(একটু বড় হয়ে গেছে! আশা করি ধর্যচ্যুতি ঘটবেনা )
জীবন বহিয়া যায়!
মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের সময়ের কথা খুব মনে পরে! জীবন এখনকার মতই তখনও জটিল-ই ছিল!
মাগরিব-এর আজান এর সময় হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসার তাগিদ। সকল দুষ্টামি বারণ। বাসায় নালিশ আসলে আমার খুব খারাপ অবস্থা! যা আমার চোখে নিছকই দুষ্টামি, পিতার কাছে তা গভীর অপরাধ। অপরাধের বিচার হত আমার-ই বানানো বাশের কঞ্চি-তে। হায়!
দৈনিক দুই টাকা হাত খরচ আমার জন্যে বরাদ্দ ছিল। ক্লাস টু থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত। ক্লাস টেন-এ সবাই ময়নামতি গেল-আমি বাদে! দুই’শ টাকা আমার পরিবার এর জন্যে অনেক, আর আমার কল্পনার বাইরে!
ক্লাস এইট-এর বৃত্তি পরীক্ষার আগে, প্রথম প্রাইভেট। আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিক্ষক- পিতা। তিনি পাটিগণিত, জ্যামিতিতে সুদক্ষ হওয়ায় আমাকে গনিতে খুব বেগ পেতে হয়নি। সমস্যা দেখা দিল বীজগণিতে। আমার ব্যাকডেটেট পিতার কারিকুলামে বীজগনিত না থাকায়- আমাকে প্রায় বাধ্য হয়েই পরীক্ষার আগে গনিত পড়তে হুমায়ন স্যার এর দ্বারস্থ হতে হয়।
যথাসময়ে বৃত্তির রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। আমি জানার প্রয়োজন বোধ করি না। সত্যি বলতে কি, আমি কখনো বৃত্তি পাব বলে ভাবিনি। স্যার এর বাসায়, এনিয়ে কথা উঠলে, আমার চোখে অপার বিস্ময়!
মনে হয়-ওপরওয়ালা, পিতার পরিশ্রম আর মাতার মায়াবী চোখে তাকিয়ে, এমনিতেই দান করেছিলেন।
প্রাইভেট পরতাম ভোর ৬:০০ টায়। আধো অন্ধকার আধো ফর্সা পূর্বাকাশ সাথে নিয়ে, পীচঢালা রাস্তায় পা ফেলা। অথবা মাঝে মাঝে বন্ধু সাইকেল নিয়ে আসলে, পেছনের ক্যারিয়ার এ দুইদিকে পা ছড়িয়ে বসা। শীতের সকালে কুয়াশা আর গাছে জমা শিশিরের টপটপ ফোটায় ভেজা পীচঢালা পথে নিজের পদশব্দে অথবা সাইকেলের টুংটাং বাজিয়ে আমাদের বয়সন্ধি আসে!
প্রথম সিনেমা দেখতে যাই- স্কুল পালিয়ে। দোতলা আর নীচতলার সিড়ির মাঝখানের ভাঙা জানালার গরাদ মলে- ক্লাস রুমেই বইপত্র ফেলে, সাইকেল নিয়ে আমাদের বেড়িয়ে পড়া। সিনেমা শেষে, ফাকা স্কুলে ফিরে অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার-বইপত্র সব হাওয়া! অতঃপর বাড়ি ফিরে হাতেনাতে বাবার কাছে ধরা পরে অপমানের একশেষ।
পরদিন ভোরে, ভেজা পীচঢালা পথে- আমার সঙ্গী ...‘বাবা’! প্রাইভেট-এ আমার বন্ধু-বান্ধবীদের সামনে স্যারের কাছে অভিযোগ আর আমার আরেকদফা অপদস্ত হওয়ার পালা। এর মাঝেই এক বান্ধবী ফিসফিস করে স্মিত হাসিমুখে ভরসা দেয়- গতকালের স্কুলে ফেলে যাওয়া বই তার কাছে। কষ্টমিশ্রিত হাসিতে দুর্ভাগ্য ভোলার চেস্টা!
বিদায় অনুষ্ঠান এর কথাও মনে আছে। এর ঠিক আগেই, আমি আমার পছন্দের কাপড় কিনতে পারি। একটা কলার অয়ালা গেঞ্জি- মখমলের! তার আগে, পিতার সকল পছন্দ-ই আমার পছন্দ ছিল!কেউ একজন আত্মীয়, বেড়াতে এসে- আমার পরীক্ষার শুভকামনায় ৩০০ টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়েছেন। আর আমি একদৌড়ে মার্কেটে!
তারও পরে, এস এস সি রেজাল্ট এর দিন, একটা সাইকেল ম্যানেজ করে- পলায়ন। নিজের কাছ থেকেই। কা-কে যেন সাথে নিয়েছিলাম- আজ মনে পরেনা!
পালাতে পালাতেই উপলব্ধি, আমার হারানোর কোন জায়গা নেই!
অগত্যা, ঘোর সন্ধ্যায়- বাড়ির সামনের রাস্তায় ফিরে দেখা- সবাই দুশ্চিন্তায়। পিতার বিস্ময়মাখা চোখে একবার তাকিয়েই, নতমস্তিষ্কে স্কুলের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আবিস্কার- আমি পাশ করেছি !
ফেল করতে করতে পাশ করে ফেলা জীবন নিয়ে খুউব প্রত্যাশা ছিলনা- হুদাই কিছু বেখাপ্পা স্বপ্ন ছিল। মনে ছিল পাশ করেই ঢাকা কোন কলেজে ভর্তি হব। যে পরিবারে দুই’শ টাকাই অনেক হয়ে দেখা দেয়, ওখান থেকে ঢাকায় পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন ক্যামনে মাথায় আসল- তা জানিনা। হয়ত বাবাকে সুপারম্যান মনে করেছিলাম- মনের কোনায় হয়ত ধারণা ছিল, সব ম্যানেজ করে ফেলা বাবা হয়ত এটাও ম্যানেজ করে ফেলবে।
কিছুদিন নির্বাক সময় কাটিয়ে, আমরা মুখোমুখি হই। আমাদের কথোপকথনে তখন মাটিতে তাকানোর সময়!
আসে পাশের তিন চারটা কলেজে ঘুরাঘুরি শেষে সিধান্ত নেই- বাড়ির কাছেরটাতেই ভর্তি হব। স্কুলের প্রথম সারির সবাই ঢাকায় পারি জমায়। রেসিডেনশিয়াল, নটরডেম, সরকারি বিজ্ঞান, ঢাকা কলেজ। সময়ের সাথে দূরত্ব বাড়ে- আমি নামমাত্র বেতনে বাড়ির কাছের কলেজে। আজ মনে হয়, খুব ভাল হয়েছে; তখন ঢাকা গেলে আমার আজকের এই চমৎকার জীবনসঙ্গীর সাথে হয়ত দেখাই হতনা!
কলেজের ক্লাস শুরুর কিছুদিন পর একবন্ধুর সাথে আলাপ হয়। তার ভাগ্নিকে পড়াবার প্রস্তাব দেয়! আমার চোখে সেই অনেক টাকার(২০০) বিনিময়ে, প্রথম শ্রম বিক্রি। মাস শেষে সেই অনেক টাকা বাবার হাতে তুলে দেওয়া। অনেক কাচা আবেগের সেই বয়সে, জীবনের রুক্ষ রুপ দেখার শুরু। যখন পড়াতাম মনখুলেই পড়াতাম- প্রফেশনালিজম শেখা হয়ে উঠেনি। স্টুডেন্ট এর পরীক্ষার আগে পড়ানোর সময় কখনো গৎবাঁধা ফ্রেমে বন্দী ছিলনা। অথচ, চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়ে দশ-বার দিন টিউশান মিস দেয়ায়, মাস শেষে গনিতের ঐকিক সূত্রের ব্যবহারে- বেতন কাটা পরে! খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম, উত্তর আসল- মাঝখানে কিছুদিন তো আসনি!
তারপরে আমিই আর ফিরিনি। আমার সাথে দেখা করে অনেক রিকোয়েস্ট- টাকা বাড়িয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিতেও আর ফিরতে ইচ্ছে করেনি। শুধু বলেছি, সামনে আমার পরীক্ষা-আমি আর কন্টিনিউ করতে পারব না।
(চলতে পারে)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৯:২১