‘তো কথাডা হইল-একাকীত্ব মানে পরশ্রীকাতরতা! বুঝলেননা বিষয়ডা !?’
কথাটা শুনামাত্র, মাথা নোয়ানো উবু হয়ে বসা লোকটা ঝটকরে একবার বক্তার মুখের দিকে তাকিয়েই আবার নামিয়ে ফেলে! এই মুহূর্তে তার অখন্ড মনোযোগ মাটিতে-তার দুই পায়ের মাঝে-একদল পিপড়া’র প্রতি নিবিষ্ট! যুবক বিস্মিত!- কি ছোট একটা বিস্কিটের টুকরা, তার থেকেও অনেক ক্ষুদ্রাকার পিপড়া’র দল টেনে নিয়ে যাচ্ছে! একটা নিদিষ্ট গতিতে- পদার্থবিজ্ঞানের দূরত্ব= বেগ*সময়, সূত্র মেনে নিয়েই পিপড়ার দল কি অদ্ভুতভাবে বিস্কিটের টুকরা কামড়ে ধরে একটা বলের আকৃতি নিয়ে নির্দ্দিষ্ট বেগে গড়িয়ে যাচ্ছে! তার মনে পড়ে, এইরকম বলের আকৃতি তৈরি করেইতো পিঁপড়ার দল-জলাশয় পাড়ি দেয়। বেশকিছুক্ষণ এই দেখে একঘেয়েমি আসে, তার হাই উঠে! অবশ্য একঘেয়েমি আসার পিছনে অপর লোকটারও বেশ জোরালো দাবি আছে! লোকটা সেই কখন থেকে, এই এককথাই কতবার কতভাবে তাকে বলে যাচ্ছে! ‘বড্ড বেশি কথা কয়’- সে ভাবে।
দুজনের আজই প্রথম দেখা। একই অফিসে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে ফেরার পথে নিচে চায়ের দোকানে পরিচয়। দুজনেই জানে এই চাকরি তাদের হবে না! কম্পিউটার অপারেটার পোস্টের ভাইভা-তে যদি কোশ্চেন করে-পৃথিবী থেকে চান্দের দূরত্ব কত, তাইলে উত্তর জানা থাকুক আর না থাকুক, চাকরিটা যে হবে না-তা জানা হয়ে যায়!!!
চায়ে চুমুক দেয়ার সাথে সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি! দুজনের কথাবার্তা আগায়, সাথে আগায় বৃষ্টির বেগ- একসময় ঝুম বৃষ্টি! বৃষ্টির ছাটে টুল ভিজে, চালার ফুটায় তা আরও ত্বরান্বিত হয়ে একসময় বাধ্য হয়েই টুল থেকে নেমে মাটিতে উবু হয়ে বসা।
বক্তার এদিকে নজর দেয়ার ফুসরত নাই! সে ভেজা বেঞ্চি একটু তেছরা করে নিয়ে, বসে, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলেই চলছে-
‘পরশ্রীকাতরতা জিনিসটাই বিশ্রী! স্বাভাবিক ভাবে, ধরুন আমারা সবাই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত। দিন শেষে সবাই একসাথে হই; সুখ দুঃখের গপ্প করি! এইখানে সুখের গপ্পের থেকে দুঃখের গপ্প তুলনামূলক বেশি গুরুত্বপূর্ন! দুঃখের লেভেল যাদের যত কাছে, তাদের গপ্প তত জমে... হে হে হে’
বক্তা এটুকু বলেই শরীর দুলিয়ে হাসে আর এতক্ষনে তার পূর্ণ মনোযোগ পায়! হয়ত শরীরদুলানো হাসি দেখে তার চিন্তায় ছেদ পড়ে! ভ্রু কুঁচকে সে বলে উঠে- ‘আপনে বলতে চাইছেন- পরশ্রীকাতর হইয়াই মাইনষে একলা হইয়া যায়? কি কন এইগুলা !! আর কিছু মনে না করলে একটু চুপ থাকবেন? আইজকা এই টিনের চালে ঝুম বৃষ্টির শব্দে দেখেন ক্যামন গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে!’
বক্তা সায় দেয়। ভাবে-আজ এই বর্ষণমুখর দুপুরে চিন্তার মৌন সঞ্চালন হোক তবে!
অনিশ্চয়তা হাতছানি, বাসায় আপন মানুষগুলার আশাহত দৃষ্টির কথা ভাবলে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না! তখন পাহাড়কে খুব আপন মনে হয়-তার বিশাল স্কন্ধের কোন এক কোনায় মাথাটুকু গুজে দিয়েই নির্ভার! বক্তার চিন্তায় এখন আবার একটা মরুভূমি-র দৃশ্য উকি মারে। তপ্তবালি- ধু ধু প্রান্তর, উপরে অবশ্যই শকুনের চক্কর অথবা একটু দূরে উটের কাফেলা! এসবের মানে কি সে জানেনা, জানার ইচ্ছেও নাই; খালি মাঝে মাঝে রাতে প্রচণ্ড পিপাসায় ঘুম ভাঙলে তার খুউব ভয় হয়। জলের কুঁজো থেকে গেলাসে নেয়ার আর ধর্য্য থাকে না- সরাসরি ঢকঢক করে গলায়!
অথবা দুজনেই একই চিন্তায় মগ্ন-ঠোটের কোনায় হাসি! সে হাসি চোখ ছুঁই ছুঁই করছে। তাদের চিন্তায় একটা পুকুর ঘাট-শান বাঁধানো। হাতে ছাতানিয়ে ইলশেগুঁড়ির মধ্যেই বসে আছে। ঘাটের শেষধাপ থেকে যেন কারও অস্ফুট গলা শুনা যায়- গুনগুন! এরই মাঝে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। অস্ফুট গলার কথা স্পষ্ট হয়, ‘অ্যাঁই, আফনে ছাতা নিয়েও এই বৃষ্টিতে খালিখালি ভিজেন ক্যান, অ্যাঁ?। এমন পাগল তো দেহি নাই’
কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ে! সাথে পড়ে স্বপ্ন। একঝাকিতে আবার বর্তমান! বক্তা আবারও শুরু করে... ‘ভাইজান, একাকীত্ব মানে......’
দোকানদার ঝিমায়... তাদের স্বপ্নের মতই। যুবকের ফর্মাল ড্রেসআপের সাথে মানানসই ফাইলব্যাগ থেকে আস্তে বের হয়ে আসেন ‘আবুল হাসান’। দোকানদার এর কাছে আরেককাপ দুধ-চিনি বেশি চা অর্ডার করে বক্তার দিকে অথবা জীবনের দিকেই চোখ টিপে দিয়ে বলে, ‘তবে, একটা গান হোক বটাই!’
অনেকগুলা পৃষ্ঠা উলটে যুবকের আঙুল স্থির হয়, কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়ঃ
“যেখানেই যাই আমি সেখানেই রাত!
স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরায়
অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর
ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর
সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত
আমার কেবলই শুধু রাত হয়ে যায় !”