১] সকাল বেলাটা ছিল খুব ধোঁয়াশা। বাতাস জলীয়বাষ্প ধরে না রাখতে পেরে ছেড়ে ছেড়ে দিচ্ছিল! আমাদের মতই-সম্পর্ক ধরে না রাখতে পেড়ে আমরাও! ধোয়াটে সেই আস্তরণে হাটতে বেশ লাগে। নিজের কাছে নিজেকে লুকোনোর মত! জলের মিহি বাষ্পকণা চোখে মুখে ঝাপটা দিয়ে গেলে তার মনে পড়ে- আহা- বিস্মৃত সেই অতীতে; এই রকম কতবার হেটে বেড়িয়েছি। বিকেলে খেলতে না গিয়ে, ক্যাচক্যাচে সাইকেলটা নিয়ে কত বেড়িয়েছে। আহা- সেই বালক বেলা।
জীবন নাকি ক্ষয়িষ্ণু! মেরামতের জন্যে নাকি মাঝে মাঝেই তার রসদের প্রয়োজন পড়ে। সেই রসদের প্রয়োজনেই নাকি সেদিন সে ছুটে বেরিয়েছিল- এ পাড়া থেকে ও পাড়া, ক্ষেতের এ আল থেকে সে আল। ডিপকল /সেলুকলের উগড়ে দেয়া টলটলে স্বচ্ছ পানিতে মাথা এগিয়ে দেয়ার আগে সে কি খুব করে ভেবেছিল একবার- যে বাসনের উপরে বাসন দিয়ে গামছায় বেধে দেয়া জাউ বা গরম ভাতের সাথে লাল করে দেয়া সেই ভর্তার খুব দরদ একদিন খুউব করে কাটা দেবে? হাটতে হাটতে সামনে পড়া সেই অসম্ভব টক তেতুল গাছ- যার নরম পাতা ছিঁড়ে মুখে দিলেও, চোখের পাতা দু তিনবার পিটপিট করে মুদে আসত! তার একপাশে সেই যে কাঠালতলা! দুপুরের খা খা গরমে যার তলায় বসলে, কোথা হতে বয়ে আসা ঝিরি ঝিরি বাতাসে আরামে গায়ে কাটা দিত! সেই যে জীবন তার আজ স্বপ্নের মত মনে হয়।
যেমন স্বপ্নের মত লাগে, কাঁঠালতলা পেছনে ফেলে একটু এগিয়ে হাতের বামের শিমুল গাছটা! তিনমাথার একদম কেন্দ্রে সটান দাড়িয়ে চার পাশে মেলে দেয়া তার শাখা প্রশাখা! মৌসুমে তার আগুনলাগা শাখা প্রশাখায় পাখিদের কিচির মিচির। ঝড়ে পড়া একদম তাজা আগুনের মাঝ খান থেকে বের করে আনা সেই লিপস্টিক! অথবা, তারও কিছুদিন পড়ে ঝড়ে পরা মোচার খোল ছড়িয়ে পৃথিবীর বুকে ভাসিয়ে দেয়া সেই শিমুল তুলো। বাতাসে উড়ে উড়ে কতদুর যে যেত! তার মনে হত, পৃথিবীর সীমানা বুঝি খুব বেশি দূরে না।
সকালের মিহি কুয়াশা ভেজা ঘাসের উপর নগ্ন পা ফেলে হেটে যাওয়া সেই সকাল গুলো তার কেমন নেশা জাগানো ছিল। তাই ঢুলুঢুলু চোখে লাঙলের কুটি ধরে গরুর লেজ ধরে হঅ...হট...হট আর সেলুকলের পানিতে ভেজানো কর্ষিত কাদাময় জমির সোদা গন্ধে ঠিক মাত হত! সেই রকম নেশা জাগানো সময়েই একদিন তার ইচ্ছের পাতায় যোগ হল- ফেরীওয়ালা।
২] সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি। গত দশ বারো দিন ধরেই চলছে। কখনো টিপ টিপ, কখনো মুষলধারে। ‘মঠকীতে চাল বাড়ন্ত-রে! আর, ঘরে মাছ টাছ কিছু নাই; কি করা যায় ক দেহি?’- মায়ের কথা শুনে কপালে ভাজ পড়ে। কতইবা আর তার বয়স- ৯-১০? কিন্তু জীবনের ঠোকরে এখনই সাংসারিক পূর্ণ জ্ঞান লব্ধ! অকালে বাবা হারানোয়, খাবি খেতে থাকা ছোট্ট সংসারের বৈঠা বড়জনের হাত ফস্কে ক্যাম্নে যেন তার হাতে উঠে আসে! অনভিজ্ঞতায় তাতে ঘুর্নির মত সে পাক খায়- ঘোলা সময়ে!
চৌকির নিচে রাখা জালটা কাধে নিয়ে পায়ের নখে টিপে টিপে বাড়ী থেকে সে বের হয়। গন্তব্য- নদী!
হাটতে হাটতে কি তার ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়ে? নাকি বড় ভাই? দুজনেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত! ঘানিটা তাই তার একারই ঠেলতে হয়! কাক ভেজা হয়ে দুপুর গড়িয়ে যখন সে বাড়ী ফেরে, ডোলা ভরা মাছ তার বালক মন থেকে নিমিষেই সব চিন্তা দূরে ঠেলে দেয়। গভীরে চাপা দেয়া ছেলেমানুষি আবার ভেসে উঠে। বারবারী থেকেই সে হাক দেয়… মা, মা, অ মা!
৩] পড়াশোনার প্রতিযোগিতায় অনিচ্ছুক ছেলেটাকে বাবার ইচ্ছাতেই এখানে সেখানে উপবৃত্তিতে অংশ নিতে হয়। বাপের খুব চাওয়ায়, তার কাজও খুব সহজ হয়ে আসে--- খালি পরীক্ষায় বসলেই হয়! বৃত্তি পাওয়া না পাওয়া কোন ঘটনা!? বাবা তাকে নিয়ে যান- এখানে সেখানে। ২০ টাকা / ৫০ টাকায় ফরম কিনে জমা; তারপর, পরীক্ষার দিনে তাদের রিক্সায় চেপে বসতে দেখা যায় ! ছেলের পরনে প্যান্ট আর শার্ট! মাথায় মায়ের হাতে ঘষটে ঘষটে লাগানো চুল চপচপ নারিকেল তেল! বাবার পরনে লুঙ্গী আর ফুল হাতা শার্ট।
কোন কোন দিন একদিনে দুই পরীক্ষা থাকে। মাঝের সময়কালে, বাবার ইচ্ছার প্রতি কোন সন্মান না দেখিয়েই সে ঘুরে বেড়ায়- আহা অই যে নারিকেল গাছটা, এই যে চকমকি পাথর, আরে নিম গাছের ডালে ওইটা বুলবুলি না! জীবনের কল্পিত ঝোলায় গল্প জমা হয়। ফেরিওয়ালার জীবন চিন্তা করে চোখমুখ ঝকমক করে! আর বাড়ীর পাশের ধুলা উড়ানো মেইন সড়কটার থেকে গাঙ্গের দিকে চলে যাওয়া দুপেয়ে পথের একদম শেষ মাথার তালগাছের উপরে সুর্যের হেলে পড়ায়, আরো একটা দিনের অবসান হয়!
৪] লাংগলের কুঠি লাগাল না আসায়, নিচের অংশ টাইট করে বুকে বেধে সে পাজুন নিয়ে টুক করে নেমে পড়ে- হাল চাষে। শক্ত মাটিতে লাঙ্গলের ফাল বসতে চায়না, লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে- আর বুকের চামড়া ছিলে ছিলে যায়! পুরোটা খেত চষতে চষতেই বুকে দগদগে ঘা! বাড়ীতে ফিরে দুভাইয়ের গল্প শোনা- জানিস, স্কুলে না আজ স্যার কত মজার একটা গল্প শুনাইছে; শুনবি?
গত মাসে সেই উত্তর পাড়ার কাসেম-এর ঘানিতে ভাঙ্গানো খাটি সরিষার তেল, বুকে হাতে মাখাতে মাখাতে মায়ের চোখ কি ঝাপসা হয়ে আসে! হারিকেনে’র নরম টিমটিমে অদ্ভুত আলোয় মা – ছেলের দুজনের চোখেই রহস্য খেলা করে!
সেই রাতের একযুগ পরেও দিনের শেষে রাত আসে! ছেলেটা বর্ণ পরিচয়ের বই কিনে পাটকাঠির স্তুপের ভেতরে লুকায়ে রাখে! সারাদিন কাজ কাম শেষে দৌড়ায় রাতের স্কুলে।
৫] বাপের প্রয়োজন থেকে মাছ ধরার বিষয়টা উত্তরাধীকার সুত্রে তার কাছে হস্তান্তরিত হয়- শখ হিসাবে। মাঝে মাঝেই ছেলেটা বড়শি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে- নদীতে ট্যাংরা ধরতে; অথবা- খালে, পুঁটি ধরতে। দুএকদিনের স্কুল কামাইও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হয়!
সূত্র আবিষ্কৃত হয়ঃ সুলতানদের পুকুরে কচুরীপানা দলের মাঝের ফাক গলিয়ে বড়শি ফেলে দিতে পারলেই একখান কই/ শিং মেলা খুবই সম্ভব।
দুপুরের খাবার সময় পেড়িয়ে যায়, হাতে পায়ে কাদা মেখে- জঙ্গলের মশার কামড় খেয়ে সে ঠায় দাড়িয়ে থাকে। অধ্যাবসায়ে বাগড়া আসে একমাত্র তখনই যখন ক্ষেতের শেষ আলের মাথায় দেখা যায়- চোখমুখ লাল করে লাঠি হাতে তেড়ে আসা – মা। এবার কল্পিত ঝোলায় গল্পের সাথে আকঙ্খারও অনুপ্রবেশ ঘটে- ইশ, কবে বড় হব!
৬] সংসার সামলানো, মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডী পেরোতে পেরোতেই চুলে পাক ধরে! এর মধ্যে- মাধ্যমিকের ফল্প্রকাশের দিনে মায়ের চোখে চিকচিক করা মুক্তোর দানা দেখা যায়। রাতের খাবার শেষে- ঢিমেতালে জ্বলা হ্যারিকেনের আলোয় চলা আপাত অর্থহীন কথাবার্তার মাঝে মাঝেই অকারণ উচ্ছ্বাস ভেসে বেড়ায়। পোড়া পীঠের ফোসকা আজ আর চাটাইয়ে ঘুমের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না!
৭] এস এস সি রেজাল্টের ঠিক ছয়দিন পড়ে সে বড় হয়ে যায়। স্কুলের কোন এক কোর্স টিচারের ভবিষ্যতবানী সফল করে দিয়ে, পরীক্ষার আগেই ঢ্যংঢ্যাঙ্গা বেড়ে সে উঠেছিল ঠিকই, খালি বয়সের পরিপক্কতার কমতি ছিল। থাকারই কথা- বাবা চেয়েছিল একটু ধাক্কাদিয়ে সামনে এগিয়ে দিতে । তাই- বয়স পাঁচের আগেই বইপত্র সব বগলদাবা করে স্কুলের পথ ধরতে দেখা যায়! যাইহোক, বালকবেলা থেকেই সে দেখে আসছে, তার সকল আবদার দুদিন পরে হলেও পূরণ হয়। তাই পরীক্ষা শেষে দেওয়া বড় শহরে পড়তে যাওয়ার ঘোষণায় বাবার চুপ থাকা মানেই অনুকূল ধরে নিয়েছিল। বাস্তবতার কশাঘাতে বয়স দৌড়ে ব্যবধান কমায়! সময় এসে হাতে ধরে সব বুঝিয়ে যায়- ফিসফিস। ফেরিওয়ালার স্বপ্নকেও সে গল্প শোনায়- ফিসফিস।
৮] আজ সেই গুটি ধরা কাঁঠাল গাছের নীচে, দুই প্রজন্মের দুই বালক ঊবু হয়ে বসেছিল। সময়ের ঝড় ঝাপটা গাছের উপরেও এসে পড়েছে! পাশের সেই তেতুল গাছ কবেই বিগত! শুধু শিমুল গাছটা বিশাল প্রতাপ নিয়ে এখনো সটান দাঁড়িয়ে। সেই সেলুকলের পতনে, তার সমগোত্রের আরেকজন এখন দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। ধান খেতে সেই লু হাওয়ার মাতামাতি। বাড়ির সামনের সেই ধুলি মাখা পথ কবেই আধুনিকতার ছোয়ায় পীচের নীচে ঢাকা পড়ে আছে! তার গল্প আর কে জানতে চায়! শুধু মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতা চিরে সমগ্র বাংলাদেশ- ৫ টন যখন ধেয়ে যায়, তখন তারও মনে পড়ে- কোন এক বিস্মৃত অতীতে- ধুলিমাখা তার বুকের উপর দিয়ে আখবাহী গরুর গাড়ীর মন্থর ক্যাচক্যাচে চলে যাওয়া।
সুলতানদের পুকুরের উপরে আজ ইট কাঠের খাঁচা।
কাঠাল গাছের নীচে বালকদের কথোপকথন হয় খুব টুকটাক। খালি অব্যক্ত কথাগুলা কাঠির আঁচড়ে মাটিতে হাবিজাবি একে চলে। হয়তো প্রথম প্রজন্ম বড় একটা শ্বাস ছেড়ে ফেলে আসা অরৈখিক পথের কথা মনে করে। তার চোখে ভেসে আসে, দ্বিতীয় জন; সেই পথের কোন অংশটা একসাথে পাড়ি দিয়েছে। ঊবু পায়ে পিপড়ার কামড়ে সম্বিত ফিরে আসে।
মনের চিন্তা কণ্ঠনালীতে প্রতিধ্বনি তোলে-—“দেখছস, কি রহম ব্যাকাত্যাড়া—পিপড়ার রাস্তা?”
অদ্ভুত হলেও সত্য, পাশের জনের মুখ থেকে- ঠিক একই চিন্তায় অস্ফুটে বেরিয়ে আসে--- “হ, আব্বা; -- অরৈখিক!”
চার চোখের চোখাচোখির পরে, এই ভারিত্ত্বের বাকী কথাবার্তা বয়ে চলার জন্যে- আজ অবধি পৃথিবীতে বর্তমান এক এবং একমাত্র মাধ্যমেরই প্রয়োগ হয়—মৌনতা।
নির্ঘণ্টঃ
সেলুকল/ডিপকল- সেচ দেয়ার জন্যে পানির পাম্প
জাউ- আতপ চাল দিয়ে সিদ্ধ করা নরম- পানিসমেত ভাত
পাজুন- হালচাষে গরু তাড়িয়ে নেয়ার জন্যে লাঠি বিশেষ
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:২৫