বলা হয়, প্রতিভা আর প্রাকৃতিক চাপ নাকি দাবায়ে রাখা যায় না ! প্রথমটার ব্যাপারে আমি বলতে পারিনা; তবে দ্বিতীয়টার ব্যাপারে আমার অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা হয়েছে। আগে একটা শেয়ার করেছি (প্রকৃতির বিড়ম্বনার গপ্পো-১ )। আপনারা যারা শুচিবায়গ্রস্ত আছেন, এখানেই ক্ষেমা দেন, নীচে যাইয়েন না !
সময়কাল খুব সম্ভবত ২০০৮-ই হবে। আমি তখন লেভেল ৩ টার্ম-২ অথবা লেভেল ৪ টার্ম-১ এ। হঠাত করেই প্ল্যান সেন্ট মার্টিন যাব। আমরা ৪ জন। কোন এক বুধবার কোন আগপিছু না ভেবেই, পাওয়ার ইলেক্ট্রনিকস সেশনাল মিস দিয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে দে ছুট!
চট্টগ্রাম হকার্স মার্কেট থেকে কিছু কাপড় চোপড় কিনে নিয়ে, সিনেমা প্যালেস থেকে রাতের বাসে টেকনাফ এর উদ্দেশ্যে রওনা হই। বাসের ঝাঁকুনিতে আর বিকেল থেকে এখানে সেখানে ঘুরার ফলাফলে -অল্পক্ষণেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হটাত হটাত ঘুম ভেঙে কতদুর এলাম আন্দাজ করে -ফের ঘুম! রাতের জার্নি বিশেষ বৈচিত্র ছাড়াই ভোর বেলায় শেষ হয়!
শুনেছি সেন্ট মার্টিনে সবকিছুর দাম একটু বেশী। তাই টেকনাফে নেমেই বার্মিজ মার্কেট থেকে টুকটাক কেনাকাটা শেষে, আমরা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ট্রলারে চেপে বসি। অনেকক্ষণের অপেক্ষা শেষে, ট্রলার ভর্তি মানুষজন নিয়ে মাঝি- আবদুর রহমান তার কিস্তি ভাসান।
কিস্তি দরিয়ায় পড়া মাত্রই, মোচার খোলার মত উপর-নীচ করতে করতে ভটভট শব্দে আগায়। মৃদুমন্দ বাতাস, সকালের ম্যাড়ম্যাড়ে রোদের রেশ কাটতেই-প্রখর রৌদ্রকে সঙ্গী করে আমাদের গানে টান! এই গান-ই মাঝির সাথে আমাদের সখ্যতা বাড়ায়- যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে আমরা তার অতিথি হিসাবে পূর্ব বরাদ্দকৃত সময়ের থেকে একদিন বেশি থেকে আসি । মাঝির সাথে আমাদের দারুন জমে!
যাই হোক, একসময় সেন্টমার্টিন পৌছাই। তারপর নীল দিগন্তে-চেক ইন করেই দে ছুট- সমুদ্রে! সারাদিন দফায় দফায় সমুদ্রস্নান আর এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি শেষে, সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে বার-বি-কিউ । ইচ্ছেমত ভুড়িভোজ শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার সমুদ্র পাড়ে। গল্প, আড্ডা গানের মাঝেই আমাদের সাথে শরিক হয়- ট্রলারের মাঝি! রাত বাড়ে- কেওয়া গাছ আর নারিকেল গাছের পাতায় বাতাস হামলে পড়ার শব্দের সাথে কূলে ঢেউ আছড়ে পড়ার অনুনাদ! আর আকাশে লক্ষ কোটি তারার মেলা! চারপাশের পরিবেশ কি ভীষণ রকমের- অপার্থিব! সময়জ্ঞান হারিয়ে একসময় রুমে ফেরা।
পরদিন নাস্তা করে, আগের দিনের প্ল্যান অনুযায়ী ছেড়া দ্বীপ এর উদ্দেশ্যে হাটা শুরু। ভাটার সময় নাকি- হেটেই যাওয়া যায়! সাথে গতকাল হোটেলে চেক-ইনের আগেই আমাদের সাথে জুটে যাওয়া গাইড- জাভেদ।
ফ্রেশ হয়েই বের হয়েছি, তাও মাঝপথে এসে এত সুন্দর প্রকৃতি আমায় ডাক দিয়ে বসল! আকুল হয়ে জাভেদ এর শরণাপন্ন হতেই সে জানায়, আশে পাশে কোন ব্যবস্থা নাই । আমার চক্ষে তখন ঘোর অমানিশা! কি করি! কি করি! আল্লাহ’র নাম জপতে জপতে যখন কেয়া গাছের চিপায় দৌড়ের কথা ভাবছি, তখনি দু’কান অবধি প্রশস্ত হাসি হেসে, জাভেদ বলল – একটা বিকল্প আছে!
তীরে নোঙর ফেলা মাছ ধরার ট্রলার এর দিকে ইশারা করে, আমায় চোখ টিপে দিয়ে বলল- ট্রলারে উঠে যেতে। ওখানে নাকি ব্যবস্থা আছে! আমি পড়িমরি করে এক দৌড়ে ট্রলারে উঠে জায়গামত গিয়ে দেখি- দু’খান তক্তা বিছানো, নীচে পুরা ফাকা। সমুদ্রের নীল জল দেখা যায়। পাশেই একটা বদনা- রশি বাধা! তক্তার উপরে বসলে-তীর আড়াল, কিন্তু দাড়ালেই- পুরা পৃথিবী প্রকাশিত! মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, তক্তার উপরে বসে পরি । আহ...কি আরাম, কি শাআআআন্তি! গুনগুন করে গানও শুরু করে দিলাম ।
এইবার পানি নেয়ার জন্যে রশিময় বদনা নীচে ফেলতেই কলিজায় কামড় দিয়ে উঠল। মুখের গান হরিয়ে-শঙ্কায় গলা শুকিয়ে কাঠ! অস্ফুট গলায় ডেকে উঠলাম, ‘ইয়া মাবুদ!’
মাঝি মাল্লাদের বেগ পেলে, মাঝ নদীতে তারা রশিময় বদনা ফেলে পানি উত্তোলন করেন। তারা রশি ওই মাপমতোই রাখছেন! তীরে নোঙর ফেলা নৌকায় ওই দৈর্ঘ্যে আমি ক্যামনে পানি উঠাই! বদনা পানির নাগালের প্রায় একহাত উপ্রে থাকতেই রশির দৈর্ঘ্য শেষ!তক্তায় বসেই (দাড়ালেই তো পৃথিবী প্রকাশিত ) চিন্তায় মাতি- ‘উপায় কি নাই কোন!?’ রশিতে দোল দিতেই বদনা পেন্ডুলামের মত এদিক- ওদিক দোলে; পানির নাগাল আর পায় না!
অবশেষে, উপরওয়ালার খাস মেহেরবানিতে- মনে পড়ে, ট্রলারে উঠার সময় শ্যালো ইঞ্জিনের পাশে নৌকার তলায় পানি দেখেছি। কিভাবে ওই তক্তা থেকে উঠে নৌকার তলানীর ওই পানি পর্যন্ত পৌছালাম, তা জানতে চেয়ে লজ্জা দিবেন না । ঝামেলা মিটানোর পর, আবারো সৃষ্টিকর্তার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ট্রলার থেকে নেমে তীরে আসতেই দেখি- আমার কর্ম ঢেউয়ে ঢেউয়ে হাতছানি দিতে দিতে কূলে আছড়ে পড়ছে! আর আমি শশব্যাস্ত হয়ে, অন্য কারও উপলব্ধির আগেই বলে উঠি- ‘দ্রুত ছেড়া দ্বীপ চল! জোয়ার চলে আসবে!’
কর্ম পেছনে ফেলে, আমরা ছেড়া দ্বীপের পথে পা বাড়াই ।