somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্যা ম্যান উইথ জার্মান শেপার্ড!

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইউনিভার্সিটি থেকে প্রায় আধা ঘন্টার ড্রাইভ। সিনিক ভিউ রোড দিয়ে প্রথমবার যখন যাই, তখন ফল’এর প্রায় শেষ। গাছের রঙিন পাতারা ঝরে ঝরে পড়ছে। বিকেলের শেষ আলোয়, সাড়ি সাড়ি গাছের ফাক দিয়ে লালচে আলোর হটাত চিকমিকে নরম মিঠে রোদ নিয়ে যেতে যেতেই মনে কোনে আকুপাকু করে উঠে, আহা... সৃষ্টিকর্তা এ পৃথিবীটা বড়ই আদর আর দরদ দিয়ে বানিয়েছেন!

নতুন আসা এই দেশে, শঙ্কিত আর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া আমি, গ্রীষ্মের শেষে’র সেই অতুলনীয় সন্ধ্যার অপরূপ দেখে অস্ফুটে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল- “অপূর্ব!” সেই অবিস্মরণীয় মুহুর্তে আর সব কিছু ছিল গৌণ। তাই সকল আতিথেয়তা, জনসমাগমের মাঝেও কেমন যেন নিজের ভেতরে একটুকরো নির্জনতা লালন করে রেখেছিলাম। ঝড়ে ভেঙে পরা একশো বছরের পুরাতন সাদা পাইন গাছের কাণ্ডে তৈরি ম্যাপল সেপ সংগ্রহের কেবিনে দাড়িয়ে সমস্ত প্রসেস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারনা দেয়া সেই ভদ্রলোকের (ডেভিড রজস্কি) প্রতি খুব গভীর মনোনিবেশ করা হয়নি। বলছিলাম ম্যাপল সিরাপ ফার্মে প্রথমবার ভিজিটের কথা। ২০১৪ তে, আমার প্রথম সেমিস্টারের শুরুর দিকে, ইউনি’র ইন্টারন্যাশানাল স্টুডেন্ট এসোসিয়েশান থেকে নতুন স্টুডেন্টদের নিয়ে অনেকগুলা আউটিং এর একটা ছিল ম্যাপল সিরাপ ফার্ম ট্রিপ।


ঘন সেই ম্যাপল ট্রির বনে হাটতে হাটতে নিজেদের পদধ্বনি, টুকটাক কথাবার্তা ছাড়া সাথে ছিল বনের নির্জনতা, নির্মল ঠাণ্ডা বাতাস, আর খুব করে কান পাতলে- পাতার পতনধ্বনি! দু একটা হরিণের সাথেও দেখা হয়েছিল সেবার। হরিণ এখানে হরহামেশাই চোখে পড়ে। এমনকি বাসা বাড়ি’র পেছনের লন-এ ঘাস চিবুতেও দেখেছি। ইউনিভার্সিটি এলাকায় হুটহাট দেখা যায় -হয়ত বেশ আয়েশ করে হেলে দুলে, লম্বা শিং দুলিয়ে (শিং ছাড়াও আছে!) পায়চারি করতে; অথবা দুলকি চালে এদিক সেদিক ছুটে যেতে। আমেরিকান লোকজনের অনেকেরই শিকার খুব পছন্দের। কিন্তু সিটি এলাকায় এদের শিকারের অনুমতি নেই। তাই প্রাণীকুল বেশ নির্ভয়েই থাকে। রাস্তা ক্রসিং এর সময় দু’ধারের গাড়ী স্লো হয়ে থেমে যায়; তারা বিড়দর্পে পার হয়  ! সামারে কাজ থেকে ফেরার পথে একদিন শেয়াল শাবকের সাথে দেখা হইছিল। বনের ভেতর থেকে হুট করে বের হয়েই আমাদের সামনে। ব্যাটা একটুও ভয় পায়নি। ভীষণ কৌতূহলে ঠায় আমাদের দিকে চেয়েছিল। আমরা হাতদুয়েক দুর থেকে সেলফোনে ছবি টবি তোলে একাকার! আর একদিন লোকাল মিডিয়ায় কাল ভালুক শাবকের ডাউনটাউন ভিজিটের ভিডিও দেখি! রাস্তা দিয়ে গাড়ী চলে যাচ্ছে, আর উনি ফুটপাতের উপর জমে যাওয়া বরফের উপর দিয়ে হেলতে দুলতে চলে যাচ্ছেন! শেষ মেশ পছন্দসই একটা গাছ বেছে নিয়ে, ওটায় চড়ে বসলেন!

যাই হোক, যা বলছিলাম- ম্যাপল ট্রিতে ড্রিল করে স্টিলের গোলাকার কালেক্টরের (অনেকটা আমাদের খেজুরের রস আহরণের মত!) মাথায় লাগানো প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে নিচে বড়, মোটা স্টিলের পাইপ দিয়ে বনের ভেতর থেকে কাঠের সেই কেবিনের ভেতরে ট্যাংকে এসে লাগে। একটা ভ্যাকুয়াম মেশিনও ট্যাংকের সাথে লাগানো আছে। ভ্যাকুয়াম মেশিন অন করলে গাছ থেকে রস পাইপ দিয়ে শুষে নিয়ে ট্যাংকে জমা করা হয়। পড়ে এই রস বয়লারে জ্বাল দিয়ে ঘন সিরাপে পরিণত করে পরবর্তিতে বোতলজাত করে রাখা হয়। শীতের শেষের একমাস (সাধারণত মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি), যখন রাতে তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে নেমে আসে আবার দিনে তাপমাত্রা মোটামুটি উষ্ণ থাকে- তখন এই ম্যাপল সিরাপের মৌসুম। ড্রিলকৃত হোল কে ট্যাপ বলে। একবার গাছের যেখানে ড্রিল করা হয়, সেখানকার আশে পাশের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষত শুকাতে প্রায় দুই তিন বছর লাগে। এই গাছ খুব অল্প বাড়ে! তিনশ বছরের পুরোনো ম্যাপল ট্রি দেখে মনে হবে ৪-৫ বছরের রেইন-ট্রি’র মত!

ডেভ ( ডেভিড রজস্কি) ও তার পরিবার ২০০০ সালে এখানের প্রায় দুহাজার একর ম্যাপল ট্রি সমেত জায়গা কিনে নেন। সেবছরই পরীক্ষামূলক ২০টি ট্যাপ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন, যা এখন প্রায় পাচ হাজারেরও বেশী।

আমার দ্বিতীয় ট্রিপ এই গত সপ্তাহের। আগের দুই দিনের তুমুল তুষার পাতের পর, চমৎকার রোদ্রজ্জল বিকেলে ডেভ এর সাথে আবার দেখা হয়। এবারের দৃশ্য অন্যরকম। গাছে গাছে আটকে থাকে সাদা থোক থোক তুষার আর চারপাশে সাদার চাদরে ঢাকা সব। শুধু এভারগ্রীন ট্রি’র সবুজ পাতা ছাড়া, আসে পাশে সব ধবধবে সাদা। বাইসাইকেল চালিয়ে শ্বেত শুভ্র-তুষারময় পাহাড়ী রাস্তায় তার সঙ্গী দুই জার্মান শেপার্ড কুকুর। সাইকেল থেকে নেমে আমাদের সাথে কুশল বিনিময়ের মাঝেই দুই প্রভুভক্তের হুড়োমোড়ি, লুটোপুটি! কথায় কথায় জানা যায়, মৌসুম শেষে প্রতিবছর সে আলাস্কায় পাড়ি জমায়। সেখানে পুরো সামার আটলান্টিক মহাসাগরে মাছ ধরার জন্যে নিজের বোটে পাড়ি জমায় গভীর সমুদ্রে!


অসম্ভব অতিথিপরায়ণ এই পরিবারের সবাই ভীষণরকমের ভালো। ডেভ আর তার অর্ধাঙ্গী এ্যনী’র এই নিরিবিলি খুবই প্রিয়। প্রতি মঙ্গলবার সিটি’র রেস্টুরেন্ট আর কিছু ফিস্কড স্টোরে বোতলজাত সিরাপ সরবরাহ আর অন্যান্য দিন সিরাপ কালেকশানের নানাবিদ প্রস্তুতির ব্যস্ততা শেষে, কাঠের তৈরী বাড়ীটার ভেতরে,ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে আড্ডা হয়, হয় খুনসুটি! মাঝে মাঝে লিভিং রুমে রাখা পিয়ানোতে, অথবা ডেক-এ বনফায়ারের পাশে গীটার হাতে টুং টাং হয়। হয়তোবা; মাঝে মাঝে টেলিস্কোপ লাগানো রাইফেলটা বগলদাবা করে, দুই জার্মান শেপার্ড সাথে নিয়ে, নিঃশব্দে বেড়িয়ে পড়ে- হরিণ শিকারে! ফিরে এসে আবার সেই আড্ডা, খুনসুটি। কখনো কখনো প্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্ট খুলে বসে।

আলাস্কার সেই ট্রিপে ধরা আটলান্টিক স্যমন, ম্যাপল সিরাপ আর ওয়াইল্ড রাইস দিয়ে আমাদের আপ্যায়নের শেষে, ডেভ আবৃত্তি করে শুনায় তার প্রিয় কবিতা- “Stopping by Woods on a Snowing Evening”। ফায়ারপ্লেস এর আগুনে গুজে দেয়া কাঠের লালচে আলোয়, গমগমে ভরাট গলায় উচ্চারিত হয়-

‘---- The woods are lovely, dark and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep.’

বিদায় নিয়ে চলে আসি। সারাটা পথ চোখের কোনে ভাসে- একটা বাইসাইকেল, জার্মান শেপার্ড, শ্বেত শুভ্র পাহাড়ি রাস্তা; আর কানে গুনগুন করতে থাকে ৫৯ বছরের তারুণ্যের কণ্ঠস্বর- ‘এন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ, এন্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’!




সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৫২
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×