ভালোবাসার কোন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নেই। ভালোবাসা কখনো পাপ হতে পারে না।
১.
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো। হু বলে ডাক শুনে আমি পাশ ফিরে শুইলাম। মা আমার মুখের উপরের কম্বল সরিয়ে বললেন, কি রে ভূলে গেছিস? ঘাটে যাবি না? জলদি ওঠ।
- সকাল হয়ে গেছে?
- সেই কখন ফজরের আজান দিয়েছে। এতক্ষণে তো ঘাটে লঞ্চ এসে গেছে। তুই যাবি না রহিমকে একা পাঠিয়ে দেবো?
- বড় ভাইয়া আসছে আর আমি যাবো না তাই কি হয়। তুমি শার্টটা দাও।
শার্টটা গায়ে চাপিয়ে তার উপরে শাল খানা জড়িয়ে নিলাম। বেশ ঠান্ডা। নিমের দাঁতন হাতে মেসওয়ার্ক করতে করতে হাটা শুরু করলাম। আমার পিছে পিছে পা ফেলছে রহিম। রহিম আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। কাজ কর্ম করার জন্য ওকে রাখা হয়েছে। কাজের ছেলে বলা ঠিক হবে না। আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছে। চারকূলে কেউ নেই তার। বেশ হাসিখুশী প্রানচঞ্চল একটা ছেলে। বিকেলে মাঠ থেকে গরু আনার সময় খোলা মাঠে গলা ছেড়ে গান গায়। কেউ কোন কাজ করে দিতে বললে সানন্দে লেগে যায় সেই কাজে। সব কাজে সে মজা খুজে পায়। দুনিয়াটাই যেন ওর কাছে এক মজার জায়গা। ওর পায়ের দিকে চোখ পড়তে জিজ্ঞেস করলাম।
- কিরে রহিম, স্যান্ডেল কই তোর? এই শীতে খালি পায়ে আইছিস ক্যান?
- ছোড ভাই, স্যান্ডেল পরলি পা কুটকুট করে। আমি হাঁট্টি পারিনে। খালি পায় হাট্টি আমার খুব ভালো লাগে। আর হাটাও যায় তাড়াতাড়ি। মিয়া ভাই ইবার কদিনের ছুটিতে আইলো?
- কথা না কয়ে পা ফেল। লঞ্চ মনে হয় ঘাটে চলে আইছে এতক্ষণে। আরো আগে বারুতে হইতো।
- না ভাই। এহনো আসে নাই। আসলি লঞ্চের গুড়গুড় শুনা যাতো। আমি কান পাতি রইছি।
আমাদের বাড়ী সুন্দরবনের খুব কাছে। উনবিংশ শতকের শেষ প্রান্তে এসেও যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত। বড় ভাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছে। আমাদের এই এলাকায় ভাইয়াই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র। গ্রামে বিএ পাশ কয়েকজন আছে। কিন্তু তারা সবাই খুলনার বিএল কলেজে পড়া। ঢাকা থেকে খুলনা আসার পর আইডব্লিউর ঘাট থেকে লঞ্চে করে আমাদের গ্রামে আসতে হয়। রাত দশটার লঞ্চে উঠলে আমাদের এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যায়। আর এখন শীতের সময়। কুঁয়াশার কারণে লঞ্চ খুব আস্তে চলে। অজেদ মোড়লের পুকুর পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় নিমের দাঁতন ফেলে দিয়ে কুলি করে মুখ ধুয়ে নিলাম। পুকুরের চারপাশে অনেক উঁচু উঁচু গাছ। পুকুরের রোদ পড়ে না। তাই পানি বরফ ঠান্ডা হয়ে থাকে। গরম কালে এই পুকুরে গোছল করে মজা। মুখ ধুয়ে মোছার আগেই একরাশ ঠান্ডা হাওয়া আমার নাকের ডগা ছুয়ে উড়ে গেলো। সেই ঠান্ডায় হিড়হিড় করে কেঁপে উঠলাম।
লঞ্চ ঘাঁটে গিয়ে দেখি তখনো লঞ্চ আসে নাই। নদীর ওইপারে সুন্দরবন। ঘন সবুজের সমাহার। কিন্তু কুয়াশার চাঁদরে মোড়া। মিনিট পঞ্চাশেক বসার পরে লঞ্চের শব্দ শুনতে পেলাম। অপেক্ষার পর এই গুড়গুড় শব্দ কানে মধুর হয়ে উঠলো। আমি লঞ্চঘাটের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। শব্দ শোনার পর আরো মিনিট দশেক পর লঞ্চের দেখা পেলাম। মালপত্তর সহ ভাইয়াকে নামিয়ে নিলাম। ভাইয়ার সাথে তার এক দোস্ত এসেছে। সিনেমার নায়কদের মত দেখতে। মানুষ এত ফর্সা হয়? আমি আগে দেখিনি।
২
রান্নাঘর থেকে ফুফু ডাক দিলেন। আমি বারান্দায় বসে হায়ারম্যাথ করার চেষ্টা করছিলাম। সবে ক্লাস নাইনে উঠেছি এবার্। ক্লাসে এবার ফার্স্ট হতে পারলেও স্কুল ফার্স্ট হতে পারিনি। তাই চেষ্টা করছি সামনের বার স্কুল ফার্স্ট হতে।এবার স্কুল ফার্স্ট হয়েছে অঞ্জন পাল। পাল বাড়ির ছেলেদের মাথা বরাবরই ভালো। স্কুলের হুজুর স্যার আব্দুল কুদ্দুস মাঝে মাঝে মজা করে ইসলাম শিক্ষা ক্লাসে বলেন, " হিন্দুদেরমাথা এত ভালো কেন বলতে পারিস ?" স্যারের চোখে মুখে কৌতুকের হাসির ছায়া । আমরাও মজা পাই। স্যার নিজেই বলেন, " হিন্দুরা কাঁকড়ার ঘিলু খায় বলেই তাদের এত মাথা । তাই বলে তোরা সব কাঁকড়ার ঘিলু খাবি নাকি সব ? "
আমাদের কেউ কেউ মাথা দুলিয়ে না জানায়। স্যার আবার বলেন, " ইসলামে কাঁকড়া খাওয়া মাকরুহ। মাকরুহ দুই প্রকার্। মাকরুহ তাহরিমি এবং মাকরুহ তানঝিহি। কাঁকড়া খাওয়া মাকরুহ তানঝিহি। "
গ্রামের মানুষ মাকরুহ শব্দটা শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। তারা বলে মোকরুব। আমি এটাও জানি চিংড়ি মাছ, কাঁচা পেঁয়াজ খাওয়াও মোকরুব। কিন্তু এগুলো আমাদের বাড়িতে খুব খাওয়া হয়। কিন্তু কাঁকড়ার নাম শোনা যায় না। আমার ক্লাসমেট অনুপ সাহা একদিন বলে ওর ফেভারিট খাবার হচ্ছে কাঁকড়া ভর্তা। এগুলো শুনলে আমার গা গুলিয়ে ওঠে। মুলত আমাকে ক্ষেপানোর জন্যই অনুপ এই কথা গুলো বেশী বেশী বলে। ওর কথা শুনে মনে হলো আমি নিজেই খাচ্ছি কাঁচা কাঁকড়া চিবিয়ে। দুই দাঁতের মাঝে কচকচ করে শব্দ হচ্ছে। আমার গা কেমন করে উঠলো। আমি দৌঁড়ে কলপাড়ে চলে গেলাম। পাকস্থলীর খাবার সব গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো। পৃথিবীর সব থেকে কঠিন কাজের একটি হলো বমি করা। হড়হড় করে বেশ খানিকটা বমি হয়ে যাওয়ার পর হালকা বোধ করলাম।
কলপাড়ে অনুপ এসে দাঁড়িয়েছে। " তুই মেয়েদের মত এত দুর্বল হার্টের মানুষ আগে জানতাম না। "
অনুপ টিউবয়েল চেপে দিলো। গতবছরে আমাদের হাই স্কুলে এই টিউবয়েলটি বসানো হয়েছে। আমি হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। আমার বাড়ি থেকে স্কুল আড়াই মাইল দুরে। প্রতিদিন হেঁটেই যাই আসি। কিছু মনে হয় না। আজ খুব কাহিল লাগছে। পা যেন তুলতে পারছি না। মাঝে মাঝে এরকম হয়। বিরস ভঙ্গিতে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি। রাস্তা শুনশান। কোন জনমানব নেই। কোন গাছে বসে বউ কথা কও পাখি ডাকছে। এক চিলতে বাতাস বয়ে গেলো। আমাদের অনেকেই সাইকেলে স্কুলে আসা যাওয়া করে।
এই পৃথিবীতে এসেছি খুব বেশিদিন না । তখন আমার বয়স তেরো। আমি অনেক কিছু পারি। আবার অনেক কিছুই পারি না। এই না পারা কাজের একটি সাইকেল চালানো। আমি সাইকেল চালাতে পারি না। কিছু দুর যাওয়ার পর দড়াম করে পড়ে যাই। সাইকেল বেল বাজানোর শব্দে সাইডে সরে গেলাম। জোরে ছুটে আসা সাইকেল আমার পাশে।এসে কড়া ব্রেক কষে থামলো। অনুপের মুখে ফিচকা হাসি। উঠে পড় তোরে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসি। আমি পেছনের ক্যারিয়ারে উঠে বসলাম। মাটির পথ ধরে এদিয়ে চলল দ্বিচক্রযান। রাস্তার দুপাশের গাছের সারিরা ডানা মেলেছে রাস্তার উপর। অনুপ অনর্গল বকে চলেছে এটা ওটা। কেমন যেন ঝিমানি লাগছে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বসলাম। এটুকু শুনেছিলাম স্পষ্ট, “দোস্ত তুই না হইয়া কোন মাইয়্যা যদি আমারে এইভাবে জড়ায়া ধইরতো সারকেলের পিছে বইয়া তাইলে জীবনটা ধইন্য হয়া যাইতো।” অনুপের মাথায় সারাক্ষণ মেয়েদের চিন্তা। এজন্যই তো পরীক্ষায় ফেল করতে করতে পাশ করে প্রতিবার। শেষের দিক থেকে ফার্স্ট হওয়ার রেকর্ড ওর মত আর কারও নেই বলে মনে হয়।
৩.
আমি রান্নাঘরে মুখ বাড়ালাম। ফুফু এবং মা রান্নায় ব্যস্ত। কাজেরমেয়েটা পাটায় মসলা পিষে চলেছে একমনে। মা চুলার উপর কড়াই থেকে চামচে একটু ঝোল নিয়ে ফুঁ দিয়ে চেখে দেখতে দেখতে ফুফু কে বলছেন , বু তুমি এই দুপুর বেলা পায়েস রানতে বইছো। ওরা পায়েস খাবে কখন আর ভাত ই বা খাবে কখন ! বেলা তো গড়িয়ে গেছে।
- ভাত খাবার পরে খাবে। বড় খোকা খাজুরের রসের খির খাতি কত পছন্দ করে। ঢাহার শহরে কি আর খাঁজুরের টাটকা রস পাওয়া যায়। ব্যান বেলা আমি পায়েস রাইন্দে রাখতি চাইলাম। তা গফুর গাছি আইজকে রস পাড়তি আসতি দেরিং করবে তা কিডা জানতো।
আমার দিকে তাকায়া বললো , দুপুর বেলা এত পড়াশোনা কের জন্যি। অত পড়লি মাথা খারাপ হুয়ে যাবেনে। যায়ে দেখদিন টিকটিকিটার ঘুম ভাঙ্গিছে নেই। আর কত ঘুমুবে। সারা রাইত তো লঞ্চে ঘুমুতে ঘুমুতে আইছে। সাথে কুটুম নিয়ে আইছে। পইর ঘাটে নিয়ে গিয়ে ঘা ধুয়ায়ে আন।
আম্মা বললেন, আমার ঘরে টেবিলের উপর নতুন সাবান আর গামছা আছে। নিয়ে যা।
আমি ভাইয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছি এই সময় ফুফু ডেকে বসিয়ে এক প্লেট রসের পায়েস খেতে দিলেন। আমাদের ফুফু, আব্বার থেকে কয়েক বছরের ছোট। অধিকাংশ সময় গম্ভীর হয়ে থাকেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকেন দিনের পর দিন। কারো সাথে কথা বলেন না। খাওয়া দাওয়া করেন না। এগুলো এখন আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। গ্রামের লোক বলে ফুফুরমাথায় ছিট আছে। আবার একেক দিন ফুফুর মন খুব ভালো থাকে। আমাদের সাথে দুনিয়ার গল্প জুড়ে বসেন। ফুফুর দুনিয়া অবশ্য অনেক ছোট। পশ্চিমে বাইনবাড়ির মাঠ.উত্তরে হিন্দু পাড়া , দক্ষিনে বড় গাঙের পাড় দিয়ে এঁকে বেঁকে চলা ওয়াপদা রোড আর পূর্বে শালিক খালির খাল। শালিক খালি এখন শীর্ণকায় এক খাল। দাদীজানের কাছে শুনেছি এই খাল এক সময় নদী ছিলো। মূল গাঙের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলো। একেক সময় খালে কুমির কামট চলে আসত। শালিক খালীর পাড়ে ঘাস খেতে যাওয়া গরু বাছুর টেনে নিয়ে যেত। একবার দাদীর রাঙা গাইয়ের বাছুরটা কুমিরে টেনে নিয়ে যায়।
ফুফুর বিয়ে হয়েছিলো আমার জন্মেরও আগে। ফুফু তখন এক দুরন্ত কিশোরী। দস্যি মেয়ে বলে সারা গ্রামে অখ্যাতি ছিলো। তরতর করে গাছে উঠে সে ছেলেদেরকে হার মানিয়ে দিত। এই নিয়ে দাদি তাকে সারাক্ষণ বকাঝকা করতেন। এমন কোন সন্ধ্যা পার হত না যেদিন সে দাদির হাতে চুলটানা কি লাঠির বাড়ি খেত না। রাতে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলতেন। আবার সকালে উঠে সব ভুলে যেতেন।
ফুফুর বিয়ে হয় তিনগ্রাম দুরে মাওলানা বাড়ি। ফুফাও মাওলানা ছিলেন। কিন্তু কোন কারণে তাদের দুজনার মধ্যে বনিবনা হত না। ফুফু কিছুতেই শ্বশুর বাড়ি যেতে চাইতো না। অনেক জোরাজুরি করে মারধর করেও পাঠানো যেত না। তাবিজ কবজ পানিপড়া কিছুই বাদ গেলো না। কাজের কাজ কিছু হলো না। শ্বশুর বাড়িতে তাকে অনাদর করা হত বলে শুনিনি। একবার জোর করে তাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হলো। সেই রাতেই ফুফু ফসলে দেয়ার " এন্ডিন " খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে আব্বারা কয় ভাই ছুটে যায় ফুফুর বাড়ি। হাসপাতাল আছে সেই থানা সদরে। নৌকায় করে নিতে হবে। নৌকা এক খান নিয়ে সবাই মিলে অমানুষিক ভাবে বৈঠা বাইতে শুরু করলো। হাতের তালুতে পানি ঠোলা উঠে গেলো। নৌকার গলুইতে বসে ফুফা চোখের পানি ফেলতে লাগলেন নিরবে। তিনিও জানেন না বউ ঘর করতে চায় না কেন।
এদিকে বাড়িতে দাদিজানকে ধরে রাখা যায় না। এক মাত্র মেয়ে। তিনি উঠানে ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত তড়পাতে লাগলেন। কেউ তাকে শান্ত করতে পারছে না। ফুফুকে দিন তিনেক বাদে ফিরিয়ে আনা হলো বাড়িতে। এবার কিন্তু কেউ তার চুল ধরে টানলো না। লাঠির বাড়িতে দাগ বসালো না পিঠের চামড়ায়। দাদি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকতেন সারাদিন। ফুফুও শিশুর মত মাকে আঁকড়ে ধরে বসে রইলো। ফুফুর মুখে চঞ্চল হাসি মুছে গেলো। আষাড়ের মেঘলা দিনের মত গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু একটু করে তার মাথায় সমস্যা দেখা দিতে লাগলো। অনেক কষ্টে তাকে ঘর থেকে বাইরে আনা গেলেও বাড়ির সীমানার বাইরে নেয়া যেত না। ফুফুর এক সখি ছিলো। তার নাম সুখি বিবি। সুখি এসে ফুফুকে খবর দিত কোন বনে বইচি পেঁকেছে, কাদের জাম্বুরা গাছ থেকে জাম্বুরা চুরি করা যায় এইসব। দাদিই এসব সুখিকে দিয়ে বলাতো। ফুফু শুনে উদাস চোখ মেলে তাকাতো বাড়ির উঠানে।
৪.
ভাইয়ার ঘরে উকি দিলাম। ভাইয়া পড়াশুনা করতে বাইরে যাওয়ার পর থেকে রুমটা তালাবদ্ধ থাকে। মেহমান এলে তাদেরকে এই রুমে থাকতে দেয়া হয়। গত কাল মা মর্জিনাকে সাথে নিয়ে ঘর খানাকে সাফ সুতরো করে রেখেছে। ফুফু তখন গম্ভীর হয়েই ছিলো। রাতে অবশ্য মা কে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, কে আসবে বড় ভাবী? ভাইয়া আসার খবর শুনে তার মন ভালো হলো। সেই থেকে খেঁজুরের রসের পায়েস রাঁধার প্লান করছে। পারলে তো তখনি পায়েস রাঁধতে পারে। মিয়া ভাইকে ফুফু অনেক ভালোবাসে। নি:সন্তান এই রমনী তার অপত্য স্নেহের ক্ষুধা মেটায় মিয়া ভাইয়ের উপর । আর কেউ খেলো না খেলো সেদিকে সে।ভ্রুক্ষেপও করে না। কিন্তুমিয়া ভাইয়ের দিকে সর্বক্ষণ নজর থাকে।
সকালে ভাইয়াকে আনার সময় তার বন্ধুটি বেশী কথা বলে নাই। গলায় ঠান্ডা বসে গেছে। ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলো কেমন আছো। আমার হাত ধরে হ্যান্ডশেক করলো। গ্রামদেশে খুব একটা হ্যান্ডশেক করা হয় না। আমার একটু সংকোচ লাগছিলো। সারাপথ ধরে মিয়া ভাই কথা গেলো। পুরো গ্রামের খবর তার জানা চাই। ভাইয়ার বন্ধুটি মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলো। মাফলার দিয়ে পুরো মুখ এমনভাবে বেঁধে রেখেছে যে শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা তার চোখ কি কাজল টানা দেখতে নাকি শহরের আল্ট্রা মডার্ন ছেলেরা জেনানাদের মত চোখে কাজল মাখে !
বাসায় এসে ভাইয়া গরম পানি করে দিতে বললেন। রহিম গরম পানি নিয়ে গেলে, ভাইয়া তার বন্ধুটিকে বললো , " নে দীপ্ত , গরম পানি দিয়ে গার্গল করে ফেল। আরাম লাগবে। " ভাইয়ার বন্ধুটির নাম তাহলে দীপ্ত । হিন্দু নাকি ! দ্বীপ নাম তো হিন্দুদের হয়। আমার এক ক্লাস আগে পড়ে দ্বীপ শংকর মুখোপাদ্ধ্যায় । আমার মাথায় তখন ঘুরছে নতুন একটা শব্দ শেখার আনন্দ। গার্গল মানে যে গড়গড় করে কুলি করা এটা জানতাম না।
ফুফু যে গতরাতে এত পায়েস রাম্নার পরিকল্পনা করলো সকাল থেকে তার কোন খোঁজ নেই। দরজাই খোলেনি।মা গরম ভাতের উপর ঘি ছিটিয়ে আমাদের খেতে দিলেন। আমাদের গোয়ালে তিনটা দুধেল গাই আছে। ঘি আমাদের বাড়িতে তৈরী হয়। গরম ভাতের সাথে ঘি খেতে আমার দারুন লাগে। মা বলে আমি খেতে ভালো বাসি। ফুফু বলে পেটুক কোথাকার্। ভাইয়ার বন্ধুটি বিশেষ খেলো না। গলায় ব্যাথার জন্য খেলো না নাকি গ্রামের রান্না বলে খেতে পারছে না আমি ধরতে পারলাম না।
৫.
খাটের উপর পাশাপাশি দুজন লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। কোন টা কে বুঝতে পারছি না। মনে হলো খাটের এই পাশের জন মিয়া ভাই । কাছে গিয়ে ডাকলাম মিয়া ভাই, ও মিয়া ভাই। দুজনের কারোই নড়াচড়া নাই। মিয়া ভাইয়ের প্রচন্ড ঘুম। সে মনে হয় সারাদিন ঘুমাতে পারে। বিছানায় সারাক্ষন টিকটিকির মত লেগে থাকে বলে ফুফু তাকে টিকটিকি বলে খেপায়। মা হেসে বলে ভাইয়া হওয়ার পর ফুফু নাকি সারাক্ষন তাকে দোলনায় দোল দিয়ে ঘুম পাড়াত। সেই জন্যই ছেলেটা এত ঘুম কাতুরে।
আমি ভাইজানের গায়ে হাত গিয়ে সামান্য নাড়া দিয়ে আবার ডাকলাম , ও মিয়া ভাই।
ভুল হয়ে গেলো। লেপ থেকে মুখ বের করলো ভাইয়ার ফ্রেন্ড। আমি থতমত খেয়ে গেলাম । কিন্তু ভাইয়ার ফ্রেন্ড মন জুড়ানো একটা হাসি দিয়ে বলল, কি ছোট মিয়া ?
আমাকে কেউ ছোটমিয়া বলে ডাকে না। তবে তার হাসিটি আমার ভালো লাগলো।
- উঠেন ভাই। আম্মা খেতে ডাকছেন।
- হুম। উঠবো।
আড়মোড়া ভেঙে , হাই তুলে ভাইয়াকে ডাকলো, এই সজল ওঠ।
ভাই র নাম তো শাহ জালাল। সজল হলো কবে। ভাইয়া একটু হা হু করে আবার পাশ ফিরে শুলো। মিয়া ভাইকে তুলতে না পেরে সে নিজেই উঠে পড়লো। গোল গলা গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরা । অসম্ভব সুন্দর তার দেহের গঠন। মিয়া ভাইয়ের কাছে জিমনেসিয়ামের গল্প শুনেছিলাম ।মিয়া ভাই পড়াশুনা বাদে আর সকল কাজে মহা অলস। সে তো জিম করে না। কিন্তু দীপ্ত ভাইয়া করে বলে মনে হচ্ছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম , ভাই আপনি কি জিম করেন ?
সে লুঙ্গি পরতে পরতে বললো কেন ?
আমি কিছু না বলে হাসি দিলাম এক খান ।
- হুম। মাঝে মাঝে যাই। তোমাদের টয়লেট কোন দিকে যেন । ভুলে গেলাম।
- শহরে টয়লেট নাকি ঘরের সাথে থাকে।
- হুম। এটাচড থাকে।
আমাদের টয়লেট বাড়ির পেছনে বাগানের ভেতর্। আমাদের বাড়িতে পাকা পায়খানা আছে। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে অস্বাস্থ্যকর পায়খানা।
- ছোট মিয়া শোন।
- বলেন ভাই।
- আমার কোন ভাই বোন নেই। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আমার একটা ছোট ভাই থাকুক। আমাকে ভাইয়া বলে ডাকুক।
এই সময়ে মিয়া ভাই এসে হাজির্।
- কিরে দ্বীপ্ত , গোছল শেষ ?
- হুম। তুই তো ওঠার নাম করিস না। কতক্ষন শুয়ে থাকা যায়। সেই ফুফু কই যিনি বলেন শুয়ে শুয়ে তোর পিঠ তক্তার মত সমান হয়ে গেছে।
- ফুফু কে দেখে এলাম রান্নাঘরে। তুই দাঁড়া । আমি একটা ডুব দিয়ে নেই।
ভাইয়া পুকুরের ঘাট থেকে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়লেন।
দুপুরে বাড়ির সবাই এক সাথে খেতে বসেছি। সবাই বলতে বাড়ির ছেলে সদস্যরা। আব্বা দীপ্ত ভাইয়ার খবরাখবর নিলেন। মিয়া ভাই আব্বাকে জমের মত ভয় পায়। এখনো সেই ভয় আছে তার্। যদিও আব্বা আগের মত অত কড়া নেই। হুটহাট রেগে যান না। দিপ ্ত ভাইয়ার পুরো নাম সুদীপ্ত রহমান শান্ত । ঢাকার গুলশানে তাদের বাড়ি আছে। দেশের বাড়ি ময়মনসিং এ । তার বাবা নেই। মা সরকারী চাকুরি করেন।
বিকেলে মিয়া ভাই তার বন্ধুকে নিয়ে গ্রাম ঘুরতে বের হলো। আমি আব্বার সাথে গঞ্জের হাঁটে গেলাম। রাতে বাড়ির ছাদে আড্ডা বসেছে। ভাইয়া কাঠে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। আমরা আগুনকে ঘিরে গোল হয়ে বসলাম। মুরুব্বি বলতে শুধু ফুফু আছে আমাদের সাথে। ছাদে আগুন জ্বালালে ছাদ ফেটে যানে এই নিয়ে তিনি কিছুক্ষন গজগজ করলেন। আমরা কিন্তু সেটাকে পাত্তা দিলাম না। এভাবে আগুন জ্বালানোকে ক্যাম্পফায়ার বলে। এই প্রথম ক্যাম্পফায়ায়ের স্বাদ পাচ্ছি। হোক না সেটা আমাদের ঘরের ছাদে। তবু নতুন কিছু তো একটা।
এরই মধ্যে কাজের ছেলেটা বলে বসলো, সাদা খেরেস্তানেরা এইরাম আগুন জ্বালিয়ে নাকি কুত্তা পুড়ায়ে খায়!
সবাই তার কথা শুনে হেসে উঠলো। শান্ত ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো , কে বলেছে তোমাকে ?
সে বুঝতে পারলো না তার কথায় কোন ভুল হয়েছে কি না। আমিও বুঝতে পারছি না। মনে ভয় পাচ্ছি। বলদ টা না আবার আমার নাম বলে দেয়। মাঝে মাঝে আমি তার কাছে দেশ বিদেশের নানান গল্প বলে আমার জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষমতা জাহির করি। অনেক বিষয় আছে যা আমার নিজের কাছেই পরিষ্কার না। তাতে দুই চার লাইন নিজের মত বসিয়ে দেই। এখানে ভুল হলে তো আর রসায়নের স্যার কলমের খোঁচা মেরে নাম্বার কেটে নেবেন না।
৬
দিন দুই পরের ঘটনা। বেলা এগারোটা বাজে। রোদের তেজ হালকা। আমরা চারজন নেমে পড়েছি পাথরখালি খালে। মৃতপ্রায় খাল। মাঝখানে কোমর পানি হবে। বেশীর ভাগ জায়গায় হাটু পানি। খালে কখনো পাথর পাওয়া যায় নি। তাই কিভাবে এ খালের নাম পাথরখালি হলো তা জানা যায়নি। ভাইয়া তার ফ্রেন্ডকে বলে এসেছে গ্রামে তাকে তেল য়ালা কই মাছ খাওয়াবে। সেই উক্তিকে সত্যে বাস্তবায়ন করার জন্যই এখানে আসা। খালের বুক জুড়ে ফুটে রয়েছে অজস্র শাপলা। সাদা শাপলা, নীলচে সাদা শাপলা। চেউচির বন। এখানে জাল দিয়ে মাছ ধরে সুবিধা করা যাবে না। এটা রহিম আগেও বলেছিলো। কিন্তু মিয়া ভাই পাত্তা দেয় নাই রহিমের কথা। ইয়া বড় খ্যাওলা জাল কাঁধে করে আনাই বৃথা হয়েছে। জাল খান বিলের পাশে রেখে আমরা নেমে গেলাম খালের হাটু পানিতে। হাতড়ে মাছ ধরার অন্য রকম আনন্দ আছে।
মিয়া ভাই খুব মাছ ধরতে পারত। ভাই যখন হাইস্কুলে পড়ত তখন আমি বড়ওয়ানে পড়লেও আমার বেশ মনে আছে। মিয়া ভাই ডুব মেরে পুকুরের নিচের গর্ত থেকে মাছ ধরে আনত। সেবার সে ডুব মেরে এক গর্তে হাত ঢুকিয়েছে। সেই গর্তে ছিলো ইয়া বড় কাঁকড়া। কাঁকড়া তার দাঁড়া দিয়ে চেপে ধরেছে মিয়া ভাইয়ের বামহাতের তর্জনী। ডাঙায় উঠে আসার পরে সে এক রক্তারক্তি অবস্থা। আঙুল ফুটো করে দিয়েছে। সেই ক্ষত আজও হালকা রেখা এঁকে মিশে আছে মিয়াভাইয়ের আঙ্গুলের ডগায়।
আমরা শাপলা চেউচির গোড়ায় হাত দিয়ে মাছ তালাশ করছি। দ্বীপ্ত ভাইয়া খারাই হাতে পাড়ে বসে আছে। সেও নামতে চেয়েছিলো। মিয়া ভাই নামতে দেয় নাই। ট্যাংরা মাছে কাটা মারার ভয় দেখিয়ে বসিয়ে রেখেছে। মাঠ থেকে ধান কেটে নিয়ে যাওয়ার পরে এখন মাঠ জুড়ে নাড়া । সেই নাড়া কিছু ছিড়ে এনে জড়ো করে তাকে বসতে দিয়েছে। কাঁদের গামছা খানা পাগড়ীর মত মাথায় জড়িয়ে নিয়েছে সে। আমাদের এলাকায় মাছ রাখার পাত্র কে খারাই বলে। অনেক এলাকায় এটাকে খালুই বলে। প্রথম মাছটি ধরা পড়ে মিয়া ভাইয়ের হাতে। বড় সাইজের একটা টাকি মাছ। মাছটা তিনি দ্বীপ্ত ভাইয়ার দিকে ছুড়ে দিলেন। পানির কিনারা থেকে কিছু উপরে গিয়ে পড়ল। দ্বীপ্ত ভাইয়া মাছটা দ্রুত তুলে খারাইয়ে রাখতে গেলো। কিন্তু টাকি মাছ বেশ পিছলা। এবং তিনিও মাছ ধরায় বেশ অপটু বোঝা গেলো। ঢাকা শহরের ধারে কাছে মনে হয় মাছ ধরার কোন জায়গা নেই। মাছটা দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাত থেকে ফসকে গিয়ে পানিতে পড়লো। ভাইয়া ঠাঁঠা করে হেসে উঠলো। বন্ধুর দিকে চোখ টিপ মেরে বললো,
- কিরে দীপ্ত, আজ পর্যন্ত এখনো টাকি মাছটাই ঠিকমত আয়ত্বে আনতে পারিস না।
দ্বীপ্ত ভাইয়াও সেই কথায় হেসে উঠলো। আমি আর রহিম কথার মানে বুঝলাম না। কিন্তু আমরাও হেসে দিলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন , তেলয়ালা টাকি পিছলাতেই পারে।
ঘন্টা খানেকের ভেতর আমরা বেশ মাছ ধরলাম। কই মাছ, টাকি মাছ, শোল মাছ, পুটি মাছ, টেংরা মাছ, খলিশা মাছে আমাদের খালুই অর্ধেক ভরে গেছে। ভাইয়া বেশ কয়েকটা ঢ্যাপ তুলে দ্বীপ্ত ভাইয়ার দিকে ছুড়ে মারলো। শাপলার যে ফল হয় ওটাকে বইয়ের ভাষায় বলে শালুক। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ওটা ঢ্য্যাপ নামেই পরিচিত। আমরা হাত ধুয়ে এসে সবাই বসে ঢ্যাপ খেয়ে নিলাম। ঢ্যাপের ভেতর অজস্র বিচি থাকে। এই বিচি খেতে ভালোই লাগে। যদিও অনেক বেশী খেলে পেট খারাপ করার সম্ভাবনা থাকে। শীতের রোদ ছুয়ে আসা একটা বাতাস বইছে। ঠান্ডা গরমের মিশেল। অনেকটা টক মিষ্টির মত। ভালোই লাগছে। আমি নাল সহ একটা শাপলা নিয়ে চেইন গাঁথা শুরু করলাম। চেইন গাঁথা শেষ হলে লক্ষ্য করলাম দ্বীপ্ত ভাইয়া সেটা বেশ মনোযোগ নিয়ে দেখছেন। আমি নালের মাথায় গিঁট দিয়ে দিলাম। হঠাৎ কোন কিছু না ভেবে সেটা দ্বীপ্ত ভাইয়ের গলায় পরিয়ে দিলাম। হঠাৎ একটু বিব্রত হলে তিনি নিজেকে দ্রুত সামলে নিলেন। হেসে উঠে বললেন, কি ছোট মিয়া ক্লাসের বান্ধবীদের কি এভাবে মালা পরিয়ে ছাড়ো নাকি। আছে নাকি কোন মালাবদলের গল্প। বলো শুনি।
মিয়া ভাইয়ের সামনে আমার লজ্জা লাগলো। আমি কিছু না বলে পানিতে নেমে গেলাম মাছ ধরতে। একবার চোরা চোখে চেয়ে দেখলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া খালের উপর চেয়ে আছে। গলায় তার শাপলার চেইনে ঝোলানো মালা। নেকলেসের মত ঝুলছে শাপলা ফুলটা। এই মানুষটার প্রতি আমার অন্যরকম একটা টান এসে গেছে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে অন্যরকম ভালো লাগে। এই ভালোলাগাটা আমার কাছে অচেনা। অচেনা ধরনের এই ভালো লাগাটাকে আমি ঠিক বোঝাতে পারবো না। তার দিকে তাকাতে কেন ভালো লাগে বুঝি না। এটাকেই কি ফ্যান্টাসি বলে। চোরা চোখো, সোজা চোখে তার দিকে কতবার যে তাকিয়েছি তার ইয়ত্তা নাই। অনেকবার চোখাচোখি হয়ে গেছে। ভাইয়া হেসেছেন। আমিও লাজুক হেসে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছি।
মিয়া ভাই আর রহিম বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে হাতড়ানো শুরু করেছি। আরেকবার তাকাতে গিয়ে দ্বীপ্ত ভাইয়ার চোখে চোখ পড়ে গেলো। তিনি উঠে পড়লেন। আমার দিকে হাঁটা শুরু করলেন। জিন্সের প্যান্ট হাটুর নিচ পর্যন্ত গোঁটানো। ফর্সা ধবধবে পা। হালকা কিছু পশম তাতে। আমার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। ভাইয়া এসে আমার পাশে উপুর হয়ে অপটু হাতে মাছ হাতড়ানো শুরু করলেন। হঠাৎ তিনি আমার নাম ধরে ডাকলেন। এই প্রথম। আমি তার দিকে তাকালাম। বড় মধুর সেই ডাক।
- শুভ্র তুমি যে গতকাল থেকে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকছো আমার বেশ ভালো লাগছে।
এই কথার পরে কি বলা উচিত আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। চুপ করে থাকলাম।
- শুভ্র তুমি দেখি মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে থাকো। তোমার চোখে মুগ্ধতা আছে। শহর থেকে আসা মানুষকে দেখে গ্রামের মানুষের এরকম মুগ্ধতা কখনো হয়ে থাকে। সেটা হেয়ার স্টাইল কিংবা পোষাকের কারণে হতে পারে। তোমার কোনটা ভালো লাগে।
এই প্রশ্নের উত্তর তো একটা দিতেই হবে। আমি বললাম,
- ভাইয়া নীল কালার আপনার খুব পছন্দের।
- হুম। আকাশী নীল বেশী পছন্দের।
- নীল কালারের শার্টে আপনাকে খুব মানায়।
- তাই?
- জ্বি হ্যাঁ।
- তুমি আমার শার্ট দেখ?
- হুম।
- ও তাহলে আমাকে দেখো না।
কি করে বলি ভাইয়া আমি শুধু তোমাকেই দেখি। দ্বীপ্ত ভাইয়া হা হা হা করে কিছুক্ষন হাসলেন। তারপর বললেন, তুই আমাকে ভাইয়া ডেকেছিস। সো আজ থেকে আর তুমি নয় তুই বলে ডাকবো। আর তুই সজলকে তুমি বলিস, আমাকে কেনো আপনি বলবি। আমাকে আপন ভাবতে পারিস না! আমাকে আজ থেকে তুমি বলবি।
আপনাকে আপন ভাবতে তো আমার ভালোই লাগে। আমি মাথা উপরে নিচে মৃদু ঝাঁকিয়ে বললাম, জ্বি ভাইয়া।
৭
মাথার ভেতরে এক অচেনা অনুভূতি সুড়সূড়ি দিয়ে যাচ্ছে আমায়। দীপ্ত ভাইয়াকে আমার অন্যরকম ভালো লাগছে। কি রকম ভালো! আমি নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তবে তার কথা ভাবতে ভালো লাগছে। দুপুরে খাওয়ার পর থেকে তার কথা ভাবছি। ভাবছি তো ভাবছি। ভাবনার কোন শুরু নেই, শেষও নেই। নিজের মত করে কাহিনী সাজাচ্ছি। সেখানে মূল চরিত্রে থাকছে সে আর আমি। আজ আমাদের বাসায় পিঠা বানানো হবে। অন্যান্য সময় পিঠা বানানোর খবর শুনলে আমি আনন্দ বোধ করতাম। বিড়ালের মত চাল কোটা থেকে শুরু করে পিঠা বানানো পর্যন্ত আমি আম্মার পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করতাম। আজ কোন কিছুতেই উৎসাহ নেই। পড়ার টেবিলে বসে আছি।
কি এক প্রয়োজনে একবার বাইরে এলাম। ঢেঁকিঘরে চাল কুটছে মা, ফুফু। কাজের মেয়েটা একই ছন্দে ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে। ফুফু মাঝে মাঝে হাত দিয়ে “নোটের” ভেতরের চাল “এলে” দিচ্ছে। মা তার পাশে বসে ছাঁকনি দিয়ে গুড়ো আলাদা করে ফেলছেন। মা বললেন, “যা তো ছোট খোকা, দোকান থেকে সের দুয়েক তেল নিয়ে আয়।” আমি রহিমকে পাঠিয়ে দিতে বললাম। এশার আজান হচ্ছে মসজিদে। এই সময় মিয়া ভাই এবং তার বন্ধু গ্রাম ঘুরে ফিরে এলেন। আমাকেও ডাকা হলো। সবাই বসেছি রান্নাঘরের দাওয়ায়। আমাদের রান্নাঘরের বারান্দা পাকা করা। উপরে গোলপাতার ছাউনি। আব্বা টিনের চাল দিতে চান। কিন্তু আম্মা রাজি হন না। আম্মা বলেন টিনের চালের রান্নাঘর অনেক বেশী গরম হয়ে যায়।
আজ তিন ধরণের পিঠা বানানো হচ্ছে। কুলি পিঠা, পান পিঠা, আর রসে ভেজানোর জন্য চিতই পিঠা। প্রথম হওয়া পিঠাটা আমার চাইই চাই। আজ আমি চাইলাম না। চুপ করে ছিলাম। মা প্রথম পিঠা টা আমাকে দিলেন। আব্বা বসেছেন বড় ঘরের দাওয়ায়। তাকে এক বাটি কুলি পিঠা দিয়ে এলাম। ভাইয়া আর দীপ্ত ভাইয়াও পিঠা খাচ্ছেন। পিঠা খাওয়ায় দীপ্ত ভাইয়ার চোখে মুখে আনন্দের রেশ ফুটে উঠছে। ভাইয়া পিঠা খেতে খেতেই বললো, আমাদের উত্তরের একটা জমি নিয়ে মামলা চলছে কয়েক বছর। ভাইয়াকে সেই কারনে আগামীকাল খুলনা টাউনে যেতে হবে। দীপ্ত ভাইয়া একটু হতাশ হলো। সেও ভাইয়ার সাথে যেতে চাইলো। ভাইয়া তাকে নিরস্ত করলো। ওখানে গিয়ে সারাদিন উকিল সাথে কথা বলতে হবে, আদালতের বারান্দায় দিন কেটে যাবে। দিন তিনেকের তো মামলা।
সকালে উঠে রসে ভেজা পিঠা খেয়েই ভাইয়া আর আব্বা ব্যাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। সাতটার লঞ্চে তারা খুলনা যাবে। রাতের লঞ্চে যাওয়া যেত। কিন্ত আব্বার একটু ঠান্ডার ধাঁত হয়েছে। তাই রাতে গেলেন না। কয়েকদিন স্কুলে যাওয়া হয় না। আমিও স্কুলের পথ ধরলাম। দীপ্ত ভাইয়া বললেন, বিকেলে আমার সাথে বেড়াতে যাবেন। আমার তখনি মনে হচ্ছিলো, আজ আর ইস্কুল যাওয়ার দরকার নেই। চলেন এখনি বেড়াতে যাই। অতিকষ্টে লোভ সামলালাম। ক্লাসে কোন মনযোগ দিতে পারলাম না। প্রশান্ত স্যার তো বলেই বসলেন, কোন আনারকলির কথা ভাবছো ক্লাসে বসে শুভ্র? পড়ায় মনযোগ নেই কেন! পড়ায় ধ্যান দাও। বিকেলে ৪ টায় স্কুল ছুটি হয়। আমি দুইটাতেই শর্ট লিভ নিয়ে চলে এলাম। এসে দেখি দীপ্ত ভাইয়া দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি তার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় রইলাম।
ভাইয়া বলে গেছেন, সে আসা না পর্যন্ত আমি যেন দীপ্ত ভাইয়ার ঘরে থাকি। আমাদের এখানে বিদ্যুৎ নাই। সেজন্য শহরের মেহমানকে একা থাকতে দেয়া হয় না। কখন কি লাগে। আমি দীপ্ত ভাইয়া যে ঘরে থাকেন সেখানে গেলাম। দরজা হালকা ভেজানো। শব্দ না হয় এমন ভাবে দরজা খুললাম। ভাইয়া ঘুমিয়ে আছেন। আমি আস্তে করে খাঁটের কোনায় বসলাম। প্রতিটি ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে নিষ্পাপ লাগে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ঘরের পাশের নিমগাছে একটা কোকিল পাখি ডাকছে। শীতকালে কোকিল পাখি ডাকে কেন!
৮
পানিতে বৈঠা ফেলার শব্দ হচ্ছে। নৌকা তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাগরিবের আযান হয়ে গেছে বেশ আগে। প্রকৃতি এখন কালো চাদরে মোড়া। কিছুক্ষন আগেই আকাশের কোনার দ্বাদশীর চাঁদ উঁকি দিলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া বসেছে নৌকার পাটাতনে। আমি গলুইতে বসে বৈঠা বাইছি।প্লানটা দ্বীপ্ত ভাইয়ের্। ঘুম থেকে উঠে বললেন , চল নৌকা করে ঘুরে আসি। এ তো আর শহর না যে ঘাটে গেলেই ভাড়ার নৌকা পাওয়া যাবে। মা অবশ্য হালকা বাঁধা দিলেন। ঠান্ডা বিকেলে নৌকা চড়ার কি দরকার্। দ্বীপ্ত ভাই আর আমি বেড়াতে যাবো। মনটাই আমার আনন্দে নেচে উঠলো। কোন বাঁধা মানার পাত্র নই আজ আমি। নৌকা জোগাড় করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। রহিম আসতে পারলো না। সন্ধ্যার আগেই তাকে গরু বাছুর গোয়ালে তুলতে হবে। চটের মশারি টাঙিয়ে দিতে হবে। ধুয়া দিয়ে মশা তাড়াতে হবে। না হলে সারা রাত অবলা পশু গুলো মশার কামড়ে কষ্ট পাবে। আমিও চাচ্ছিলাম না রহিম আমাদের সাথে আসুক। সে একবার বললো আজ না হয় মর্জিনা গরু গুলোকে গইলে তুলুক। আমি বাধা দিলাম। সন্ধ্যা বেলায় হাস মুরগী গুলো তুলতে হয় তাকে।
আমাদের বাড়ী থেকে শালিক খালি নদী মিনিট পনেরো হাঁটা পথ।পাশাপাশি দুজন হাঁটছি। আমার খুব ইচ্ছে করছে দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাত ধরে হাঁটতে । কিন্তু কিভাবে ধরি। বড়ই বেমানান দেখায়। হঠাৎ দ্বীপ্ত ভাই এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। আমি পুলকিত হলাম। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। কি একটা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলছিলেন। আমার কানেই ঢুকছিলো না।
এশার আযানের পর চাঁদ অনেক উপরে উঠে গেছে। এক মোহনীয় মায়াময় আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।শালিক খালির পানিতে , আমাদের নৌকার উপর , বৈঠায়, দ্বীপ্ত ভাইয়ার মুখে। ডাঙায় ঝোঁপে ঝাড়ে জোনাকি পোকার মিটিমিটি জ্বলে আর নেভে। আমি অপলকে চেয়ে আছি। দ্বীপ্ত ভাইয়ার চোখে । সেও তাকিয়ে আছে। চোখে যেন আজ নেশা , মনে আজ ঘোর্। চুম্বকের মত একে অন্যকে টানছি আমরা। আমি বৈঠা রেখে কখন যে পাটাতনে এসেছি জানিনা। কখন যে আমার মাথার পেছেনে দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাত এসেছে তাও জানিনা। মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি কখন ঠোঁট রেখেছি দ্বীপ্ত ভাইয়ার ঠোঁটে তাও জানি না। আমাদের দুটি ঠোঁট চুম্বকের দুই মেরুর মত এক হয়ে আছে। আমাদের দুজনের লালা মিশে যাচ্ছে। নি:শ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। শরীর কাঁপছে। হৃদপিন্ডের ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে জানিনা।
একটা সময় কামনার আগুন শীতল হলো। আমরা দুজন দুজকে ছেড়ে দিলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া পাটাতনে শুয়ে পড়লেন। আমি তার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম। তিনি বাঁধা দিলেন না। আমাকে টেনে পাশে শোয়ালেন। আমি তার বাহুতেমাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। ঢেউয়ে ভেসে নৌকা একাই এগিয়ে যেতে লাগলো। আমি দুর আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চাঁদটাকে আজ অসহ্য সুন্দর লাগছে। জ্যোছনার আলোয় সে আজ ভাসিয়ে দেবে তামাম দুনিয়া। দ্বীপ্ত ভাইয়া গলা ছেড়ে রবীন্দ্র সংগীত ধরলেন। তার গানের গলাও চমৎকার্। অনেকটা শ্রীকান্ত আচার্যের মত।
তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি
সকাল আমার গেল মিছে বিকেল যে যায় তারি পিছে গো
রেখো না আর বেঁধো না আর কুলের কাছাকাছি...
৯
নির্ঘুম একটি রাত কেটে গেলো। সারা রাত দুচোখের পারা এক করতে পারিনি। মানুষের চিন্তার বাইরে, চাওয়ার বাইরেও অনেক কিছু ঘটে যায়। আজ রাতটিও ছিলো সেরকম একটি রাত। ঠান্ডা বাতাস যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য মা সন্ধ্যা বেলা এসে জানালা আটকে দিয়ে গেছেন। জানালার গ্রিল পেরিয়ে কবাটের ওপাশে বাগানের উপর, আমাদের ঘরের ছাদে অবাক জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে। নৌকা থেকে আমরা দুজন ফিরে আসি রাত বারোটার দিকে। আসার পথে দ্বীপ্ত ভাইয়ের মুখ বেশ গম্ভীর। সারা পথ কোন কথা বললেন না। আমি দুয়েকটা কথা বলার চেষ্টা করলাম। অপরজনের সাড়া না পেয়ে আমাকে থামতে হলো। খাওয়ার টেবিলেও কোন কথা বললেন না। আমি তার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করলাম। অনেকটা মেয়েলি পনা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। আবেগের জোয়ার যেন আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে অজানা দেশে। দ্বীপ্ত ভাইয়া চোখ সরিয়ে নিলেন। ভাতের প্লেটের দিকে সেই যে চোখ নামালো। আর একটি বারের জন্য চোখ তুললো না। কি হলো তার!
রাতে ঘুমাতে গেলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া কম্বল মুড়ি দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। আমি সাড়া দিয়েই ঘরে ঢুকলাম। একটু শব্দ করলাম। কিন্তু কোন নড়চড় নেই। হালকা করে ডাকলাম, দ্বীপ্ত ভাইয়া। সে ডাক শুনলো, হুম, কিছু বলবে?
- ঘুমিয়ে গেছেন।
- হু!
আমার হাসি পেলো। ঘুমিয়ে গেলে ডাক শোনে কিভাবে মানুষ। আমি তার পাশে শুয়ে পড়লাম। মিয়া ভাই আর দ্বীপ্ত ভাইয়ার জন্য আলাদা কম্বল রাখা ছিলো ঘরে। আমি মিয়া ভাইয়ের কম্বলটি টেনে নিলাম। আশা করছিলাম অপর পক্ষ থেকে সাড়া পাবো। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হতে লাগলো। আমি উৎকর্ণ হয়ে আছি। দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দটা কানে লাগছে। ঘরের পাশে গাছের পাতা থেকে টুপটাপ শিশির ঝরার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। দূরে কোথাও একটা ভুতুম পেঁচার ছানা কেঁদে উঠলো। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে। হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরতে। তার ওই কমলা কোয়া ঠোটে ঠোট রেখে চুমু খেতে। তার মুখের লোনা স্বাদ চিনির থেকেও মধুর লাগে। কিন্তু সে নিঃসাড় হয়ে শুয়ে আছে। আজকের রাত আলিফ লায়লার এক হাজার এক রাতের চেয়ে দীর্ঘ ছিলো। রাতের তারারা কখন যে মিলিয়ে যেতে শুরু করলো আমি টের পেলাম না। পোড়া চোখ দিয়ে কেন পানি গড়িয়ে পড়ে! কার জন্য, কিসের জন্য এই পানি! আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু আজ আমি আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। খোঁয়াড় থেকে বড় ঝুঁটিওয়ালা লাল মোরগটি কোক্করো কো বলে বাগ দিতে শুরু করেছে। মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুললিত কন্ঠে আজানের সুর ভেসে আসছে। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম। ঘুম হইতে নামাজ উত্তম ।
সকালে উঠে আমি স্কুলে চলে গেলাম। একটা ক্লাসেও মন বসছে না। স্যারদের বকা খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। সুস্মিতা বললো, দোস্ত, আজ তোর কি হয়েছে?
- কিছু না।
- শরীর খারাপ?
- না।
- মন খারাপ?
- না।
- প্রেমে পড়েছিস?
আমার অবাক হয়ে তাকালামা সুস্মিতার দিকে তাকালাম। আমি কি তবে প্রেমে পরেছি। দ্বীপ্ত ভাইয়ার প্রেমে! ছেলে ছেলে কি প্রেম সম্ভব? আমি কি দ্বীপ্ত ভাইয়াকে ভালোবাসি? আমি এরকম করছি কেন? একটা ছেলেকে চুমু খেলাম কেন? তার শরীরের গন্ধ পেতে আমি এত উতলা কেন! এটাকেই কি সমকাম বলে? মসজিদের ইমাম সাহেবের মুখ ভেসে এলো চোখের পাতায়। এক জুম্মাবারে ইমাম সাহেব পবিত্র আল কোরআনের সুরা আল আরাফের তর্জমা করছিলেন। সুরার ৮০ থেকে ৮১ আয়াতে হযরত লুত (আঃ) এর কওমদের সমকামীতার অপরাধে ধ্বংস করে দেয়া হয় সেই ইতিহাস বিবৃত আছে । সমকামিতার অপরাধে আল্লাহ তায়ালা আদ, সামুদ, লুতের কওমদের ধ্বংস করেন। সোদম ও গোমরা নগরীর লোকদের মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। জিবরাইল আলাহিস সালামের আঙুলের আঘাতে সেখানে এক সাগর তৈরি হয়। সেই সাগরের নাম ডেড সি। জর্ডান ইসরাইলের মাঝে মৃত সাগর অবস্থিত। সেখানকার পানিতে লবনের মাত্রা এত বেশী যে কোন উদ্ভিদ বা জলজ প্রানী বাঁচতে পারে না। আমি সুস্মিতার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। ফেল ফেল করে তাকিয়ে রইলাম। তারা আমাকে খোঁচাতেই লাগলো। বল দোস্ত, প্লিজ বল। কে সেই সুন্দরী। কার প্রেমে তুই মজনু হয়েছিস। প্লিজ বল।
বন্ধুদের ইয়ার্কি ঠাট্টা অসহ্য লাগছিলো। আমি টিফিনের আগেই বাড়ি ফিরে এলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়ার রুমের দিকে একবার আড়চোখে তাকালাম। কোন শব্দ নেই। আমার নিজের রুমের দিকে গেলাম। পড়ার টেবিলে বসলাম। কিছুই ভালো লাগে না। দুই ব্যাটারির একটা রেডিও আছে আমার। সুইচ ঘুরিয়ে চ্যানেল ধরানোর চেষ্টা করলাম। বাংলাদেশ বেতার খুলনায় অনুরোধের আসর গানের ডালি হচ্ছে। উপস্থাপিকা বলে গেলো, আজকের শেষ গানটি এখন বাজানো হবে। এই গানটির জন্য অনুরোধ করেছেন যশোরের আরবপুর থেকে আতিফ, খুলনার ডুমুরিয়া থেকে সাকিব এবং আরো অনেকে। এর পরপরই মিউজিক বেজে উঠলো। রবীন্দ্র সংগীত। ইন্দ্রাণী সেনের কন্ঠে, আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে। গতরাতে বসন্ত ছিলো না। কিন্তু ছিলো ফিনিক জ্যোৎস্না । ফুটফুটে চাঁদ। জোনাকির মেলা। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। নদীর শান্ত জলে ভেসে থাকা এক নৌকা। মৃদুমন্দ দুলছে। পাটাতনে শুয়ে আছে দুটি মানব সন্তান। একে অন্যকে জড়িয়ে। আমার দুচোখে আজ বান নেমেছে। শ্রাবণ ধারার মত বাঁধ ভাঙা জোয়ার।
মরার কোকিল নিম গাছে বসে কুহু কুহু করে ডাকা শুরু করছে। বারান্দায় মায়ের সাথে গল্প করছে ওপাড়ার মন্ডল বাড়ির মেজ দাদী। মাকে ডেকে বলছে, বড়বৌ, অসময়ে কোকিল পাই ডাহা তো ভালো না। বালা মুসিবত আসতি পারে । ঢেলা মারে তাড়াই দাও দিন পাইডারে।
মা হেসে বললো, কি যে কও না চাচী। পুরোনো দিনের মানষির মত কথা। পাই ডাকলি বিপদ হবে ক্যান। দ্যাহো পাইডা সাথি খুজে পাতিছে না। তাই ডাকতিছে।
মেজদাদী বললো, তোমরা যা হতিছো না বউ। মডার্ন হতি গে সব মানা গোনা ভূলি যাতিছো।
১০
আমাদের বাড়ির নিচের ব্যাড়ের নিচ থেকে শুরু হইছে বিল। আমাদের এলাকায় ফসলের মাঠকে বলা হয় বিল। ব্যাড়ের নিচের বিলে নাড়া গাদা করে রাখা হয়েছে। আটি বেঁধে রাখা নাড়ার উপর আমি বসেছি। আমার পাশের নাড়ার আটির উপর বসেছে দ্বীপ্ত ভাইয়া। আমাদের মাথার উপর বিকেলের মিঠে রোদ। দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকিয়ে আছি দক্ষিণের বিলের দিকে। এই বিল ধরে হেঁটে গেলে পাথর খালির খাল পড়বে। সেই খাল পেরিয়ে কিলোমিটার খানের পরে ওয়াপদার রাস্তা। তার পরে বড় গাঙ। সেই গাঙের অন্য পারে সুন্দরবন। আমাদের ভাষায় বাঁদা। দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার নাম ধরে ডাকলেন,
দ্বীপ্তঃ শুভ্র
আমিঃ জ্বি, বলেন।
আমার দিকে তাকাবে।
আমিঃ তাকালাম। বলেন।
দ্বীপ্তঃ কি হয়েছে তোমার?
আমিঃ কিছু হয় নাই। আপনি তুই থেকে তুমিতে উঠে গেছেন কেন?
দ্বীপ্তঃ তুমিও তুমি থেকে আপনি তে উঠে গেছো।
আমিঃ তুমি বললেই কি আর আপনি বললেই বা কি!
দ্বীপ্তঃ সত্যি করে বলবে কি হয়েছে তোমার?
আমিঃ কিছুই হয় নাই।
দ্বীপ্তঃ আমি গত রাতের ঘটনার জন্য মাফ চাইছি তোমার কাছে।
আমিঃ মাফ চাচ্ছেন কেন?
দ্বীপ্তঃ দেখ, যা ঘটেছে কেন ঘটেছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আমি নিজে থেকে এসব চাইনি
আমিঃ তাহলে করলেন কেন?
দ্বীপ্তঃ সেজন্যই মাফ চাচ্ছি।
আমিঃ চুমু খাওয়ার জন্য কেউ মাফ চায়! আমি তো এটাতে কোন অপরাধ দেখি না।
দ্বীপ্তঃ তোমার বয়স অল্প। তুমি কি বুঝবে সব কিছু।
আমিঃ বুঝিয়ে বললেই বুঝবো। মাথা খারাপ না আমার। প্রতিবার ফার্স্ট হই।
দ্বীপ্তঃ এটাকে সমকামিতা বলে। এটা ধর্মে নিষিদ্ধ। ইসলামে নিষিদ্ধ পৃথিবীর সব ধর্মে নিষিদ্ধ।
আমিঃ জানি।
দ্বীপ্তঃ জানো?
আমিঃ হ্যাঁ।
দ্বীপ্তঃ তোমার ভেতর পাপবোধ কাজ করছে না।
আমিঃ না।
দ্বীপ্তঃ কেন না?
আমিঃ কারণ আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
দ্বীপ্তঃ এত দ্রুত কিভাবে আমাকে ভালোবেসে ফেলবে তুমি?
আমিঃ আমি জানিনা।
দ্বীপ্তঃ এটাকে ভালোবাসা বলে না শুভ্র। এটা মোহ। মোহ কেটে গেলে তখন তোমার মনে হবে আমি পৃথিবীর সবথেকে খারাপ একটি মানুষ। আমি তোমাকে পাপের পথে টেনে এনেছি।
আমিঃ মনে হবে না।
এটা তো কথার কথা।
আমিঃ আপনি পাপবোধে ভুগছেন?
দ্বীপ্তঃ হ্যাঁ।
আমিঃ জাহান্নামের আগুনে পোড়ার ভয় পাচ্ছেন?
দ্বীপ্তঃ সমকামীদের জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে এই কথা আল কোরআনের কোথাও লেখা নেই। কোরআনে বলা হয়েছে তাদের প্রতি লানত বর্ষিত হোক।
আমিঃ তাহলে কিসের পাপবোধ?
দ্বীপ্তঃ তুমি আমার বন্ধুর ছোট ভাই। প্রিয় বন্ধুর ছোট ভাই। তোমাকে আমি কখনো কোন ভূল পথে টেনে নিয়ে যেতে পারিনা।
আমিঃ আপনি কোথাও আমাকে টেনে নিচ্ছেন না। আমি নিজেই নামতে চাচ্ছি।
দ্বীপ্তঃ আচ্ছা তুমি কি কখনো প্রেম করেছ আগে?
আমিঃ না।
দ্বীপ্তঃ মেয়েদের প্রতি আকর্ষন বোধ করো?
আমিঃ কিরকম আকর্ষন?
দ্বীপ্তঃ এই সেক্সুয়াল ফিলিংস!
আমিঃ হুম।
দ্বীপ্তঃ ছেলেদের প্রতি?
আমিঃ আগে করতাম না। এখন করি। আপনাকে দেখার পর থেকে।
দ্বীপ্তঃ কিন্তু কেন?
আমিঃ আমি জানি না।
দ্বীপ্তঃ তুমি আমাকে সমকামিতার জগতে টেনে নামাতে চাও?
আমিঃ না। একতরফা কিছুই হয় না। গতরাতে আমরা দুজনেই চুমু খেয়েছি। কেউ বাঁধা দেয়নি। আমাদের দুজনের সায় ছিলো।
দ্বীপ্তঃ তুমি তো বেশ কথা বলতে পারো।
আমিঃ বোবা ছাড়া সবাই কথা বলতে পারে।
দ্বীপ্তঃ আমি গুছিয়ে কথা বলার কথা বলছি।
আমিঃ কথা কিভাবে গোছায়?
দ্বীপ্তঃ বাপস! আমি তোমার সাথে কথায় পারবো না। যাও তোমার জিত।
আমিঃ হার জিত দিয়ে আমি কি করবো।
দ্বীপ্তঃ তুমি কি আমার উপর ক্ষেপে আছো?
আমিঃ না।
দ্বীপ্তঃ রেগে আছো?
আমিঃ না।
দ্বীপ্তঃ কষ্ট পেয়েছ?
আমিঃ না।
দ্বীপ্তঃ কাল সারা রাত ঘুমাও নি কেন?
আমিঃ ঘুম আসে নি তাই।
কাঁদছিলে কেন?
আমিঃ কে বললো?
দ্বীপ্তঃ রহিম বলেছে।
আমিঃ মিথ্যা বলার কি দরকার। তুমিও তাহলে সারারাত জেগে ছিলে।
দ্বীপ্তঃ হুম।
আমিঃ এরকমটি কেন করলে?
দ্বীপ্তঃ আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
আমিঃ এখন বুঝেছ?
দ্বীপ্তঃ জানিনা। তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো?
আমিঃ নিজেকেই জিজ্ঞেস করো। এবার বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা।
দ্বীপ্ত ভাইয়া উত্তর দেয়ার আগেই বাড়ির ব্যাড় থেকে ফুফুর গলা ভেসে এলো, “ছোট খোকা বাড়ি আয় তো। মজিদ সরদারের বাড়ি যাতি হবে। ধাক্কুরি (জলদি) আয়”। আমার মন এখন ভালো। আমি ছুটে গেলাম। পেছন ফিরে একবারো তাকালাম না। কিন্তু আমি জানি, একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক চোখে। যে চোখে আমি ভালোবাসা দেখেছিলাম।
১১
সন্ধ্যাটা আজ বড়ই মধুর লাগছে। সরদার বাড়ি থেকে আসতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গেলাম। মনই বসে না কোন কিছুতে। দ্বীপ্ত ভাইয়ার রুমে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে না। না যাবো না। দেখা যাক। দেখি সে নিজে থেকে আসে কিনা। ছাদের উপর রাতের আকাশ , তাতে হাজার তারার ফুটকি আঁকা। কোন গ্রাম্য মেয়ের হাতে আঁকা এক নকশি কাঁথা যেন। আমি ছাদের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরের শিরিষ গাছে শালিকের কিচির মিচির এই মাত্র থেমে গেলো। হয়তো সবাইকে গুডনাইট জানিয়ে ঘুমাতে গেলো শালিকের ঝাঁক। আমাদের একটা পোষা শালিক ছিলো। কথা বলতে পারত। গুটি কয়েক শব্দ ছিলো তার ভাণ্ডারে। কেমন আছিস, বয় ( বস) । আব্বাকে সে আব্বা বলে ডাকত। আর মা কে বলত বু। বারান্দার উত্তর কোনায় ঝোলানো থাকত তার খাঁচা। একবার ঝড়ের রাতে। মন্টু কোথায় যেন উড়ে যায়। আমাদের পোষা শালিক পাখিটার নাম ছিলো মন্টু। কে তার নাম মন্টু রেখেছিলো ঠিক মনে পড়ছে না। পরদিন দুপুরে মন্টু নিজেই ফিরে আসে। তারপর থেকে মন্টু ছাড়াই থাকত। সারা বাড়িময় সে উড়ে বেড়াতো। সারাক্ষন জানা কয়টি শব্দ আওড়ে চলত। মানুষ গরু যেই তার সামনে দিয়ে যাক বলত , ভাত খেয়ে যা। এটা শিখেছে মায়ের কাছ থেকে। মা প্রায়ই রান্নাঘর থেকে আমাদের দুই ভাইকে ডেকে বলত ভাত খেয়ে যা। মাস খানেক পরে এক আম কাঠাল পাকা জৈষ্ঠের দুপুরে সবাই যখন বিছানায় , কেউ ঝিমুচ্ছে, কেউ ঘুম, এক হুলো বেড়ালের খপ করে চেপে ধরে মন্টুর গলার কাছে। মন্টু বারান্দায় রাখা বেঞ্চের হাতলে বসে ছিলো। রহিম ঢেলা মেরে হুলো বিড়ালের মুখ থেকে মন্টুকে ছাড়িয়ে আনে। কিন্তু ততক্ষনে মন্টু আর বেঁচে নেই। আর কেউ কাঁধে উড়ে এসে বসে বলে না, ভাত খেয়ে যা। উত্তর দিকের নারিকেল গাছটার ওপাশে রহিম আর আমি দুজনে মিলে মন্টু আর তার ঘাতক বিড়াল টিকে কবর দিয়ে রাখি। রহিমের ঢেলা গিয়ে লাগে হুলোটার মাথায়। সেখানেই সে কাঁত হয়ে পড়ে। আর সোজা হয়ে দাঁড়ায় নাই।
উত্তরের নারিকেল গাছটার দিকে তাকাতে মন্টুর কথা মনে পড়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো, ভাত খেয়ে যা। পুরোনো কথাই ভাবছিলাম। হঠাৎ কেউ যেন আমার কাঁধে দুই হাত রেখে দাঁড়ালো। নাকে একটা অপরিচিত গন্ধ ভেসে এলো। রহিমের উচ্ছস্বিত ডাক শুনলাম একই সাথে। পাশ ফিরে দেখি কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে দ্বীপ্ত ভাইয়া। একটু দূরে ট্রে হাতে রহিম, তার দুই গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে হাসি। এত খুশী কি হলো!
- কিরে রহিম , আজ এত খুশি ক্যান। না চাইতেই চা নিয়ে এলি।
- ভাইজান এইডা চা না। এইডা কপি। শহরের ভাইজান নিজে বানাইছে। ওল কপি, ফুল কপি , পাতা কপির মত এইডার নামও কপি। কিন্তুক চায়ের মত দেখতি। ঘ্রানডা আলাদা। ন্যাও খাও।
- অত কথা বলে কাজ নেই। যা নিচে গিয়ে কফি খা। আর যাওয়ার সময় সিড়ি ঘরের দরজা টেনে দিয়ে যা। না হলি বিড়াল ঢুকবে।
বইয়ে কফির কথা পড়া আছে। আমাদের এদিকে তো কফি পাওয়া যায় না। সত্যি বলতে কি কফির স্বাদ কেমন আমি এখনো তা জানিনা। দ্বীপ্ত ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম , কফি কোথায় পেলেন ?
দ্বীপ্ত ভাইয়া জানালো সে সাথে করে কিছু কফি বিন নিয়ে এসেছে।
- নাও শুরু করো।
- তুমি শুরু করো আগে ।
আমি কফিতে চুমুক দিলাম। একটু তিতকুটে স্বাদ। কিন্তু মন্দ না।
- স্বাদ কেমন ? কেমন হয়েছে ?
- জীবনে প্রথম কফি খাচ্ছি। স্বাদ কেমন তা বুঝবো কিভাবে!
- জীবনে অনেক কিছুই তো প্রথম খাচ্ছো। সেগুলো জিজ্ঞেস করলেতো ভালই পাকা পাকা কথা বলতে পারবে।
আমি চুপ করে রইলাম । দ্বীপ্ত ভাই কিছু না বলে আমার চোখে চোখ রাখলেন একবার্। আমার কফি মগ ধরা হাতে ধরলেন দুহাতে। হাত খানা মুখের কাছে টেনে নিলেন। সেই কফি মগে তিনি চুমুক দিলেন। পুরোনো আবেশে আমরা মুগ্ধতা ফিরে পেলাম। আমরা পালাক্রমে কফি মগে চুমুক দিতে লাগলাম। আমি চাদর আনি নাই। ঠান্ডা লাগছিলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া তার চাদরে আমাকে জড়িয়ে নিলেন পেছন থেকে। আমাকে বেষ্টন করে ধরে রাখা হাতের উপর আমি হাত রাখলাম। তিনি আমার কাঁধে টুক করে চুমু খেলেন। তার দেহের উষ্ণতা আমার দেহে আগুন ধরিয়ে দিলো।
- শুভ্র।
- বলো।
- আজ পহেলা ফাল্গুন । বসন্তের প্রথম দিন। আজ রঙিন হবার দিন। পলাশের রঙে লাল হবার দিন।
- ভাইজান , আমরা গ্রামের মানুষ বাংলা দিনপঞ্জির হিসেব ভালোই রাখি।
- শুধু জান বললেই হয়। ভাইটা আবার লাগানোর কি দরকার! বলো দেখি একবার শুনি। বলো বলো।
আমি ভেবেছিলাম শুধু জান বলাটা অনেক সহজ। কিন্তু বলতে গিয়ে দেখলাম মুখ থেকে বেরুতেই চায় না।
- শুভ্র।
- তুমি কি জানো আগামীকাল কি দিবস ?
- না।
- আগামীকাল ১৪ই ফেব্রুয়ারী , বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। অনেকে এটাকে ভ্যালেনটাইনস দিবস বলে।
- কেন ? এই দিনে কি ভ্যালেন্টাইনস ভালোবাসার জন্য শহীদ হয় নাকি এরকম কিছু ?
- হা হা হা। সব দিবসেই কি শহীদ হতে হবে! আসলে ভ্যালেন্টাইনসের ইতিহাসের সাথে যুগলদের ভালোবাসার কোন সম্পর্ক নেই। চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে রোমে ভ্যালেন্টাইনস নামে এক খ্রিস্টান পাদ্রি বাস করত। রোম তখন শাসন করত ইহুদি শাসক ক্লডিয়াস। ভ্যালেন্টাইনসের পেশা ছিল ডাক্তারি। রোমে সেসময় খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিলো। খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের অভিযোগে ভ্যালনটাইনসকে বন্দী করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তিনি জেলারের দৃষ্টিহীন মেয়ের চোখের চিকিৎসা করে চোখ ভালো করে দেন। প্রহরী সৈনিকদের মধ্যে ভ্যালনটাইনসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজা ক্লডিয়াস ঈর্ষান্বিত হয়ে তার মৃত্যুদন্ড দেন । ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে তা কার্যকর করা হয়। এর চারশো বছর পরে অস্টম শতাব্দীতে খ্রিস্টিয় চার্চ সেন্ট ভ্যালেনটাইনসের স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারীকে ভ্যালেন্টাইনস দিবস ঘোষনা করে।
- এটা তাহলে খ্রিস্টানদের উৎসব? -
- হুম । সেরকমই।
- তাহলে বাঙালিরা পালন করে কেন ?
- এটা খ্রিস্টিয় অনুষ্ঠান হলেও দিনটিকে বিশ্বব্যাপি পরিচিতি দেয় প্রেমিক প্রেমিকারা। এদিনে হাজার মানুষ তাদের ভালোবাসার মানুষকে ফিল করে, তাদের উইশ করে। ফুল পাঠায়, কার্ড পাঠায়। ভালোবাসার রঙে মেতে ওঠে পুরো পৃথিবী। আমরাও যদি সেই মিছিলে যোগ দেই তবে খারাপ কি!
- ওরে বাবা। এত হাই থটের কথাবার্তা আমার মাথার উপর দিয়ে গেলো। মাথা ঘুরছে। একটা গান শোনাও প্লিজ।
আমার মাথায় হালকা চাপড় মেরে হাসি মুখে বললেন, কোন গানটি ?
- তোমার পছন্দের যে কোন গান । রবীন্দ্র সংগীত।
দ্বীপ্ত ভাইয়া গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলেন , তোমারে করিয়াছি জীবনের ধ্রুব তারা ।
গান শেষ হওয়ার আগেই মা খেতে ডেকে পাঠালেন রহিমকে দিয়ে। সিড়ি ঘরে পায়ের আওয়াজ পেয়ে আমি ছিটকে আলাদা হয়ে গেলায় দ্বীপ্ত ভাইয়ার বাহুডোর থেকে। খেতে বসলাম। আমার বাম পাশে বসেছেন দ্বীপ্ত ভাইয়া। আমার খুব ইচ্ছে করছে নিজ হাতে তার মুখে খাবার তুলে দিতে। অন্তত এক লোকমা। তার হাত থেকে এক নোলা ভাত খাবারও লোভ হচ্ছে। কিন্তু সবার সামনে তা কিভাবে হয়। ফুফু দাঁড়িয়ে আছেন। বারান্দার খাটের উপর আমরা তিনজন খেতে বসেছি। আমি , দ্বীপ্ত ভাইয়া এবং রহিম। আজ আমি জোর করে দ্বীপ্ত ভাইয়ার পাতে খাবার তুলে দিতে লাগলাম। রুই মাছই তুলে দিলাম তিন পিস। একটু বেশী বেশি হয়ে যাচ্ছে নাকি ! রহিম খেয়ে উঠে গেলো। তার অত বাচবিচার নেই। গরুর মত গপাগপ খেয়ে শুতে চলে যায়। ফুফু যেন কি আনতে ভেতর ঘরে গেলো। আমি টপাক করে তার প্লেট থেকে এক মুঠ মাখানো ভাত তুলে মুখে দিলাম। ভাইয়া মৃদু স্বরে বললেন, পাগল একটা।
রাত বারোটার কিছু আগে আমরা ঘুমাতে গেলাম। যদি হয় সুজন, এক কম্বলে দুজন। আজ আর আলাদা কম্বলের প্রয়োজন হলো না। এক কম্বলের নিচে আমরা দুজন একে অন্যকে জড়িয়ে শুয়ে আছি। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললো , জানো শুভ্র প্রেম ভালোবাসা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক কথা বলা হয়েছে। তোমার ঠোঁট দেখে চর্যাপদের এক কবির কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে। চর্যাপদের নাম জানো তো ? বাংলা ভাষায় রচিত সব থেকে প্রাচীন বই। এর আগে বাংলা ভাষায় লেখা কোন বইয়ের অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায় নাই।
গুণ্ডরীপাদের রচিত একটি পদ পার্থিব
প্রেমের তীব্র আর্তিতে জীবন্ত:
“যোইণি তঁই বিণু খনহিঁ ন জীবমি। তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি।” (পদ ৪,
অর্থাৎ- যোগিনী, তোমাকে ছাড়া মুহুর্তকালও বাঁচব না। তোমার মুখ চুম্বন করে কমলরস অর্থাৎ পদ্মমধু পান করব। )
আবার ধরো এই যে আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি। বড়ই মধুময় এই রাত্রিযাপন। এরকম একটি চিত্রকল্প আছে অন্য এক কবির পদে। শবরপাদের একটি পদে আছে প্রেমের এক অপূর্ব চিত্রণ-
উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত
গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর
গুলী গুহাডা তোহৌরি।
ণিঅ ঘরণী ণামে সহজ সুন্দারী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত
লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ
কুণ্ডলবজ্রধারী।।
(পদ ২৮, অর্থাৎ- উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-
প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর- শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-
শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।)
আর রবীন্দ্রনাথে যদি খোঁজ, তবে তুমি ভালোবাসার ...
আমি বাঁধা না দিয়ে পারলাম না। এসব রাখো তো পন্ডিত। জ্ঞানের কথা পরে শোনা যাবে। রাত এখনো অনেক জোয়ান। এই রাত তোমার আমার। শুধু দুজনার।
আমি ভাইয়ার নাকের ডগায় আলতো করে চুমু খেলাম। সেও আমার কর্নমুলে চুমু খেলো। তার বলিষ্ঠ হাত আমার ঠোট ছুয়ে গেলো। আমি সেই ফর্সা আঙ্গুলেও চুমু একে দিলাম।তার হাত আমার গলা ছুয়ে নেমে যেতে লাগলো। বুকের জমিন পেরিয়ে নাভিমুল ছাড়িয়ে আরো আরো অনেক নিচে নেমে গেলো। লুঙ্গির গিট ঢিলা হলো। তার হাত আরো নিচে নেমে গেলো। আমার সারা শরীর সুপ্ত কামনার ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি আজ আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। নি:শ্বাস ঘন হয়ে এলো। দুজন দুজনার ইঞ্চি ইঞ্চি জায়গা আজ চিনে নিতে শুরু করলাম। জিহবার তুলিতে আঁকা হলো চিত্রে ভরে গেলো সারা শরীর। বাহুমূল, বুক, পিঠ, আরো আরো সব জায়গা। ভালোবাসার পরশে মাখামাখি হয়ে গেলো বসন্তের প্রথম রাত। দুটি দেহ একই সাথে কামনার আগুনে লাল হতে লাগলো, নীল হতে লাগলো। শ্বাস দীর্ঘ হ্রস্ব হতে লাগলো বারবার। শীতের রাতে আমাদের দেহে ভিসুভিয়াসের উত্তাপ। টপটপ করে ঘামে ঝরে পড়তে লাগলো। কখনো ব্যথায় মৃদু চিৎকার, কখনোবা শিহরণের শিৎকার। শৃঙ্গার সঙ্গমে মত্ত মহাকাল। ক্লান্ত দুটি দেহ ঘুমের অতলে হারিয়ে গেলো। তবে হারিয়ে যাওয়ার আগে মুখ চুম্বনেরও আগে দুজন দুজনকে জানিয়ে দিলাম ভালোবাসা দিবসের প্রথম প্রহরে, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
আহা আজি এ বসন্তে , কত ফুল ফোঁটে, কত পাখি গায় ...
সুখে আছে যারা , সুখে থাক তারা ...
১২
সুখে আছে যারা , সুখে থাক তারা ...
রাতটা সুখেই কেটে গেলো। ভোরের আলো কখন যে জানালার ফাঁক গলে ঘরে উঁকি দেয়া শুরু করেছে বলতে পারবো না। ঘুম ভাঙলো দ্বীপ্ত ভাইয়ার মৃদু ঝাঁকুনিতে। আস্তে আস্তে করে ডাকছে, এই শুভ্র। আমি চোখ মেললাম। গত রাতের ক্লান্তি এখনো শরীরে। চারটার কিছু আগে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার ঠোটে নিজের ঠোট চেপে ধরলাম। চুমুটা বেশিক্ষণ দীর্ঘায়িত হলো না। দরজায় রহিমের ডাকাডাকি শুনে দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার ঘুম ভাঙায়। তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম। লুঙ্গি কই গেলো। রেখেছিলাম কোথায়। খুজে পাই না। কম্বলের ভিড়ে খুঁজলাম দুজন। আরে এটা তো দ্বীপ্ত ভাইয়ার প্যান্ট । লুঙ্গি কই। লুঙ্গি খুঁজে পেলাম পালংকের নিচে । টপাক করে আরেকটা চুমু খেলাম দ্বীপ্ত ভাইয়াকে।
বাইরে এসে দেখি ভাইয়া আর আব্বা দুজনেই ফিরে এসেছেন। মামলায় আমাদের জয় হয়েছে। হাত মুখ ধুয়ে খুলনা টাউন থেকে আনা সাতক্ষীরা ঘোষ ডেয়ারি থেকে আনা মিষ্টি খেলাম। মিয়া ভাই ঘুমাতে গেলো।
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, চল ভোরের হাওয়ায় কিছুক্ষণ খালি পায়ে ঘুরে আসি। কুয়াশা কাটেনি এখনো। ঠান্ডা নেই। আমরা দুজন হাত ধরে হাঁটছি। আজ সোয়েটার পরেছি। দ্বীপ্ত ভাইয়ের গায়ে সাদা কালো ডোরাকাটা সোয়েটার্। পেছনে হট হট শব্দ শুনে আমরা রাস্তার সাইডে সরে দাঁড়ালাম। রহিম গরু গুলোকে তাড়িয়ে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা আস্তে হাটছি। রহিম আমাদের ছাড়িয়ে গেলো। কালো দামড়াটা অনেক বেয়াড়া। এর গাছ খায়, ওর বেড়া ভাঙে। ওকে কন্ট্রোল করতে রহিমকে ছুটতে হয়। সামনের বকরি ইদে কুরবানি দেয়ার জন্য গরুটাকে রাখা হয়েছে।
পায়ের নিচে শিশির ভেজা ঘাস। দ্বীপ্ত ভাইয়া মনে হয় বহুকাল পরে ঘাসে পা দিয়েছে। পায়ের নিচে ঘাসের সুড়সুড়ি লাগার অভিব্যক্তি তার চোখে মুখে ফুটে উঠছে। কথা বলতে বলতে আমরা মধ্যির ডাঙা পর্যন্ত চলে এসেছি। মধ্যির ডাঙায় কেউ থাকে না। উচু উচু খেজুর গাছ আছে অনেকগুলো। গফুর গাছি গাছ থেকে রস নামাচ্ছে। একজায়গায় মাটির ভাড় জড়ো করে রাখা । অধিকাংশই খালি। বাকি গুলো ভরা। আমাদের দেখে মাঝ গাছ থেকে গফুর গাছি ডাক দিলো কিডা যায় ?
- এইতো আমরা। রস কখান হলো আইজকে গফুর কা।
গাছ থেকে গাছি ততক্ষনে নেমে এসেছে। আধাভরা একটা ভাড়ে হাতের ভাড় থেকে রস ঢালতে ঢালতে বললো, রস হলো এই ধরো সাতখান। আরো দুখোনের মত হবে। সাথে কিডা ?
- ভাইয়ার বন্ধু।
- খুইল্লে শহরে বাড়ি ?
- না ঢাকায়।
- ও ঢাহায়। রস খাও। দাড়াও দিতিছি।
- না থাক।
- আরে থাকপে ক্যান। সাথে শহরের কুটুম। আমাগে শাহ জালাল ভাইয়ের বন্ধু মানুষ।
দ্বীপ্ত ভাইয়া হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালো। গাছি গলায় ঝোলানো গামছায় ভালো করে হাত মুছে হাত মেলালো। গাছিকে কখনো চাদর কি জাম্পার পরতে দেখা যায় না। পাতলা হাফ হাতা ফতুয়ার উপর গামছা খানাই তার শীতের সাজ। একটা ভাড়ের গলায় এলুমিনিয়ামের গ্লাস বাঁধা। গ্লাস টা ভালো করে ধুয়ে এনে তাতে রস ভরে বাড়িয়ে দিলো রস। গাছি বললো, তোমরা রস খাতি থাকো। আমি ভাড় খান পাইতে দিয়ে আসতিছি। উলা রস দিয়ে গুড় বানাতিছি এবার্।
ঠান্ডা শীতল রস বেশ কিছুটা সময় নিয়ে খেলো দ্বীপ্ত ভাইয়া। যখন গ্লাস থেকে মুখ তুললো দেখলাম তার উপরের ঠোটে রসের সাদা ফেনা লেগে আছে। আমি আরেকটু হলে মুছেই দিতাম। কিন্তু গফুর গাছি চলে আসায় হাত সরিয়ে পেছনের দিকে একটা জমি দেখিয়ে বললাম , ঐটা আমার জমি। দ্বীপ্ত ভাইয়া হাতের তালুতে মুখ মুছে সেদিকে তাকালো। কুয়াশার উপরে সুর্য মামা হাসি মুখে ভেসে উঠলো।
১৩
পরের দিন সকালে আমরা সবাই জড়ো হয়েছি মধ্যির ডাঙায়। প্লানটা দ্বীপ্ত ভাইয়ার্। মিয়া ভাই গাইগুই করছিলো। কিন্তু আমি দ্বীপ্ত ভাইয়া র সাথে তাল দেয়া শুরু করলাম। রহিম কিছু না বুঝেও বললো, অনেক মজা হবেনে। আমরা বনভোজনে এসেছি। ভাইয়া বললেন, বনভোজনটা সুন্দরবনে গিয়েই করলে হত। আর দ্বীপ্ত তুই যে এত সুন্দরবন দেখার বায়না ধরতি , আর এখানে এসে তো একবারও বলিস না।
- এতদিন বলতাম। এখন সুন্দরবন দেখানোর দ্বায়িত্ব তোর্। তোর যা ভাব দেখছি তাতে মনে হয় না সুন্দরবনে নিয়ে যাবি।
- নিয়ে যাবো না মানে । আগামীকালই নিয়ে যাবো।
- দেখা যাবে ঘুম কুমার্।
মধ্যির ডাঙায় বড় ঝাকড়া গাছটার নিচে মাদুর পেতে বসেছে ফুফু আর তার বাল্য কালের সখী সুখী ফুফু। সখী ফুফু গতকাল ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। সকালে ফুফুর সাথে দেখা করতে আসে। আমরা তাকেও যেতে দেইনি। রহিমকে নিয়ে মিয়াভাই মাটিতে চুলা খুচছে। দ্বীপ্ত ভাইয়া আলুগুলোর খোসা ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। আমি মাংসগুলো ধুয়ে আনলাম পুকুর থেকে। দেশী মোরগের মাংস দিয়ে ভুনা খিঁচুড়ি রান্না হবে। বাবুর্চি আমাদের দ্বীপ্ত ভাইয়া। সকালে মোরগটা ধরতে গিয়ে ঘন্টাখানেক লেগে গেলো। রহিম মাছ ধরা খ্যাপলা জাল ছুড়েও ধরতে পারে নাই। দ্রুত ছুটে যায়। শেষে মর্জিনা রান্নাঘরের দরজা খোলা রেখে একমুঠো চাউল রেখে এলো। ডান বাম ক্লিয়ার দেখে মোরগটা রান্নাঘরে ঢুকলো। মর্জিনা টুক করে দরজার শিকল তুলে দিলো। ঘরের ভিতর আগে থেকে ওঁত পেতে আছি আমি আর রহিম।
ফুফু তো কিছুতেই আসবে না। ঘর দোর থাকতে বন বাঁদাড়ে গিয়ে কেন রান্না করতে হবে। এইসব পাগলামি কে কবে শুনেছে। মানুষে বলবে কি ! সে সুখী ফুফুকে সাক্ষি মানে। সুখী ফুফু কিছুই বলে না।
এখানে এসে মর্জিনা আলুকাটা শুরু করেছিলো। দ্বীপ্ত তাকে ফুফুদের পিছে গিয়ে বসতে বললো। আজ মেয়েরা কোন কাজ করবে না। আমরাই সব করবো। শুনে সুখী ফুফুও গালে হাত দিলো। পাগল ছেলেরা বলে কি! আমরা থাকতে তোমরা রাধবে কেন! আর মর্দ মানুষ কি রাধতে পারে নাকি। কোন দিন তো চুলোর পিঠে যাও নাই।
ফুফু বলেন, গাছ তলায় বসে রান্না করলে ভুতে নজর দেয়। পেট খারাপ হয় তাতে।
আমরা শুনে হাসি। ফুফু সেই আগের জমানার বিশ্বাসেই রয়ে গেছে। রান্না শুরু হবে। কিন্তু আমরা কিছুতেই চুলা ধরাতে পারি না। সাদা ধোয়া কালো ধোয়া গাছের মাথা গিয়ে ছোয়। কিন্তু আগুন জলেনা। আমরা চারজনে পারলে ফু দেই একসাথে। আমাদের কান্ড দেখে ফুফুরা বাচ্চা মেয়ের মত হেসে উঠলো। শেষপর্যন্ত মর্জিনা চুলা ধরিয়ে দিলো। ফুফুরা গভির মনোযোগ নিয়ে রান্না বান্না দেখতে লাগলো। তারা তো বিশ্বাস করে নি যে শেষ পর্যন্ত আমরা রান্না করতে পারবো। আসার সময় ফুফু মাকে বলে এসেছে আমাদের জন্য রান্না করে রাখতে।
কিন্তু রান্না শেষ হলো। আমরা সবাই মধ্যির ডাঙার পুকুরে গা ধুয়ে নিলাম এক এক করে রহিমের গামছা পরে। রহিমের জন্য মিয়া ভাই যে নতুন জামাটা এনেছে এবার সেটা সে পরে এসেছে। বেচারার মন খারাপ। নতুন জামাটায় কালি লেগে গেছে। মর্জিনা বলেছে বাড়ি গিয়ে ভালো করে সাবান দিয়ে দেবে।
আমরা খেতে বসলাম। রান্না খুবই ভালো হয়েছে। ভুনা খিচুড়ি আমি দুই প্লেট খেলাম। আমার তো তার হাতের রান্না খারাপ লাগতেই পারে না। মর্জিনা ফিসফিস করে রহিমকে বলে কাঁচা মরিচ নেই না। ঝাল কম হইছে। ফিসফিস করলেও আমরা শুনে ফেললাম। ফুফু বললেন, মর্জিনা তোকে বলেছি খাবারের বদনাম করবে না। গুনা হয়। হাদিসে নবীজী বলেছেন, তোমরা খাবার পছন্দ না হলে খেয়ো না কিন্তু খাবারের বদনাম করো না।
মর্জিনা ভয় পেয়ে মিনমিন করে খাবার ভালো হয়েছে। খাবার তো আমি খারাপ বলিনি।
দ্বীপ্ত ভাইয়া সলাজ হেসে বলল, আমি ঝালের অনুমানটাই ঠিক করতে পারিনি। আর সব ঠিক আছে।
ফুফু বললেন, ঠিক আছে। তোমার রান্না তো অনেক ভালো। আর শহরের মানুষ ঝাল কম খায় আমরা জানি। তাই তো রান্নার সময় ঝাল কম দেই।
মিয়া ভাই বাড়িতে আগেই বলেছিলো যেন ঝাল কম দিয়ে রান্না করা হয়। ফুফুর কথা শুনে মিয়াভাই হা হা হা করে হেসে ঊঠলেন, দ্বীপ্ত এখন কি ভাবছে জানো। ভাবছে এই যদি কম হয় তবে বেশীর নমুনা কি !
দ্বীপ্ত ভাইয়া প্রতিবাদ করে বললেন , কখনোই না। রান্না আমার খুব ভালো লাগছে। বিশেষ করে মুলা বেগুন দিয়ে ভেটকি মাছের কারিটা জোস লাগছে। ফুফু আমাকে রান্নাটা শিখিয়ে দেবেন?
কারি কি ? ফুফু জানতে চাইলেন। মিয়া ভাই বললেন, তরকারিকে ইংরেজীতে কারি বলে। রহিম বলে উঠলো, তাই। ইংরেজী এত সুজা ! আমরা গ্রামের অন্যান্য বাড়ির তুলনায় ঝাল কম খাই। কিন্তু এটুকুও দ্বীপ্ত ভাইয়ার জন্য বেশী হয়ে যায়। আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করে দেখেছি সে ভাত খাওয়ার মাঝে ঘনঘন পানি খায়। মাছ মাংসে ঝোল ভাত দিয়ে মুছে নেয়। ঝালের উত্তাপে তার লাল ঠোট আরো বেশি লাল হয়ে যায়। শীতের দুপুরে তার শুভ কপোলে মুক্ত দানার মত বিন্দু ঘাম জমে।
১৪
চলনা ঘুরে আসি অজানাতে , যেখানে নদী এসে থেমে গেছে...
ভটভট করে ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে। বানিয়াখালি ফরেস্ট ক্যাম্প পেরিয়ে এসেছি একটু আগে। নদীর ডানপারে সুন্দরবন, বামপাশে লোকালয়। নদীর বুকে ঘোলা পানি। নদীর পাড়ের মেয়ে বধুরা নেটের জাল নিয়ে কোমর পানিতে টানা দিচ্ছে চিংড়ীর পোনা ধরতে। একজায়গায় দেখছি বুড়ো বুড়ি ছোট্ট নৌকায় বসে কাঁকড়া ধরছে। মাঝে মধ্যে সুন্দরবনে জীবিকার অন্বেষনে যাওয়া বাওয়াল , মৌয়াল, জেলেদের ফিরে আসা নৌকা দেখা যাচ্ছে। তারা জোরে জোরে বৈঠা বাইছে। খুলনা গামী একটা দোতলা লঞ্চ আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো। পানির ঢেউয়ে ট্রলার খানা দুলে উঠলো।
ট্রলারে আমরা গুটিকয়েক মানুষ। হাল ধরে বসে আছে ছাকা মাঝি। ছাকার নাম ছাকিম। কিন্তু গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এটা ছাকা হয়ে গেছে, যেমন আজিজুল হয়ে যায় আইজুল, বাকের হয় বাকা। ছাকার বাপ রমজান মাঝি খেয়াঘাটে মানুষ পারাপার করত। শক্ত সামর্থ্য লোকটা গত অগ্রহায়নে হঠাৎ করে মারা গেলো। ছাকা কিছু টাকা জমিয়ে ট্রলার খানা বানিয়েছে কয়েক মাস আগে। ভাড়ায় মহাজনদের মাল টানে এই হাট থেকে ওই হাটে। মিয়া ভাইয়ের বয়সী। ভাইয়া ট্রলার খুঁজছে শুনে সে নিজে এসে বললো, জালাল ভাই আমার টলার থাকতি ভাড়া কত্তি যাবা ক্যান। আমিই কাইলকে তুমাগে নিয়ে যাবো বাঁদা দেখাতি। ভাড়া নেয়ার ব্যাপারে সে কিছুতে রাজি হলো না। একবার ওদের পুবের বিলের দুই বিঘে জমি নিয়ে সরদার বাড়ির মজিবর সরদারের ঝামেলা হয়। মজিবর সরদার ভুয়া কাগজ বানিয়ে গরীবের শেষ সম্বল জমিটুকু গাপ করে দেয়ার ফন্দি আঁটে। ছাকার বাপ গরীব ঘাটের মাঝি। অফিস আদালত কোট কাচারি করবে কিভাবে। আব্বা হাট থেকে সদাই নিয়ে একা ফিরছিলো। মাঝি বৈঠা টানে কিন্তু নৌকা এগোয় না। আব্বা মাঝিকে শুধায়, শরীর খারাপ? মাঝি মাথা নাড়ায়। শরীর খারাপ না। মনডা বড় ব্যাজার্। বাপ দাদার শেষ সম্বল দুবিঘে জমি, তাও ধরে রাখতে পারছে না। পোলাডার জন্য কিছুই রাইখা যাইতে পারবে না সে। সারাদিনে খেয়া পারের টাকায় সংসারই চলে না। মামলা মোকদ্দমা চালাবে কি দিয়ে। আব্বা রমজান মাঝিকে শুধু টাকা দিয়ে সাহায্য করেনি উপরন্তু নিয়মিত কোর্টে যেত মাঝির সাথে। এটা নিয়ে সর্দার বাড়ির লোকের সাথে আমাদের ঝামেলা হয়। বিল থেকে একদিন আমাদের একটা খাসি ছাগল নেই হয়ে গেলো।
ট্রলারের ছাদে বসেছে দ্বীপ্ত ভাইয়া, মিয়া ভাই ও মিয়া ভাইয়ের স্কুলের বন্ধু রবি ভাই, খোকন ভাই, গোলাপ ভাই। রবি ভাই স্কুলে পড়া শেষ করেনি বখাটে পনা স্বভাবের কারণে। তার বাপ তাকে বিয়ে দিয়ে গঞ্জের হাটে নিজেদের দোকানে বসিয়ে দিয়েছে। রবি ভাইয়ের ছেলেই এখন প্রাইমারিতে পড়ে। খোকন ভাইয়া কলেজ পর্যন্ত পড়েছে। দুইবার পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেন নি। উদাস কবি টাইপের মানুষ। গানের গলা আছে। বাউল গানে আসর মাতাতে তার জুড়ি আমাদের গ্রামে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই গানের সুত্র ধরেই পাশের গ্রামে অখিল সাহার বাড়িতে তার নিয়মিত যাতায়াত । অখিল সাহার মেয়ে কবিতা রানী সাহার সাথে খোকন ভাইয়ের প্রেমের গল্প গ্রামে চাউর আছে। মেজ দাদি বলে, গ্রামে কি মোচলমানের মাইয়ার আকাল পড়ছে যে মালাউনের মাইয়ার লগে সাদি করতে হবে। গোলাপ ভাই পড়াশোনা করছে। খুলনা বিএল কলেজে পড়ে বাংলা সাহিত্যে। দ্বীপ্ত ভাইয়া তাদের সাথে মিলে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সেই রাতের পর থেকে আমরা দুজন আর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু সময় এত দ্রুত কেটে যাচ্ছে যে কিছুই টের পাই না। আজ ট্রলারে আমি তার গা ঘেঁষে বসলাম। দেখলাম তিনি চুপচাপ। সরে এলাম।
ট্রলারের গলুইয়ে বসেছি আমি এবং রহিম । ট্রলার এখন মুল নদী ছেড়ে শাখা নদী দিয়ে বেশ ভেতরে চলে এসেছে। দুপাশেই সুন্দরবন। গাছের সারি দেখলে মনে হয় কোন মালির হাতে সযতনে লাগানো গাছের বাগান। গেওয়া, গরান, ধুন্দল, পশুর, বাইন, সুন্দরী, কেওড়া গাছের সারি। কোথাও গোলপাতা বন। গোলপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে বাঘ। আব্বা পইপই করে বলে দিছে যেন সুন্দরবনের বেশী গভীরে না যাই। বাঘের ভয়ে নয়। ডাকাতের ভয়ে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় ডাকাতের উৎপাত অনেক বেশী। সুন্দরবন হচ্ছে ডাকাতদের অভয়ারন্য।
সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য হচ্ছে বিশুদ্ধ এবং নির্মল। এই অপরূপ রূপের বর্ননা ভাষায় বর্ননা করা সম্ভব নয়। শুধু দুচোখ ভরে উপভোগ করা যায়। বনের মাঝে শুনশান প্রশান্তিময় পরিবেশ। ভটভট শব্দে ট্রলার এগিয়ে চলে। নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ। সাদা বকের দল তার নিচ দিয়ে উড়ে গেলো। গাছের ডালে বসা মদন টাকটি ঝিমুচ্ছে। তার পাশের ডালে উড়ে এসে বসলো একটি বন মুরগী।মদনটাক একটু মাথা উচু করে দেখে আবার ঘুমিয়ে গেলো। বনমুরগী টি কোকর কো করে ডাকতে লাগলো। নিচের থেকে বনমোরগের পাল্টা ডাক শোনা গেলো। কিন্তু দেখতে পেলাম না। মুরগিটা সেদিকেই উড়ে গেলো। বনমুরগী উড়তে পারে । এরা কক মুরগীর মত স্লিম হয়। রহিমের ডাকে ফিরলাম। নদীর পানির উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে সাঁতরে পার হচ্ছে কি একটা সাপ। রহিম বললো, দেবো নাকি বাশের লগি দিয়ে একটা বাড়ি!
আজব হাতে লাঠি থাকলেই বাড়ি মারতে হবে! খোকন ভাই ভাটিয়ালি সুর ভাসিয়ে দিলো বাতাসে, কে যায়রে ভাটির গাঙ বাইয়া, আমার ভাইজানরে কইয়ো ....
গান শেষ হলো বান্দরের চেঁচামেচিতে। কেওড়া গাছের ডালে ঝুলে বুড়ো ধেড়ে কচি জোয়ান বাঁদরের দল চিৎকার করছে। খুব সম্ভবত তাদের মধ্যে কোন কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। ছাঁকা ভাই মিয়া ভাইকে জিগাইলো সামনে যাবে কিনা ? সামনে একটু রিস্ক আছে। দুইদিন আগে কোহিনুর ডাকাতের দল দুই জেলেকে তুলে নিয়ে গেছে জোড়া খালের মাথা থেকে। বিশ হাজার টাকা মুক্তিপন চাইছে মহাজনের কাছে। মিয়া ভাই ট্রলার ঘোরানোর নির্দেশ দিলেন।
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, এত দ্রুত ফিরে যাবো?
মিয়াভাই: গাছপালা আর কত দেখবি!
দ্বীপ্ত: বাঘ হরিন কুমির কিছুই তো দেখলাম না।
খোকন ভাই : বাঘ কুমিরকে চিঠি না দিয়ে এলে কি তারা দেখা করে।
ট্রলার ফেরার পথ ধরেছে। গোলপাতা বন পার হবার আগেই একটা হরিন শাবক কে দেখা গেলো। আমরা সব হইহই করে উঠলাম। বাচ্চাটা থমকে দাঁড়ালো। তার মা ছুটে এলো। তারপর সে মায়ের সাথে দৌড়ে পালিয়ে গেলো বনের ভেতর। হরিন দেখার আনন্দ আমাদের চোখে মুখে। কিছু মানুষের উপস্থিতি, কিছু প্রানী আমাদের মনে অনাবিল প্রশান্তি এনে দেয়।
বাড়ি ফিরে আসতে আমাদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। দুপুরে বাড়িতে খাবার কথা ছিলো। মা রান্না করে বসে আছেন পথ চেয়ে। ফুফু বলেন , বাঁদায় গেলি তা একটা হরিন ধরে আনলি না ক্যান। পুষতাম।
সবাই মিলে খেতে বসলাম। পারছে মাছ ভাজা, ভেটকি মাছ ভুনা, বাগদা চিংড়ির কোর্মা। বড় বড় বাগদা মাছ কিনে এনেছে আব্বা। দ্বীপ্ত ভাইয়ার পাতে ফুফু বেশ কয়েকটা তুলে দিলো। আমি চিংড়ি খেতে পারিনা। গা ঘিন ঘিন করে। দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার প্লেটে একটা তুলে দিলো। সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো। সবাই দেখতে চাচ্ছে এবার আমি কি করি।
১৫
কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে ...
লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে মিয়া ভাই এবং দ্বীপ্ত ভাইয়া হাত নাড়ছেন। একটু একটু করে লঞ্চ বানিয়াখালী লঞ্চ টার্মিনাল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। লঞ্চের যান্ত্রিক চিৎকারে বিকেলের বাতাস ভারী হয়ে গেলো। আকাশের দিকে ছুটে গেলো একরাশ কালো ধোঁয়া। ঘাটে দাঁড়িয়ে রহিম আমি দুজনেরি হাত নাড়ছি। রহিম মর্জিনার সাবান দিয়ে কেচে দেয়া শার্ট পরে এসেছে। মুখে উপচে পড়া হাসি। আমার হাত খানাই নড়ছে শুধু। মুখে কি বিষাদের ছায়া নাকি কালো ধোঁয়ার আভা ! বুকটা আমার ছিড়ে যাচ্ছে। আমার মুখের হাসিটুকু কি চলে যাচ্ছে এই লঞ্চে করে ?
কয়েকদিনের ব্যস্ত সময়ে আমি ভুলেই গেছিলাম অনেক কিছু। পড়ালেখা মাথায় উঠেছে। মায়ের বকুনি শুনে সন্ধ্যার একটু পরে পড়তে বসেছি। কিন্তু পড়ায় কি আর মন বসে। রহিম আমার ঘরের ওপাশের চৌকি খাঁটে ঘুমায়। সে দোকানে গেছে কেরোসিন তেল কিনতে। এখনো বিদ্যুত আসে নাই এদিকে। কয়রা থানা সদরে অবশ্য বিদ্যুত আছে। আমি প্রথম বিজলি বাতির আলো দেখি কয়রা থানা সদরে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে। এখনো মধ্য যুগের মত কেরোসিনের কুপি বাতিই আমাদের ভরসা। কেরোসিনের প্রদ্বীপকে আমরা বলি টেমি।
দরজায় ঠুকঠুক শব্দ শুনে আমি ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়ার কথাই ভাবছিলাম। মিয়া ভাই ফিরে আসার পর আমরা দুজন আর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পাইনি। মিয়া ভাই যেন মুল ভিলেন। সারাক্ষণ বন্ধুর পাশে কেন থাকতে হবে! কিন্তু আমার ঘরে কে নক করে আসবে ! সবাই এসে দড়াম করে দরজা খোলে। ছোট হওয়ার এই এক জ্বালা । প্রাইভেসি বলে কিছুই থাকে না। আমি বললাম, কে ?
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, আমি দ্বীপ্ত।
- ভেতরে আসছেন না কেন ভাইয়া?
আমি টেবিল ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি এরই মধ্যে দ্বীপ্ত ভাইয়া রুমে ঢুকে ভেজানো দরজা আবার ভিজিয়ে দিয়ে দরজার কপাটে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়ালেন। নি:শব্দে আমার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিলেন। তার চোখের চাহনি আমাকে বাঁধনহারা করে ফেললো। আমি তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমাদের তৃষ্ণার্ত অধরে প্রেমের সুধাবারি বর্ষিত হত। দ্বীপ্ত ভাইয়া যে আমাকে ভেতরে ভেতরে এতটা মিস করেছে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। বাহিরে তিনি ছিলেন সহজ সরল প্রাঞ্জল।
দ্বীপ্ত ভাইয়ার চোখের মনি কাঁপছে।
- কি হয়েছে জান ?
- আগামীকাল আমি চলে যাচ্ছি।
আমি হঠাৎ চমকে উঠলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া যে বেড়াতে এসেছে, দুদিন বাদে চলে যাবে এই কথাই তো আমি ভুলে গেছিলাম।
- এত দ্রুত যাবে কেন ? আমি যেতে দিলে তো !
- আজ না হোক কাল যেতেই হবে। তাছাড়া সজলই তাড়াহুড়া করছে।
আমি আর কিছু বলার খুঁজে পেলাম না। দুচোখ কান্নার জলে ঝাপসা হয়ে এলো। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার বুকে মাথা রাখলাম। শব্দ করে কাঁদতে পারছি না। চাঁপা কান্নার উচ্ছ্বাসে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি। আমি মাথায় কয়েক ফোঁটা গরম জল পড়লো। আমি মুখ তুলে দেখি দ্বীপ্ত ভাইয়াও কাঁদছেন নিরবে। তার হাতের আঙুলগুলো আমার চোখের পানি মুছে দিলো। আমিও দিলাম। তার ঠোট নেমে এলো আমার ঠোঁটে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের আগে হয়তো এটাই আমাদের শেষ চুমু।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেটে সেই আকাশ নীল শার্ট। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললো, তুমি আমাকে কি দেবে?
কি দেবো ! আমি দেওয়ার মত কিছুই খুঁজে পেলাম না। ঘরের চারদিকে তাকাই। কি দিবো আমি !
- শুভ্র, তুমি আমাকে আমার জীবনের সেরা কিছু মুহুর্ত দিয়েছ। আমার খুব ইচ্ছে করে আমার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেই । পুব বিলের মাঝে, শালিক খালির নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আমি স্মৃতি হিসেবে তোমার ব্যবহার করা এই গামছাটা নিয়ে যাবো। দেবে আমাকে ?
- তুমি আমাকে সাথে নাও। আমি ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করবো । আর শুধু গামছা কেন, আমার সব কিছুই তোমার্। সব কিছু নাও তুমি।
পাগল ছেলে একটা। বলে তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রহিমের গলার স্বর শুনে হাত সরিয়ে নিলেন।
- খবর শুনিছো ছোড ভাই। ম্যাভাই কাইলকে চলে যাবে। আমাগে তো আগোয় দিতি যাতি হবে। তাড়াতাড়ি করে খায়ে শুয়ে পত্তি হবে।
- তুই আছিস তোর শোয়া নিয়ে। যাবে তো বিকেলের লঞ্চে। তাতে তোর এখনি ঘুমানো লাগবে !
রহিম বকা খেয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। যাওয়ার সময় দরজা হাট করে খুলে রেখে গেছে। খোলা দরজায় মিয়াভাইয়ের মুখ দেখা গেলো।
- শুভ্র, পড়াশোনা করছিস তো। দ্বীপ্ত কাছ থেকে অংক দেখিয়ে নিলে পারতি। অংকে দ্বীপ্ত সবসময় ৯৫% করে মার্ক পেয়ে এসেছে।
গার্জেনদের এই এক সমস্যা। বাড়িতে লেখাপড়া জানা কেউ এলে বলে অমুকের কাছ থেকে ইংরেজি অংক দেখে নে।
১৬
বিকেল পাঁচটার লঞ্চ ঘাটে এলো সাড়ে পাঁচটার কিছু পরে। শেষ বিকেলের সুর্য্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। দিগন্ত জুড়ে লাল আবিরের ছড়াছড়ি। সাড়ে চারটার দিকে ঘাটে এসে গেছি, পুরুষ বিশ্রামাগারে বসে আছি। দ্বীপ্ত ভাইয়ার গা ঘেঁসে বসেছি। চেনা গন্ধটাকে বুক ভরে নেয়ার চেষ্টা করছি। রহিম মিয়া ভাইয়ের সুটকেস মাথায় করে নিয়ে এসেছে। দ্বীপ্ত ভাইয়ার ব্যাকপ্যাক টা আমি কাঁধে করে আনলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া নিজেই বয়ে আনবে । আমাকে তো কিছুতেই নিতে দেবে না। আমি জোর করেই কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম।
মিয়া ভাই রহিমকে সাথে নিয়ে আগে আগে অনেক দুর এগিয়ে হাটছিলেন। আমি আর দ্বীপ্ত ভাইয়া পাশাপাশি হাঁটছি। মনের ভিতর হাজার কথা আকুপাকু করছে। কিন্তু মুখের কথা হয়ে সেগুলো বের হচ্ছে না। আজ দ্বীপ্ত ভাই সাবলীলভাবে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে এলো। অথচ প্রথমদিন সাঁকো পার হওয়ার সময় সেকি কাঁপাকাঁপি। তার কাঁপুনিতে পুরো বাঁশের সাঁকো দুলতে শুরু করলো। সে বাঁশের দুদিকে পা ঝুলিয়ে মাঝ সাঁকোয় বসে পড়লো। দোকানঘরের সামনে কয়েকজন লোক বসা ছিলো। তারা হেসে উঠলো শহুরে বাবুর কান্ডকারখানা দেখে। তার করুন অবস্থা দেখে আমারো হাসি পেয়েছিলো। শেষে আমি তার হাত ধরে ওপারে নিয়ে যাই। মাফলারে মুখ ঢাকা ছিলো বলে তার মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু তার ফর্সা সুন্দর হাত দেখি এবং ধরার পর থেকে এক অন্যরকম মুগ্ধতা শুরু হয়।
সাঁকোর কিছু আগে নতুন দাদির বাড়ি। নতুন দাদি বাড়ির মাটির প্রাচীরের গায়ে গোবরের ঘুটি লাগাচ্ছিলো শুকানোর জন্য। এই অবেলায় গোবর চটকাচ্ছে। কাজ ছাড়া নতুন দাদীকে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। এই ক্ষ্যাতের বেড়া বাঁধছে নয়তো নাতনীর হাত ধরে ছাগল গুলোকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষন সে গরুর জাবর কাটার মত পান চিবায়। নতুন দাদা বেঁচে থাকতে এই নিয়ে নতুন দাদিকে খুব খেঁপাতো। নতুন দাদি খুব হাসিখুশী একজন মানুষ ছিলো। কিন্তু দাদা মারা যাওয়ার পর অনেকটা মৌন হয়ে গেছে। আগের মত হাসির কোন কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খায় না, বিয়ে বাড়িতে গিয়ে গাঁয়ে হলুদে কাঁদামাটি করে না। গানে গলা মেলায় না। উঠতি মেয়েদের নাঁচে হারিয়ে দিতে চায় না। নতুন দাদির ছেলেটা গঞ্জের দোকান থেকে ভালোই আয় রোজগার করে। নতুন দাদি আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। পানের রসে তার ঠোট টুকটুকে লাল হয়ে আছে। পান চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলেন, শহরের কুটুম বাড়ি যায়?
- হ্যাঁ।
- আমাগে বাড়ি বসো।
- না দেরী হয়ে যাবে।
আমরা এগিয়ে যাই। নতুন দাদি তার নাতনীকে ডাকতে থাকে। নাতনীর নাম রেখেছে তার মামারা শাকিলা আক্তার্। নতুন দাদি ডাকে তারাচান বানু বলে। মেয়ের নামের বিকৃতি নিয়ে পুত্রবধু কয়েকদিন কথা বলার চেষ্টা করেনি এমন নয়। কিন্তু নতুন দাদি কান দেয় নাই। নাতনি এসে নতুন দাদির আঁচলের খুঁটে বাঁধা পান সুপারি তার মুখে তুলে দেয়। নিজেও এক টুকরা গো ( সুপারি) মুখে পুরে ছোট দাঁত দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে।
বাড়ি থেকে বেরোনোর পর রাস্তায় দেখা হয় গফুর গাছির সাথে। সে গুড় নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। দ্বীপ্ত ভাইয়া তার দিকে হাত বাড়ালো। গফুর গাছি নিজের তেল চিটচিটে গামছায় হাত ঘষে নিয়ে হ্যান্ডশেক করলো। হ্যান্ডশেকের আরবি মোসাফাহ। গফুর গাছি দ্বীপ্ত ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ঢাহায় খাঁজুরের গুড়ের দর নাকি অনেক বেশি? শুনিছি সেহানে সের প্রতি পুঞ্চাশ ষাইট টাকা কইরে দর পাওয়া যায়। রাস্তা ঘাট সিরাম চিনা জানা নাই । জানা থাকলি একবার দুই কলসি গুড় বেঁচে আসতাম।
গাছির সরলতায় অন্য সময়ে দ্বীপ্ত ভাইয়া নিশ্চিত হাহা করে উঠত। আজ ঠোঁটে হালকা হাসি ফুঁটিয়ে বললো, গফুর ভাই। ঢাকা শহর এখান থেকে অনেক দুর। দুই কলস গুড়ের দামে তোমার আসা যাওয়ার খরচে লেগে যাবে। যদি কিছু মনে না করো তবে এটা রাখো।
দ্বীপ্ত ভাইয়া বেড়াতে আসার আগে অনেক কিছুই নতুন করে কিনে এনেছিলো। যদিও সেগুলো ব্যবহার করার দরকার হয় নাই। তার নতুন কেনা তোয়ালে টা বাড়িয়ে দিয়েছেন গফুর গাছিকে। গফুরের চোখে খুশিতে চকচক করছে।
- না । কিছু মনে করবো ক্যান। আল্লার নবী নিজের গায়ের বস্তর খুলে গরীব দুখীকে দিয়ে দেতো।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা আর ফুফু বরাবরের মত কান্নাকাটি করলো। আব্বা দেখে শুনে ভালোভাবে যেতে বললেন। মিয়া ভাই সবাইকে কদম বুচি করলেন। তাকে দেখে দ্বীপ্ত ভাইয়াও কদম বুচি করল।
মা বললেন, থাক বাবা । সালাম করতে হবে না। দোয়া করি। অনেক বড় হও। আমাদের এখানে তো কয়েকদিন তোমার থাকা খাওয়ার অনেক সমস্যা হলো। আবার বেড়াতে আইসো।
মা ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। গ্রামীন টানে তিনি বেশ শুদ্ধ বাংলা বলেন মাঝে মাঝে। যদিও তাতে সাধু ভাষার প্রাবল্য থাকে।
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, কষ্টের কথা কি বলছেন চাচীমা। আমি আমার জীবনের সেরা সময়টা উপভোগ করলাম এই কয়দিনে। আমার তো ইচ্ছে করছে সারা জীবনের জন্য এই গ্রামে থেকে যেতে।
মিয়া ভাই বন্ধুকে ফোঁড়ন কেটে বললো, মা দেখতো গ্রামে বিবাহ যোগ্যা কোন মেয়ে আছে কিনা। বিয়ে দিয়ে দ্বীপ্ত মিয়াকে ঘর জামাই হিসেবে রেখে যাই।
সবাই হেসে উঠলো। মিয়া ভাই দ্বীপ্ত ভাইয়াকে তাড়া দিলো, নে এবার বের হ। আসার সময় এমন ভাব নিলি যেন মনে হচ্ছিলো সুন্দরবনের মাঝখানে যাচ্ছিস। এটা সেটা কত কি কিনলি। তোর ব্যাগ থেকে মশারি বের হলেও আমি অবাক হতাম না।
দ্বীপ্ত ভাইয়ার আনা অনেক জিনিসের মধ্যে আছে মা ও ফুফুর জন্য ঢাকার জামদামি শাড়ি। সবাই বেড়াতে এসে প্রথমেই উপহার বের করে। আর দ্বীপ্ত ভাইয়া বের করলো যাওয়ার দিন সকালে। সবাই চমক পেলো। সেই শাড়ী এখন পরা মা ও ফুফুর পরনে। রহিমকে দিলো বডি স্প্রে । সেই বডি স্প্রে রহিম এখন এতটা মেখেছে যে সারা বাড়ি সুগন্ধময় হয়ে গেছে।
মা ফুফু আমাদের এগিয়ে দিতে রাস্তা পর্যন্ত এলেন। যতক্ষন আমাদের দেখা যায় ততক্ষন তারা দাঁড়িয়ে রইলেন।
১৭
লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার পরও দীর্ঘক্ষণ পল্টনে বসে থাকলাম। রহিম তাগাদা দেয়। " ছোড ভাই, ওঠো। বাড়িত যাবা না। সইন্ধ্যে হয়ে আইলো। শীত কত্তিছে। " রহিম চাদর আনে নাই। শীত লাগাটাই স্বাভাবিক। যে পথে গুড়্গুড় করে লঞ্চ চলে গেছে সেদিকে আরেকবার তাকালাম। চোখের আয়নায় দ্বীপ্ত ভাইয়ের হাস্যোজ্বল মুখ ভেসে উঠলো। লঞ্চের নাম মেসার্স মোহাম্মাদি। লঞ্চের ছাদে একটা প্লেনের রেপ্লিকা আছে। তাই অনেকেই এটাকে প্লেন লঞ্চ বলে। কয়রা নদী ধরে লঞ্চ এগিয়ে যাবে হড্ডার মোহনা হয়ে শিবসা নদীতে পড়বে। শিবসা নদী দক্ষিনে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। তাই শিবসা নদীর প্রশস্ততা অনেক বেশী। বর্ষায় শিবসা হয়ে ওঠে প্রমত্তা, মাছ ধরা জেলে নৌকা গিলে খায়। গরু বাছুর মানুষ পর্যন্ত গিলে খায়। তবু তার ক্ষুধা মেটে না। শীতে শিবসা অনেক শান্ত। শিবসা পেরিয়ে নলিয়ান ঘাট তারপর আবার কোনাকুনি পাড়ি দিয়ে শান্তা লঞ্চ ঘাট। এরপর তৃতীয় বারের মত শিবসা পাড়ি দিয়ে জয়নগর ঘাট হয়ে লঞ্চ ঢোকে চুনকুড়ি নদীতে। কালিনগর, দাকোপ, চালনা ঘাট পেরিয়ে লঞ্চ এসে পড়ে পশুর নদীর মোহনায়। চালনা ঘাটের পর আর কোন ঘাট নেই। পশুর নদী দিয়ে লঞ্চ ঢোকে বটিয়াঘাটার কাজিবাছা নদীতে। এরপর রুপসা নদীর নতুন বাজার ঘাট পেরিয়ে আইডব্লিউর লঞ্চ ঘাটে গিয়ে নামবে দ্বীপ্ত ভাইয়েরা।
খুলনা শহরের সোনাডাঙা বাস স্ট্যান্ড থেকে ঢাকার বাস ছাড়ে। বাস ছূটবে নতুন রাস্তার মোড় , দৌলতপুর , ফুলবাড়ি গেট , শিরোমনি ফুলতলা পেরিয়ে যশোর । তারপর নড়াইলের আড়পাড়া দিয়ে মাগুরা, ।ফরিদপুর অতিক্রম করে পৌঁছে যাবে দৌলতদিয়া - পাটুরিয়া ফেরিঘাটে। এই ফেরিঘাটকে খুলনা সাতক্ষীরার মানুষ আরিচা ফেরিঘাট নামে চেনে। যদিও মুল আরিচা ঘাট আরো দূরে। ফেরিঘাটে অনেক জ্যাম থাকে।ফেরি ঘাট পেরিয়ে মানিকগঞ্জ সাভার হয়ে ঢাকার গাবতলি বাস স্ট্যান্ড। দ্বীপ্ত ভাইয়েরা গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। তখন কি দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার কথা সত্যি মনে রাখবে !
- ছোড ভাই জোরে হাঁটো। জাড় কত্তিছে।
বাতাসটা আজ অনেক ঠান্ডা। শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। জোরে হাঁটার চেষ্টা করছি। কিন্তু পা চলতে চাইছে না যেন। পায়ের পাতা দুই মন ভারি বলে মনে হচ্ছে। রহিম কিছু দূর হেঁটে গিয়ে আমার জন্য থামছে বারবার্।
বাসায় পৌঁছানোর কিছু পরে এশার আযান শোনা গেলো। আজ অপরিচিত কেউ আযান দিচ্ছে। ইমাম সাহেব মনে হয় ছুটিতে গেছে। অন্যদিন হলে কে আযান দিচ্ছে এটা বের করার জন্য রহিমের সাথে আলোচনা শুরু করে দিতাম। স্বাভাবিক ভাবে রহিম জিজ্ঞেস করলো, " ছোড ভাই কওতো কে আইজ আয়জান দিতাছে? " প্রশ্ন করে রহিম আমার বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষন। বিছানার উপর লেপে গলা পর্যন্ত ঢেকে আমি বসে আছি। উত্তর না পেয়ে রহিম আপন ভাবনায় ডুব দিলো।
কিছু পরে মা খেতে ডাকলো। বারান্দার কোনায় পোষা শালিক মন্টু থাকলে সেও বলতো, ভাত খেয়ে যা। মন্টুর খাঁচা এখনো আছে। সেখানে এখন অপরিসীম শূন্যতা। সেই শূন্যতা এখন আমি অনুভব করি বুকের গভীরে। আমি লেপের ভেতর থেকে বললাম, "আজ রাতে আমি খাবো না। " খাওয়ার রুচি নেই। রহিম খেতে গেলো। রহিম জগতের সুখী মানুষদের একজন। খাওয়া ঘুম আর গরুগুলোকে দেখাশোনার চিন্তা ছাড়া তার মাথায় আর অন্য কিছু নেই। দুটো খেতে পেলেই সে নাক ডেকে ঘুমাতে পারে।
মা রান্নাঘর থেকে আবার ডাকলেন। খাবার ঘরে দিয়ে যাবে কিনা জানতে চাইলেন। আমি না বললাম।
আম্মা বললেন , শীতের বড় রাত। সারা রাত না খেয়ে থাকবি ?
আব্বার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, একরাত না খেলে কিচ্ছু হবে না। কয়দিন তো খুব হুড়পাড় করে কাটালো। এবার একটু শান্তি করে ঘুমাক।
মা তাও ঘরে এসে আমার টেবিলের উপর বাটিতে করে বাড়িতে কোটা নতুন ধানের চিড়া আর খেঁজুরের পাটালি গুড় রেখে গেলো।নতুন ধান ওঠার পরে আমাদের বাড়িতে গ্রামের আর সব গৃহস্ত বাড়ির মত চিড়া কোটা হয়। নতুন ধানের চিড়ার গন্ধে বাড়ির বাতাসটা ম ম করে। একেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে লুঙ্গির কোচড়ে করে অনেক গুলো চিড়া খেয়ে ফেলি। একমুঠ চিড়ার সাথে এক কামড় করে খেঁজুরের পাটালি গুড়। কিন্তু আজ চিড়া গুড় সেভাবেই পড়ে রইলো। মাঝ রাতের তারারা ঘুমিয়ে যেতে শুরু করলো। একটা একটা করে সবাই ডুব দিতে লাগলো। একসময় সাদা সাদা ফুটকি আঁকা আকাশ নামের নকশি কাঁথা পুরোটাই কালো হয়ে গেলো। এই সময় বাতাসটাও আরো বেশী ঠান্ডা হয়ে যায়। ঘরের সামনের সিঁড়ির পাশে লাগানো হাস্নাহেনার গন্ধ ভেসে আসে ঘরে। ফুফু বলে হাস্না হেনার গন্ধে সাপ আসে ঘরে। তিনি আব্বাকে বলেন গাছ গুলো কেটে ফেলতে। আব্বা হাসেন । আমি ফুফুকে কার্বলিক এসিডের বোতল দেখিয়ে বলি এটা থাকলে বাড়িতে সাপ আসে না। ফুফু বিশ্বাস করে না। এটা কি বড় হুজুরের পানি পড়া নাকি যে এর জন্য সাপ আসবে না ! রাতে ঘুমিয়ে গেছি কখন তা নিজেও টের পাইনি। হাঁস মুরগির খোঁয়াড় থেকে লাল মোরগের কক্কর কো শোনা গেলো। আব্বার গলা খাঁকারির শব্দ শোনা গেলো সিঁড়িতে বসে ওযু করছেন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য । তার মানে এখনো সুবহে সাদেক হয় নাই। সকাল হতে অনেক বাকি। আমি পাশ ফিরে শুইলাম। রহিম অঘোরে ঘুমুচ্ছে। গায়ের লেপ পড়ে গেছে সে খেয়াল নেই। আজ রাতে খুব একটা কুয়াশা ছিলো না। দ্বীপ্ত ভাইয়েরা এতক্ষণে খুলনা টাউনে পৌঁছে যাওয়ার কথা। এত সকালে কি তারা কোন রেস্টুরেন্টে বসে নাস্তা করছে নাকি ঢাকার বাসে উঠে পড়েছে !
১৮
পুরো ১০ দিন আমি স্কুলে যাই না। চুপিচুপি স্কুলে ঢোকার আগে হেডস্যারের সাথে দেখা।
- কি ব্যাপার , শুভ্র সাহেব নাকি ! তা এদিকে কি মনে করে ! পথ ভুল করে আজ এদিকে এলেন নাকি !
আমি নিরুত্তর হয়ে স্যারের সামনে মাথা নিচু করে রইলাম। স্যার আমাদের সবসময় মাথা উচু করে চলার পরামর্শ দেন। কিন্তু তার সামনে এলে আমাদের উঁচু মাথা নিচু হয়ে যায়। বিনয়ে নয় ভয়ে। স্যার মহা তেজী। অন্য স্যারেরাও স্যারকে ভয় পায়, সমঝে চলে। ভয় পান না শুধু সুশীল স্যার্। ু সুশী স্যার হেডস্যারেরও স্যার্। স্কুলের বড় ভাইয়ারা আড়ালে হেডস্যারকে ডাকেন টাইগার স্যার বলে।
ক্লাসে ঢুকে আমার চিরাচরিয়ত স্বভাব অনুযায়ী বামপাশের দ্বিতীয় বেঞ্চের ডান কোনার সিটে বসলাম। ক্লাসের তিন সারি বেঞ্চের দুই সারি ছেলেদের্। এক সারি মেয়েদের্। মেয়েদের সারিতে বসা সুস্মিতা গলা তুলে বললো, কিরে দোস্ত , কোথায় ডুব মেরেছিলি আজ কয়েকদিন। খুব ডেটিং করলি না ?
ডেটিং এর কথা শুনে ক্লাসের সবাই মনযোগ দিলো আমাদের দিকে। সুস্মিতা সবাইকে বানিয়ে আমার প্রেমের গল্প বলে দিলো। আমি নাকি কোন মেয়ের সাথে তিন মাস চুটিয়ে প্রেম করছি। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কাছের বন্ধুদের অনেকের কোনায় সুক্ষ ঈর্ষা, আবার কারো চোখে সলাজ অভিনন্দনের ভাষা।
স্কুলের পরে আমি বাড়ির পথ ধরলাম। সরকার পুকুর পাড়ে এসে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। আমাদের বাড়িতে খাওয়ার জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয় ইটের তৈরি হাউজে। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই তারা পানীয় জলের চাহিদা মেটায় এই পুকুর থেকে। পুকুরের পাড় অনেক উঁচু। বৃষ্টি, বন্যায় আশপাশের বিল পুকুর তলিয়ে গিয়ে একাকার হয়ে যায় কিন্তু সরকার পুকুর তলায় না। এই পুকুরে জনসাধারণের গোসল করা নিষিদ্ধ। ঘাসের বুকে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নি:সঙ্গ এক পাখি উড়ে যাচ্ছে । ডানায় তার শেষ বিকেলের রোদ ঝিলিক দিচ্ছে। কাদের একটা বউ পানি নিতে পুকুরে নেমেছে। পুকুর পাড়ে বসে থাকা দৃষ্টিকটু দেখায়। আমি হাটা শুরু করলাম। মদ্যির ডাঙার এসে থমকে দাঁড়ালাম। আমাদের বনভোজনের স্মৃতি হয়ে পড়ে আছে ছাই গুলো। খেঁজুর গাছের আড়ালে দেখাগেলো গফুর গাছিকে। তোয়ালে খানা চাদরের মত গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। ইষৎ হলুদাভ তোয়ালের উপর বড় করে কয়েকটা গোলাপ ফুল আঁকা।
শুকনো পাতাদের মাড়িয়ে আমি হেঁটে চলি। আমার সাথে একরাশ স্মৃতি হয়ে হেটে চলে দ্বীপ্ত ভাইয়া। এক শহুরে যুবক, যার জামার কাটিং , চুলের স্টাইল আমাকে বিমুগ্ধ করেছিলো। অন্যকে অনুকরন করার, অন্যের মত হওয়ার এক বিশাল প্রবনতা কাজ করে কৈশোরে।
রাস্তার বুকে হাঁচড়ে পাঁচড়ে এগিয়ে আসছে সবুর । সবুর জন্ম থেকে বোবা এবং পঙ্গু। বাপমায়ের কোল জুড়ে আসা প্রথম সন্তান। সবুর যেদিন বসা শিখলো সেদিন বাবা মায়ের কি আনন্দ। সবুরের দাদি জুম্মা ঘরে গিয়ে বাড়ির বড় মোরগের রান্না করা মাংস দিয়ে গালে ভাত দিলো। মাংসের ঝালে সবুরের কচি গালে উত্তাপ আনে। সে কেঁদে দেয়। তার মুখ দিয়ে লালা ঝরে। দাদি শাড়ীর আঁচলে মুখ মুছে দেয়। ছেলের বয়স দুই পেরিয়ে যায়, তিন পেরিয়ে যায় তবু সবুর হাটা শেখে না। বাবা মা সবর করে। হুজুরের পানিপড়া, কবিরাজের তাবিজ কত কিছুই করলো। একসময় তারা হাল ছেড়ে দিলো। পরে তার দুটি বোন একটি ভাই জন্মে। অভাবের সংসারে লুলা গুঙ্গা ছেলেটার প্রতি আর সেভাবে লক্ষ্য করে না। মুখের লালা চোয়ালে লেপ্টে যায়। তাতে ধুলোর কালো আস্তরন পড়ে। দাদি মাঝে মাঝে বল সাবান দিয়ে ভালো করে ঘসে মেজে গোছল করিয়ে দেয়। কিন্তু বিকেলে দেখা যাবে আবার সেই ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
মাটিতে ঘসে ঘসে সে অনেক দূর চলে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম , সবুর কই যাবি ?, সবুর বয়সে আমার থেকেও বড়। কিন্তু অপুষ্ট শরীরে তাকে ১০ বছরের ছেলে মনে হয়। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই তাকে পাগল বলে ডাকে। সবুর হাতের বাঁকা আঙুল গুলো সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে। বোবা মুখে কথা ফোঁটে না। আউ আউ শব্দ হয়। মুখের লালা ঝরে পড়ে মাটিতে। আমি তাকে বললাম, বাড়ি যা। সে কি বুঝে হাসির মত শব্দ করে। উপরে নিচে মাথা ঝাকায় কয়েকবার্। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বিলে সবুরের দাদির মত কাউকে মাঠে চরা গরুর গোবর কুড়াতে দেখলাম। আমি গলা চড়িয়ে তাকে ডাকলাম। সবুরের দাদিই ছিলো। সে বিরক্ত মুখে গোবর মাখা হাতে এক চড় বসিয়ে দিলো সবুরের পিঠে। আমি বললাম, মাইরো না। ও কি আর বোঝে!
- মারি কি আর সাধে বাপ। রাস্তার ধারে কত পইর আছে। পইড়ে ডুবে মরলি কিডা দেইখতো। আমি ঘুটে নুড়ি বানানির জন্যি এক ঝুড়ি গবর কুড়োতে আলাম। বাড়িতে ওর মা ছিলো। সে এট্টু দেখে রাখলি তো পাত্ত। গুঙ্গা ছেইলে বলে মা নিজির হাতে ছাবাল ডারে মৃত্যুর দিকি ঠেইলে দেবে! ইরাম ডাইনি মা আমি এই জীবনে আর দেই নি।
অদৃশ্য পুত্র বধুর উদ্দেশ্যে গজগজ করতে করতে সবুরকে বাড়ির দিকে টানতে থাকে। সবুর উল্টো দিকে টানে। সে উল্টো পথে কোন দিকে যেতে চায়! তার কি ধারণা উল্টোপথে তার এই জীবন থেকে মুক্তির দুয়ার খোলা আছে?
আমি একটা মহা গাধা। আমাকে উত্তমরূপে থাপড়ানো উচিত। দ্বীপ্ত ভাইয়ার কাছ থেকে ঠিকানা টা রেখে দিলে আমি তো চিঠি লিখতে পারতাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া তো আমাদের ঘরবাড়ি সব জানে। সে কি একটা চিঠি দিতে পারে না !
১৯
৯ ফাল্গুন, ২১ শে ফেব্রুয়ারী। মহান ভাষা শহীদ দিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ দিবস বাঙালীর আত্মত্যাগের , এই দিবস বাঙালীর আত্মত্যাগের্। এই একটি দিনে আমরা হিন্দু , মুসলমান, খ্রিস্টান হয়ে নয়, বাঙালী হয়ে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস তুলে ধরি। খালি পায়ে বসন্তে ফোঁটা সজীব পুষ্পমাল্য হাতে, প্রভাতফেরীর সারিতে প্রভাত সংগীতে সব বাঙালী ছুটে যাই শহীদ মিনারে। আমাদের সেই মিছিলে যোগ দেয় পৃথিবীর নানান ভাষাভাষী মানুষ।
একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীর অনুষ্ঠান ছিলো স্কুলে। সকালে চলে গেলাম এক গোছা ফুল নিয়ে। পথে দেখা হলো ওপাড়ার মেজ দাদির সাথে। পাড়া সম্পর্কীয় এই দাদিকে আমি বরাবরিই অপছন্দ করি। কথা লাগানো , কুটনামি ইত্যাদিতে তার জুড়ি মেলা ভার্। সকালে দুটো খেয়ে একটা পান মুখে পুরে সে পাড়া বেড়াতে বের হয়। ফেরে দুপুরের আগে। বলতে গেলে সবার হাঁড়ির খবর তার জানা। তাই সেভাবে কেউ ঘাঁটায় না । আমাকে দেখে বলে, কই যাও ছোড খুকা। শহীদ পূজো কত্তি ? মোচলমানের ছাবাল হয়ে তুমরা সব ক্যান যে হিন্দু গো লাহান পুজো করো। ক্লাসের বইতে এইসব ল্যাহা থাহেনি?
আমি কথা বাড়াই না। গতবছর আমি এই বিশিষ্ট তর্ক বাদীকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছি। তার ব্যাপারটা এরকম, আমি ঘুমিয়ে আছি, কেমন পারো আমাকে জাগাও দেখি।
রাস্তার পাশে পলাশ গাছ গুলোয় যেন আজ আগুন লেগেছে। সকালের রবি কিরণে লাল বর্নের ফুলগুলো জ্বলজ্বল করছে। স্কুলে এসে দেখি বিলাস, সৌমিত্র, সাজ্জাদ, আরমান, কিশোর, অনিক, রুদ্র , সুস্মিতা, ছোয়া , ফারজানা সবাই এসে হাজির খালি পায়ে স্কুলের পোষাকে । সবার হাতে এক গোছা ফুল। ফারজানার হাতে কয়েকটা গোলাপ। এক গোলাপের সাইজ এত বড় যে আমরা প্রায় সবাই লক্ষ্য করেছি। কিশোর গোলাপ টা হাত করার জন্য ফারজানাকে পটানোর চেষ্টা করলো। ফারজানা কিছুতেই রাজি হয় না। শহীদদের উদ্দ্যেশ্যেই সে বাগানের সব থেকে বড় গোলাপটা আজ নিজ হাতে ছিড়েছে। ছিড়তে গিয়ে বামহাতের অনামিকা ছড়ে গেছে গোলাপ কাটায়। কিশোর মনোক্ষুন্ন হয়ে গজগজ করে। তোর আঙুলে আজ মরিচ বাটা লাগুক। তোর গোলাপ ঝাড় উইপোকায় কাটুক। ফারজানা বদদোয়া শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে যায়। সে হাতের ফুলের গোছা ছুড়ে মারে কিশোরের মুখের উপর্। কিশোর বড় গোলাপ টা কুড়িয়ে নিয়ে তাতে নায়ক রাজ্জাকের মত ভাব নিয়ে চুমু খায়। আমরা সবাই হেসে উঠি। ফারজানা গটগট করে চলে গেলো। সাজ্জাদ বলে, ওই কই যাস? সে উত্তর দেয় না। ছোঁয়ার সাথে ফারজানার সম্পর্ক ভালো না। তারা দুজন ছয়মাস কথা বলে তো বাকি ছয়মাস বলে না। ফারজানা ঠোঁট বাকিয়ে বলে, দ্যাখ, টাইগারের স্যারের কাছে নালিশ করতে গেছে।
কিছু পরে ঘন্টার টুংটুংটুং শোনা গেলো। অফিস ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পিয়ন চিৎকার করে সবাইকে শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হতে বললো। স্কুলের গেট থেকে ঢুকে বাদিকে শহীদ মিনার্। শহীদ মিনারের পেছনে বড় দুটো শিমুল তুলোর গাছ। শিমুলের ফুল পাতায় শহীদ মিনার জঞ্জাল হয়ে থাকে। আজ সব সাফ সুতরো করে রাখা হয়েছে। হেডস্যার সব শিক্ষকদের নিয়ে প্রথমে পুষ্পার্ঘ অর্পন করলেন। বাংলা স্যারের তত্বাবধানে বিভিন্ন ক্লাসের মেয়েরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়ে গাইছে ফেব্রুয়ারীর থিম সং
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভূলিতে পারি...
একে একে আমরা সবাই ফুল দিলাম। কিশোর ফারজানাকে কোথা থেকে ধরে এনেছে। ফারজানার হাতে ফুলের গুচ্ছে শোভা বাড়িয়েছে সেই গোলাপ। ফুল দিয়ে বাইরে এসে দেখি গোলাপটি ফারজানা কিশোরের হাতে গুঁজে দিলো।আমারও ইচ্ছে করছে আমার জান পাখিটার হাতে একটা টকটকে লাল গোলাপ ধরিয়ে দিতে। আমার জান পাখিটা এখন কোথায় ? শাহবাগে নাকি শহীদ মিনারের প্রভাত ফেরীর মিছিলে! নাকি বন্ধের দিন বলে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে ঢাকা যেতে।
২০
সময় যেন আর কাটে না, বড় একা লাগে ...
দ্বীপ্ত ভাইয়া চলে যাবার পর খুব একা মনে হয়। চারপাশের সেই চিরচেনা মুখ গুলো আগের মতই আছে। তবুও নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত মনে হয়। জন মানুষের মাঝে থেকেও আমি বড় নি:সংগ বোধ করি। শুধু মনে পড়ে সেই মুহুর্তগুলোকে যা আমাকে দিয়েছে কিছু রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার দিয়ে যাওয়া শার্টটা পরি। শার্টটা পরলে মনে হয় দ্বীপ্ত ভাইয়া আমাকে আলিংগন করে আছে। আমি তার স্পর্শ পাই, তার শরীরের গন্ধ খুঁজে ফিরি এই শার্টে। আমি মিয়াভাইয়ের ঘরের তালা খুলি। আমার প্রথম মিলনের সাক্ষী এই পালংক খাট। আমি খাটের উপর শুয়ে থাকি। বালিশে মাথা রাখি। দ্বীপ্ত ভাইয়ার ব্যবহার করা বালিশে চুমু খাই। চোখ ফেটে জল আসে। একা একা কাঁদি।
বিকেলের হেটে বেড়াই শালিক খালী নদীর পাড় ধরে। সবুজ ঘাসে মুখ ডুবিয়ে এক মনে ঘাস খাচ্ছে নতুন দাদীর ছাগল দুটি। ছগীর শেখ খ্যাওলা জাল ছূড়ে মাছ ধরছে। খারাই হাতে মাছ কুড়াচ্ছে তার বাচ্চা মেয়েটা। দুটি সাদা বক পাশাপাশি উড়ে গেলো বাঁদার দিকে। বাড়ির উঠোনের সব্জি বাগান থেকে ওলকপি তুলছে আর পান চিবুচ্ছে নতুন দাদী। বাঁশের সাঁকোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের কথা শুনছে ছাকা মাঝি ও গফুর গাছি। ইমাম সাহেবের নাম কাইয়ুম মৌলভি। চার গ্রাম পরে লেবুপাতা গ্রামে তার বাড়ি। আমি সামনে এগিয়ে যাই। কিছুদুর পরে সবুরদের বাড়ি। সবুরের দাদি সবুরকে গজা খাওয়াচ্ছে বারান্দায় বসে। মোড়লপাড়ার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম, কে যায়?
ঘরের দাওয়ায় বসে জাল বুনছে মোজাম মিয়া। মোজাম মিয়া জন্মান্ধ। পৃথিবীর রূপ সে কখনো দেখেনি । তবুও সরস একজন মানুষ। আমাদের বিচিত্র সব গল্প শোনায় । তার বর্ননা শুনলে চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে ওঠে সব। আরব দেশের গল্প সে বেশী করে। চোখে যারা দেখে না তাদের কান অনেক শার্প হয়। আমি হাঁটছিলাম আপনমনে খুব আস্তে ধীরে। তাও সে শুনতে পেলো। ডাক দিলো।
আমি উত্তর দিলাম , "আমি " । দ্বীপ্ত ভাইয়া হলে বলত, আমি দ্বীপ্ত। আমার গলার স্বর শুনে মোজাম কানা আমাকে চিনতে পারলো, ও ছোড খুকা। আসো। এইহানে বসো। দুডো গল্প করি।
আমার তেমন কোন তাড়া নেই। বারান্দায় পাতা খেঁজুর পাটির উপর উঠে বসলাম। রসের জন্য খেঁজুর গাছ কাটার আগে বাইল্লে কাটা হয়। খেঁজুরের পাতা দিয়ে পাটি বোনে চাচী। মোজাম কানা ভালো জাল বুনতে পারে। দিনের বেশিরভাগ সময় সে জাল বোনে আর গুনগুনিয়ে গান গায়। মহুয়া সুন্দরীর পালা, বেহুলা লক্ষীন্দরের পালা, ভানুমতির পালা সব তার মুখস্ত। গলার সুরও চমৎকার্। জুম্মাবারে সে লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে চলে যায় মসজিদে। মুয়াজ্জিনের আজান দেওয়ার আগে সে সুললিত স্বরে গজল গায় দুই তিন খানা। গ্রামের বউঝিরা কাজের ফাঁকে তার গজল শোনে। মোজাম কানার বিয়ে হয় গরীব এক চাষীর মেয়ের সাথে। একে তো গরীব চাষা তার উপর একখান ছেলের আশায় তার ছয়ছয়খান মেয়ে হলো পরপর । এত গুলো পেটের অন্ন জোগাতে সে চোখে সর্ষে ফুল দেখে। পারলে তো সে মেয়েগুলোকে গাঙের জলে ভাষায় দেয়। সেই ছয় মেয়ের একজন মোজাম চাচার বউ। শত দু:খ কষ্ট মুখ বুঝে সহ্য করা আশ্চর্য্য সহনশীল এক রমনী। তাদের একটা ছেলে ছিলো। বেশ সুন্দর দেখতে । সবাই কোলে নিয়ে আদর করত। সবার কথা শুনে মোজাম কানা খুশীতে পুলকিত হত। ছেলের মুখে পিঠে, হাতে পায়ে সে হাত বুলিয়ে ছেলের সৌন্দর্য্য দেখার চেষ্টা করত। গায়ের রং বাপ মাকে ছাড়িয়ে যায় । তাই নিয়ে ওপাড়ার মেজদাদির মত লোকেরা এই চাচীর নামে সারা গাঁয়ে কুৎসা রটাতে ছাড়ে না। ঘটনার কোন সত্যতা ছিলো না। তাই একসময় আর কেউ ওসব কথায় গা করতো না। সাত বছর বয়সে তাদের ফুটফুটে ছেলেটি তিন দিনের কালাজ্বরে মারা যায়।
- চাচী কই ?
- ধান ভানতি গেছে শাবুদ্দি মোড়লের বাড়ি। গরীব মানুষের বেটি, গরীব মানুষের বউ সারা জীবন শুধু খাঁটে গেলো। সুখ পাইলো না একটু।
- চাচা , তোমার কি মন খারাপ ?
- নারে বাপ। মন খারাপ না। নিত্যি অভাবের সংসারে মন খারাপকে পাত্তা দিলি কি জীবনের এতডা পথ পাড়ি দিয়ে আসতি পাত্তাম। বাজান বাঁইচে থাকতি আমারে নিয়ে খুব চিন্তা করত। বেশী জমিজমা নেই। কি হবে আমার? এই ভাবনায় তার রাইতে নিদ হইতো না। তার আওলাদকে ভিক্ষে করে খাতি হবে সারাজীবন। না। ভিক্ষে আমি করিনি। কতদিন শুধু নুন দিয়ে হাত খাইছি, কতক দিন তাও জুটতো না। খিদের জ্বালা বড় জ্বালারে বাপ। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না মানুষের্। তবু কখনো হাত পাতিনি কারো কাছে। যাকাত ফেতরা কেউ বাড়ি এসে দিয়ে গেলে নেই। এই টুকু না নিয়ে তো পারিনে। দুটো মানুষের পরনের কাপড় তো কেনা লাগে । জীবন কাটায়ে দিলাম ঘর আর বারান্দায়। এই জীবন যে কি কঠিন তা যে পার করে সেই শুধু জানে।
মাইনষে কয় কানা খুড়া বুবা মানুষগো আল্লাহ বেশী ভালোবাসে। আমার তো মনে হয় না আল্লাহ আমাগে ভালোবাসে। আমারে যদি আল্লাহ ভালোবাইসতো তাহলে কি কানা করে পয়দা করত । জাহান্নামের জীবন কি দুনিয়ার অপূর্ন জীবন থেকে কঠিন! বুঝলে শুভ্র মিয়া। জেবন অনেকক কঠিন। জেবনে অনেক বালা মসিবত আসপে। কাছের মানুষ পর হয়ে যাবে। তখন কিন্তু ঘাবড়ালি চলবে না।
এই সময় চাচী ফিরে এলো। আঁচলে তার চাউল বাঁধা। মোজাম কানা ব্যকুল হয়ে বললো , " চাইল আনিছো। শিজ্ঞির ভাত চড়াই দাও। দুই দিনের খিদে চাগান দিয়ে উঠিছে চালের গন্ধে। " চাচী আমার সাথে দুটো কথা বলে ঘরের বারান্দায় পাতা চুলায় আগুন ধরাতে বসলো। পাতার আগুনের ধোঁয়ায় সারা বারান্দা অন্ধকার হয়ে গেলো। আমি উঠে পড়লাম। দোকানের দিকে জোরে পা চালালাম।
দুই দিন। এই দুটি মানুষ দুই দিন না খেয়ে আছে। কারো কাছে হাত পাতে নি পেটের জন্য। অভুক্ত শরীরে আধা বেলা ধান ভেঙে সে কেজি পাঁচেক চাল নিয়ে ফিরেছে ঘরে। শিমের মাঁচা থেকে কয়েকটা শিম ছিড়ে ভাতের হাড়িতে দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিয়েছে চাচী। চুলার আগুনের আভা চাচীর মুখে। সে মুখে কোন রাগ নেই, অভিমান নেই, কষ্ট নেই। নিজের অজান্তে দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো।
২১
নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম , বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম।
বাংলাদেশ বেতারে রুনা লায়লার গলার গান আজ আমার দুপুরের হাহাকার বাড়িয়ে দিলো। আজ এক মাস হয়ে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়ের কথা আমি সারাক্ষন ভাবি। সেকি একবারও আমার কথা ভাবে না। এক লাইনে একটা চিঠি লিখে পাঠানোর সময় কি তার হয় না !
শেষ বিকেলে এলো চিঠি। বাবার পকেটে চড়ে। এক খামে দুটো চিঠি। একটা আব্বার, আরেকটা আমার্। দ্বীপ্ত ভাইয়া পাঠিয়েছে। তারআনে আব্বা দুটো চিঠিই পড়েছেন। আমি কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠিখানা নিলাম।
নিজের ঘরে গিয়ে জানালার কাছে আলোয় মেলে ধরলাম চিঠির নীলচে পাতা। ছোট চিঠি। মাত্র কয়েকটা লাইন তাতে লেখা।
প্রিয় শুভ্র,
শুভাশিষ নিও। আশা করি বাড়ির সবাইকে নিয়ে কুশলে আছো। পরসমাচার তোমাদের বাড়ি থেকে আসার পর পরীক্ষার ডেট পড়ে যাওয়ায় প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই তোমাকে চিঠি লেখা হয় নাই। তোমার পড়াশুনা টা কেমন হচ্ছে ? মন দিয়ে পড়াশুনা করবে।
ভালো থাকবে। আমার জন্য দোয়া করবে। আর সময় পেলে চিঠি দিও।
ইতি,
তোমার দ্বীপ্ত ভাইয়া।
পুনশ্চ: আমার ঠিকানা খামের উপর পাবে।
অল্প কয়েকটি লাইন। আমি চিঠিখানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার পড়তে লাগলাম। প্রতিবার চিঠিখানাকে নতুন বলে মনে হলো। এই কয়টি লাইন আমার সময়কে রঙিন কর দিলো। মনে হচ্ছে দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার সাথে মুখোমুখি কথা বলছে। আজ মন আমার অনেক ভালো। চিঠির অক্ষরগুলো মৌমাছির মত আমার চারপাশে গুনগুন করতে লাগলো। আমি তখনি চিঠির উত্তর দিতেবসে গেলাম। মনের রাজ্যে হাজার কথার ভিড়। কোনটা রেখে কোনটা লিখি ! সম্বোধন কি লিখব সেটা লিখতেই কয়েক পাতা নষ্ট হলো। প্রিয়তম, হৃদয় আমার, জানপাখি বাদ হয়ে শুধু থাকলো দ্বীপ্ত ভাইয়া।
বাতাসে ভেসে যেতে লাগলো আমাদের সময়। রাগ অভিমান , প্রেম ভালোবাসা সব চিঠির কাগজে ডানা মেলত। দুত হয়ে হাজির হত পোস্ট অফিসের পিয়ন। সপ্তাহে আমার নামে একটি দুটি চিঠি আসা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রেডিওতে মনির খানের শোনা গানের দুকলি একদিন লিখে পাঠালো দ্বীপ্ত ভাইয়া। আমার খুব হাসি পেলো। কারো সাথে শেয়ার করতে পারি নাই। তেঁতুল তলায় ওইপাশের বাগানে গিয়ে একা একা হো হো করে হাসলাম।
চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙা ভাঙ্গা হাতে, প্রদীপ জ্বালাইয়া নিভাইয়া ...
২২
প্রিয় দীপ্ত ভাইয়া,
পত্রে আমার শতকোটি সালাম নিয়ো। আশাকরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বন্ধুকে নিয়ে কুশলে আছো। পর সমাচার এই যে গতকাল আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়াছে। আমি খুব ভালো করি নাই। এ গ্রেড পেয়েছি। 4.38 পেয়েছি। আব্বা আম্মা ফুফু রহিম সবাই খুশী। খুশী হন নাই হেড স্যার্। আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে বললেন , 'শুভ্র তুমি আরেকটু মনোযোগী হলে এ প্লাসটা পেতে পারতে। ভবিষ্যতে এ প্লাস পাও এই দুয়া করি। ' মন আমার পড়ে থাকে কোথায় তুমি সেটা ভালো করে জানো দীপ্ত ভাইয়া। সেজন্যই তো যোগের খাতায় আজ এত বিয়োগের অংক।
তুমি আমাদের বাড়ি থেকে গেছো বছর পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে মিয়াভাই কয়েকবার বাড়ি এসে গেলো। তুমি আসলে না। মিয়া ভাই না হয় তোমাকে আসতে বলে নাই তাই বলে কি কোন একটা কারণ দেখিয়ে তুমি আসতে পারতে না। ইচ্ছাটাই বড় কথা বুঝলে। তোমার পাঠানো ২৩৩ টা চিঠি আমি এতবার পড়েছি যে সব গুলো আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। দাঁড়ি কমা সহ সব আমি গড়গড় করে বলে দিতে পারি। গত আগস্ট মাসে পাঠানো চিঠিতে তুমি বিশ্বব্রম্মান্ড বানান ভূল লিখেছ। এর শাস্তি হিসেবে দুইশো চুমু পাওনা রইলো।
জানো দীপ্ত ভাইয়া, তোমার চিঠি পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু চিঠি পড়া হয়ে গেলে বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। দুচোখ ফেঁটে কান্না আসে। লুকিয়ে আমি কাঁদি। অনেক সময় রহিমের সামনে ধরা পড়ে চোখে পোকা পড়ার মিথ্যা অজুহাত দেখাতে হয়। তুমি বলতে পারো কান্নাকাটি করলে ক্যারেকটারে মেয়েলি ছাপ ফুটে ওঠে। কিন্তু সত্যিকারের এই আমাকেই আমি তোমার সামনে তুলে ধরতে চাই।
মিয়া ভাই বলেছিলো আইএ পড়ার জন্য আমাকে ঢাকা নিয়ে যাবে। কিন্তু আব্বা বলছে খুলনায় আইএ পড়তে। আমার খুব ইচ্ছে ঢাকায় পড়ার্। কিন্তু আব্বার যুক্তি খন্ডন করতে পারলাম না। আব্বা বলছেন, " দেখ শুভ্র, আমাদের বয়স হয়েছে। তোমাদের দুটি ভাইকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা। । তোমরা দুটি ভাই ঢাকায় চলে গেলে বিপদে আপদে কে ছুটে আসবে বলো। আর খুলনায় যে পড়াশুনা হয় না এমন না। পাবলিক কলেজ থেকে প্রতিবছর স্ট্যান্ড করে ছেলেরা। আমি পড়েছি সুন্দরবন কলেজে। সেখানে তো আর তোমাকে ভর্তি হতে বলছি না। তবে সিটি কলেজের একটা ফরম তুলো। "
আগামী সপ্তাহে পাবলিক কলেজে ভর্তি পরীক্ষা। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে তোমাকে আরো চিঠি লিখবো। আমার জন্য দোয়া করবে। পাবলিক কলেজে না মাত্র ১০০ ছেলে নেয়। আমার মনে হয় আমি পারবো। কিন্তু কেমন জানি নার্ভাস লাগছে। তোমাকে আবারো বলছি, সময় করে আসবে কিন্তু। আমাদের লাল গরুটার জমজ বাচ্চা হয়েছে। একটা লাল ঠিক ওর মায়ের মত। আরেকটা সাদা কালোর ফুটকি আঁকা । ফুফু বাছুর দুটোর নাম রেখেছেন লালচান আর তারাচান। বাছুর দুটো কি বোঝে জানি না নাম ধরে ডাক দিলেই লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটে আসে। আচ্ছা চায়ে দুধ মেশালে দুধ চা হয়, কফিতে দুধ মেশালে কি দুধ কফি হয়?
আজ আর নয়। দোকানে যাওয়ার জন্য আম্মা ডাকছেন। ভালোবাসা নিয়ো।
ইতি ,
তোমার শুভ্র।
এপ্রিল ২০০২
২৩
ভর্তি যুদ্ধ। জীবনের প্রথম কোন ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছি। কিছুটা নার্ভাস। রুম ভরা অপরিচিত যোদ্ধাগন। যুদ্ধের জন্য সবাই যেন প্রস্তুত। সকাল দশটায় পরীক্ষা শুরু। আমরা ৮ টার আগেই চলে আসি। আমরা বলতে আমি এবং আব্বু। আব্বুকে বলেছিলাম আসতে হবে না। আব্বু শুনলেন না। গেট খুলেছে সকাল ৯ টায়। কলেজ হোস্টেলের মাঠে সাদা শার্ট সাদা প্যান্ট পরা একদল ছেলে ঘোরাঘুরি করছে। আমি যদি পাবলিক কলেজে চান্স পাই তাহলে আমাকেও এরকম সাদা পোষাক পরতে হবে। আমার গলা শুকিয়ে আসছে কেন বুঝতে পারছি না। ভয় পাচ্ছি কেন তাও বুঝছি না। প্রথম দিকে বেশ উত্তর লিখতে পারছিলাম। কিন্তু এখন কিছুই মনে করতে পারছি না। মাথার ভিতর এক বিশাল শূন্যতা। প্রশ্নগুলোকে সব অচেনা মনে হচ্ছে। সবাই এক মনে লিখে যাচ্ছে। আর আমি বসে বসে কলম কামড়াচ্ছি। এত সুন্দর কলেজে কি আমার চান্স হবে না!
পরীক্ষা শেষের ঘন্টা বাজলো। একে একে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। আমিও বেরিয়ে এলাম। কলেজ বিল্ডিং পেরিয়ে বাগান। বাগানে ঝাউ গুল্ম দিয়ে ময়ুর হাতি ইত্যাদির শেপ বানানো হয়েছে। ইট বিছানো পথ ধরে এগিয়ে গেলাম গেটের কাছে। গেটের বাইরে আব্বু উৎসুক মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত উঁচিয়ে ধরলেন। কাছে যেতেই সেই চিরচেনা প্রশ্নটি করলেন। যেটা আমি ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি। পরীক্ষা কেমন হলো? সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি তো।
পরীক্ষা কেমন হলো এই প্রশ্নের উত্তর আমি কোন কালে দিতে পারি না। আজো উত্তর দেই, মোটামুটি। আব্বা কি বুঝলেন কে জানে। বললেন, চল, সিটি কলেজের ফর্ম তুলে আনি। টেম্পুতে করে সিটি কলেজের সামনে গিয়ে নামলাম। পাবলিক কলেজ দেখার পর সিটি কলেজের অল্প জায়গায় গাঁয়ে গাঁয়ে দাড়ানো পুরোনো বিল্ডিংগুলো আমার ঠিক মনে ধরছিলো না। ফরম কিনলাম। ৬০ টাকা। ফরম কিনে বেরিয়ে আসার আগেই শুরু হলো ছাত্রদল আর ছাত্রলীগের তাড়াতাড়ি। আমার কাছে এই জিনিস সম্পূর্ন অপরিচিত।
কোন মতে জানটাকে হাতে নিয়ে বের হলাম। ডাকবাংলো গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। ইলিশ মাছ । শহরে জিনিসের দাম অনেক বেশী। রাতের লঞ্চে বাড়ির পথ ধরলাম। অন্ধকার রাত। আকাশে মিটমিট করে তারা জ্বলছে। রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগলো মুখে।
২৪
মাঝে মাঝে ভাগ্যকে মেনে নিতেই হয়। সেটা ইচ্ছাই হোক আর অনিচ্ছায় হোক। নিয়তির লিখন না যায় খন্ডন। কিন্তু নিয়তিকে গড়ে নেয়া যায়। সিটি কলেজে আমাকে আর পরীক্ষা দিতে হয় নাই। আমি খুলনা পাবলিক কলেজে চান্স পাই। মেধাতালিকায় ১০০ জনের মধ্যে আমার অবস্থান ৯৯ তম। যদিও পাবলিকের স্কুল সেকশান থেকে আসা ছেলেরা সামনের দিকে কোটা পায়। বিজ্ঞান বি গ্রুপে। ভর্তি হওয়ার দিন কিছুটা টেনশানে ছিলাম। কারণ ডাক্তারি টেস্ট আছে। আব্বুর সামনে আবার কাপড় খুলে ন্যাংটো করে চেক করবে নাতো। সেরকম কিছুই হয় নাই। জাস্ট চেহারার দিকে তাকিয়ে হাতের চামড়ায় একটা সিল মেরে দিলো। ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। সাদা শার্ট প্যান্ট। কালো বেল্ট , কালো স্যু। চিকন শরীরে ইন করে একটু আন ইজি লাগছিলো। কলেজ শুরু হয় সকাল আটটায়। আমার জানা ছিলো না। আমি নয়টায় ক্লাস ভেবে সাড়ে আটটার দিকে কলেজে পৌঁছাই। এক পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় পিরিয়ডের ঘন্টা শুনলাম সিড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে। পিয়ন আমাকে রুম দেখিয়ে দিয়ে গেলো । সারি সারি বেঞ্চ। সাদা পোষাক পরা অচেনা মুখ সব তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি কিছুটা আনইজি ফিল করি। কেউ একজন ডেকে বলল, পেছনের সারিতে সিট খালি আছে। আমি সেই বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলাম। বেঞ্চে বসা ছেলেটা উঠে আমাকে ভেতরে যাওয়ার যায়গা দিলো। আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। বড় শুষ্ক ছিলো সে হাসি। অপরিচিত পরিবেশে আমি বড়ই নার্ভাস বোধ করি। অচেনা পরিবেশে সহজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি না। মনে হয় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ভূল গুলো, আমার খুঁতগুলোকে লক্ষ্য করেছে। এটা মানসিক হীনমন্যতা কিনা তা আমি জানি না। একজন দাঁড়িওয়ালা শিক্ষক ক্লাস নিতে এলেন। সিরাজুল ইসলাম স্যার্। ইংরেজীর শিক্ষক। বেশ স্মার্টলি ইংরেজি বলেন। ইংরেজি গুলো মাথার উপর দিয়ে গেলো। খুব কম কথাই বুঝলাম। তার পরে এলেন তাসরিনা পারভিন। পুরোনো ছেলেরা সবাই তাকে টিপি ম্যাডাম বলে ডাকছেন। বেশ ফ্রেন্ডলি তার ব্যবহার্। পোশাক, চুল ইত্যাদি নিয়ে তিনি অনেক উপদেশ দিলেন। দশটায় টিফিনের ঘন্টা পড়লো। পিয়ন এসে বিস্কুট আর মিষ্টি দিয়ে গেলো। আমার আর ভালো লাগছিলো না। বাসায় ফিরে এলাম।
বাসা বলতে মেস বাড়ি। পরিচিত লোকের মাধ্যমে মেসের সিট পাই দৌলতপুরে। পাবলা তিন দোকানের মোড় । প্রথম প্রথম এত দূর থেকে গিয়ে সকাল আটটায় ক্লাস ধরতে বেশ কষ্ট হত। পাবলিক কলেজের আশেপাশে বয়রা এলাকায় মেস খুঁজেছিলাম। কিন্তু একটাও পছন্দ হয় নাই। ছেলে পেলে এত ঘিঞ্জি ভাবে কিভাবে থাকে বুঝি না। দৌলতপুরে আমি বেশ আছি। টিনশেডের বাসা। বাসার সামনে এক চিলতে খোলা জায়গা। জানালা খুললে নারিকেল গাছের মাথার উপর দিয়ে খোলা আকাশ দেখা যায়।
আমার রুমমেটের নাম আদিত্য। সাতক্ষীরার ছেলে। সহজ সরল, কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের্। আমারই বয়সের হবে। প্রেম করে বিয়ে করে ফেলেছে এই কাঁচা বয়সেই। আদিত্যরা নম:শুদ্র আর তার স্ত্রী ব্রাম্মণের মেয়ে। হিন্দু জাত প্রথা মিইয়ে গেলেও এখন বিলীন হয়ে যায়নি। আদিত্যের শ্বশুরেরা এই বিয়ে মেনে নেয় নাই। তারা এপারের বাড়ি ঘর বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। তার স্ত্রীর নাম শ্রাবন্তী। বাঙালি নিন্মবিত্ত হিন্দু পরিবার পুত্র সন্তানকে বিয়ে দিয়ে চড়া যৌতুক প্রত্যাশা করে।মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত হিন্দুরা যে এর বাইরে এমনটি নয়। তবে আজকাল শিক্ষিত হিন্দু যুবকেরা যৌতুককে না বলছে এটাই আমাদের আশার আলো দেখায়। সংসারে শ্বাশুড়ির হাতে শ্রাবন্তীকে সকাল বিকাল নিগৃহীত হতে হয়। শ্রাবন্তীকে আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু মেয়েটার জন্য বেশ চাপা কষ্ট অনুভব করতাম। জানি না কেন মানুষের কষ্টগুলো আমাকে এত ছুঁয়ে যায় কেন!
আদিত্য টিউশনি পড়িয়ে খায়। দৌলতপুরে ছাত্র পড়িয়ে টাকা না দিয়ে মাস্টারকে তিনবেলা খেতে দেয়া হয়। পেটে ভাতে মাস্টার রাখাকে বলা হয় পেউস মাস্টার্। পেউস মানে পেট উন্নয়ন সংস্থা। কে নাম দিয়েছে কে জানে। কিন্তু মানুষের মুখে মুখে নামটা রয়ে গেছে।
বাসে জার্নি করা অভ্যাস না। দুপুর দুইটায় কলেজ ছুটি হয়। মেসে ফিরতে তিনটা বেজে যায়। মেসের বুয়ার রান্না জঘন্য লাগে। কোনমতে নাকে মুখে গুঁজে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। সন্ধ্যার দিকে হালকা হাঁটাহাটি করি। অচেনা মানুষের মাঝে জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজি। মাঝে মাঝে মেস বর্ডারদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেই। গল্পে তর্কে রাত গভীর হয়ে যায়। রাত পেরিয়ে সকাল আসে। আবার কলেজের জন্য ছুটতে হয়। ক্লাসের পর ক্লাস মাথা ভারী হয়ে আসে। চিরন্তন সেই ভাবনা মাথায় আসে, পড়াশুনা যে শালা আবিষ্কার করেছে তার লুঙ্গি খুলে মাথায় বেঁধে দেবো।
২৫
বিকেলের সূর্য্য হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। আদিত্য ছাত্র পড়াতে বেরিয়ে গেলো। সাইকেল চালিয়ে সে দেয়ানার দিকে চলে গেলো। ঘরে বসে বসে একা একা খুব বিমর্ষ লাগে। মাঝে মাঝে হাঁটতে বের হই। পাবলা সবুজ সংঘ মাঠে গিয়ে বসি। নানান বয়সী ছেলেরা খেলা করে। হাফ প্যান্ট পরা সুদর্শন কিছু ছেলে ফুটবল খেলছে। ছেলেগুলো খুব সম্ভবত খুলনা বিএল কলেজে পড়ে। দ্বীপ্ত ভাইয়ার বয়সী হবে। আজকাল আর সারাক্ষণ দীপ্ত ভাইয়ার কথা মনে পড়ে না। দীর্ঘ বিরহ যেন আবেগকে ভোঁতা করে ফেলেছে। সিনেমার গল্প আর বাস্তব জীবনের ঘটনা অনেক আলাদা। তবে দীপ্ত ভাইয়া আমাকে সারাক্ষণ ছুঁয়ে থাকে। নিজেকে মানসিক ভাবে একলা মনে হয় না।
আমার সারাটি হৃদয় জুড়ে দ্বীপ্ত ভাইয়া। সুদর্শন ছেলে দেখলে আমার চোখ চলে যায় । কিন্তু তাদের দেখে আমি কামনার উত্তাপ অনুভব করি না। বিএল কলেজের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদী। বিএল কলেজের হিন্দু হোস্টেলের পেছনের নদীর পাড়ে গিয়ে বসি। কদম বটের ছায়ায় বসে আছে কত মানুষ। অদূরে বসে গল্পে মশগুল কপোত কপোতি। আমারও ইচ্ছে করে এভাবে হাত ধরে দীপ্ত ভাইয়া আর আমি দুজনা মুখোমুখি বসে রবো।
বিএল কলেজের পরে দৌলতপুর বাজার্। বাজারের পাশে শামীম হোটেল। এই হোটেলের মোঘলাই পরোটা খেতে ভালো লাগে। সিংগেল ১০ টাকা , স্পেশাল ১২ টাকা। স্পেশালে ফুল ডিম দিতো। সময়টা ২০০২ সাল। মোঘলাই খাওয়া শেষে রেল লাইন ধরে হেঁটে চলে যেতাম। স্লিপারের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। কিছুদুর যাওয়ার পর পা ফসকে গেলে নেমে যেতাম। রেল লাইনে হাঁটার বড় অসুবিধা হচ্ছে জায়গায় জায়গায় মনুষ্য বিষ্ঠা ছড়িয়ে থাকে। পায়ে জড়িয়ে গেলে কেলেংকারি ব্যাপার্।
দৌলতপুর রেলওয়ে স্টেশান একটি লোকান স্টেশান। আন্ত:নগর ট্রেন গুলো এখানে থামে না। আমি ওভার ব্রিজের উপর উঠে দাঁড়িয়ে থাকি। সুন্দরবন এক্সপ্রেস ঢাকার দিকে ছুটে চলে গেলো। চাকার ঘটাং ঘটাং শব্দে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। লোহার ব্রিজ থরথর করে কেঁপে উঠল। ভেঁপু বাজিয়ে রেলগাড়ি সামনের ঘরবাড়ি আর গাছ পালার আড়ালে বিলীন হয়ে গেলো।
আবার শুনশান নিরবতা নেমে এলো প্লাটফর্মে। নিস্তব্ধতা যেন কানের উপর ভারী হয়ে বসেছে। প্লাটফর্মের ওপাশে একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ লাল ফুলে ছেয়ে আছে। আর কয়েকদিন বাদে পহেলা বৈশাখ। বাঙালি মেতে উঠবে আপন প্রাণের উচ্ছ্বাসে। সেই আবাহনের সুরে সুর মেলাতেও প্রকৃতিও যেন নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে।
হঠাৎ আকাশের ঈশান কোনে মেঘ জমতে শুরু করলো। ঘন কালো মেঘ। চৈত্রের এই শেষ লগ্নে কাল বৈশাখীর ছোট খাট শো ডাউন হয়ে যায় মাঝে মাঝে। চৈত্র মাসের ঝড়টাকে কাল চৈত্রী বা কাল চৈতালি নামে ডাকলেই তো নামকরণের স্বার্থকতা হয়। বাতাস শুরু হওয়ার আগেই আমি মেসের পথ ধরলাম। মেস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলাম না। মোল্লার মোড়ের কাছাকাছি আসতেই শুরু হলো ঝড়। ধুলোবালি চোখে মুখে ঢুকে অন্ধ হবার জোগাড়। কোন মতে চোখ সামলে মেসে পৌঁছালাম। আজকাল কি হয়েছে , একটু বাতাস হলেই বিদ্যুত অফিস বিদ্যুত বন্ধ করে দেয়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাতড়ে মোমবাতি বের করে জ্বালালাম। কড়াৎ করে আকাশে মেঘ ডাকার শব্দ হলো। বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে।
২৬
ঘরের ভেতর বৃষ্টির সিঁচ লাগছে। ফ্লোরে পানি জমে গেছে। পা দিয়ে রুমের ন্যাকড়াটা টেনে নিয়ে পানিটুকু মুছে ফেললাম। বৃষ্টির পানি যাতে ঘরে ঢুকতে না পারে সেজন্য জানালা আঁটকে দিলাম। কড়াৎ কড়াৎ করে বাঁজ পড়ার শব্দ হলো বেশ কয়েকবার্। সেই সাথে তীব্র আলোর ঝলকানি। ছেলেবেলা বিদ্যুৎ চমকালে খুব ভয় লাগত। ভয় কাটাতে গলা ফাঁটিয়ে কলেমা পড়তাম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। বারান্দার সামনের অংশে চাল থেকে কলকল করে জল পড়ছে। সেই পানিতেই হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। বরফ শীতল পানি। মনে হয় আকাশ থেকে কেউ বরফ গলা জল পৃথিবীতে ছুড়ে মারছে। হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় রাখা কাঠের বেঞ্চে বসলাম। এখানেও বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে। দরজা খুলে রেখে ঘরের ভেতর আমি চেয়ার টেনে বাইরের দিকে মুখ করে বসলাম। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। টিনের চালে বৃষ্টির এক টানা রিমঝিম শব্দের মাদল বাজছে। শত সহস্র পরী যেন পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ঘরের চালে নৃত্য করছে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় প্রকৃতির এক অপরুপ রূপ উন্মিলিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কয়েক সেকেন্ড পরে আবার সেটা অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। মুষল ধারে বৃষ্টি হলে আমার গাঁয়ের লোম কেমন যেন খাড়া হয়ে যায়। শিরশিরিয়ে ওঠে সমস্ত শরীর্। শীত শীত করে। হাতের কাছে কোন শীত বস্ত্র নেই। বিছানার উপর থেকে কাঁথা টেনে নিয়ে গাঁয়ে জড়িয়ে বসলাম।
এশার আজান শোনা যাচ্ছে। শো শো বাতাসের সাথে কাঁপছে মোয়াজ্জিনের সুললিত সুর্। পরিষ্কার শোনা যায় না। বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে আজান শুনে মনের মাঝে এক পবিত্র অনুভূতি তৈরী হয়। বাইরে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম গেটে মনে হয় কেউ ধাক্কাচ্ছে। যার খুশী ধাক্কাক। আমার কি ? মেসের সবার কাছেই গেটের চাবি আছে। আমি এখন বৃষ্টিতে ভিজে গেট খুলতে যেতে পারবো না। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে গেটের পাশের আমগাছটা ঝুপসি হয়ে আছে। গাছের ডালের বাড়ি লাগছে কিনা গেটের গায়ে কে যানে। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে আদিত্য আজ চাবি নিতে ভূলে গেছে। তার ফেরার সময়ও তো হয়ে গেছে। আমি মোমবাতি হাতে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে চললাম।
গেটের লোহার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কেউ একজন বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে মোমবাতির শিখা কাঁপছে। হাতের আড়ালে শিখাটুকু বাঁচিয়ে পথ চলছি। মেসের উঠানের পুরোটাই ইট বিছানো। বৃষ্টির জলে ভিজে পিঁছলা হয়ে আছে। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। অসাবধানে পা ফসকে আছাড় খেলে নির্ঘাত মাজা ভেঙে যাবে। বাতাসে ছাতাটাকে সামলে রাখা কষ্ট হচ্ছে। পরনের লুঙিটাকে গুটিয়ে দুইভাঁজ করে নিয়েছি। তবুও বৃষ্টির ছাঁট লেগে বেশ খানিকটা ভিজে গেছে। মোমের শিখাটিকে উচু করে ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে ?
- শুভ্র, আমি।
ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। গলার ভয়েস আমার খুব পরিচিত। আমার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে গেলো। টুপ করে হাতের মোমটা নিচে পড়ে গেলো। পানিতে পড়ার আগেই নিভে গেছে শিখা। আঁধারের চাদরে ঢেকে গেলো চারপাশ। কাঁপা কাঁপা স্বরেই জিজ্ঞেস করলাম ,
- তুমি!
- হ্যাঁ আমি। কেন বিশ্বাস হচ্চে না ?
- তুমি আসবে এ কথা তো জানাও নাই।
- সারপ্রাইই ই ই ইজ। গেট খুলবে না ? নাকি এখান থেকে ফিরে যাবো। আধা ঘন্টা ধরে আমি এই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে গেট থাপড়াচ্ছি। কারো কোন সাড়া নাই।
অবিশ্বাস্য। এতবার অনুরোধ করে যাকে আনতে পারিনি সে আজ হঠাৎ করে চলে এসেছে আমাকে বিন্দুমাত্র না জানিয়ে। আমি লজ্জা পেলাম। চাবি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অথচ দরজা খুলতে ভুলে গেছি। আলোর অভাবে তালার ছিদ্র খুঁজে চাবি ঢোকাতে হিমশিম খেয়ে গেলাম। গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে দ্বীপ্ত ভাইয়া শব্দ করে হেসে উঠল। " বাসর রাতে কি করবি তুই শুভ্র। "
গেট খুলে যাওয়া মাত্র দ্বীপ্ত ভাইয়া ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। বহুদিনের তৃষিত হৃদয় আজ দিশেহারা যেন। বাতাস ছাতা উড়িয়ে নিয়ে কোথায় ফেলল কে জানে। আমি পাগলের মত দ্বীপ্ত ভাইয়াকে বুকের সাথে চেপে ধরলাম। আমরা হারিয়ে গেলাম। ঠোঁটে ঠোঁটে কথা হয়। অব্যক্ত অস্ফুট সে ধ্বনি বুকের জমানো কথা জানিয়ে দিচ্ছে শিরায় শিরায়।
কতক্ষণ কেটে গেলো জানিনা। মহাকাল আজ থমকে দাঁড়িয়েছে, শেষ চৈত্রের এই বৃষ্টিভেজা সাঁঝের মায়ায়। রাস্তা দিয়ে একটা রিকশা যাওয়ার সময় টুং করে বেল বাজিয়ে গেলো। আমি সংবিত ফিরে পেয়ে দ্বীপ্ত ভাইয়ার ঠোঁট হতে ঠোঁট সরিয়ে নিলাম। এই ঘুঁটঘুটে অন্ধকারে লজ্জা পাওয়ার কিছু ছিলো না। মেসেও কেউ নাই। সবাই ছাত্র পড়াতে গেছে। এই মেসে একমাত্র আমি টিউশনি করি না। বৃষ্টিতে ভিজে দুজনেই সঁপসঁপে হয়ে গেছি। দ্বীপ্ত ভাইয়াকে বললাম, ঠান্ডা লেগে যাবে। চল , কাপড় চেঞ্জ করে নাও।
কাপড় নিংড়ে রুমে গিয়ে মোমবাতি জ্বালালাম। দ্বীপ্ত ভাইয়ার কাঁধের ব্যাগ ওয়াটার প্রুফ হওয়ায় রক্ষে। টিউবওয়েল চেপে বালতিতে পানি ভরে দিলাম। মগে করে দ্বীপ্ত ভাইয়া মাথায় পানি ঢালতে লাগলেন। খুক খুক করে বার দুয়েক কাশলেন। তার হালকা ঠান্ডা লেগে গেছে। আমি গামছা দিয়ে আচ্ছামত তার মাথা মুছে দিলাম।
ঘরে ফিরে দ্বীপ্ত ভাইয়া চুল আঁচড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মেসের বুয়া খাবার বেড়ে গামলায় আলাদা করে রেখে যায় রান্নাঘরে। আমি গিয়ে আমার গামলাটি নিয়ে এলাম। ফ্লোরে পেপার বিছিয়ে দ্বীপ্ত ভাইয়াকে খেতা ডাকলাম।
- নাও, খেয়ে ঘুমিয়ে নাও।
দ্বীপ্ত ভাইয়া আড়মোড়া ভেঙে বলল,
- এখনি ঘুমাতে হবে কেন জান। ঘুমুতে এসেছি নাকি। জ্বালাইয়া প্রেমের বাতি, জেগে রবো সারা রাতি গো।
- কাব্য এখন রাখো। সারাদিন জার্নি করে এলে। আগে বিশ্রাম নিয়ে ক্লান্তি দুর করে নাও।
- আমি একদম ক্লান্ত না। টোটালি ফিট। চেক মি ম্যান।
- কোন কথা না। অনেক গল্প হবে। সব হবে। সোজা খেতে বসো।
- তুই কিন্তু অনেক বড় হয়ে গেছিস শুভ্র। শেভ করিস নাকি?
- বড় হবো না তো কি। হাইটও বেড়ে গেছে। পুরো পাঁচফুট দশ ইঞ্চি।
- সব কিছুই কি বেড়ে গেছে। কই দেখি!
দ্বীপ্ত ভাইয়া বিছানা থেকে উঠে আমাকে জাপটে ধরলেন। তার হাত নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে।
- ফাজলামো রাখো। ছাড়ো।
- ওকে ছেড়ে দিলাম। একটু ধরতেও দেয় না। কি নিষ্ঠুর!
- নিষ্ঠুরতার দেখেছ কি! ভাত খেয়ে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে পড়। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।
- হাত বুলিয়ে দেবে। তাহলে আমি এখনি শুয়ে পড়ি।
বলেই দ্বীপ্ত ভাইয়া ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
- আজ তোমার হয়েছে কি! ফাজলামো রাখো।
- ফাজলামো কোথায় রাখবো? ফাজলামো রাখার একটা পাত্র দে।
- বেশ কথা শিখেছ আজকাল।
- তোর ইয়া বড় বড় চিঠি পড়ে আমি কথা শিখে গেছি জানু।
- নাও কথা কম। খেতে বসো।
- কি রান্না হয়েছে আজ ? আমার জন্য কি আর রান্না হয়েছে। চল হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসি।
- এই ঝড় বাদলের রাতে কি হোটেল খোলা পাওয়া যাবে? হোটেলে খেতে হবে না। অনেক খাবার আছে। আজ তেমন ভালো কিছু রান্না হয় নাই। কঙ্কন মাছ দিয়ে সজিনার ডাটা এবং ডাউল। সজিনা খাও তো ?
- বেশ খাই। কংকন মাছ আবার কি ?
- এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ। এদিকের বাজারে পাওয়া যায়। আমাদের ওদিকে কখনো দেখিনি। আমার কাছে মাছটা খেতে ভালোই লাগে। অন্যরকম স্বাদ। মাছের দাঁড়ার অংশে কিন্তু বেশ কাঁটা। দেখে খাও। কাঁটা বেছে দেবো ?
- এমন ভাব করছিস যেন আমি বাচ্চা ছেলে নতুন মাত্র নিজের হাতে ভাত খাওয়া শিখেছি।
আমি নাক ধরে একটা ঝাঁকি দিয়ে বললাম, বাচ্ছা ছেলেই তো। তা আমার বাবু সোনাটা কিসে করে এলো। বাসা চিনলে কিভাবে ?
- ট্রেনে করে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সিট পেলাম না। বাসে করে এসেছি। হানিফ সার্ভিসের বাস। সার্ভিস ভালোই কিন্তু বেশ রাফ চালায় বলে মনে হলো। আর দৌলতদিয়া পাটুরিয়া ঘাটে পদ্মা পার হওয়া আর এক যন্ত্রণা। ফেরীর জন্য ছয়ঘন্টা ঘাটে অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর তোর বাসা চেনা এত কি কষ্ট। চিঠিতে তো কোন কিছু লিখতে বাকি রাখিস না। আমি চোখ বুঝলে সব যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম। তুই গল্প লিখিস না কেন ? পাম্প দিচ্ছি না। সত্যি , তুই যদি লেখালেখি করিস তবে একসময় শরৎ , বিভূতিভূষনদের কাতারে চলে যাবি বলে আমার বিশ্বাস।
- ধ্যুর্। কি যে বলো না। কি লিখবো ? আমার মাথায় কোন গল্প আসে না। কাহিনী ছাড়া কি গল্প লেখা যায়।
- গল্পের কি এতই ঘাটতি। আমাদের চারপাশে কত গল্প আছে। শুধু থাবা মেরে ধরার অপেক্ষা মাত্র। তোর আমার প্রেম কাহিনী লিখে ফেল। জানিস তো নিষিদ্ধ জিনিসের কাটতি বেশী।
- হুম। এইসব নিয়ে লিখি। শেষে তসলিমা নাসরিনের মত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেবে। আর এসব গল্প কি কেউ পড়বে ?
- পড়বে না কেন।! তুই কি মনে করিস শুধু মাত্র তুই আর আমি সমকামী। আমাদের মত হাজারে হাজার ছিলো। আছে এবং থাকবে। সমকামীরা কখনো এক হতে পারে নি বলে হাজার বছর ধরে বিষমকামীদের বানানো আইনের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়। আদ সামুদ জাতি সেই কোন জমানায় পৃথিবীতে ছিলো তার সঠিক দিন তারিখ কেউ বলতে পারে না। কত যুগ পেরিয়ে গেছে। আর ...
- খাওয়াটা আগে শেষ করো।
- আর খেতে পারবো না।
- মেসে আর কত খাবার দেয়। এটুকু তোমাকে খেতেই হবে। কোন কথা শুনছি না। আরেক চামচ ডাউল নাও।
- আরে না না।
- তুমি একবার তুই আরেকবার তুমি বলছো কেন ?
- বলছি নাকি?
- হুম।
- হা হা।
দ্বীপ্ত ভাইয়া হেসে ফেললেন। হাসিতে দ্বীপ্ত ভাইয়াকে বেশ বোকা বোকা লাগছে। আমিও হেসে দিলাম।
২৭
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো.........
বৈশাখকে নিয়ে লেখা কবিগুরুর অনবদ্য এক গান। যে গান ছাড়া পহেলা বৈশাখ অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়। আমার মনে হয় প্রকৃতিও গুনগুনিয়ে বৈশাখের এই আবাহন গীতি গাইতে থাকে। দাঁত ব্রাশ করতে করতে দিদির ঘরের দিকে তাকালাম। দিদির জানালা বন্ধ। কলপাঁড়ে দাঁড়িয়ে দিদিকে ডাক দিলাম।
- দিদি। ও দিদি।
দিদি জানালা খুললেন। লাজুক স্বরে বললেন, “শুভ নববর্ষ”।
আমি বললাম, শুভ নববর্ষ। কি করেন?
- এই স্নান সেরে পূজো করতে বসলাম। পান্তা খাইছো? আসো পান্তা ভাত খেয়ে যাও।
- নাহ দিদি। এখন আর আসবো না।
- তোমাদের মেসে কি পান্তা রান্না হইছে?
- হ্যাঁ। হয়েছে। পান্তা খেয়ে একটু বেরুবো।
- কোথায় যাবে?
- এক ভাইয়া এসেছে। বিএল কলেজের দিকে যাবো।
- মেলা থেকে কি কিনে আনবা আমার জন্য।
- আগে তো যাই।
সারা রাত জাগার পরে ঠান্ডা শীতল পানি দিয়ে গোছল করতে ভালোই লাগছে। সময় নিয়েই গোছল করলাম। গোছল করে ফিরে এসে দেখি। দ্বীপ্ত ভাইয়া উঠে বসেছেন। দেয়ালে বালিশ ঠেঁস দিয়ে তাতে হেলান দিয়ে বসে আছেন।
- ঘুমাবে না?
- ঘুম আসছে না। একবারে ঘুরে এসে ঘুমাবো না হয়।
- তাহলে হাত মুখ ধুয়ে আসো।
- হুম। একবারে গোছল করে আসি।
- ওকে। যাও।
- শুভ্র।
- জ্বি।
- চোখ বন্ধ করবে?
- কেন?
- করবে কিনা জিজ্ঞেস করেছি। করতে তো বলিনি।
- ওকে , এই চোখ বন্ধ করলাম।
খসখসে আওয়াজ পাচ্ছি। ব্যাগ থেকে কিছু বের করছেন। নববর্ষের গিফট হবে সে বিষয়ে আমি শিওর। সিনেমার মত তো আমার গলায় নেকলেস পরিয়ে দেবেন না! আর দিলেও সেটা অনেক অড দেখাবে।
- চোখ মেলবে?
- ঢং রাখো। সোজা করে কথা বলো!
- চোখ মেলো সোনা।
- মেললাম। ওয়াও। পাঞ্জাবী! আমি তো তোমাকে কিছু দিতে পারবো না।
- মার খাবি। পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা বল। তোকে কিছু দিতে কে বলেছে। পাগল একটা।
লালচে খয়েরী রঙের পাঞ্জাবী। গলার কাছে রুপালী সুতোয় হাতে নকশা করা। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তোমার দেয়া সুতোটুকুও আমার পছন্দ হবে দ্বীপ্ত ভাই। দ্বীপ্ত ভাইয়া গোছল করতে গেছে। এই ফাঁকে আমি পাঞ্জাবীটা পড়ে ট্রায়াল দিলাম। বেশ ফিট হয়েছে। শুধু হাত উঁচু করতে গেলে একটু বাঁধো বাঁধো লাগে। ব্যাপার না। অনুমান করে এনেছে। সাইজ যে ঠিক আছে তাই না কত। দ্বীপ্ত ভাইয়া গোছল করে এলে। দুজনে বসে পান্তা ইলিশ খেয়ে নিলাম। ভোরে এসে মেসের বুয়া পান্তা ইলিশ রান্না করে গেছে। ইলিশের সাইজ ছোট বলে মনে হচ্ছে। জাটকা সাইজ হবে। পহেলা বৈশাখের আগে বাজার থেকে ইলিশ কেনাই কষ্টসাধ্য। পহেলা বৈশাখের ইলিশ বড়লোকের জন্য যেন অপেক্ষায় থাকে।
দ্বীপ্ত ভাইয়া ব্যাগ থেকে আরেকটা পাঞ্জাবী বের করলেন। তখনো চমক বাকি। একই রঙের দুটি পাঞ্জাবী কিনেছেন দ্বীপ্ত ভাইয়া। তার এবং আমার জন্য। ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন এবং খুব রোমান্টিক বলে মনে হলো। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম।
- এই আস্তে! নতুন পাঞ্জাবী দলা মোঁচড়া হয়ে যাবে।
- যাক! এই তোমার ভালোবাসা। পাঞ্জাবীর থেকে কম দামী। হা হা হা।
- মাইর খাবি মাইর!
- খাবো। দাও।
- পরে খাইস। এখন চল।
২৮
রুমে তালা লাগিয়ে বাইরে এলাম। দিদি জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছেলেরা কেউ বাসায় নেই। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
-বাইরে যাচ্ছো?
- জ্বি।
- সাথে কে এটা?
- আমার বন্ধু।
যদিও আমাদের বয়সের ডিফারেন্স বোঝা যায়। তবু মুখ ফসকে বলে ফেললাম বন্ধু। দিদি কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। বিকেলে বন্ধুকে নিয়ে তার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার দাওয়াত দিলেন। দ্বীপ্ত ভাইয়া দিদির কুশল জিজ্ঞেস করলেন। দিদির কথা আমি তাকে চিঠিতে অনেক লিখেছি।
আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছি। দুজনের একই পাঞ্জাবী হওয়ায় এতক্ষণ যে চাপা আনন্দ বোধ করছিলাম। তা বেশ মিইয়ে গেলো। মনে হচ্ছে একই রকম পোষাক পরায় সবাই আমাদের দুজনের দিকে লক্ষ্য করছে। দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার হাত ধরে হাঁটছিলেন। আর গুনগুন করে গাইছেন, এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার, জ্যৈষ্ঠতে পরিচয়......
আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, আমাদের পরিচয় কিন্তু শীতে। দ্বীপ্ত ভাইয়া গানের কলি বদলে গাওয়া শুরু করলেন, এক শীতে দেখা হলো দুজনার.........
রিকশা নিয়ে খুলনা বিএল কলেজে চলে এলাম। আজ রিকশা ভাড়াও দ্বিগুন দিতে হলো। ব্রজলাল কলেজে ছোট খাট বর্ষবরনের অনুষ্ঠান হচ্ছে। খুলনা সার্কিট হাউজের মাঠে নাকি বেশ বড় মেলা হচ্ছে। কিন্তু এই সাত সকালে অতদূরে যেতে ইচ্ছে করলো না। স্টেজে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা মেয়েরা বৈশাখের গান করছে। ক্যাম্পাসে পাঞ্জাবী পরা ছেলে আর শাড়ী পরা মেয়েরা ঘুরঘুর করছে। আমরা দুজনে অনেকক্ষণ হাটাহাটি করলাম। মানুষ দেখলাম, পাঁপড় খেলাম, ঝুরি ভাজা খেলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, চল কোথাও বসি।
কোথায় একটু নিরিবিলি বসা যায়। সব খানেই আজ মানুষ। পুকুর পাড় তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা। পুকুর ঘাটের বাঁধানো বেদিতে গিয়ে বসলাম। মাথার উপর বকুল গাছ থাকায় সকালের রোদ পড়ছে না। ওপারে ব্রজলাল কলেজের সাদা মসজিদ ভোরের আলোয় চকচক করছে। পুকুরের জলে মসজিদের প্রতিবিম্ব ঢেউয়ের তালে দুলছে। বাদাম ওয়ালাকে ডেকে একশো গ্রাম বাদাম কিনে নিলাম। খোসা ছাড়িয়ে দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন। কিভাবে পারছে কিজানি! আমি তো বাদাম ছুলেই মুখে পুরি। দেরি করতে পারি না।
-আচ্ছা দ্বীপ্ত ভাইয়া।
- হুম।
- পহেলা বৈশাখ নাকি হিন্দুয়ানি কালচার? মুসলমানদের পালন করতে নেই।
- কে বলেছে।
- অনেকেই বলে। আমাদের স্কুলের ইসলাম শিক্ষার স্যার বলতেন, পহেলা বৈশাখ পালন করলে ইমান চলে যায়।
- ধ্যুর। যতসব ফালতু কথা। কথা বললেই হলো। কথার পিছে লজিক থাকতে হবেনা। আবু দাউদ শরীফের হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই বলে যে যারা অন্য ধর্মের রীতি নীতি পোষাক আষাক অনুসরণ করে তাহলে তারা সেই ধর্মের অনুসারী হয়ে যায়। কিন্তু শাড়ী, পাঞ্জাবী, পান্তা ভাত এগুলো বাঙালী হিন্দুর একলা সম্পত্তি নয়। একটি বিশেষ দিনকে উপলক্ষ করে শাড়ি পরলেই ধর্ম চলে যাবে! তুই বাংলা নববর্ষের ইতিহাস জানিস না?
- না। বলো।
- বলতে গেলে তো অনেক কথাই বলতে হবে।
- বলো। আমি শুনবো।
- বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌরদিন গণনা শুরু হয়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাই এক সৌর বছর। গ্রেগরিয়ান সনের মতো বাংলা সনেও মোট ১২ মাস। এগুলো হল বৈশাখ , জ্যৈষ্ঠ , আষাঢ়, শ্রাবণ , ভাদ্র , আশ্বিন , কার্তিক , অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ , ফাল্গুন ও চৈত্র । আকাশে রাশিমণ্ডলীতে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দের মাসের হিসাব হয়ে থাকে। যেমন যে সময় সূর্য মেষ রাশিতে থাকে সে মাসের নাম বৈশাখ। বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। বাংলাদেশ এবং পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে এই বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়। বাংলা সন শুরু হয় পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে যে দিনটি ইংরেজি বর্ষপঞ্জির ১৪/১৫ এপ্রিল (ভারতে) এবং ১৪ এপ্রিল (বাংলাদেশে)। বাংলা সন সব সময়ই ইংরেজি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির চেয়ে ৫৯৩ বছর কম। তাই বর্তমান ইংরেজী সাল থেকে ৫৯৩ বিয়োগ করলে বাংলা সাল পাওয়া যাবে।
-দাঁড়াও যোগ করে দেখি।
- যোগ করলে কর কিন্তু দাঁড়াতে পারবো না। উঁহ! পা একদম ব্যাথা হয়ে গেছে।
- তারপর বলো।
- মোঘলদের হাত ধরে ভারতবর্ষে ইসলামী শাসনের সুত্রপাত ঘটে। ইসলামী শাসনামলে আরবদেশের প্রচলিত হিজরী ক্যালেন্ডার অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। আরবিতে ক্যালেন্ডারকে বলা হয় তারিখ। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরর চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। একারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। প্রতিবছর ঈদ দেখিস না দিন দশেক করে এগিয়ে আসে। ভারতবর্ষ কৃষিনির্ভর দেশ। আর চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। ফসল উত্তোলনের সাথে খাজনা আদায় সম্পর্কিত। খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে ভারতের মহান মোগল সম্রাট আকবারের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আকবর নিজে লেখাপড়া না জানলে কি হবে তিনি বিদ্যার সমাদর করতেন। তার নবরত্ন সভায় তিনি সেরকম কিছু জিনিয়াস ব্যক্তি ছিলো। সম্রাট আকবর নবরত্ন সভার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। শিরাজী সাহেব ইরানের লোক। শিরাজির সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জীর অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খৃস্টাব্দে সম্রাট আকবার হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন।
- ৯৯২ হিজরী সাল থেকে বাংলা সাল শুরু হলে ১৪২১ বছর কিভাবে হয়? এখন তো ২০০৩ সাল। চারশো বছরের মত হয় আকবারের শাসনামল থেকে!
- আরে হিজরী সাল থেকেই বঙ্গাব্দ গণনা করা হয়। মানে অত বছর পর থেকে গণনা শুরু হয়।
- ৯৯২ বঙ্গাব্দ ছিলো প্রথম বাংলা সন?
- না। সম্রাট আকবার ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ বঙ্গাব্দ হচ্ছে প্রথম বাংলা সন। ইতোপূর্বে রাজা শশাংকের আমল থেকে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্চির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরী সালের মুহাররাম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।
-তবে মুহাররাম মাস কি আষাঢ় মাসে পড়লে বছরের প্রথম মাস হত আষাঢ়।
- আমার তো তাই মনে হয়।
- তাহলে তো কবিগুরু লিখতেন, এসো হে আষাঢ়, এসো এসো......
- হা হা হা। ফাঁজিল একটা।
- আচ্ছা এই বাংলা বারো মাসের নামকরণ কিভাবে করা হলো? নাম গুলো তো হিন্দু হিন্দু। কার্তিক তো আবার হিন্দুদের এক দেবতার নাম।
- বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হযেছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ "সূর্যসিদ্ধান্ত" থেকে। সূর্যসিদ্ধান্ত বইটি লিখেছেন ভারতবর্ষীয় জোতির্বিদ বরাহ মিহির। তাই নক্ষত্রগুলোর নাম চয়ন করা হয়েছিলো সংস্কৃত থেকে। বাংলা মাসের এই নামগুলি হচ্ছে -
বৈশাখ - বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, জ্যৈষ্ঠ - জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে , আষাঢ় - উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে , শ্রাবণ - শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে , ভাদ্র -উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে, আশ্বিন - অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে, কার্তিক - কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, অগ্রহায়ণ(মার্গশীর্ষ¬) - মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, পৌষ - পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, মাঘ - মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে, ফাল্গুন - উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে , চৈত্র - চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে।
২৯
- সম্রাট আকবরই কি এই বাংলা মাসের নাম নির্ধারণ করেন?
- না। এই নামগুলো পরে নির্ধারণ করা হয়। সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী - র মাসের নামগুলি প্রচলিত ছিল পারসি ভাষায়, যথা: ফারওয়াদিন, আর্দি, ভিহিসু, খোরদাদ, তির, আমারদাদ, শাহরিযার, আবান, আযুর, দাই, বহম এবং ইসক্নদার মিজ।
-আচ্ছা বাংলা দিনের হিসাব সূর্যোদয় থেকে শুরু হয় কেন?
- আরে বোকা এটা মানুষের মাঝে প্রচলিত হয়ে যাওয়া একটা নিয়ম মাত্র। যেমন বাংলা সনে দিনের শুরু হয় সূর্যোদয়ে। আবার ইংরেজি বা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির শুরু হয় যেমন মধ্যরাত হতে আর হিজরি দিনের গণনা শুরু হয় সুর্যাস্তে বা চন্দ্রোদয়ে। বাংলাদেশের বাইরে পশ্চিম বঙ্গ , আসাম , কেরল ,মণিপুর , নেপাল , ওড়িশা , পাঞ্জাব , তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরায় এই বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনকেই নতুন বর্ষের শুরু হিসেবে উদযাপন করা হয়।
- তাই নাকি।
- হুম। পারস্যে নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে নওরোজ হিসেবে পালন করত। নওরোজের আদলে নববর্ষের প্রচলন করা হয়। সেই নববর্ষ আজ বাঙালীর সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
- তা অবশ্য ঠিক। এই একটা উৎসব যা হিন্দু কিংবা মুসলমানের নয়, সকল বাঙালীর। পৃথিবীর বুকে নিজেদের আলাদা করে চেনানোর জন্য কিন্তু এটাই যথেষ্ট।
- কিন্তু আমরা সেটা পারি না। নববর্ষের দিনে অধিকাংশ মানুষ পরিবারকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। আর গুটিকয়েক মানুষ ঘরের কোনে বসে চিৎকার করতে থাকে গেলো গেলো সব গেলো। জাত গেলো। ধর্ম গেলো, সংস্কৃতি গেলো। বছরের আর দশটা দিনের সাথে এই দিনের খুব বেশী পার্থক্য থাকেনা। মেয়েরা শাড়ী পরে স্কুল কলেজ রাস্তা ঘাট হাট বাজারে যাচ্ছে। তাতে ধর্মের জাত যায় না, বৈশাখে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরলে কেন এদের এত জ্বলে আমি বুঝি না।
- ছায়ানটের যে অনুষ্ঠান হয় রমনার বটমূলে সেটা আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয় সেটা কি সার্বজনীন থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা মঙ্গল পূজার মত হয়ে যায় না!
- আসলে ব্যাপারটায় অতিউৎসাহী কিছু মানুষের ভূমিকা কাজ করেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব বেশী পুরাতন নয়। ১৯৮৯ সাল থেকে চারুকলা ইনস্টিটিউট বর্ষবরণ শোভাযাত্রা চালু করে। এরশাদ সাহবের পতনের পর খালেদা জিয়ার শাসনামলে এই অনুষ্ঠান ব্যাপকতা পায়। জনগনের সম্পৃক্ততা বাড়ে। বর্ষবরণ শোভাযাত্রা নববর্ষের অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বর্ষবরণ শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা রাখা হয়। আর তারপর থেকে সমালোচকেরা এটাকে মঙ্গল পূজা বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। তবে আমার মনে হয় এটার নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা না রেখে বর্ষবরণ শোভাযাত্রা রাখলেই সার্বজনীন মাত্রা পেত। গলা শুকিয়ে গেলো রে।
- চল ঠান্ডা খাওয়া যাক।
- না । গরম খাবো।
- গরম কি খাবে?
- চুমু।
- মাইর খাবা! চারপাশে মানুষ।
- চারপাশে মানুষ তাতে আমার কি? আমি কি তাদের সবাইকে চুমু খেতে যাচ্ছি নাকি!
- সবাইকে চুমু খাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?
- হুমম! মন্দ হতো না।
- যাও। ট্রাই করে দেখো। ঠ্যাঙ ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেবে।
- ভালই তো। তখন আমি তোমার কোলে উঠে বাড়ি ফিরবো।
- কোলে ওঠার এত সখ! চল বাসায়। আজ সারা দিন কোলে বসিয়ে রাখবো।
- চল উঠি। ঘুম পাচ্ছে এবার।
জনমানুষের ভীড়ে আমরা দুজন হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলেছি। একে অন্যের কড়ে আঙুল ধরা। কেউ খেয়াল করলো কিনা, কিছু মনে করলো কিনা, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। বাসার পথ ধরেছি। মাইকে কোথাও মকসুদ গাইছে, মেলায় যাইরে, মেলায় যাইরে......
৩০
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা। এখনো পুরোপুরি সন্ধ্যা হয় নাই। বিকেলের আলো ম্লান হতে শুরু করেছে মাত্র। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন , গ্রাম সাইডে চল। একটু ফ্রেশ এয়ার সেবন করা যাক।
- চল তবে দেয়ানার দিকে যাওয়া যাক।
- দেয়ানা ?
- এই তো পাবলার পরের গ্রাম।
- দেয়ানা নাম কেন ? এখানকার সবাই কি প্রেমে দিওয়ানা হয়ে আছে নাকি!
- হুম আছে। তোমার প্রেমে !
-তাই। সৌভাগ্যবান আমি।
- আর আমি সৌভাগ্যবান যে তোমাকে পেয়েছি।
খুলনক সিমসাম ছোট একটা শহর্। শহুরে জীবনের যান্ত্রিক ব্যস্ততা এখনো সেভাবে খুলনাকে গ্রাস করে নাই। শহর বলতে ডাকবাংলো কেন্দ্রিক জনজীবন এবং তার আশপাশের কিছু এলাকা। সেই অর্থে দেয়ানা গ্রাম। সন্ধ্যারাতে রাস্তার মাঝকানে শিয়াল দাঁড়িয়ে থাকে।
মেস থেকে বেরিয়ে অনেকটা দূর যাওয়ার পর দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাত ধরলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়ার উচ্চতা ৫.১১ ফুট। আরেকটু বড় হলে আমি তার সমান হয়ে যাবো। বেশ দূরে চলে এসেছি। রাস্তা ফাঁকা । অন্ধ্র মহিলাটা রাস্তা দিয়ে লাঠি ঠুকঠুক করে এগিয়ে আসছে। কাদের বাড়ির বুড়ি জানিনা। এদিকে হাটতে এলে মাঝে মধ্যেই দেখি। মাথায় সামান্য সমস্যা আছে। আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে জিজ্ঞেস করলো , কে যায় ?
আমি উত্তর করলাম , আমাদের চিনবেননা দাদী।
দ্বীপ্ত ভাইয়া হেসে বলেন , তোমার দাদি নাকি ?
আমি বললাম , থামো তো।
ব্রৃদ্ধা মহিলা : বাবা দুইটা টাহা দাও।
আমি মানিব্যাগ ব্যবহার করিনা। অভ্যাস হয়ে ওঠেনি এখনো। টাকা বের করতে পকেটে হাত ঢুকালাম। এর মধ্যে দ্বীপ্ত ভাইয়া মানিব্যাগ বের করে বৃদ্ধার হাতে পাঁচ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়েছেন। বৃদ্ধা টাকার গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন টাকা না সাদা কাগজ। অনেককেই এই অন্ধ মহিলার হাতে টাকা বলে সাদা কাগজ ধরিয়ে দেয়। বৃদ্ধা বুঝতে পারলে খেপে যায়। পিতা মাতার চৌদ্দপুরুষ তুলে যে সম্ভাষন তখন সে করে তা কলমের ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। আজ সে বেশ সময় নিয়েই হাতড়াচ্ছে। বুঝতে পারছে না।
জিজ্ঞেস করলো, সত্যি টাহা দিছো তো না কাগুজ দিছাও ?
- টাকাই দিয়েছি। পাঁচটাকা।
- ওহ। তাই কও। সবাই দু টাহা দেয়। তাই এত সময় ভাবতিছিলাম দুই টাহার মত লাগতিছে না ক্যান। আজ তালি বেশি করে পান খাবো।
বৃদ্ধা বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে চলে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন , দেখেছিস মানুষ কি অল্পেই না তৃপ্ত হতে পারে!
রাস্তার পাশে সবুজ ধানখেত। কচি সবুজ পাতা তিরতির করে কাঁপছে। গরমের ধানের চাষ করেছে কেউ। আমরা রাস্তার ঢালের সবুজ ঘাসে পা বিছিয়ে বসে পড়লাম। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার গা ঘেঁষে বসলাম। তিনি আমার কাঁধের উপর হাত রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
নির্বাক কিছু মুহূর্ত কেটে গেলো। অদূরে একটা গাছে হলুদ ফুলের ঝুরি বাতাসে দুলছে। দ্বীপ্ত ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম ফুলটা চেনে কিনা। সে ফুলটার নাম বললো সোনালু ফুল। এই এলাকায় অবশ্য ফুলটিকে বাঁদর লাঠি বলে। ফল অবশ্য দেখতে লাঠির মত। কিন্তু ফলের সাথে বাঁদরের কি সম্পর্ক আছে সে ইতিহাস কোথাও লেখা হয় না।
মাগরিবের আজান পেরিয়ে গেছে। রাস্তা দিয়ে মুরুব্বি গোছের একটা লোক এগিয়ে আসছে এদিকে। আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
দ্বীপ্ত ভাইয়া ওই গানটা গাও না।
- কোন গানটা ?
- নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তা চলেছি একা ।
- কিন্তু এখন তো আমরা দুইজিন মিলে রাস্তা চলতেছি। আর সন্ধ্যার আকাশ নীল হয় না।
- ওকে বাবা। তাহলে পারফেক্ট গান টাই গাও , এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত বলো তো ...
৩১
সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি দিওয়ানা ...
আদিত্য ছাত্র পড়াতে গেছে। আজ বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু দ্বীপ্ত ভাইয়া বাতি নিভিয়ে রেখেছেন। অনেকে বাতি নেভানো বলতে তেলের প্রদ্বীপ নেভানোকেই বোঝে। আমি বৈদ্যুতিক বাতির সুইচ অফ করে রাখার কথা বলছি। ঘরের ভেতর প্লেটে পানি রেখে তার মাঝখানে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। পানিতে আলো প্রতিফলিত হয়ে ঘরের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে, মৃদু মোমবাতির আলোয় ঘরের মাঝে এক মায়াময় পরিবেশ। চারকোনায় চারটা মোমবাতি জ্বলছে। মাঝখানে আমরা দুজন বসে আছি। আজ প্রেম রসে আদ্র মন। ঠিক প্রেম রস নয়, দ্রাক্ষা রস বললেই প্রকৃত অর্থ বোঝায়। একজন আরেকজনের মুখ থেকে আঙুর নিচ্ছি। দ্রাক্ষারস লালারস মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। প্লাস্টিকের বক্সে রাখা আড়াইশো গ্রাম আঙুর ফুরিয়ে গেছে। আরো বেশী করে কিনলে ভালো হত। একে অন্যের ঠোঁট থেকে আঙুর খাওয়ার মজাই আলাদা। এটা যেন আঙুরের স্বাদ শতগুন বাড়িয়ে দেয়। আমাদের অতৃপ্ত ঠোঁট তখন একে অন্যকে চোষায় ব্যস্ত। রঙিন মিষ্টতায় আচ্ছন্ন গৃহলোক। দীর্ঘ নিস্তব্ধতার পরে আমি আস্তে করে ডাকলাম,
- দ্বীপ্ত ভাইয়া
- হুম।
- আমরা কি সারা জীবন এক সাথে থাকতে পারবো ?
- কেন পারবো না?
- কেন পারবো! ধর্ম সমাজ সংসার কেউ কি আমাদের এই সম্পর্ক মেনে নেবে। কোথাও কারো কাছে কি আমাদের ভালোবাসার স্বীকৃতি মিলবে ?
- মেনে না নিলে না নিবে। তোকে ছাড়া বাঁচবো না আমি শুভ্র।
- তোমাকে ছাড়া বাঁচার কল্পনাই যে আমি কখনো করিনি।
- আমি জানি সেটা ।
- জানো ভাইয়া মাঝে মাঝে আমার খুব ভয় হয়।
- কিসের ভয়?
- তোমাকে হারানোর ভয়।
- আমি হারিয়ে যাবো কেন ! হারিয়ে যাওয়ার বয়স আমার অনেক আগেই চলে গেছে।
- আচ্ছা আমরা কি বিষমকামীদের মত বিয়ে করে সারাজীবন দুজন একসাথে কাটিয়ে দিতে পারিনা?
-সে সময় হয়তো এখনো আসে নি। দুজন একসঙ্গে থাকতে পারবো। কিন্তু সমাজ বৈধতা দেবে না আমাদের সম্পর্ককে।
-সেই সময় কবে আসবে ভাইয়া?
- প্রতিটা অর্জনের পিছনে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস আছে। আমাদের দেশে সেরকম কিছু পেতে গেলে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা সহ্য করতে হবে সোনা।
- কারা করবে সেই সংগ্রাম? অধিকার আদায়ের মশাল জ্বালবে কে?
- তোমার আমার মত কেউ করবে। পৃথিবীর বুক থেকে আপন অধিকার আদায়ের দৃপ্ত শপথে পা ফেলবে।
- ইংরেজ দেশ গুলোতে নাকি সমকামি বিবাহকে বৈধতা দেয়ার আলোচনা হচ্ছে?
- হুম। কিন্তু তাদেরও আছে সংগ্রামের ইতিহাস। একদিনেই তারা নিজেদের অধিকার অর্জন করে নাই। সরকারকে গিয়ে বলেছে দাও, আর সরকার আইন করে দিয়েছে এমনটি নয়।
- তাহলে?
- আচ্ছা শোন তোকে স্টোনওয়াল রায়টের কথা বলি।
- স্টোনওয়াল রায়ট? পাথুরে দেয়াল দাঙ্গা। সমকামীরা কি পাথরের দেয়াল ভেঙে দাঙ্গা বাঁধিয়েছিলো।
- আজকাল কথা বেশী বলিস তুই।
- হুম। আর তুমি মোটেও কথা বলো না!
- আমি কবে কথা বললাম! আজব!
- তোমার উচিত মাস্টারি করা।
- মাস্টার হিসেবে তোকেই মানাবে। তোর এই সুন্দর চোখের উপর মোটা কাঁচের চশমা পরবি। না হলে ক্লাসের ছাত্র ছাত্রী সবই কিন্তু তোর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যাবে।
- গাধা পিটিয়ে কে বানাবে। বাপস। আমার দ্বারা মাস্টারি হবে না। ওকে, এবার স্টোনওয়াল রায়টের কথা বলো।
- না বলবো না। তুই মুড অফ করে দিয়েছিস।
- তাই বুঝি। বলো তোমার মুডের সুইচ কোথায়? আমি এখনি অন করে দিচ্ছি। বলো বলো।
- হাত কোথায় নিচ্ছিস। ছিহ! তুই এত পাঁজি হয়েছিস কেন?
আমি তার কান মলে দিয়ে বললাম, তাহলে বলো প্লিজ। এই তোমার কানে ধরছি।
দ্বীপ্ত ভাইয়া কানে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, আমার কানই তো ধরবে! নিজের কান ধর। ওকে। তাহলে হাত সরিয়ে স্থির হয়ে বস।
তার কোলের কাছে বাবু হয়ে বসে বললাম, এই বসলাম। এবার বলো।
- সমকামিতার ইতিহাসে Stonewall riots একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নিউইয়র্ক সিটির গ্রীনউইচ গ্রামের ক্রিস্টোপার রোডের ৫১-৫৩নম্বরে স্টোনওয়াল ইন নামে একটা রেস্তরাঁ আছে। আবার বলিস না, গ্রীনউইচ ভিলেজ মানে সবুজ জাদুকরদের গ্রাম। বহুদিন ধরে এই রেস্তোরাঁ সমকামীদের আড্ডা দেয়ার স্থান হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় সমকামীরা এখানে জড়ো হয়ে একসাথে গল্প গুজুব করত। বিষমকামীরা এই ধরণের গে-বারগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ষাট- সত্তুরের দশকে পুলিশ এই ধরনের গে-বার গুলোতে হঠাৎ করেই হামলা চালাতো। পানশালায় এসে পুলিশ সমকামীদের উপর চড়াও হয়ে গণহারে গ্রেফতার করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যেত। তাদের একটাই অপরাধ তারা সমকামী। আর সে সময় সমকামীদের পক্ষে পৃথিবীর কোন দেশেই তেমন কোন আইন ছিলো না। ১৯৬৯ সালের ২৮শে জুন পুলিশ খুব স্বাভাবিক নিয়মেই গ্রীন উইচের গ্রামের গে-বারটিতে হানা দেয়। কিন্তু সেদিন পুলিশ বারটিতে হানা দিলে সেখানকার উপস্থিত লোকেরা অন্য দিনের মতো পিছু না হটে সরাসরি পুলিশের সাথে সম্মুখ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। থালা বাসন, গ্লাস, বোতল – যার সামনে যা কিছু ছিলো তাই নিয়েই পুলিশের মোকাবেলা শুরু করলো। একটা পর্যায়ে সব পুলিশকে রেস্তোরাঁর ভিতরে আঁটকে করে ফেলে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিলো। সেই পুলিশদের উদ্ধার করতে কন্ট্রোলরুম থেকে আরো পুলিশ পাঠানো হলো। কিন্তু পুলিশ এসে দেখে পরিস্থিতি প্রতিকূলে। তারা আবদ্ধ সহকর্মীদের দুরবস্থা দেখা ছাড়া খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। জনগণ ততক্ষণে রেস্তরাঁর আশে পাশের রাস্তাগুলো দখল করে নিয়েছে। পুলিশদের আটকে রেখে দিনভর আর রাত জুড়ে দাঙ্গা চলতে থাকে। পুলিশ আক্রমণ করে। এর পরদিন সমকামীদের সমর্থনে গ্রীনউইচ গ্রামের আশ-পাশ থেকে আরো বহু লোক এবং সংগঠন এগিয়ে আসে। পুলিশদের উদ্দেশ্য পাথর ছোঁড়া থেকে আগুন জ্বালানো, পোড়ানো – কোন কিছুই বাদ যায়নি। প্রায় চারশ পুলিশের সাথে প্রায় দু হাজার সমকামী মানুষ খালি হাতে যুদ্ধ করছিলো।
স্টোনওয়াল ইন-এর প্রভাব পরবর্তীকালে আমেরিকার রাজনীতিতে ব্যাপক ভাবে পড়েছিলো। নিউ ইয়র্কের মেয়র জন লিন্ডসের প্রেসিডেন্টশিয়াল ক্যাম্পেইনের সামনে সমকামীরা দল বেঁধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাদের আন্দোলনের মুখে মেয়র পুলিশকে সমকামী বারে হানা দিয়ে লোকজনকে গ্রেপ্তার ও হেনস্তা না করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হন। সংখ্যালঘু যৌনপ্রবৃত্তির কারণে সমকামীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে যে নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছিলেন, তা থেকে মুক্তির পথে এক ধাপ এগিয়ে যায়। এই দিনটিকে স্মরণ করে সমকামী অধিকার কর্মীরা প্রতি বছর গৌরব পদযাত্রায় অংশ নিয়ে থাকেন। এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রাইড মার্চ বা গৌরব পদযাত্রায় আয়োজন করে। হয়তো আমাদের বাংলাদেশে কোন এক দিন কোন সাহসী প্রাণ এমনি কোন গৌরব পদযাত্রার আয়োজন করতে সক্ষম হবে। পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবে তারাও মানুষ।
- কি বলবো বুঝতে পারছি না দ্বীপ্ত ভাইয়া। এতদিন আমার ধারণা ছিলো সমকামী ব্যক্তি মাত্রেই সেক্স কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা করে।
- কিছুই বলতে হবে না। আমাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরে বসে আছিস। এভাবেই বসে থাক। তোর স্পর্শ আমাকে স্বর্গীয় সুখানুভূতি দেয়।
- মনে হয় স্বর্গে তুমি কয়েকবার গিয়েছ তুমি।
- গেছি তো। আমার স্বর্গ হলি তুই। তোকে ছেড়ে আমি অন্য কোন স্বর্গের লোভ করতে পারবো না। যদি নরকের আগুনে পুড়ে মরতে হয় তবুও আমি তোমাকেই চাই।
- এত ভালোবাসা কি আমার কপালে সহ্য হবে ভাইয়া?
আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না।
- পাগল ছেলে কাঁদছিস কেন!
দ্বীপ্ত ভাইয়া আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিতে লাগলো।
আমি বুঝিনা পোড়া চোখে এত পানি আসে কেন! সুখে দুঃখে এত পানির মজুদ সে পায় কোথায়!
৩২
- বসো। খাটের উপর বসো। খাটের উপর বসতে বলার পরেও দ্বীপ্ত ভাইয়া কি করবে বুঝতে না পেরে আমার মুখের দিকে তাকালো। দিদির ঘরখানা মাঝারী আকারের। পাশাপাশি দুটি রুম। এই রুমটা বড় ঘর। পাশেরটায় তার ছোট ছেলে থাকে। এই ঘরে আসবাব তেমন নেই। পুব দিকে একখানা পালং খাঁট। খাটের পাশে জানালা। এখানেই বসে দিদি আমার সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দেয়। এর উল্টোপাশে খাটের গা ঘেঁষে ঠাকুরের কাঠের আসন। আসনে রাঁধা কৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। রাঁধাকে বাহুডোরে জড়িয়ে কৃষ্ণঠাকুর বাঁশি বাজাচ্ছেন। জরির ফিতা আর রঙিং কাগজে দিদি সেই ছোট আসনটিকে সাজিয়ে রেখেছেন। সামনে প্রদ্বীপদানি এবং ছোট একটা ঘন্টা রাখা। প্রতি সন্ধ্যায় দিদি সরিষার তেলে প্রদ্বীপ জ্বেলে ঠাকুরের সামনে বসেন। পূজার মন্ত্র পড়ে উলুধ্বনি দেন এবং ঘন্টা বাজান। আমাদের মেসের বুয়া নামাজ কখনো পড়ে কিনা তার ঠিক নেই , মুখে বিরক্তির ভাব ফুঁটিয়ে বলে, মাগরিবের নামাজের সময় মালোরা শুরু করলো টা কি !
দিদি আজ দুইদিন ধরে বলছেন , তোমার বন্ধুকে নিয়ে বেড়াতে আসো। আমি তো গতকাল বলেই বসলাম, “কি দিদি আপনার তো মেয়ে নাই। আমার বন্ধুকে বাড়িতে ডাকার উদ্দেশ্য কি”!
দিদি হেসে বলে , তোমার বন্ধু তো আমার বন্ধু। না ডাকলে কেমন করে হয় !
দ্বীপ্ত ভাইয়া প্রথমে যেতে গররাজি হয়ে বললেন , আমি যাবো কেন ?,আমাকে চেনে নাকি।
- আরে গিয়েই দেখ না। দিদি অনেক ফ্রেন্ডলি একটা লোক । তোমার মনে হবে আপন কারো বাড়ি এসেছো।
আমরা যাওয়ার পর কি খেতে দেবেন তাই নিয়ে দিদি শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আমি বলতে গেলে প্রায়শই দিদির সাথে হাসি ঠাট্টা করি। বলেই বসলাম, দুই দিন ধরে দাওয়াত দিচ্ছেন। আর এখন বলছেন কি খাওয়াই!
সহজ সরল দিদি লাজুক হেসে বললেন , আজ সকাল পর্যন্ত হাতে তিনশো টাকা ছিলো। দুপুরের বাবুর মা এসে এত করে ধরলো যে তিনশো টাকা ধার দিতে হলো।
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, দিদি একদম ব্যস্ত হবেন না। আপনাকে কোন কিছু ব্যবস্থা করতে হবে না। আমরা একটু আগে নাস্তা করে এসেছি।
আমি বললাম , না দিদি। কিছু খাবো না তাই হয়। চানাচুর মাখাও। চানাচুর মাখা খাবো।
দ্বীপ্ত ভাই আহত হয়ে বললেন , শুভ্র!
দ্বীপ্ত ভাইয়ের মুখের ভাব দেখে দিদি হেসে ফেললেন। বললেন, ভাই বোনে এক হলে খুনসুটি হবেই। তুমি আহত হয়ো না।
আমারও হাসি পেলো। ডিশ লাইনে সারাদিন বসে সিরিয়াল দেখতে দেখতে দিদি আজকাল নাটুকে ডায়ালগ দেয় দেখি। আমি দ্বীপ্ত ভাইকে বললাম, “তুমি যা ভাবছো তা না। আমার দিদি অত গরীব না। টাকা পয়সা হাতে থাকলে দিদি ইচ্ছেমত খরচ করে বলে জামাইবাবু প্রতি সপ্তাহে বাড়ি এসে সারা সপ্তাহ চলার টাকা দিয়ে যান। কালকে জামাইবাবু বাড়ি আসবে। তাই না দিদি”।
দিদি মাথা ঝাঁকিয়ে আমার কথায় সায় দিলেন। উঠে গিয়ে আলমারির মাথা থেকে মাঝারি সাইজের একটা বোয়েম নামিয়ে নিয়ে এলেন। বোয়েম ভর্তি চানাচুর। তপনের চানাচুর। আমাদের খুলনার এদিকে বেশ চলে।
দিদি জিজ্ঞেস করলেন, পেঁয়াজ তো বেশী খাও। ঝাল কয়টা দেবো ? তোমার বন্ধু কি পেঁয়াজ বেশী খায়?
আমি বললাম, ঝাল পেঁয়াজ একটু বেশী দেন। পেঁয়াজ এত কম খান। তরকারীতে স্বাদ হয় দিদি?
দিদি বললেন, পেঁয়াজ তো আমি খুলনা শহরে এসে খাওয়া শিখছি। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি এমনকি আমার বাবার বাড়িতে পেঁয়াজ খাওয়া হত না। তোমার জামাইবাবু এসব মানে না। হোটেলে খায়। গরুও খাওয়া শিখেছে কিনা কে জানে।
দ্বীপ্ত ভাই বললেন , জামাইবাবু কোথায় থাকেন দিদি?
দিদি বললেন , তিনি একটা হোটেলের ম্যানেজারী করেন। মৌসুমী হোটেল। রুপসা ঘাটের ওইদিকে। তিনি হোটেলেই থাকেন। সপ্তাহে একদিন বাড়ি আসেন। তোমাদের তরমুজ কেটে দেবো। একটা তরমুজ কিনেছিলাম আজ সকালে।
আমি বললাম, না দিদি। তরমুজ খাবো না। তরমুজ খেলে চানাচুরের স্বাদ পাবো না।
দিদি পেঁয়াজ মরিচ নিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। একটা শশা হাতে নিয়ে বললেন, আর্ধেকটা কুচিয়ে দেই। বাকি আর্ধেকটা ঠাকুরের ভোগে দেবো সন্ধ্যাবেলা।
দ্বীপ্ত ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে বললেন, ঠাকুরের ভোগে আমরা ভাগ বসাতে চাইনা দিদি। পুরোটাই থাক।
দিদি হেসে বললেন, শুভ্র, তোমার বন্ধুটি বেশ কথা বলে তো।
আমি ভাব নিয়ে বললাম, দেখতে হবে না কার বন্ধু।
দিদিঃ ভাব নিয়ো না। তোমার কথায় এখনো কয়রার টান আছে।
আমি প্রতিবাদ করে বললাম, তুমিও তো কয়রা থেকে উঠে এসেছো। তুমিই বা এমন কি শুদ্ধ কথা বলো!
দিদি পেঁয়াজ কাটতে কাটতে ঠোঁট টিপে হাসছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি দিদি একলা একলা হাসেন কেন?
দিদিঃ এখটা কথা মনে করে হাসলাম।
আমিঃ কি কথা?
দিদিঃ না থাক। বললে তুমি খেপে যাবে।
দ্বীপ্ত ভাইয়াঃ না দিদি খেপবে না বলেন।
দিদিঃ আজ দুই দিন লক্ষ্য করছি তোমরা দুজন যেভাবে একে অন্যের সাথে সারাক্ষণ লেপটে থাকছো তাতে একজন মেয়ে হলে আমি বিয়ে পড়িয়ে দিতাম।
আমি আতংকিত বোধ করলাম। দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম, লেপটে থাকা মানে কি দিদি? কি দেখেছেন আপনি?
দিদিঃ এই যে সারাক্ষণ একই সাথে আছো। ঘুরতে বের হচ্ছো।
আমার বুক থেকে যেন কেউ পাথর নামিয়ে নিলো। এতক্ষণ তো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড় হয়েছিলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া পরিবেশ হালকা করার জন্য বললেন, খুলনায় তো এটিই আমার বাহন। এটাকে ছাড়া আমি কিভাবে চলি বলেন। আচ্ছা দিদি শাড়ি পড়লে কি আমাকে মেয়ে মেয়ে লাগবে? আপনার একখানা শাড়ি পরে দেখবো নাকি!
দিদিঃ নাহ ! তোমাকে লাগবে না। মদ্দা মদ্দা লাগবে। অনেকটা হিঁজড়াদের মত। শুভ্রকে মানাবে।
আমি আহত গলায় বললাম, আমাকে মানাবে কেন দিদি? আমি কি মেয়েদের মত কোমর দুলিয়ে হাঁটি নাকি?
দিদি হিহি করে হেসে বললেন, মেয়েরা কোমর দুলিয়ে হাঁটে নাকি। আমার কোমর দোলে নাকি। অবশ্য আজকাল কলেজ পড়া কয়েকটা মেয়েকে মাজা দুলিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখি। শুভ্রকে লাগবে বলেছি কারণ ওর চোখ দুটো দেখ। কেমন বড় বড়। অনেকটা মেয়েদের চোখের মত। আর গলার সুরটাও চিকন।
আমি বললাম, দিদি, আপনি কিন্তু আমাকে পঁচাচ্ছেন।
দিদিঃ আরে তুমি রাগ করছ নাকি। আমরা কিন্তু মজা করছি।
আমি বললাম, রাগ করি নাই।
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, আর যাই বলেন দিদি শুভ্রর গলার ভয়েস কিন্তু মারাত্মক। ওর গলার স্বর শুনলে আমার যেন কেমন কেমন লাগে। ও মেয়ে হলে নির্ঘাত আমি ওর প্রেমে পড়ে যেতাম। ওকেই বিয়ে করতাম।
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, মজা নেয়া হচ্ছে না। দিদি গান শুনবা?
দিদিঃ তুমি গান গাইতে পারো।
আমিঃ আমি গান গাইতে পারলে তো হত। দ্বীপ্ত ভাইয়া পারে।
দিদিঃ তাহলে একখান গান শোনাও দাদা।
দ্বীপ্ত ভাইয়াঃ কোন গানটা গাইবো?
দিদিঃ চরণও ধরিতে দিও আমারে।
দ্বীপ্ত ভাইয়াঃ রবীন্দ্র সংগীত?
দিদিঃ হ্যাঁ।
দ্বীপ্ত ভাইয়াঃ এই গানটা যে আমার মুখস্ত নেই দিদি।
দিদিঃ তবে ক্ষণিকের অতিথি?
দ্বীপ্ত ভাইয়া গেয়ে উঠলেন, হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে, কারে চাহিয়া, ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া, হে ক্ষনিকের অতিথি......
৩৩
পরদিন দ্বীপ্ত ভাইয়া চলে যাবেন। কিন্তু এটা আমি কিছু্তেই মেনে নিতে পারছি না। মনের ভিতর একটা লাল পিঁপড়া কুটুরকুটুর করে কামড়াবে।। দ্বীপ্ত ভাইয়ার মাস্টার্স পরীক্ষা সামনে। তার যাওয়া উচিত। আবার এক দুই দিন বেশী থাকলেও তাকে চলে যেতে হবেই সেটাও বুঝি। কিন্তু আমি ছেলে মানুষের মত বায়না ধরলাম। আরেকদিন তাকে থাকতেই হবে। সেও খুব বেশী গাঁইগুই করলো না। সহজে রাজী হয়ে গেলো। বোঝাই যাচ্ছে তার যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই।
গতকাল দিদির বাসা থেকে বের হয়ে আমরা দৌলতপুর রেলস্টেশানের দিকে হাটতে যাই। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন চিঠিতে তিনি যে রেল স্টেশানের কথা এত পড়েছেন সেটা দেখতে চান। শামীম হোটেলে স্পেশাল মোঘলাই পরোটা খেয়ে দৌলতপুর বাজার ছাড়িয়ে রেল লাইন ধরে হাঁটা শুরু করলাম। দুজন দুজনের হাত ধরে রেল স্টেশানের স্লিপার দিয়ে হেঁটে গেলাম স্টেশান পর্যন্ত। লোহার ব্রিজের উপর উঠে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্টেশান কাঁপিয়ে কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ছুঁটে গেলো রাজশাহীর দিকে। সারা দুপুর খুলনা শহরে ঘুরলাম। বয়রা, নিউমার্কেট, পাওয়ার হাউজ মোড়, ডাকবাংলা, শিববাড়ী, রয়েল মোড়, পিকচার প্যালেস, হেলাতলা মোড়। নিউমার্কেট থেকে দ্বীপ্ত ভাইয়াকে একটা আকাশী নীল রঙের শার্ট কিনে দিলাম। সে তো নেবেই না।
‘নিজে কামাই করে দিস। তখন নেবো’।
‘ওসব কথা শুনছি না। তোমাকে নিতেই হবে’।
নিতে তিনি বাধ্যই হলেন। আমাকে কথা শুনাতে পেরেছে এমন কেউ আছে নাকি পৃথিবীতে। বরাবরই আমি বেশী বুঝি। দুপুরে আমরা লাঞ্চ করলাম হোটেল ক্যাসল সালামে। বেশ সুন্দর একটা হোটেল। খাবারের মান ভালো। কিন্তু দাম বেশী রাখলো। অন্তত আমার পকেটের তুলনায় বেশী মনে হলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া কিছুতেই আমাকে বিল দিতে দিলো না। হেসে বললেন, ‘‘একটা সময় আসবে যখন দিল দিতে দিতে হয়রান হয়ে বলবি আমাকেই শুধু বিল দিতে হয় কেন!’’
বিকেলে আমরা দুজন রুপসা নদীর পাড়ে গিয়ে বসলাম। ফুরফুরে বাতাস বইছে দক্ষিন দিক থেকে। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন,
“ দক্ষিণা বাতাস। সুন্দরবনের গা ছুয়ে আসছে”।
“ হুম। এই বাতাসে আমি বাড়ির ঘ্রাণ খুঁজে পাই। আমার বাড়ি দক্ষিণ দিকে কিনা”।
‘শুভ্র’।
‘হুম’
‘বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগে না’?
‘ এই যা! বাড়ির কথা মনে করে দেবে না। বাড়ির কথা মনে হলে আমি থাকতে পারবো না। দেখা যাবে কালকেই বাড়ি চলে যাবো’।
‘তোদের বাড়ি আমার খুব যেতে ইচ্ছে করে। সহজ সরল মানুষে পূর্ণ একটি গ্রাম। জৌলুস নেই কিন্তু প্রাণপ্রাচুর্য্য আছে। ভালোবাসা আছে। মানুষে মানুষে সহানুভূতি আছে’।
‘যাবে। চল কালকেই যাই’।
‘নাহ। এবার থাক। পরে কোন এক তারিখ যাবো। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে ঢুকতে হবে’।
‘জলদি চাকরি নাও। তখন ইচ্ছেমত খাবো’।
‘পেটুক একটা। খাওয়া ছাড়া কিছুই বুঝিস না! বাছবিছার না খেলে এই চিকন কোমরে চর্বি জমে যাবে। স্থুল মেদবহুল শরীরে কি এই চাকচিক্য আর থাকবে! তখন সবাই মোটে ডাকবে মোটকু শুভ্র বলে’।
‘মোটকু হয়ে গেলে কি তুমি আমাকে আর ভালো বাসবে না?’
‘ আমি মোটেও তোর দৈহিক সৌন্দর্য্যকে ভালোবাসিনি। তুই এমন কি সুন্দর। ঢাকা শহরে তোর থেকে শত গুন সুন্দর ছেলে ঘুরে...’
‘ তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছ। সেই সুন্দর গুলোকে গিয়ে ভালোবাসো। খুলনা পর্যন্ত ছুটে এসেছো ক্যান?’
‘ কথা শেষ করতে দে গাধা! এত বেশী বুঝিস ক্যান তুই। সব কিছু আগে থেকে তোকে কে বুঝে নিতে বলেছে?’
‘ আমাকে পঁচাবে আর আমি কিছু বলবো না বুঝি?’
‘শোন আমি যেটা বলতে চাচ্ছিলাম। ঢাকা শহরে এত সুন্দর ছেলে আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই সমকামী আছে। কিন্তু আমি তাদের ভালোবাসিনি। আমি তোকে ভালোবেসেছি। কেন বেসেছি? কারণ তোর মনটাকে আমি ভালো বেসেছি। তোর সরলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তুই মুখ ফুঁটে কিছুই বলিস নাই কিন্তু তোর চোখের চাহনী আমাকে চুম্বকের মত করে টেনেছে নিরন্তর। তাই তো সেই জ্যোৎস্না রাতে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। সমকামীদের আমি অপছন্দ করতাম। ঘৃণাই করতাম বলা যায়। তাদেরকে মনে হত বিকৃত রুচির মানুষ। যে জিনিস আমি কখনো কল্পণা করিনি। যা আমার জীবনে কখনো ঘটতে পারে বলে আমার ধারণা ছিলো না সেটাই ঘটলো আমার জীবনে। এটাকে আমি জীবনের একটা দুর্ঘটনা বলে ভাবতে পারতাম। তোকে ভূলেও যেতে পারতাম। নতুন কাউকে খুঁজে নিতে পারতাম। কিন্তু কিছুই করিনি আমি। কেন করিনি। কারণ, তুই আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে ঢুকে গেছিস। তোকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। তোকে ছাড়া এক মুহূর্ত কল্পণা করতে পারি না। তুই তো এখন বাচ্চা আছিস। মনের সব কথা অকপটে বলে ফেলিস। কিন্তু আমি তা বলতে পারি না। আগে পরে অনেক কথাই ভাবতে হয় আমাকে। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারবো কিনা সেটাও ভাবতে হয়। তোকে আমি ভালোবাসি এটাই আমার কাছে ধ্রুব সত্য শুভ্র’।
আমি প্রতুত্তোর করার কিছুই পাইলাম না। চুপ করে বসে রইলাম। রূপসার ওপারে পশ্চিম আকাশে একটু একটু করে চাঁদ উঠতে শুরু করলো। সেই পুরোনো চাঁদ। হাজার বছর ধরে প্রতিসন্ধ্যায় যে চাঁদ চিরনতুনরূপে উদ্ভাসিত হয় সন্ধ্যাকাশে।
৩৪
বাসায় ফিরতে রাত দশটা বেজে গেলো। আদিত্য তার বিছানায় টনটন হয়ে শুয়ে আছে। জেগেই ছিলো। আমাদের দেখে হাসি মুখ বলল,
‘ কোথায় গেছিলেন ভাই?’
‘এই দ্বীপ্ত ভাইয়াকে খুলনা শহর ঘুরে দেখালাম। কোথায় ছিলে গতকাল। দেখিনি যে?’
‘বন্ধুর মেসে ছিলাম। আড্ডা দিতে দিতে রাত হয়ে গেলো। তাই আর ফিরিনি’।
‘বেশ’
‘শুভ্র ভাই। পাশের রুমের সবাই তো ফিরে এসেছে’।
‘আরে কোন ব্যাপার না। তুমি তোমার বিছানাতেই ঘুমাও। আমরা এই বিছানাতেই ঘুমাতে পারবো’।
আদিত্য নির্বিরোধী মানুষ। খুব বেশী প্যাঁচগোছ নাই। সে ঘুমিয়ে পড়লো। আর ভদ্রতা করে সে তার বিছানা ছেড়ে দিয়েছিলো এটাই তো অনেক কিছু। যদিও তার বিছানায় আমি কখনোই ঘুমাই নাই। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত শরীর। কোন মতে গোছল সেরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলেই বাঁচি।
দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছি। কিন্তু আজ কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না। আদিত্য শুয়ে আছে অন্যপাশের বিছানায়। হোক রুম অন্ধকার। হোক আদিত্য নিদ্রামগ্ন। তবুও তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি আমাদের আলাদা করে রাখলো। দুজন দুজনের হাত ধরে রাখলাম শুধু। হাতের এই বন্ধনের মাধ্যমে আমাদের মনের সব কথা সব উত্তাপ সব কামনা বিনিময় হতে লাগলো যেন। আমরা নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছি শুধু।
ঘুম ভাঙলো আদিত্যর ডাকে। তখনো আমরা হাত ধরে আছি। আদিত্য লক্ষ্য করার আগেই হাত সরিয়ে নিলাম। দীর্ঘক্ষণ চাপ লেগে থাকায় হাত অবশ অবশ লাগছে। একটু নড়াচড়া করতেই রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এলো। উঠে বসে লুঙ্গি ঠিক করে গিট দিতে দিতে বললাম,
‘কি ব্যাপার আদিত্য?’
সে লাজুক মুখে বলল, ‘একটা সুখবর আছে ভাই’।
আমি আঁচ করতে পারলাম, ‘ সুখবর মিষ্টি দিয়ে দিতে হয়। মিষ্টি কই?’
সে হাসতে হাসতে বলে, ‘মিষ্টি খাবেন’।
‘ তা ভাইস্তা হলো নাকি ভাইঝি?’
‘ছেলে’।
‘বেশ, তাহলে তো তোমার সুইস ব্যাংকে একাউন্ট খোলা হয়ে গেলো আদিত্য!’
দ্বীপ্ত ভাইয়া ঘুম চোখে বলল, ‘কে ছেলের বাবা হলো?’
আমি বললাম, ‘আদিত্য’।
বিস্ময়ে দ্বীপ্ত ভাইয়া হা হয়ে গেলেন, ‘এত টুকু ছেলে বাবা হয়ে গেলো! এটা কি ঠিক হয়েছে আদিত্য। তোমার আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হত’।
আদিত্য লজ্জা পায়। কথা বলে না।
আমি বললাম, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন তোমার উপদেশ আর কাজে লাগবে না’।
আদিত্যর দিকে ফিরে বললাম, “বাড়ি যাবে কবে?’
‘আজকেই চলে যাবো’।
‘বাব্বাহ! নতুন বাবার দেখি আর একদম তর সইছে না’।
‘টিউশনি বাড়িতে বলেই চলে যাবো। আমি তাহলে বেরিয়ে যাচ্ছি শুভ্র ভাই। দ্বীপ্ত ভাই দোয়া করবেন’।
‘সাবধানে যেও আদিত্য’।
আদিত্য বেরিয়ে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া টিনের চালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
‘এত মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছো দ্বীপ্ত?’
‘অবশেষে ভাইয়া টা কি উড়ে গেলো নাকি?’
‘না ওড়েনি। আবার ফিরে আসবে। তোমার নামের পিছনে ভাইয়া না লাগালে কেমন যেন ন্যাংটো ন্যাংটো লাগে। দ্বীপ্ত ভাইয়াই বেটার। এবার বলো কি ভাবছো’।
‘কিছুই ভাবছি না। টিনের চালের সৌন্দর্য্য দেখছি’।
‘কথা ঘুরিয়ো না’।
‘কথা কি সাইকেলের চাকা যে ঘুরাবো?’
‘খালি পাকা পাকা কথা। যেহেতু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে বলতেই হবে’।
‘সব ব্যাপারে এত জোর করা ঠিক না শুভ্র’।
‘তোমার আমার মাঝে অজানা অব্যক্ত কিছু কি থাকা উচিত?’
‘ওকে বলছি। মুখ বাড়িয়ে শুধু চড় খেতে চাও। ভাবছিলাম আমাদের এই ভালোবাসার পরিণতি কি? আমাদের গন্তব্য কোথায়? আমরা যদি সারাজীবন এক সাথে থাকি তবে কখনোই আমরা আদিত্যের মত বাবা হতে পারবো না। কোন ফুঁটফুটে শিশু ছুটে এসে বাবা বলে আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়বে না। আমি তাকে কাঁধে নিয়ে কোন বৈশাখী মেলায় যেতে পারবো না, ঈদের মাঠে যেতে পারবো না!’
সত্যি কেউ যেন সপাটে আমার গালে চড় মারলো। আমি কথা খুঁজে পেলাম না। দীর্ঘসময় পরে বললাম, ‘এসব এখন ভাবছো কেন? আরো আগে ভাবা উচিত ছিলো তোমার’।
‘আগে কখনো এসব মাথায় আসে নাই। আর আমি সিরিয়াসলি কিছু ভাবছি না’।
‘কিছু কিছু জিনিস সিরিয়াসলি ভাবতে হয়, সব কিছু নিয়ে হেয়ালি করা ঠিক না দ্বীপ্ত ভাইয়া!’
‘রাগ করো না। আমাকে মাপ করে দাও। আমি এরকম কিছুই ভাবছি না। হঠাৎ চিন্তাটা মাথায় এলো। আর তুমি জোর করে কথা বের করে নিলে। এরকম রিয়াক্ট করবে জানলে কিন্তু বলতাম না। কিছুতেই না’।
‘আমি ভয় পাচ্ছি দ্বীপ্ত ভাইয়া’।
‘কিসের ভয়?’
‘পরিস্থিতির ভয়’।
‘কিসের পরিস্থিই?’
‘পরিস্থিতি তোমাকে খুব দ্রুত বদলে দেবে’।
‘পাগল ছেলে। এসব বাদ দাওতো আজ যাওয়ার দিনে। কাছে আসো।’
‘ছাড়ো তো’।
‘ছাড়ো তো বললেই হচ্ছে। কাল একটা রাত ব্যর্থ হলো। আরেকবার ফরজ গোছল না করে আমি যাচ্ছি না’।
‘আরে ছাড়ো। দরজা খোলা’।
‘থাক দরজা খোলা। দেখুক সবাই’।
‘মাথা ঠিক আছে তোমার?’
‘না নেই। তোমার স্পর্ষ আমাকে পাগল করে দেয়’
‘দাঁড়াও দরজা দিয়ে আসি’।
দরজার ছিটকিনি আটকে দিলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখের চাহনীতে আমার সব রাগ গলে পানি হয়ে ঝরে গেলো।
‘কি দেখো এমন করে?’
‘রিস্কমুক্ত ভালোবাসা নেই। রিস্ক নিয়েই ভালোবাসতে হয়। সব সময় হারানোর ভয় থাকলে তুমি ভালোবাসার আসল মজাটাই উপভোগ করতে পারবেনা শুভ্র। এবং আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি’।
৩৫
মেস থেকে দুই মিনিটের পথ পেরিয়ে তিনদোকানের মোড়। এটুকু পথ ইট বিছানো। আমরা চুপচাপ হাঁটছি দুজন। বিদ্যুতের তারে বসে একঝাঁক কাক কাঁ কাঁ করে অস্থির করে তুলেছে। অনেকে মনে করেন কোকিল গানের পাখি। কিন্তু মূলত গানের পাখি হচ্ছে কাক। যেসব পাখির স্বরথলি থাকে তাদেরকে গানের পাখি বলা হয়। কোকিলের কুহুকুহু ডাক সুমধুর হলেও তার স্বরথলি নেই। অন্যদিকে কর্কশ কন্ঠের কাকের গলায় আছে স্বরথলি। ছোটবেলা থেকে আমরা জেনে এসেছি কোকিল গানের পাখি। তাই হঠাৎ করে কাকের বিষয়টা মেনে নেয়া কষ্টকর হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে ছোট বেলা থেকে গড়ে ওঠা বিশ্বাসের কারণে বড় হয়ে আমরা তার বিপরীত কিছু মেনে নিতে পারি না। ছোট বেলা থেকে আমাদের শেখানো হয় সমকামিতা পাপ, ঘৃণার বিষয়, তারা শুধু দেহের টানে অন্য পুরুষের সাথে উপগত হয়। তাই বড় হয়ে অধিকাংশ বিষমকামী সমকামীদের ঘৃণা করে। কিন্তু একবারও ভেবে দেখে না অথবা দেখার চেষ্টাই করে না যে কেন একজন পুরুষ হয়েও অন্য পুরুষের বাহুলগ্ন হয়, তাকে ভালোবাসে!
মোড়ে যেতেই একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। রিকশার পাশে লুঙ্গি পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ডেকে বললাম, ‘মামা যাবে?’
লোকটা আমাদের দিকে ফিরে হেসে ফেললো। সহাস্যে বলল, ‘আমাকে দেখে কি রিকশাওয়ালা মনে হয়!’
আমিও লজ্জা পেলাম। লোকটাকে বারদুয়েক দেখেছি। আজ মন কিছুটা বিষন্ন। সেভাবে লক্ষ্য করিনি। লোকটার হাতে ব্রাশ। দাঁত ব্রাশ করতে করতে হাটতে হাঁটতে মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘স্যরি’।
‘স্যরি বলার কিচ্ছু নেই। ঠিক আছে’।
রিকশাওয়ালা রিকশা রেখে একটু দূরে সরে গিয়ে ড্রেনের পাশে বসে তার ব্লাডার খালি করছিলো। জলবিয়োজন শেষে সে লুঙ্গিতে গিট দিতে দিতে এগিয়ে এলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মামু কই যাবেন?’
‘দৌলতপুর বাস স্ট্যান্ড’।
‘চলেন’।
‘ভাড়া কত?’
‘ভাড়া কওন লাগে নাকি! যা ভাড়া তাই দিবেন’।
‘তোমাদের তো আগে থেকে ভাড়া বেশী না দিলে পরে বেশী চাও’।
‘আরে মামু কি যে কন না। ওরকম কাম আমি করি নে’।
রিকশায় উঠে বসলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া এতক্ষণ একটা কথা বলেনি। দুর্বলভাবে আমাকে ডাকল, ‘শুভ্র’।
‘হুম’।
‘যাওয়ার সময় এত মন ভার করে আছো কেন! আমার বুঝি খারাপ লাগে না!’
আমি হাসার চেষ্টা করলাম। জানিনা সেই হাসি করুন দেখালো কিনা।
‘আরেকটা দিন থেকে গেলে পারতে’।
‘এভাবে আরেকটা দিন আরেকটা দিন করলে তো দিন বেড়ে যাবে। একসময় তো আমাকে যেতেই হবে। তাছাড়া মাস্টার্স পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিছে। পরীক্ষার কিছু নোটস এখনো জোগাড় করা হয় নাই।’
‘আবার কবে আসবে?’
‘খুব দ্রুতই আসবো। পরীক্ষা দিয়েই চাকরিতে ঢুকবো। তখন পকেটে টাকা হবে। তোমাকে সাথে নিয়ে কক্সবাজারে হানিমুনে যাবো। দুজন হাতে হাত ধরে বেলাভূমে ঘুরবো। একই রকম পোষাক পরবো যাতে সবাই বুঝতে পারে আমরা লাভ বার্ড’।
‘তাতে কি লাভ হবে?’
‘সব কিছু কি লাভ লসের চিন্তা করে হয়!’
মোল্লার মোড় পার হবার সময়ে রাশেদের সাথে দেখা। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে শুভ্র? কোন খবর নেই কেন? আজ কয়েকদিন কলেজে আসিস না? শরীর খারাপ? কোথায় যাচ্ছিস?’
এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে গেলো রাশেদ। রিকশা টান দিয়েছে। আমি বললাম, ‘ বিকেলে মেসে আসিস। কথা আছে।’
দ্বীপ্ত ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ক্লাসমেট?’
‘হুম।’
‘রাশেদ?’
‘হুম’।
‘আচ্ছা রাশেদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলে না কেন?’
‘ইচ্ছে হয় নাই। সে ফ্রেন্ড মানুষ। কি থেকে আবার কিসে বুঝে ফেলে। ও আবার খুব গল্পবাজ মানুষ। আন্তরিকতাও বেশী। দেখা যাবে তুমি আমার ভাইয়ার ফ্রেন্ড জানার পর তোমাকেও সে ভাইয়ের মত রেসপেক্ট করা শুরু করেছে। সংগ দেয়ার জন্য বিকেলে এসে বসে থাকত। তখন তো আর আমরা ফ্রি হতে পারতাম না’।
‘বেশ’।
দৌলতপুর বাস স্ট্যান্ড এসে নামলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়ার বাস দশটা পয়তাল্লিশে। সাড়ে দশটা বাজে। পনেরো মিনিটের মত বাকি আছে। সোনাডাংগা থেকে বাস ছেড়ে আসবে। হানিফ কাউন্টারে ব্যাগ রেখে আমরা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আবার কবে দেখবো এই মন ভূলানো চোখ
দ্বীপ্ত ভাইয়া হাত দিয়ে আমার চোখের জল মুছে দিলো।
‘পাগল ছেলে! আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো’।
তারা কোন কথায় যেন প্রবোধ মানতে পারছিলাম না। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে আসছিলো।
বাস এলো। সুপারভাইজার প্যাসেঞ্জারদের তাড়া দিচ্ছে বাসে ওঠার। দ্বীপ্ত ভাইয়া আমাকে শেষ আলিংগন করে বাসে উঠলো। তার সিট পড়েছে সি১ এ। জানালা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের কোনায় জল চিকচিক করছে। সে চোখ নামিয়ে মুছে নিলো। এখানে বাস বেশীক্ষণ দাঁড়ায় না। বাস চলতে শুরু করলো। আমিও বাসের সাথে হাঁটা শুরু করলাম। যতক্ষণ তাকে দেখা যায় দেখার চেষ্টা করলাম। একসময় বাস জোরে টান দিলো। আমি থেমে গেলাম। হোটেল বোরাকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাসটা এক সময় চোখের আড়াল হয়ে গেলো। আমার খুব কান্না পেলো। কান্নার বেগ সামলাতে না পেরে আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। ফুটপাতে বসে পড়লাম। কয়েকজন সহমর্মী ছুটে এলো।
‘কি হয়েছে? আপনি ঠিক তো?’
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। কাঁপছি আর ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছি। একজন আমার মাথায় একটু পানি দিয়ে দিলো। কিছুটা স্থির বোধ করছি আমি। বৃদ্ধ মত একজন লোক বলছে , ‘যা গরম পড়েছে এবার। গরমে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। এই অল্প বয়সে মাথা চক্কর দেয়া ভালো না। বাড়ি গিয়ে ভালো মত খাওয়া দাওয়া করবা’।
আমাকে ঘিরে ভীড় জমে গেছে। লজ্জা লাগছে। একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলাম। মেসে ফিরে দরজা জালানা বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। এখানে আমার চোখের জল দেখার কেউ নেই। এখানে আমি ইচ্ছেমত কাঁদতে পারি। কত শত সমকামীর চোখের জল যে নিরবে নিভৃতে ঝরে যায় তার খবর কেউ রাখে না।
৩৬
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙলো। দরজা খুলে দেখি রাশেদ দাঁড়িয়ে আছে।
‘কিরে? সেই কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছি। এই ভর সন্ধ্যায় মরার মত ঘুমাচ্ছিস কেন? লাইট জ্বালা’।
সুইচ টিপে লাইট জ্বালালাম। এখনো সন্ধ্যা হয়নি। ৫ টা ৪৫ বাজে। মাগরিবের আজান দেবে ৬টা ২৫ মিনিটে। আমি রাশেদকে বললাম, ‘তুই বোস। আমি ঝটপট একটা গোছল দিয়ে আসি’।
‘তোর কি শরীর খারাপ?’
‘না। কেন?’
‘মন খারাপ? কি হয়েছে?’
‘আরে মন খারাপ না’।
‘দুপুরে ভাত খাস নাই কেন’
‘ভাত খাই নাই তোকে কে বললো!’
‘শুভ্র! মিথ্যা বলিস না। মিথ্যা বললে সেটা তোর মুখে ফুঁটে ওঠে’।
‘বেশ! আজকাল শার্লক হোমস হয়েছিস। মুখ দেখে ঘটনা বলতে পারিস’।
‘তোর অভূক্ত দশা জানতে আমাকে শার্লক হোমস হতে হয় নাই। আসার সময় দেখলাম তোর দরজার সামনে থেকে বুয়া দুপুরের খাবার ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। আমি জিজ্ঞেস করাতে জানালো দুপুরে তোর দরজায় নক করেছিলো। কিন্তু তুই দরজা খুলিস নাই বলে বারান্দার রেখে গিয়েছিলো। বিকেলে রান্না করতে এসে দেখে খাবারের গামলা সেভাবেই আছে। তাই জিজ্ঞেস করছি’।
‘আরে বলিস না। প্রচন্ড ঘুম পেয়েছিলো। আমি গোছল দিয়ে আসছি। বাইরে গিয়ে নাস্তা করবো।’
কলের শীতল পানি দিয়ে গোছল করতে খুব ভালো লাগছে। আমি কয়েক বালতি পানি ঢেলে দিলাম মাথায়। দিদি একবার জিজ্ঞেস করে গেলো, ‘এই অবেলায় গোছল করছো কেন?’ দিদি জ অনেক ব্যস্ত। জামাইবাবু এসেছে। প্রথম প্রথম জামাইবাবুকে ভালো মানুষ মনে হত। কিন্তু সে একটা মহা খচ্চর লোক। এই বয়সে সেই দিদিকে যখন তখন গায়ে হাত তোলে। মেসে ছেলেদের সাথে কথা বলার জন্য কটু কাতক্তি করে। দিদি কাঁদে আর বলে, ‘আমার নাকি চরিত্র খারাপ তাই মেসের ছেলেদের সাথে কথা বলি। আমার মধ্যে খারাপ কিছু দেখেছ তুমি?’
রাশেদ। আমার কলেজের একমাত্র বন্ধু। বেস্ট ফ্রেন্ড বলা যায়। ক্লাসের বাকি সবাই আমার সহপাঠী, বন্ধু এই একজনই। ওর সাথে আমার পরিচয় এক বৃষ্টি ভেজা দিনে। কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম মাসে। দুইটায় যথারীতি কলেজ ছুটি হয়ে গেলো। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। যাদের ছাতা আছে তারা ছাতা মেলে চলে যাচ্ছে। যারা ছাতা আনেনি তারা শেডের নিচে দাঁড়িয়ে অসময়ের বৃষ্টিকে শাপশাপান্ত করতে লাগলো। আমি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখলাম। আমার কাছে ছাতা আছে। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে আমি হাঁটা শুরু করেছি। হঠাৎ পেছন থেকে একটা ছেলে এসে গলা জড়িয়ে ধরলো।
‘আমি কি তোমার ছাতার ভেতরে যেতে পারি’।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই’।
‘বি গ্রুপে?’
‘হ্যাঁ’।
‘আমিও বি গ্রুপে’
‘তাই। আমি শুভ্র’।
‘আমি রাশেদ। তোমাকে আজ কয়েকদিন ক্লাসে দেখছি’।
‘দেখেছ? তাহলে বি গ্রুপে কিনা জিজ্ঞেস করলে কেন?’
‘আসলে কথা শুরু করার চেষ্টা করছিলাম’।
আমি ছেলেটার সরল স্বীকারোক্তিতে হেসে ফেললাম। শ্যামবর্ণ চেহারা। ছোট খাট চেহারা। চোখে চশমা। ঠোটের উপর একটা ব্রণ পেকে আছে। ছেলেটা বলে উঠল, ‘তুমি কি আমার বন্ধু হবে’।
‘হবো’।
বলে কয়ে বন্ধুত্ব হয় না। কিন্তু আস্তে আস্তে রাশেদ আমার বন্ধু হয়ে উঠলো। আমরা খুব ভালো বন্ধু। একজন আরেকজনের কাছে সব কিছু শেয়ার করি শুধু একটা বিষয় ছাড়া। আমি কখনো আমার ভালোবাসার কথাটি রাশেদকে জানানোর সাহস করিনি। রাশেদ একদিন অবলীলায় বলেছিলো ওর ছোট কালে এক পরিচিত আংকেল তার পুরুষাঙ্গ ধরতে বলেছিলো। সে ঘৃণায় সেখান থেকে চএল এসেছিলো।
রাশেদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে সবুজ সংঘ মাঠের দিকে চলে এলাম। রাশেদ যখন কোন গল্প করে খুব সিরিয়াসলি করে। শ্রোতা তার গল্প শুনছে কিনা সেদিকে তার কোন লক্ষ্য থাকে না। সে নিজের গল্পে ডুবে থাকে।
চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি। সারাদিনের অভূক্ত অবস্থার পরে এক কাপ চা পরম তৃপ্তি দিলো। মাঠে এক দল ছেলে মিনি ফুটবল খেলছে। এদিকের গোলকিপার ছেলেটা অনেক মোটা। নিজের হাত পেছনে আটকে রাখতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। একজন দড়ি দিয়ে তার হাতের কবজি পেছনের দিকে বেঁধে দিলো। মাঠের উল্টদিকের নারিকেল গাছের মাথায় সূর্য ডুবে গেলো। শহরে সূর্য তার থেকে নিচে নামতে পারে না। নামার আগেই বিল্ডিংয়ের আড়ালে হারিয়ে যায়।
এই পথের শেষ কোথায়? গল্প উপন্যাসে, নাটক সিনেমায় অধিকাংশ কাহিনীর শেষ হয়। হোক সেটা মধুরেণ সমাপয়েৎ অথবা ট্রাজিডি। কিন্তু জীবনের গল্প এত সহজে শেষ হয় না। নানা ঘটনার মাধ্যমে ডালপালা বিস্তার করে।
৩৭
৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৪। ঢাকা বিমান বন্দর।
সন্ধ্যা ৭ টা ৪৩ বাজে। দীর্ঘক্ষণ বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে হাঁটাহাটি করছি। এমনি সময়ে সাউন্ডবক্সে নারীকন্ঠের সুললিত কন্ঠস্বর আমার বুকের কাঁপন বাঁড়িয়ে দিলো। আমি কোথাও যাচ্ছি না। যাওয়ার খুব বেশী জায়গা আমার নেই। বিশাল এই পৃথিবী আমার জন্য ছোট হয়ে গেছে কেমন করে তা আমি নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আজ দীপ্ত ভাইয়া আসছেন। সুদীপ্ত ভাইয়া! ফেসবুকে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। সপরিবারে মেলবোর্ন থেকে ঊড়ে এলেন তিনি। আমি যাত্রী বহির্গমন পথের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বামহাত বুকের উপর একবার বুলিয়ে নিলাম। হার্টবিটটাকে পারলে চেপে ধরে থামাতাম। লাগেজ ঠেলে এগিয়ে আসছেন দীপ্ত ভাইয়া। পেছনে ভাবী। ফুটফুটে বাচ্চার হাত ধরে হাটছেন ভাইয়ার পিছে। অনেক দিন পরে দীপ্ত ভাইয়ের সাথে দেখা। দশ পনের বছর পরে দেখা হচ্ছে। কিছুটা মুটিয়ে গেছেন। বয়সের ছাপ কিছুটা পড়েছে কিন্তু চেহারা সেই আগের মতই আছে। সেই চোখ, চিরচেনা চোখ, যে চোখে ভাইয়া দেখিয়েছিলেন অন্য এক জগত।
আশপাশে অনেক মানুষ। সবাই এসেছে অভ্যাগতদের রিসিভ করতে। কারো ছেলে, কারো স্বামী। সবার চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দের ঢেউ। আবার অনেকেই এসেছে অফিশিয়ালি রিসিভ করতে। তাদের হাতে প্লাকার্ড। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার প্লাকার্ড হাতে কিছুটা নার্ভাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ব্লেক নামের কাউকে রিসিভ করতে এসেছে। কিছু দূরে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক গোছা রজনীগন্ধা। বয়স ছাব্বিস সাতাশ এর কাছাকাছি। ফুলটুল আমার কিছু একটা আনা উচিত কিনা এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। দেখা যায় ছোট খাট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়।
দীপ্ত ভাইয়া আমার সামনে এসে গেছে কখন আমি টেরই পাইনি। কেমন আছিস? সেই চেনা কন্ঠস্বর। ফোনে শুনেছি। কিন্তু আজ সরাসরি শোনার পর বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠলো। কিছু একটা বুকের ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে উঠে গলায় এসে বেঁধে গেলো। ইচ্ছে করছিলো দ্বীপ্ত ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু অচেনা একটা লজ্জা আমাকে অনড় করে দিলো। আমি বোবা চাহনীতে সেই চেনা চোখের দিকে তাকালাম। লাগেজটা পাশে সরিয়ে রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই চেনা আলিঙ্গন। কিন্তু ভাবীর সামনে আমার আড়ষ্ঠ ভাব কিছুতেই কাটছিলো না। শুধু মনে হচ্ছিলো আমার শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে নাতো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে যে ঘামার সুযোগ ছিলো না সেটা কিন্তু মাথায় আসছে না।
কোলাকুলি সেরে দীপ্ত ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস? মাথা নেড়ে জানালাম, ভালো আছি।
-চশমা নিয়েছিস কবে? মাথার চুলগুলো কোথায়? সামনে এত ফাঁকা কেন? হেয়ার ট্রিটমেন্ট করাস না? বাড়ীর খবর কি? সজল এর কি খবর?
একরাশ প্রশ্ন করে গেলেন। যদিও এর অধিকাংশ উত্তর তিনি জানেন। ফেসবুকের এই যুগে আমরা অনেক দূরে থেকেও কাছে থাকি। আবার কাছের মানুষ থেকে দূরে থাকি নিজের অজান্তে। ফেসবুক যেমন দেয় তেমনি অনেক কিছু কেড়ে নেয়। ভাইয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই ভাবী মুখ খুললেন।
- মাস্টার মশাই , এখানে তোমার ভাইয়ার সাথে আরো অনেকেই আছে। আমাদের দিকে একটু তাকান প্লিজ।
ভাবীকে ছবিতে দেখেছি। দীপ্ত ভাইয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি যাইনি। সংগত কারনেই যাইনি। ভাবীকে এই প্রথম দেখলাম। ছবির থেকেও ভাবী অনেক সুন্দরী। এই বয়সে বাঙালী বধুরা মুটিয়ে যায়। মনে হয় একটা মাংসের স্তুপ। দুই বাঘে খেয়ে শেষ করতে পারবে না। মনে হচ্ছে ভাবী বেশ ফিগার সচেতন। ভাবীর কন্ঠস্বরে আন্তরিকতা মিশে আছে। খুব সহজেই ভাবীর সাথে ফ্রি হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম ভাবীর সাথে আমি সেভাবে কথা বলতে পারবো না।
৩৮
আমার নিজের গাড়ী নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি করে গাড়ি কেনার সামর্থ্য এখনো হয়ে ওঠে নাই। লেকচারার হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি বছর দুয়েক। দীপ্ত ভাইয়া শোনার পর প্রথম দিন থেকেই আমাকে মাস্টার মশাই বলে ডাকা শুরু করেছেন। এখনো তাই ডাকেন।
ক্যাবে ভাইয়া আর ভাবী বসেছে পেছনে। আমি সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে। আমার কোলে দীপ্ত ভাইয়ার রাজপুত্র। অক্ষর, দীপ্ত ভাইয়ার ছেলের নাম। আমার গলা জড়িয়ে ধরে বসে রাজ্যের প্রশ্ন করে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলার চর্চা কতটা হয় আমার জানা নেই। তবে অক্ষরের মুখে বাংলার আধো টানটা কানে বেশ মধুর লাগছে। তার বাংলা উচ্চারণ ঝরঝরে কিন্তু ভোকাবুলারি অত সমৃদ্ধ নয়। প্রতি সেন্টেন্সে ইংরেজী অক্ষরের ছড়াছড়ি। আমি তার কচি মুখের দিকে অপলকে চেয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষন।
ভিউ গ্লাসে দেখলাম ভাবীও ঢাকা শহর দেখায় ব্যাস্ত। অনেক দিন পরে এসেছেন। অনেক কিছুই বদলে গেছে। তাই চেনা ঢাকাকে নতুন করে চেনার চেষ্টা করছেন। দীপ্ত ভাইয়ার চোখ ড্রাইভারের উপরের গ্লাসে। এভাবে কেন তাকাও দীপ্ত ভাইয়া! সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। এই ঢাকার মহাসড়কের উপর দিয়ে পার হয়ে গেছে হাজারো মানুষ, হাজারো সব গল্প। ভাবী বেশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ঢাকার অনেক কিছুই চেঞ্জ হয়ে গেছে। পুরো রাস্তাটাই অচেনা লাগছে। কিন্তু জ্যামটা চেঞ্জ হলো না। সেই আগের মত রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা। তোমার ফ্লাটে পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে মাস্টার। শীতের এই সন্ধ্যায় ঢাকার বুকে আজ হালকা উত্তাপ। আমার বুকের উত্তাপ কি আজ বাতাসের শরীরে গিয়ে মিশলো।
- আর বেশীক্ষণ না। আধাঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো। বোরিং লাগছে খুব?
- আধা ঘন্টা! ভ্যাপসা গরম ভাব লাগছে। ড্রাইভার এসি টা একটু বাড়িয়ে দাও ভাই। অনেক দিন পর এলাম তো।
দীপ্ত ভাইয়া শিস দিতে দিতে বললেন, কণা এত অস্থির হচ্ছো কেন? হাতে আমাদের অনেক সময়। পুরো একমাস এবার দেশে থাকবো আমরা। দেশে এসেছি। দেশের বাতাস টা একটু উপভোগ করতে দাও। পুরোনো সেই উত্তাপ। পুরাতন সেই আবেগ একটু চেখে দেখি।
গুনগুনিয়ে একটা সুর ভাঁজা শুরু করলেন, পুরোনো সেই দিনের কথা ভূলবি কিরে হায়!
হায়! রবীন্দ্রনাথ, অস্থির কিছু গান লিখে গেছো তুমি। আমার মনের সব কথা তুমি যেন আগে থেকেই পড়ে রেখেছিলে। আমার সব কথা খুঁজে পাই তোমার গানে। পুরোনো দিনের কথা আমি ভূলতে পারিনি কখনো। পুরোনো দিনের কথা গুলো প্রাণের ব্যাথাগুলো সন্তানের মত লালন করি নিজের মাঝে।
৩৯
আমি দুই রুমের ছোট্ট একটা ফ্লাট নিয়ে থাকি। এক রুমেই চলে যায়। বাকী রুমটা পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে ভাবি সাবলেট দিয়ে দেবো। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে নি। আমি নিজে মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু ফ্লাটটাকে পরিষ্কার রাখা হয়ে ওঠে না। ভাইয়া ভাবী রুমে ফ্রেশ হচ্ছে। আমি এরই মাঝে চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে দিলাম। অনেকক্ষণ চা খাওয়া হয় না। আমার নিজেরও চা খাওয়া হয় না। আমি মোটামুটি নিজের রান্না করতে পারি। একদম খেয়াল ছিলো না তাদের আসার সাথে সাথে খাবার দিতে হবে। এই বেলা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে আসি। বেরোতে যাবো এই সময়ে ভাবী এসে হাজির । কাপ ধুয়ে চা ঢেলে নিলেন।
- মাস্টার কোথায় যাও?
- এই তো ভাবী কিছু খাবার নিয়ে আসি।
- দেশে এসে দোকানের খাবার খাবো? এইটা কি বলো মাস্টার! ফ্রিজে বাজার করা না।
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ভাবী তখনি কোমরে কাপড় জড়িয়ে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেলেন।
- এত দূরের পথ জার্নি করে এসেছেন ভাবী। এখন থাক। খেয়েই দেখেন না ঢাকার রেস্টুরেন্টের খাবার।
- আরে রাখো তো তোমার জার্নি। এখন আর জার্নিকে জার্নি মনে হয় না। তুমি এসে আমাকে দেখিয়ে দাও কোথায় কি রাখো।
প্রেশার কুকারে মাংস চড়িয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, মাস্টার বিয়ে করছো কবে? মাথার অবস্থা তো খারাপ। পুরোপুরি স্টেডিয়াম হয়ে গেলে তো মেয়ে পাবে না। মেয়ে দেখবো?
আমি কিছু বলার আগে দীপ্ত ভাইয়ার অট্টহাসির শব্দ পেলাম। তাকে একটু আগে চা দিয়ে এসেছি। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ঢেকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভাঙ্গে, তেমনি বাঙালী অবিবাহিত পাত্র পাত্রী পেলে বিনে পয়সায় ঘটকালী করে। মেলবোর্ণে তোর ভাবীকে সবাই ঘটক পাখি ভাবী বলে ডাকে। তিনি স্বেচ্ছাশ্রমে বেশ কয়েক যুগলের বিবাহ দিয়েছেন। ভাবী ভাইয়ার উপর কপট রাগ ঝাড়লেন। আজ অনেক দিন পর আমার ছোট্ট কিচেন গল্পে সরগরম হয়ে উঠলো। ছোট বেলায় এরকম হত। তখন আমাদের বাড়ীতে মাটির চুলায় রান্না হত। শীতকালে রান্না ঘরের সামনের উঠানে চুলা পাতা হত। সেখানে ধানের খড় দিয়ে রান্না চাপাতো মা। বাড়ি মামা খালা নানী ফুফুদের কেউ এলে চুলায় পিঠে বসে রাজ্যের সব গল্প হত।
ভাবী রান্না শেষ করে ঘরে গেলেন। দীপ্ত ভাইয়া বললেন, শার্টটা তোর কাছে আজো আছে? আমি আমার গায়ের শার্টটার দিকে তাকালাম। ভেবেছিলাম দীপ্ত ভাইয়া চিনতে পারবে না। আকাশ নীল বর্ণের এই শার্ট। আজ বহুবছর পরে আমি পরেছি।
৪০
দরজায় করাঘাতের শব্দ সেই সাথে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো, ছোড ভাই , বেহান বেলা আর কত ঘুমাবে। ওঢো।
আমি ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না, কে আমাকে ডাকছে। মা ফুফুর গলা তো এরকম না। শেষ রাতের দিকে বোধহয় ঘুমিয়ে গেছিলাম। দুচোখ ঘুমে বুজে আসছে। ঘুম জড়ানো স্বরেই জিজ্ঞেস করলাম , কে ?
ওপাশ থেকে খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ ভেসে এলো। "বেশ মানুষ তো তুমি! গত রাতে সাথে করে আনলে আর এখন চিনতেই পারছো না। "
আমি এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারি নাই। বহুকালের অভ্যেষবশত রহীমের খাটের দিকে তাকালাম। রহিমের খাট কোথায়? খাটের বদলে সেখানে একটা টেবিল। টেবিলের উপর একরাশ বই পত্র ঝাঁপ মেরে রাখা। এবার সব ঝাপসা পরিষ্কার হয়ে এলো। শালিক খালী, সুন্দরবন সব স্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছিলো গত রাতে। বহু বহুকাল পরে।
আমি ধরমড় করে উঠে বসলাম। চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলে দিলাম। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কনা ভাবি। হাতে চায়ের কাপ। হাসি মুখে বললেন, টিকটিকির ছোট ভাইটিও দেখি ঘুমে কম যায় না। চা তো ঠান্ডা হয়ে গেলো। দেখতো খাওয়া যায় কিনা?
আমি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিলাম। বহুদিন পর ঘুম থেকে উঠে এভাবে বেড টি খাওয়া হয় না। একাকি জীবনে সব নিজেকেই করতে হয়। ঘুম থেকে উঠে চা বানাতে বানাতে আর বেড টি খাওয়ার মুড থাকে না।
চা ভালো হয়েছে। ফার্স্ট ক্লাস চা।
- চিনি ঠিক আছে। তিন চামচ চিনি।
- জি। তিন চামচ চিনি খাই এটা কিভাবে জানলেন ?
- গতকালকেই লক্ষ্য করেছি । চিনি বেশী খাও। এত মিষ্টি খাওয়া ভালো না রক্তে সুগার বেড়ে যাবে।
আমি হাসি দিলাম। একাকি এই জীবন শুধু অর্থহীন ভাবে টেনে নেয়া। তাতে চিনি বাড়লেই বা কি আর কমলেই কি ! মজা করে বললাম, বেশী চিনি খাই যাতে ব্যবহার মিষ্টি হয়। এমনিতেই বন্ধুরা সবাই বলে আমি রগচটা। হঠাৎ করে রেগে যাই।
ঘরে ছড়ানো ছিটানো বইয়ের দিকে তাকিয়ে কনা ভাবি বললেন, ঘরের এই হাল কেন ? সাপ খোপ বাসা বাঁধে নাই তো ওই বইয়ের দঙ্গলে ? জলদি বিয়ে করো। বউমা এসে সব জঞ্জাল দুর করে দিক।
আবার বিয়ের কথা। এই বিষয়ে উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। কিন্তু আজ আর উত্তর দেয়া লাগলো না। অক্ষর তার ছোট পা ফেলে দৌঁড়ে এলো।
- চাচ্চু কোলে নাও। কোলে উঠবো।
কোলে নিয়ে তার তুলতুলে গালে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বললাম, কি ব্যাপার্। এতো সকালে আমার ছোট আব্বু এত ফিটফাট কেন?
- চাচ্চু, ইউ ফরগট? আজ মর্নিং এ না আমরা ওল্ড বাংলার ক্যাপিটাল দেখতে যাবো।
- স্যরি আংকেল। একদম মনে ছিলো না। আমি পাঁচ মিনিটেই গুছিয়ে নিচ্ছি।
ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা ভাবী এত জায়গা থাকতে সোঁনারগাঁয়ে কেন। সেখানে তো দেখার মত কিছু নেই।
- আসলে তোমার ভাইয়া সবসময় অক্ষরের কাছে দেশের গল্প করে। প্রাচীন বাংলার গল্প এত করেছে যে ছেলের ধারণা সোনারগাঁ অনেক সুন্দর একটা জায়গা। তাকে দেশে আশার আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম , দেশে গিয়ে প্রথম কোন জায়গা দেখতে যাবে। সে সোনারগাঁয় যাবে বললো। আমরাও রাজী হয়ে গেলাম। যদিও আরো অনেক প্লান আছে।
- ওকে ভাবী আমি পাঁচ মিনিটেই রেডি হয়ে আসছি। শেষে দেখো তুমি লেট করিয়ে দেবে।
- মেয়েদের সম্পর্কে ভালই অভিজ্ঞতা আছে দেখছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৬ রাত ৯:২২