাজার ১শত টন। এসব উৎপাদিত বর্জ্য ঠকমতো ব্যব¯হাপনা করা না গেলে এসব বর্জ্য খাল বিল নদী নালায় মিশে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। যেভাবেই এসব ডাস্ট ও স্লাড ব্যব¯হাপনা করা হোকনা কেন তা ভূগর্ভ¯হ পানির আধারস্তরে মারাতœকহারে বা খুব বাজে ভাবেই দুষণ সৃষ্টি করবে। ফলশ্রুতিতে বিদ্যুৎ অঞ্চলের সুদীর্ঘ এলাকা খাবার পানি শুন্য হয়ে পড়বে।
৫: কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোলিং সিস্টেমে প্রচুর পানি ব্যবহার করতে হয়। ১৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে বৎসরে মোট পানির প্রয়োজন ১৮৭.৫১ বিলিয়ন লিটার। এতদ পরিমাণ পানি ব্যবহার শেষে পুণরায় নদীতে বা আর্টিফিসিয়াল ক্যানেল সৃষ্টি করে বা প্রচলিত সমুদ্রের চ্যানেলে ছেড়ে দিতে হবে। আর ছেড়ে দেয়া পানির গড় তাপমাত্রা থাকবে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এত বিশাল পরিমানে গরম পানি নদীতে পড়ামাত্র নদীতে বসবাসকারী জলজপ্রাণী ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ সমুলে ধ্বংস হয়ে যাবে।
সাধারণত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কয়লাকে পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কয়লা থেকে উৎপন্ন তাপকে প্রকৃতিতে অপ্রকৃতি¯হ অবস্হায় ছেড়ে দেয়া হয়। অথবা গরম অব¯হায় পানির মধ্যে শোষন করা হয়। যা উভয় অব¯হায় প্রকৃতিকে বিরুপ করে তোলে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের জিডিপির গ্রোথে বিদ্যুতের প্রয়োজন। আপনি ও আপনার সরকারের দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার যে স্বপ্ন রয়েছে তাতেও বিদ্যুতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন তার মানে এই না আমাদেরকে সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। সুন্দরবন আমাদের গর্ব। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট, সামান্য একটা ভুলে যেন প্রকৃতির এতোবড় ক্ষতি না হয়। আপনি জনগণের নেতা দেশের নেতা বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন আপনার কাজ তেমনি দেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করাও আপনার নৈতিক দায়িত্ব। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্হান রামপাল থেকে সরিয়ে নিরাপদ কোন জায়গায় নির্ধারণের জন্য পুর্ণবিবেচনার সময়োচিত সিদ্ধান্ত এদেশের আপামর জনসাধারন আশা করে।
হাসান কামরুল: জ্বালানী ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক।