উন্নত বিশ্বে পদার্পনের পর থেকেই মনের মধ্যে দীর্ঘদিনের লালায়িত বাসনা মাঝে মাঝেই মোচড় দিয়ে উঠত! প্রায় একবছরের কাছাকাছি সময়ের এসে সুযোগ মিলাতে খুব উল্লসিত ছিলাম! হ্যাঁ... বলছিলাম রোড ট্রিপ এর কথা। গত মাসে লাইসেন্স পাওয়া, আর সামারের ছুটি- এই দুই একসাথে খাপে খাপে মিলে যাওয়ায়; বেড়িয়ে পরলাম!
গন্তব্যঃ সাউথ ডাকোটা
প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল মাউন্ট রাশমুর- দেখতে যাওয়া। ঐযে- পাহাড়ের গায়ে চার ক্ষমতাধর ইউএস প্রেসিডেন্ট; জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, থিওডোর রুজভেল্ট আর এব্রাহাম লিংকন; এর ৬০ ফুট দীর্ধ স্থাপত্য নিদর্শন। যাইহোক, তথ্য প্রযুক্তির এই দিনে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে জ্ঞানী লোকজনদের জ্ঞান দেয়ার মত স্পর্ধা আমার নাই ! ওসব পরে হবেক্ষণ! এই নোটের উদ্দেশ্য ভিন্ন-হুদাই ট্যুরের কিছু কথাবার্তা শেয়ার করা আরকি !
খুচরা প্ল্যান করেই পথে নেমে পরি। আমার মূল আগ্রহ ছিল –দ্যা জার্নি!সকাল দশটা নাগাদ বের হই। রেন্ট এ কার-এর গাড়ি, ধার করা জিপিএস, কিছু কাপড় চোপড়, আর দুই ড্রাইভার- আমি আর আমার ফ্রেন্ড ! ডুলুথ থেকে ইন্টার স্টেট ধরে সেন্ট ক্লাউড-গ্রানাইট ফলস-মার্শাল হয়ে ব্রুকিংস, সাউথ ডাকোটা- প্রায় ৩৪০ মাইল। ঘণ্টা দুই পরপর অল্টারনেট ড্রাইভিং করে করে ব্রুকিংস পৌছাতে প্রায় বিকেল ৫টা।
(হাইওয়ে)
ইন্টার-স্টেট হাইওয়ের গল্প সব একই রকম- বিশাল বিশাল লরি-ট্রাক, আসে-পাশে দিয়ে সাঁ সাঁ করে বেড়িয়ে যাওয়া গাড়ি, মোটর সাইকেল, গাড়ির সাথে টো করে বয়ে নেয়া পোর্টেবল বাড়ী(আহা! লোকজন পারেও বটে!), সদা সতর্ক গাড়ী চালানো- তারপরও অপিরিচিত রাস্তায় সেই মান্দাতা আমলের টাচ স্ক্রিনধারী জিপিএস-এর সৌজন্যে বার দুই-তিনেক এক্সিট মিস করে আবার তারই সাহায্যে পথ খুজে নেয়া। ইন্টার স্টেট হাইওয়ে গুলা’র আসা যাওয়ার রাস্তা সাধারণত পৃথক থাকে! মাঝে অনেকটুকু জায়গা ফাঁকা রেখে দুইটা আলাদা রাস্তা। প্রতিটা রাস্তায় দুইটা এক্টিভ লেন আর একটা লেন শুধুমাত্র ইমারজেন্সি সিচুয়েশানে গাড়ী পার্কিং এর জন্যে। পথে রোড মেইন্টেনেন্স হলে অথবা কোন টাউন পড়লে, আগে থেকে ওয়ার্নিং সাইন আর স্পিড লিমিট কমিয়ে দিয়ে দুই লেন একসাথে মার্জ হয়। আর একটু পর পর গ্যাস (এরা গাড়ীর ফুয়েল- মানে খাটি বাংলায় তেল-রে- গ্যাস কয়! কি কইতাম!), খাবার জায়গা, হোটেল, এক্সিট সাইন থাকে। এক্সিট ধরে গ্যাস, খাবার দোকান বা হোটেল এ যাওয়া যায়। মাঝে মাঝে কিছু বিলবোর্ড-ও চোখে পড়বে, তবে আমাদের দেশের তুলনায়, পরিমানে অনেক কম! আর আছে- রেস্ট প্লেস। এটা রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা জায়গা- যেখানে গাড়ী রেখে বিশ্রাম নেয়া যায়! বাথরুম আর হাটা হাটির করার জায়গার সু-ব্যবস্থা আছে। সাধারনত, বিশাল বিশাল লরি ট্রাক গুলা এখানে থামে- ড্রাইভার ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে, ঘুমিয়ে তরতাজা হয়ে আবার পথে নামে।এক্সিট আর এর মাঝে পার্থক্য হল- এখানে খাবার দোকান বা অন্য কিছু নাই। আর এক্সিট সাধারণত, রাস্তা থেকে একটু ভেতরের দিকে (প্রায় এক থেকে কয়েক মাইল পর্যন্ত হতে পারে) হয়। সময় বাচাতে আমরা মাঝে মাঝেই এক্সিট না নিয়ে রেস্ট-প্লেস-এ থেমেছি।
(বাড়ীঘর নিয়া পথে!)
সামারের চমৎকার রোদ্র-উজ্জ্বল আবহাওয়ায় মহাসড়কের দুই পাশে’র বিস্তীর্ন ফাঁকা জায়গা, মাঝে মাঝে মাইলের পর মাইল ভুট্টা ক্ষেত, ভুট্টা কেটে নেয়ার পর উচ্ছিষ্ট খড় সুন্দর গোল করে পেচিয়ে দলা করে রাখা দেখতে দেখতে সেন্ট ক্লাউড পৌছে দুপুরের খাবার বিরতি। তারপর বিরতির পর আবার পথে নামতেই এবার দেখা গেল অন্য রকম দৃশ্য। পথের দুধারে নানা জাতের গাছপালা, পাশের ক্ষেতে মাঝে মাঝেই সূর্যমুখি ফুলের হলুদ বাগান, ওইন্ড মিল- ছবির মত সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ! বিশেষ করে ব্রুকিংস-এ ঢোকার আগের প্রায় ২৫-৩০ মাইল রাস্তা অনেক অনেক সুন্দর। চারপাশে সবুজ- আর তার বুকচিরে আমাদের ছুটে চলা।
(সূর্যমুখী'র বাগান)
(ওইন্ড মিল)
ব্রুকিংস পৌছে পরিচিত ছোট ভাই এর বাসায় উঠা হয়। তারপর ফ্রেশ হয়েই, সাউথ ডাকোটা স্টেট ইনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ঘুরতে হই। শেষ বিকেলের আলোয় লাল-লাল বিল্ডিং আর সবুজ ঘাসে ঘেরা ক্যাম্পাস কি যে সুন্দর লাগছে! ঘণ্টা দুই-তিনের ঘুরাঘুরি শেষে ইচ্ছেমত ভূড়ি ভোজের পর আগে ভাগেই শুয়ে পরি- কাল সকাল সকাল বের হতে হব।
(সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস)
পরদিন সকাল সাড়ে পাচ। তখন সবে ভোরের আলো ফুটিফুটি করছে!নাস্তা-পানি কিছু একটা মুখে দিয়েই আগের রাতের খুব সতর্কতার সাথে ঠিক করা যাত্রা পথ আর ভিজিটিং প্লেস গুলা’র দিকে এবার আমাদের তিনজনের যাত্রা। ব্যাড ল্যান্ড-রেপ্টাইল গার্ডেন-বিয়ার কান্ট্রি-কিস্টোন-মাউন্ট রাশমুর-নিডলস হাইওয়ে!
আবারো মহাসড়কে আমাদের ছোটে চলা।পথে মিজৌরি রিভার এর সাক্ষাত মেলে। এটা নর্থ আমেরিকার সবচেয়ে সুদীর্ঘ নদী! মন্টানা’র রকি মাউন্টেন থেকে শুরু হয়ে সেন্ট লুইস, মিজৌরি’র মিসিসিপি-তে মিলিত হওয়ার আগে সে পাড়ি দিয়েছে সুদীর্ঘ-২৩৪১ মাইল!এরই মধ্যে টাইম জোন ক্রস করায় ঘড়ির কাটা এক ঘণ্টা পেছনে চলে এল!
(মিসৌরি রিভার)
যাইহোক, ব্যাডল্যান্ড-এ পৌছে দিলখোশ! সামনে বিশাল এলাকা জুড়ে (২,৪২,৭৫৬ একর!) পাহাড় বলা যাবেনা- আবার টিলা থেকেও উচু; এ’দুয়ের মাঝামাঝির আকৃতির রুক্ষ মাটি প্রকৃতির কি ভীষণ খেয়ালে কি দারুনভাবে সুবিন্যস্ত! যতদূর চোখ যায় কোন গাছপালা নাই- রুক্ষ পরিবেশ- এক অদ্ভূত সুন্দর! বাচ্চা ছেলেদের মত এদিক সেদিক ছুটাছুটি করলাম!ক্যামেরার শাটার নামল- ক্লিক, ক্লিক!
(ব্যাডল্যান্ড)
পরের গন্তব্যঃ রেপ্টাইল গার্ডেন।
২০১৪ সালে গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী- পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ এম্পিবিয়ান মানে বুকে হেটে চলা প্রানীদের সংগ্রহশালা! ভয় পাওয়ার জন্যেই ১৭ ডলার খরচ করে টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকতেই বিভিন্ন প্রজাতির অনেক সাপের ভিড়ে, চেনা র্যটল স্নেক, ভাইপার আর ওয়াটার মোকাসিন দেখেই গা শির শির করে উঠল! তারপর আছে বিভিন্ন প্রজাতির কুমীর- কোনটা ছোট, কোনটা আবার প্রকান্ড! ওহ... এইখানে এক মুভি স্টার কুমীরের সাক্ষাত মিলল :O
(মুভি স্টার!)
ব্যাটা নাকি, জেমস বন্ড- রজার মুরের ‘লিভ এ্যান্ড লেট ডাই’ মুভিতে অভিনয়(!!!)করেছে! ইনফরমেশান থেকে জানা যায়- একটা দৃশ্যে রজার মুরের- কুমীরের পেছনে দিক দিয়ে দৌড়ের সিন থাকার কথা। তখন অনেকগুলা কুমীরের মালিক-লোকটা বলল সে নাকি এই শট দিতে পারবে। প্রথমবার, সে দুইটা কুমীর পাড় হওয়ার পর পরই পানিতে পড়ে যায়- আর কুমীরের কামড় খায়! দুই-তিন মাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সে ডিরেক্টরকে বলে সে কোথায় ভুল করেছে সেটা সে জানে। দ্বিতীয় বারের সময়, ডিরেক্টর যেমন শট চেয়েছেন-তেমনই শট দেয়ার পর একদম শেষ মুহূর্তে আবারো পানিতে পড়ে কুমীরের কামড় খান! এইবার হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনি সবগুলা কুমীর বিক্রি করে দেন। লোকটা নাকি পড়ে এক বাঘের হাতে মারা পড়ে! বেচারা!!!
কুমীরের আর সাপের শো দেখে আমার কোমলমতি মন ( ) সহ্য করতে না পারায় ও সময়ের সল্পতায়, প্রেইরি ডগ আর ৪৯-বছর বয়সি প্রকান্ড কচ্ছপের সাথে ফটো খিচে আর টিয়া এবং টিয়া জাতীয় পাখির সাক্ষাতের পর বিয়ার কান্ট্রি’র উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রেপ্টাইল গার্ডেন থেকে বিয়ার কান্ট্রি ৮-১০ মিনিটের ড্রাইভ। টিকেট কেটে ড্রাইভ থ্রো দিয়ে যেতে যেতে নেকড়ে, হরিণ, লম্বা শিঙের- ভেড়া, গ্রিজলী ভালুক, কাল ভালুক, মাউন্টেন লায়ন, স্কাঙ্ক, বব ক্যাট, কাল ভালুকের ছানা, লাল শেয়াল (খেক শেয়াল পেলাম না! আফসুস!!!) ইত্যাদি দেখে আমাদের পরের গন্তব্য, সেই কাঙ্ক্ষিত মাউণ্ট রাশমুর- এর দিকে যাত্রা! বিয়ার কাউন্টি থেকে প্রায় ১ ঘণ্টার ড্রাইভ।
(বিয়ার কান্ট্রি)
এই রাস্তাটা অনেক সুন্দর! পাহাড়ের বাকে বাকে চলা রাস্তা দিয়ে, পথের দু’ধারে অপূর্ব- নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবলোকন করতে করতে এক সময় মাউণ্ট রাশমুর। আবারো ফটো সেশান ! অহহ... বলাই হয়নি! মাউন্ট রাশমুর’এর দুই মাইল আগে কিস্টোন নামে এক ছোট্ট টাউন পড়ে! খুবই ছোট- কিন্তু কেমন যেন একটা অদ্ভূত সুন্দর টোন সারা টাউনের মধ্যে ছড়িয়ে আছে! সময়ের সল্পতায় এখানে নামতে পারিনাই ! চার ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের সাক্ষাতের শেষে- বন্ধু'র ইচ্ছা ফিরে যাওয়া! কারন, দিনের আলো থাকতে থাকতে মাউণ্টেন-এর এই আঁকা বাকা রাস্তা সহ সামনের প্রায় ৪০০ মাইলের ফিরতি পথের যতটা কমিয়ে ফেলা যায়! আমার তুমুল আগ্রহে একটু ইতস্তত করে আমাদের প্ল্যানের শেষ ভিজিটিং স্পট নীডলস হাইওয়ে দেখার জন্যে রাজি হয়।
(মাউন্ট রাশমুর'এর পথে)
(মাউন্ট রাশমুর)
এইবারের রাস্তা সেই রকমের পাহাড়ি- উচু নিচু আবার একটু পর পর ১৮০ ডিগ্রি বাঁক। এদিকে দিনের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে!বাইশ মাইলের এই ট্র্যাকের প্রায় অর্ধেক পেরোতেই শুরু হয় বৃষ্টি! দূরে বিদ্যুত চমকানো! নীডলস হাইওয়ে থেকে প্রায় দুমাইল বাকি থাকতে আমরা অন্যপথে ঘুরে যাই- নাহ! এবেলা আর ভেতরের দিকে আগানো সম্ভব না! তবে এই বাইশ মাইল-আমার কাছে এই ট্রিপের সবচেয়ে চুম্বক পার্ট! পথের ধারে বিশাল বিশাল গাছের সারির মাঝে একটু পর পর বন্য হরিণ, বাইসন আর পটের মত আঁকা সিনিক ভিউ! গাছের উপর, দূরে মেঘলা আকাশের বুক চিরে সূর্যের লাল কোমল আলোক রশ্মির আবর্তনে ভয়ঙ্কর সুন্দরের খেলা, আর বিদ্যুত চমকানোর সময় মনে হয়- কে যেন এক টুকরো মেঘ আকাশে ধরে আছে আর একটু পর পর তার তর্জনী থেকে নিঃসৃত হছে- স্পাইক! একটা ছোট্ট টাউনেরও দেখা পেলাম- সেই আঠারো’শ সালের দিকের মত! ওয়েস্টার্ন মুভিগুলায় যেমনটা দেখা যায়-ঠিক অই রকম! বার রেস্টুরেন্ট, কিছু দোকানপাট, বাড়ী ঘর- মনে হচ্ছিল এই বোধহয় তরল আগুন পেটে পড়াতে, মতের অমিলে সিক্সগান থেকে একে অপরের উপর আগুন ঝড়াবে! একপাশে পতাকা টাঙ্গানোর জায়গাটা হুবহু মুভি’র ফাসিতে ঝোলানোর জায়গা গুলার মত !
(মাউন্ট রাশমুর থেকে নীডলস হাইওয়ে'র পথে)
নীডলস হাইওয়ে না গিয়ে অন্যপথে ফিরলাম হিলসিটি হয়ে কাস্টার। রাতের ড্রাইভে ফিরতি পথে রেপিড সিটিকে পাশ কাটিয়ে ব্রুকিংস ওখান থেকে ৪৩০ মাইল! ফিরতে ফিরতে ভোর ৫:৩০ টা! ঝটপট কিছু পেটে চালান করেই- ঘুম!
(কাস্টার)
পরদিন ঘুম ভাঙ্গে সকাল এগারোটা।বাইরে তুমুল বৃষ্টি!নাস্তা পানি খেয়ে সেই বৃষ্টি-বাদলা নিয়েই মিনেসোটা’র ফিরতি পথে! পৌছাতে পৌছাতে রাত ৭টা!
তিন দিন- প্রায় ১৬০০ মাইল! ডুলুথ, মিনেসোটা টু সাউথ ডাকোটা! হেল অফ অ্যা ট্রিপ !!!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ ভোর ৫:৪৫