somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমুদ্র বিলাস

১৮ ই মে, ২০১৬ রাত ৯:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সমুদ্র পুত্রদের আমি খুব হিংসে করি। কারণ সাগর আমার অসম্ভব প্রিয় একটি জায়গা। বান্দরবান থেকে যখন বিকেলের পুরোটা সময় লক্কড়ঝক্কড় গাড়িতে চেপে সমুদ্র শহরে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা সাতটার কাঁটা ছুঁয়ে গেছে। বাস থেকে নামতেই সিএঞ্জি চালকেরা জোঁকের মত ছেঁকে ধরলো। আমি বন্ধুকে বললাম, এসব বাদ। ব্লাডারে প্রচন্ড চাপ বোধ করছি সেই তখন থেকে। এমনিতে বৃষ্টিদিনে সাগরে এবং শরীরে উভয় স্থানে নিম্নচাপ একটু বেশীই থাকে। তাই আমাদের প্রথম মিশন সার্চিং টয়লেট। ব্লাডারে প্রশান্তি ফিরিয়ে এনে দাঁড়িয়ে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। এমন সময়ে সালাম পেলাম। আসসালামু আলাইকুম স্যার। এরকম সালাম আমি শুধু আমার অফিসের গন্ডিতেই পেতে অভ্যস্ত। সালামের জবাব দিয়ে মুখে অদৃশ্য প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকিয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, হোটেলে যাবেন স্যার?
- সে তো যাবোই।
- বুক করা আছে নাকি এখন বুক করবেন।
- না বুক করা নেই।
- ভালো হোটেল আছে। যাবেন?
- দেখো ভাই। এসবের দরকার নেই। এখন পর্যটন মৌসুম না। প্রচুর হোটেল ফাঁকা পাওয়া যাবে। আমাদের ঘোরাঘুরি করার অভ্যেষ আছে। নিজেরাই খুঁজে নিতে পারবো। তুমি শহরে যাবে কিনা তাই বলো।
- সে আমি স্যার আপনাদের দেখেই বুঝতে পারছি।
- যাবা কিনা বলো?
- স্যার। আমার একটা কথা শোনেন।
- বলো।
- আপনাদের হোটেল যখন ঠিক করা নেই। আমার পরিচিত হোটেলে চলেন। পছন্দ হলে উঠবেন না হলে অন্যটায় যাবেন। আমাকে শুধু ভাড়া দিলেই হবে। আপনারা হোটেলে উঠলে আমি তো ওদের কাছ থেকে কমিশন পাবো। না উঠলে আর কি করা। যা বৃষ্টি হচ্ছে আজ কয়েকদিন। টুরিস্ট নেই বললেই চলে।
- পরে আবার পেঁচাপেঁচি করবা নাতো।

ছেলেটা ভালোই। আমাদের একটা হোটেলে নিয়ে গেলো। নতুন হোটেল। নামখানা চটকদার। কিন্তু ভাড়ার সাথে সার্ভিস ম্যাচ না করায় আমরা ফিরে এলাম। ড্রাইভার কিছুটা আপসেট হলো। থামলাম হোটেল লংবিচ আইল্যান্ডে। পার নাইট ছয়হাজার। ফ্রেন্ড আমার মুখের দিকে চাইলো। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
- আরে ভাই আমরা কি এখানে এসি রুমের হাওয়া খেতে এসেছি। থাকবো তো সাগর তটে সকাল থেকে মধ্যরাত। শুধু শুধু এদের গুচ্ছের টাকা দিয়ে লাভ আছে। চল ব্যাগ রাখার মত একটা হোটেল খুঁজে নেই।

বন্ধুটির হোটেল সেন্টমার্টিনে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতার উপর ভর করে আমরা হোটেল সেন্ট মার্টিনে গিয়ে উঠলাম। ছয়শো টাকা ডাবল বেড। ব্যাগ রাখার জন্য পারফেক্ট। সিএঞ্জি ড্রাইভারকে ভাড়া দিতে গিয়ে ঠিকই প্যাঁচাপেঁচি শুরু করলো সে। পঞ্চাশ টাকা বেশী দিতে হবে। মামা বাড়ির আবদার। এই পঞ্চাশটি টাকা কামাই করতে আমাকে কয়মিনিট রাত জাগতে হয় তার হিসেব কি সে জানে!

ইচ্ছে করছিলো তখনি সমুদ্রের পাড়ে ছুটে যাই। মনের উপর অজস্র চাপ। আম্মার সাথে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলছে। ইচ্ছে করছে না বলা কষ্টগুলো সাগরের সাথে গিয়ে শেয়ার করি। বৃষ্টি থামার নামই নেই। আমি বৃষ্টিতে ভিজে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বন্ধু আমাকে নিরুৎসাহিত করলো। এত তাড়া কেন। আছি তো দুইদিন। সাগর কি পালিয়ে যাবে। এই বৃষ্টির রাতে সাগরে নামা ঠিক হবে না। হোটেলেই গোছল সেরে নেওয়া যাক।

কক্সবাজার আসার কোন প্লান ছিলো না। হুট করেই আসা। সমগ্র ট্যুর প্লান ছিলো বান্দরবনকে ঘিরে। কিন্তু কক্সবাজারের এত কাছে এসে মন খুব উচাটন হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের জন্য। বন্ধুটিকে বলতে সংকোচ হচ্ছিলো। অবশেষে বলেই ফেললাম। সেও দেখি এক পায়ে রাজি। আসলে বৃষ্টিতে বান্দরবন শহর আর আমাদের ভালো লাগছিলো না। অন্যদিকে কিশোর চাকমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে। সে তার পথ ধরবে। আমাদের বন্ধু দুজনকেই যখন ঘুরতে হবে তখন কক্সবাজার যাওয়াই ভালো। বেলা দুটোর গাড়িতে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। এত টাইমলি গাড়ি ছাড়লো দেখে আমি পরম বিস্মিত হলাম। বাংলাদেশে এত পাঞ্চুয়াল সার্ভিস পাওয়া যায়। কিন্তু ভুল ভাংতে দেরি হলো না। সারা পথ গাড়ি থামতে থামতে চলেছে। কক্সবাজারের যে মেরুবিন্দু আমাকে দুর্বার গতিতে টানছে সে এখন আর কক্সবাজার থাকে না। তবু আমি জানিনা কক্সবাজার আমাকে কেন এত টানছে। তার থেকে তো আমি দূরেই সরে যেতে চেয়েছি। সজ্ঞানে। সব থেকে অবাক লাগে আমার কষ্টের সময়ে তাকেই আমার সবথেকে বেশী মনে পড়ে। যদিও তারকাছে থেকে সেভাবে মানসিক সাপোর্ট পাওয়া যায় না। তার ধারণা আমি তাকে বুঝিনা। আমার ধারণা সে আমাকে বোঝে না। ভালোবাসার এই সংঘাত নিরন্তর।

আমি গোছল সেরে বেরোনোর পরে বন্ধুটি ঢুকলো। জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে সেই। আম্মাকে ফোন দিলাম। আমি যে কক্সবাজার আসবো নিজেই জানতাম না। আম্মাকে কি জানাবো। আম্মা ছোট বেলা থেকে আমাকে তার বাধ্যগত জেনে এসেছে। এজন্য তাকে না জানিয়ে কিছু করলে প্রাথমিক ভাবে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। বৃষ্টি হচ্ছে সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু সাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে তা জানতাম না। আম্মাই খবর দিলেন। সাথে বকা। বললেন যত তাড়াতাড়ি পারি যেন কক্সবাজার ছাড়ি। আমি ভাবতাম ফেসবুকের কল্যাণে আমার কিছু নেটওয়ার্ক তৈরী হয়েছে। কিন্তু ফেসবুক বিহীন আম্মারও দেখি নেটওয়ার্ক কম না। তিনি চট্টগ্রাম শহরে এক মেয়ে দেখার ব্যবস্থা করে ফেললেন। ব্যবস্থা তিনি মনে মনেই করেছিলেন আমার বান্দরবান ঘুরতে আসার কথা শুনে। আজ বললেন। আমি আচ্ছা বলে রেখে দিলাম। মনটা অবশ হয়ে গেলো। সন্তান বড় হলে তাকে বিয়ে দেওয়া বাঙালী বাবা মায়ের দ্বায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে বর্তায়। এবং তারা তাদের সেই দ্বায়িত্ব পালনে একটু বেশী মাত্রায় সচেষ্ট। আমরা পৃথিবীর এমনই একটা অংশে জন্মেছি যেখানে অধিকাংশ বাবা মাই সন্তানের ফিউচার সিলেক্ট করতে ভালোবাসেন। কিন্তু তারা একবারও ভাবেন না এতে করে সন্তানের ভবিষ্যৎ জটিল হচ্ছে কিনা। বিরক্ত লাগছিলো। অন্ধ আক্রোশে হাতের ফোনটা ছুড়ে মারলাম। বিছানার উপরে ডিগবাজি খেয়ে খাটের নিচে গিয়ে লুকোলো। আমার ফোনটাকে খুঁজে বের করে আছাড় মারার দ্বিতীয় ইচ্ছে ছিলো না। চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি। বন্ধুটি ইতোমধ্যে শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো, ফোন ছুড়ে মারলে যদি সব সমস্যার সমাধান হতো তাহলে জগতের সবাই ফোন ছুড়ে ফেলে দিতো। বৃষ্টি কমেছে মনে হচ্ছে। চলো খেয়ে আসি।

কোথায় খাবো? সেরকম কোন ভাবনা নেই। হাতের কাছে যে হোটেল পাই ঢুকে যাবো। টিপির টিপির বৃষ্টি ঝরছে। সমুদ্র শহর এখন অনেকটা নিশ্চুপ। দূর থেকে সমুদ্রের হালকা গর্জন ভেসে আসছে। হাতের ডানে লং আইল্যান্ডকে রেখে এলাম। বাহির থেকে দেখতে সুন্দরই লাগছে। একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। মাছরাঙা না দারুচিনি নাম লেখা খেয়াল করিনি। খেয়াল করার ম্যুডে ছিলাম না। কি খাবো কি খাবো ভাবতে আমরা বেশ সময় নিলাম। শুটকি ভর্তা দুজনেরই ফেভারিট লিস্টে রইলো। সাথে সামুদ্রিক মাছের ঝোল। মন্দ লাগলো না। যে ছেলেটা সার্ভ করছিলো বেশ আমুদে প্রকৃতির। কথা বার্তায় আন্তরিক। তার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। আমরা দুই বন্ধু যখন বেড়াতে বের হই তখন টাকা খরচের দ্বায়িত্ব থাকে তার আর হিসেব রাখার দ্বায়িত্ব থাকে আমার। আমি কিছুক্ষণ পরপর নোট প্যাডে টুকে রাখি কোথায় কি খরচ হচ্ছে। এটা আমাদের মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর ব্যাপার। না হলে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিল দেওয়া নিয়ে ঠ্যালাঠেলি বেঁধে যায়। আমি বন্ধুটিকে বললাম, ছেলেটিকে বেশী করে টিপস দিতে। খেয়ে দেয়ে বেরি আমরা সুগন্ধা পয়েন্ট দিয়ে সাগরের কাছে এলাম। একরাশ অন্ধকারে মোড়া সাগরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটানা প্রচন্ড আর্তনাদ কানের পর্দায় কেঁদে চলেছে। কি বেদনা তাহার। সমুদ্র কেন এত কেঁদে চলে। আমরা শুকনো বালিয়াড়ি ধরে হাটছি। চেয়ার গুলোতে কিছু লোক এখানে ওখানে ভুতের মত শুয়ে বসে আছে। থেকে থেকে ফসফরাসের কল্যানে সাপের ফনার মত ঢেউয়ের মাথা দেখা যাচ্ছে।

ঘন্টা খানেক বাদে বন্ধুটি ফিরতে চাইলো। আমি বললাম আরো কিছুক্ষণ থাকি। আধাঘন্টা বাদে সে আবার তাড়া দিলো। আমি আরো কিছুক্ষণ থাকতে চাইলাম। সে বললো, সাগর কি পালিয়ে যাচ্ছে। আছি তো দুদিন। সো ফিরতেই হলো।। রুমে ফিরে সেই মানুষটিকে ফোন দিলাম। যে একদা ছিলো এই সমুদ্র শহরে। যার সাথে সমুদ্র শহরে ঘোরার অনেক প্লান করেছিলাম কিন্তু বাস্তবে রূপ দেওয়া হয়নি একটারও। দুচার লাইনে জানালাম এসেছি আমি তার সমুদ্র শহরে। সে জানতে চাইলো কার সাথে। বললাম বন্ধুর সাথে। তাকে আগেও বলেছি এই বন্ধুটির কথা। বুকের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছিলো। তাকে চাপা দিলাম ঢোক গিলে। কি দরকার। যে বোঝেনা তাকে কেন মুখ ফুটে বোঝাতে যাবো।

অয়নকে ফোন দিলাম। আমার ফেসবুক লাইফে প্রথম দিকের যে কয়জন বন্ধু আছে তাদের মধ্যে অয়ন একজন। অয়নের শহরে এসে তাকে ফোন না দেওয়া অমানবিক হয়ে যায়। যদিও আড্ডা দেওয়ার মত ম্যুড ছিলো না। প্রথমে তো অয়ন বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমি সত্যি কক্সবাজার এসেছি। কারণ আমি কোথাও গেলে ফেসবুকে ঢোল পেটাতে পেটাতে যাই। অয়ন বললো কাল ওর অফিস আছে। লাঞ্চের দিকে আমার সাথে দেখা করবে। তথাস্তু। বন্ধুটি শুয়ে পড়েছে। আমিও শুয়ে পড়লাম। বাইরে প্রচন্ড শব্দ করে কারা যেন কথা বলছে। দরজায় নক শুনে এগিয়ে গেলাম। আমি দরজা খুলে দাঁড়াতে সুদর্শন একটি ছেলে বোকা বোকা অভিব্যক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আমি স্মিতমুখে শুধালাম, রুম ভূল করেছেন?
- আমাকে তো এই রুমের কথাই বলা হয়েছে।
- তাহলে যে বলেছে সে ভুল বলেছে।

ছেলেটা দ্বিধান্বিত মুখে তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আমি মজা পাচ্ছি। একদা আমারও এরকম হতো। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না কি করা উচিত। আমি তাকে বললাম, সমস্যা নেই। খুব সমস্যা হলে আপনি আমার সাথে বেড শেয়ার করতে পারেন। বিছানা বড়ই আছে।

সে সংকোচের সাথে বললো, না থাক। বলে দ্রুত চলে গেলো। বন্ধুটি তার বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলো। সে কম্বল সরিয়ে বললো, পারো বটে। এই রাতে এত রস আসে কই থেকে। সেই সন্ধ্যা থেকে দেখছি মুখ মেঘের মত গুমোট আর এখন অচেনার সাথে ইয়ার্কি মারছো।
- ভেবে দেখো। এখানে ছেলের জায়গায় মেয়ে হলে কি হতো। একদম হলিউডের সিনেমা। তাই না।
- এসব আগডুম বাগডুম চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমোও না হলে শেষে স্বপ্নদোষ হবে।
- এই বয়সেও তোমার স্বপ্নদোষ হয়?
- ঘুমাও।
- গুডনাইট।

বন্ধুটির ধারণা আমার সম্পর্কে সে হাতের রেখার মত সব জানে। অথচ সে কখনোই জানবেনা আমার মাঝে লুকিয়ে আছে এক অন্য আমি। আমি লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। সাগরও কি শুয়ে পড়েছে?
#
আমি একদা আর্লি রাইজার ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে সূর্য ওঠার আগেই আমি হলের ছাদে উঠে যেতাম। দাঁত ব্রাশ করতে করতে পায়চারী করতাম। সদ্য ঘুম ভেঙে আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে কবুতরের দল বাকুম বাকুম করতো। আমি প্রিয় নোকিয়া মোবাইলে রবীন্দ্র সংগীত শুনতাম। তখন থেকেই মূলত আমি রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়ি। গুরুদেবের বাণীর মর্মার্থ বুঝতে শুরু করি। মনে হতো রবীন্দ্রনাথ গান গুলো যেন শুধু আমারই জন্য লিখেছেন। একটু একটু করে ঘুম ভাঙা লাল চোখ মেলে সূর্য্যি মামা হেসে উঠতো মেহগনি গাছের মাথার উপর দিয়ে। এরপর জব লাইফে ঢুকে রুটিন গেলো উলটে। সূর্য্য যে কোন দিকে ওঠে, ভোরের বাতাসের অনুভূতি কেমন! সব ভূলতে বসেছি। সমুদ্র শহরে অতি প্রত্যুষে ঘুম ভাঙলো। মোবাইল ঘড়িতে সবে পাঁচটা বাজে। ফ্রেশ হয়ে পর্দা সরিয়ে দেখি তখনো বৃষ্টি ঝরছে। ধ্যুস। বন্ধুটি ভোস ভোস করে ঘুমাচ্ছে। তাকে ডাকলাম। সাড়া দিলো না।। ফেসবুকে ঢুকলাম। এত কাক ডাকা ভোরেও ফ্রেন্ডলিস্টে অনেকেই অনলাইনে আছে। আরিয়ানকেও দেখতে পেলাম। তাকে কক্সবাজার এসেছি বলতেই সে বললো, আরে আরো অনেকেই তো এখন কক্সবাজার আছে। কারা আছে জিজ্ঞেস করলাম। সে রিপ্লাই দিলো না। আমারো খুব বেশী জানার আগ্রহ হলো না। আবার গা এলিয়ে দিলাম। নাহ কিছু ভালো লাগছে না। সমুদ্র আমাকে টানছে।

বন্ধুটির ঘুম ভাঙালাম। সে বিরক্ত হলো। এখন সে উঠবে না। আমি একলাই বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের হোটেলটি দুই পয়েন্টের মাঝামাঝি। বেশ খানিকটা পথ হেঁটে যেতে হলো। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে আমি সাগরের কিনারে এসে দাঁড়ালাম। বাতাসের বেগ যথেষ্ঠ, ঝাউবনে শো শো শব্দ হচ্ছে। চারপাশে কেউ নেই। পুরো সমুদ্রের কাছে আমি একলা দাঁড়িয়ে আছি। আমি দুই হাত বিস্তৃত করলাম। অদৃশ্যভাবে সমুদ্রকে আলিঙ্গন করলাম। কেন তুমি এত টানো আমায়? বিমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু একটু করে লোক আসতে শুরু করেছে। বারাক ওবামার পিতৃদেশীয় একজন কৃষ্ণবর্ণ আমার দিকে তাকালো। আমিও তার দিকে তাকালাম। বক্সার আর ম্যাগি গেঞ্জি পরা। পেটানো শরীর। বললাম, গুড মর্নিং। সেও বললো, মর্নিং। আমি বলার মত কিছু পেলাম না। সেও না। মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থেকে নিচু হয়ে ঝুঁকে পায়ের স্লিপার খুলে দুই হাতে পরলো। এর পরে দিলো ছুট। তাগড়া ঘোড়ার মত ছুটে চলেছে সে। ছুটতে পারে বটে মালখানা। কিছু ক্ষনের মধ্যেই সে লাবনী পয়েন্ট পেরিয়ে গেলো। চারপাশে নানা ধরণের মানুষেরা আসতে শুরু করেছে।

সমুদ্র মানুষকে যেন শিশু করে দেয়। দুই বয়স্ক লোক তাদের নোকিয়ার ভিজিএ ক্যামেরা দিয়ে কতই না এঙ্গেলে ছবি তুলছে। স্যু পরে সাগর তটে হাঁটা কষ্টের বলে গতরাতে একজোড়া বার্মিজ কিনে নিয়েছিলাম। নতুন জুতোর কামড়ে বুড়ো আঙুলের মাথার এক খামছা মাংস উঠে গেছে। জুতো খুলে হাত নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কখন যে নটা বেজে গেছে টের পাইনি। বন্ধুটি চলে এসেছে। সাগরপাড়ে অনেক খাবারের দোকান। এর একটার নাম ছিলো কড়াই। সেখানে ঢুকে আমরা ব্রেকফার্স্ট সেরে নিলাম। খাবারের তুলনায় দাম খুব বেশী। তবে খাবার ভালো ছিলো। খেয়ে দেয়ে আবার সাগরের কূলে ফিরে গেলাম। দুই বন্ধু মিলে হাঁটছি। আমরা চুপচাপ। সাগরের কথা শুনছি।

হঠাৎ সবুজ টি শার্ট পরা একটি ছেলের সংগে চোখাচোখি হলো। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় চোখ যেন রাডার হয়ে গেছে। আমি তাকে পড়ে ফেললাম। সেও আমাকে। তা না হলে কিছুদূর গিয়েই সে আবার ফিরে এলো। বন্ধুটির সামনে তার সাথে আমার কথা বলার কোন আগ্রহ ছিলো। আরো একবার ক্রস করে সে আমাদের পিছে পিছে হাঁটছে। হঠাৎ সে বললো, দেখছেন নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরছে।

বুঝতে পারলাম আলাপী ধরণের ছেলে। বললাম, হাত জালে সাগরে কি মাছ পড়ে?

সে বললো, পড়ে বোধ হয়। না হলে এই বৃষ্টির মধ্যে এরা জাল নিয়ে বেরুবে কেন?

কিছুক্ষণ কথা বললাম। চট্টগ্রামের ছেলে। পপুলারের কিসে যেন জব করে। ঢাকা থেকে এদের হাজার খানেক কলিগ এসেছে কোম্পানীর বাৎসরিক ট্যুরে। তাদের সাথেই এসেছে। হ্যান্ডশেক করে বিদায় দিলাম ছেলেটিকে। বন্ধুটি বললো, তোমার আর অচেনা মানুষের সাথে কথা বলার অভ্যেষ গেলো না!
- তুমিই তো দেখলে সে আগে কথা বলেছে।
- দেখলাম।

দশটার দিকে বন্ধুটির আর তর সইছে না। সে সাগরে ছুটে গেলো। আমিও ছুটলাম। হাটু পানিতে নেমে থমকে গেলাম। কেউ একজন বলেছিলো ভাইয়া তুমি আসলে আমরা এক সাথে সাগরে নামবো। আমার পা যেন কেউ চেপে ধরেছে। কখনো মুখ ফুটে বলিনি কিন্তু এই সাগরে আসা নিয়ে মনে মনে আমারো অনেক প্লান ছিলো। আমি ওখানেই বসে পড়লাম। সাগরের ঢেউ এসে আমাকে গলা পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। পায়ের নিচ থেকে ঝুরঝুর করে বালি সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু পড়ছি না।

বন্ধুটি ফিরে এসে বললো, সেকি এখানে বসে পড়লে। প্রথম যে বার সাগরে এসেছিলে মনে আছে আমাদের থেকে তুমিই সব থেকে বেশী দূরে গিয়েছিলে। আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেছিলাম।
- আসলে আম্মা সাগরে নামতে নিষেধ করেছে।

কথা সত্য। আম্মা কিছুক্ষন আগেই আমাকে ফোন করে বলেছে, সাগরে যেন নামা না হয়। আমি বলেছিলাম আচ্ছা।

কিন্তু আম্মাও জানতেন যে আমি সাগরে নামবো। আমিও জানতাম। কিন্তু আমি নামতে পারলাম না। চোখের সামনে অন্য কেউ এসে দাঁড়িয়েছে অদৃশ্য ভাবে। ঠায় বসে রইলাম। কত ক্ষণ জানিনা। বন্ধুটির আমাকে নিয়ে অত ভাবার টাইম নেই। সাগরে নেমে সে ঢেউয়ের মাথায় লাফ ঝাঁপ দিয়ে বেড়াচ্ছে। পাংখা ছেলেদের মত হাই হুই করা আমাদের আসে না। তবুও সে চেষ্টা করে যাচ্ছে।

হঠাৎ একটি ছেলের দিকে আমার নজর গেলো। খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে রাখার ব্যাপারে আমি মাঝে মাঝেই নিজেই নিজেকে এ প্লাস দেই। ছেলেটিকে কোথায় দেখেছি দেখেছি করছি। মাঝে মাঝে এরকম হয়। অবশেষে মনে হলো আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে সাগর সৈকত বলে একজন আছে। এই ছেলেটির চেহারা একদম তার মত। যদিও ছবির মানুষ আর বাস্তবের মানুষের মধ্যে বেশ অমিল থাকে। একবার ভাবলাম ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করি সে ফেসবুকের সাগর কিনা। আবার ভাবলাম থাক কি দরকার। যে হয় হোক। আমি বসে রইলাম।

বারোটার পনেরো মিনিট আগে আমরা হোটেলে ফিরলাম। হোটেল ছেড়ে দিয়েছি। এতটা পথ হেঁটে কি বারবার সাগরে আসা যাওয়া করা যায়। আমরা হোটেল বদলে সুগন্ধা হোটেলে উঠেছি। থ্রি বেডের বিশাল এক রুম ছয়শো টাকায় পেয়ে গেছি। এদের সার্ভিসও ভালো। মোতালেব নামে বোকা বোকা চেহারার একটা ছেলে রুম সার্ভিস বয়। বেশ কাজের। ফ্রেশ হয়ে খেতে বেরোলাম। সেই দারুচিনি রেস্টুরেন্ট। কোরাল মাছের ভর্তা আর রুপচাঁদা ভুনা। আহ সেই স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে।
#
দুপুরে খেয়ে এসে গড়াগড়ি দিচ্ছি হোটেল রুমে। বাইরে হালকা রোদ উঠেছে। মোবাইল ফোনের স্ক্রিন জ্বলে উঠতেই অয়নের নাম ভেসে উঠলো। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে অয়নের সেই চেনা টোন, কৈ তুই?
- এইতো আমি হোটেল রুমে। তুই কই?
- তুর হোটেলের সামনে।
- দাঁড়া আমি আসছি।

বন্ধুটির সামনে অয়নকে ডাকার সাহস আর দেখাতে গেলাম না। একবার চট্টগ্রামে এক ফেসবুক বন্ধুকে ডেকেছিলাম। সে ছেলেটিকে আমি বোঝাতে পারিনি যে আমার রিয়েল লাইফেও কিছু নরমাল বন্ধু থাকতে পারে। সে আমার এই বন্ধুটির সামনে ঘুরে ফিরে রংধনু রিলেটেড টপিকস তুলে ফেলে। শেষ মেষ বাধ্য হয়ে তাকে তৎক্ষনাৎ বিদায় জানাতে বাধ্য হই। বন্ধুটি আমাকে কিছুটা ক্রিটিসাইজ করেছিলো। আমি বোকা বোকা এক্সপ্রেশান দিয়ে বললাম, আমি কিভাবে জানবো কার মধ্যে কি আছে। অয়নের সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। এই প্রথম দেখা হচ্ছে। জানিনা অনলাইনের মানুষটি আর বাস্তবের মানুষটির মিল অমিলের পার্থক্য কতটুকু হবে।

আমি হোটেলের রিসিপশানে দাঁড়ালাম। অনেক অচেনা মুখ। কে হতে পারে? মেলানোর চেষ্টা করছি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি ফেসবুকের বন্ধুরা দেখা করতে এসে যে জায়গার কথা বলে তার থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করে। তাই দৃষ্টিপথের রেডিয়াস বাড়িয়ে অয়নকে খুঁজছি। রাস্তার অপরপিঠে যাত্রী ছাউনির নিচে বসে চশমা পরা একটা গুল্টু গুল্টু চেহারার ছেলে মোবাইল টিপছে। আমি রাস্তা পেরিয়ে ছেলেটার পাশে গিয়ে বসলাম।

- কেমন আছিস?
- চিনলি কিবাবে?
- চিনলাম।
- শভ্র মাহমুদ! অবশেষে দেখা হলো।
- শুভ্র মাহমুদ নয়রে আমি শুভ্র মোহাম্মদ লিখি। যদিও এটাই আমার সত্যিকারের পূর্ণ নাম নয়।
- বল কি কাবি?
- কিছুই খাবো না। আমাকে খাওয়ানোর জন্য এখানে এসেছিস?
- আমার শহরে আইচিস। খাওয়াবো না।
- কিচ্ছু খাওয়াতে হবে না। চল সাগর পাড়ে যাই। তোর হাতে সময় আছে?
- আছে চল।

সুগন্ধা হোটেলের সামনের পথ ধরে আমরা সাগরের কাছে চললাম। রাস্তার পাশে অনেক গুলো বন্ধ দোকান দেখিয়ে বললো বিকেল বেলা এখানে ফিশ ফ্রাই পাওয়া যায়, তোকে ফিস ফ্রাই খাওয়াবো। অয়নের ফিশ ফ্রাই উচ্চারণ পিস ফ্রাই আর ফিস ফ্রাই এর মাঝামাঝি।

অয়ন ছেলেটি বেশ ফ্রেন্ডলি। আড্ডা দিয়ে অন্তত শান্তি পাওয়া যায়। বেশ আড্ডা দিলাম দুজন। ওকে অফিসে ফিরতে হবে। সন্ধ্যায় আবার আসবে বলে বিদায় নিলো সে। আমি একটা ছাতা ভাড়া নিয়ে তার নিচে শুয়ে নিশ্চুপে চেয়ে রইলাম সাগরের পানে। নিম্নচাপ থাকার কারণে সাগর আজ দুদিন এত এত রুপ দেখাচ্ছে যে আমার মুগ্ধতা বেড়েই চলেছে। রৌদ্র করোজ্জ্বল দুপুরে ছাতার নিচে শুয়ে সাগরের উন্মত্ব জলরাশি দেখার সৌন্দর্য্য আলাদা। কেউ যেন কিপ্টেমি করে এই সুযোগ হেলায় হারিয়ো না। এই কথা শুধুমাত্র প্রকৃতিবিলাসিদের জন্য প্রযোজ্য। একবার আমার এক ক্লাসমেট বলেছিলো গাদা গাদা টাকা খরচ করে মানুষ এই বাল দেখতে আসে! আমি শুধু একবার তার মুখের দিকে চেয়েছিলাম। কত জাতের মানুষই না আছে এই দুনিয়ায়।

এক ঘন্টার জন্য ভাড়া নিয়েছিলাম চেয়ারখানা। ঘন্টা ফুরোনোর আগেই বন্ধুটি এসে হাজির। সে আমার আয়েশী ভংগীতে বসা দেখে নিজেই পাশের চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। কোথা থেকে একটা বাচ্চা ছুটে এলো। স্যার চেয়ারে বসতে হলে ভাড়া দিতে হবে। বন্ধুটি বললো ঠিক আছে দেবো। আমি বললাম, আরে এটাতে বসো। আমি অনেকক্ষণ বসেছি। ছেলেটা বললো কয়টা বাজে? বললাম। সে বলে আপনার আর বিশ মিনিট আছে। সে চিন্তা করতে হবে না তোকে। সময় ফুরালে টাকা নিয়ে যাস। বন্ধুটিকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে আমি চলে গেলাম। সে বললো, আরে কিছু ছবি তুলে দিয়ে যাও। কই কই থাকছো সারাদিন। ছবি টবি তোলা হলো না এবার। সত্যি এবার ছবি তোলা হচ্ছে না। তাকে কিছু ছবি তুলে দিয়ে আমি সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। সাগর তীরে এখন মানুষের মেলা জমে গেছে। এত লোক কোথা থেকে এলো। সবাই খুশীতে টগবগ করছে। সাগরের কাছে এলে কি মানুষ দুখ ভুলে যায়। আমি মোবাইল বের করে ছবি তোলা শুরু করলাম।

বেশ মোটাগোটা স্বাস্থ্যবান একটি শিশু সাগরে নামার জন্য বাবার হাত ধরে টানছে। বাবা হাঁটুপানির নিচে নামতে নারাজ। ছেলে টানছে। অবশ্য ছেলের যে সাইজ। বাবার ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। যেই সাদা ফেনা মুখে তুলে ঢেউ পায়ের উপর আছড়ে পড়ছে। ছেলেটার সেকি আনন্দ। বাতাসে হাত ছুড়ে শৈশবের আনন্দে উল্লাস করছে। কৈশোরে পা বাড়ানো এক ছেলে ছুট দিলো সাগরের দিকে। সাহস আছে বটে। উচু একটা ঢেউ তেড়ে আসছে তার দিকে। ভ্রাম্যমান ক্যামেরা ম্যানদের উৎপাতে বিরক্ত হতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর এসে বিরক্ত করছে মামা ছবি তুলে দেই। আমি না বলি। তারা সরে যায়। অন্য আরেকজন আশে। শেষমেষ আমি সুন্দরচোখের এক কিশোর ফটোগ্রাফারকে জিজ্ঞেসই করে বসলাম, তোমার ক্যামেরার মেগাপিক্সেল কত? সে আমার প্রশ্ন শুনে অবাক হলো। আমতা আমতা করে বললো, পাঁচ। তার গলার স্বর আমাকে বলে দিলো যে আরো কম। আমি তাকে বললাম, দেখো ভাই নতুন মোবাইল কিনেছি। ক্যামেরা তেরো মেগা পিক্সেল। ছবি ভালই ওঠে। আমার ছবি লাগবে না। ছেলেটি একটু পিছিয়ে পড়ে আরেকজন ফটোগ্রাফারকে বলল, মোবাইলে আবার ১৩ মেগা পিক্সেল হয় নাকি? সেও কিছুটা উৎসাহী হয়ে এগিয়ে এলো। আমার হাতের মোবাইল টার দিকে তাকিয়ে বললো, মোবাইলের ছবি আর ক্যামেরার ছবি এক হয় নাকি। আমি বললাম, তা অবশ্য মন্দ বলেননি। সে উৎসাহ পেয়ে বললো, তাহলে আসেন আপনার এক খানা ছবি তুলে দেই। আমি আবার না করলাম। সবাই ভাই নিজের ছবি তুলতে ভালো বাসে না। কেউ কেউ অন্যের ছবি তুলতে ভালোবাসে। তাইতো কেউ কেউ ফটোগ্রাফার হয়। সে আর কথা বাড়ালো না। আমি ভাবছি। এদের সারাটি দিন এখানেই কাটে। ভোরের সূর্যোদয়ে এসে হাজির হয়। সূর্য না ডোবা পর্যন্ত এরা মানুষের ছবি তুলে চলে। দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। দিন দুনিয়ায় কোথায় কি হচ্ছে কোন খোঁজ রাকাহ্র সময় পায় না। ফাঁকা কাউকে দেখলে ছুটে চলে যায়। অন্যজনের আগে গিয়ে বলতে চায়, ভাইয়া ছবি তুলবেন নাকি?

সুগন্ধা পয়েন্ট দিয়ে নামতে গেলে বালিয়াড়ির দুপাশে অনেকগুলো অস্থায়ী দোকান চোখে পড়ে। শামুক ঝিনুকের জিনিসই বেশী। দুই বন্ধু মিলে ঢুকলাম দোকানে। হরেক রকম বাহারী সামগ্রী। খুব বেশী না হলেও টুকটাক ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের দুই বন্ধুর। সুযোগ পেলেই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তাই জানা আছে এসব প্লেসে জিনিসের দাম খুব বেশী চায়। প্রায় সব গুলো দোকান ঘুরে ফেললাম দামাদামি করে। দোকানদাররা বুঝে ফেললো এ কেনার কাস্টমার নয়। আমরাও বুঝে গেলাম যে এরা এর থেকে কমে নামবে না। আপুর জন্য একটা পাথরের হার কিনলাম। শুরুতে দাম চেয়েছিলো নয়শো টাকা। কিনেছি সত্তর টাকা দিয়ে। এ দামাদামির মাঝে এক অন্য আনন্দ আছে। খুব বেশী ভদ্র ব্যক্তিরাও নশো টাকার জিনিসের দাম তো পাঁচশো টাকা বলতোই। তবে কেনাকেনিতে আমার চেয়ে আমার বন্ধুটি সরেস। আমার কেনাকাটার অভিজ্ঞতা তেমন বলবার নয়। ছাত্র জীবনে একবার টাকা জমিয়ে ঢাকা শহর ঘুরতে এসেছিলাম। নিউ মার্কেটের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ঢুকেছিলাম। থরে থরে সাজানো কত কাপড়। ছোট শহরে ক্ষুদ্র গন্ডীতে বেড়ে ওঠা মানুষের চোখে চমক লাগাটাই স্বাভাবিক। দোকানদারদের ব্যবহার খুবই আন্তরিক মনে হলো। কে বলেছে ঢাকার দোকানিরা সব টাউট বাটপার। আমার
এ ধারণা যে ভূল সে ভ্রমন ভাংতে সময় বেশীদিন লাগেনি। যাই হোক ঝটপট বাবা মা ভাইয়ের জন্য কিছু না কিছু কিনে ফেললাম। তবে আরেকটি জায়গায় আমার অক্ষমতা বেরিয়ে গেলো। সাইজ। আমি যার জন্য যা কিনেছিলাম তা তাদের কারোরই ফিট করেনি। আম্মার জন্য যে জুতা কিনেছিলাম তা নানীর পায়ে ফিট হওয়ায় আম্মা নানীকে দিয়ে দিলেন। আব্বা আম্মাকে দিলেন বকা। ফিট হয়নি তো কি হইছে। ছেলে কিনে আনছে শখ করে। তুলে রাখবা।

সূর্যাস্ত দেখবো বলে সাগরে ছুটলাম। কপালটাই খারাপ। কোথা থেকে একরাশ মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে। সবার চোখে মুখে সাগর সংগমে সূর্যাস্ত দেখার অভিলাস। ঝালমুড়িওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে। পরিশ্রান্ত শীর্ণ ঘোড়ার পিঠে দামড়া সাইজের এক পঁয়ত্রিশোর্দ্ধ যুবা নানা এঙ্গেলে ছবি তোলার চেষ্টা করছে। যুবাটির জন্য করুনা হলো আর ঘোড়াটির জন্য মায়া। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম মনে মনে। জীবনেও আমি এরকম ঘোড়ায় চড়বো না।লুংগি পরিহিত এক বয়ষ্ক লোক সাগরের পানে চেয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র বাতাসে তার মুখের সাদা দাঁড়ি উড়ছে। লুংগি শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। কোন দিকে ভ্রক্ষেপ নেই তার। এক দংগল মানুষ এই ভর সন্ধ্যাতেও নাইতে নেমেছে। সি বিচের গার্ডেরা ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে বাঁশি বাজিয়ে তাদের সতর্ক করে দিচ্ছে। জোয়ার আসার সময় সমাগত। লাল ফ্লাগ গেড়ে দিয়েছে কিছুদূর অন্তর অন্তর। এক বালিকা আপন মনে ঝিনুক কুড়াচ্ছে। হাত ধরাধরি করে এক সুখী পরিবার হেটে চলেছে। আমি জানিনা তারা সুখী পরিবার কিনা। কিন্তু তাদের অভিব্যক্তিতে সুখের বহিঃপ্রকাশ মনে হচ্ছিলো। আমি বসে ছবি তুলছি দেখে তারা থামলো। আমি স্মিতমুখে মাথা নাড়ালাম। আপনারা যেতে পারেন। আমি মূলত ভেজা বালির বুকে তাদের প্রতিবিম্ব তোলার অপেক্ষায় বসে ছিলাম। ফটোগ্রাফির অ আ ক খ কিছুই জানিনা। তবে মাঝে মাঝে রিফ্লেক্স নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে ভালো লাগে।

সন্ধ্যার কিছু পরে অয়ন এসে হাজির। অয়ন সাইজে কিছুটা শর্ট হওয়ায় কাঁধ ধরে হাঁটতে বেশ সুবিধা হচ্ছে। ছোট ভাই বলো বড় ভাই বলো বন্ধু বলো কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটা আমার বহু পুরাতন অভ্যেষ। তবে সাইজে আমার থেকে একটু শর্ট হতে হবে। দুজন মিলে হাটতে হাটতে লাবনি পয়েন্টের দিকে চলে এলাম। বললাম চল বসি একটা বেঞ্চে। অয়ন দেখলাম বেশ চালু মাল। বললো, আরে এখানে বসলে পয়সা দেওয়া লাগবে। চল ওদিকটাতে ফাঁকাতে গিয়ে বসি। ফাঁকা দুটো চেয়ার বেছে নিয়ে দুজন বসলাম। সামনে সাগর একই সুরে গেয়ে চলেছে আবাহনের গান। অনেক গল্প হলো দুজনের। অয়ন সম্পর্কে আমার ধারণা সে অন্যের পারসোনাল ব্যাপারে খুব নাক গলায়। তবে এই যে এত আড্ডা দিচ্ছি একবারো সে আমার ব্যক্তিজীবন কি ব্যাংকার নিয়ে কোন গল্প শুরু করেনি। আবারও একবার বিশ্বাস হলো বাস্তবের মানুষ এবং ভার্চুয়ালের সেই মানুষটির মাঝে অধিকাংশ সময়ে যোজন যোজন পার্থক্য থাকে। বসে বসে ক্লান্ত হয়ে দুজনে উঠে পড়লাম। অয়নের আবার আগামীকাল সকালে অফিস আছে। তাকে ফিরতে হবে। এই যে অফিসের আগে পরে আমাকে এত সময় দিলো। এদের উদারতা আমাকে বারবার মুগ্ধ করে। আমি কেন এদের মতো উদার হতে পারি না। অনেক সময় দেখা যায় কেউ আমার অফিসের গেটের সামনে এসে বসে থাকলেও আমি সময় দিতে পারি না।

রাস্তার পাশে পাশে ভ্রাম্যমান ফিশ ফ্রাই এর দোকান গুলোতে সেই ভিড়। অয়ন আজ আমাকে ফিশ ফ্রাই খাইয়েই ছাড়বে। অগত্যা হার মানলাম এই শর্তে যে আমাকে বিল দিতে দিতে হবে। না হলে খাবো না। আমি ভাই এসব জোরাজুরি করতে পারি না। তাই আগে ভাগে দরকষাকষি করে নেই যে এবার কিন্তু আমার পালা। অয়নকে বললাম তুই দামাদামি কর। তোদের এলাকার মানুষ যা বাটপার। শুধু ঠকাইতে চায়। অয়ন এবং দোকানদার গজ্জনি ফজ্জনি টাইপ বাংলায় দুই খানা সুরমা মাছের দামাদামি করে ফেললো। অয়ন বললো কক্সবাজারের মানুষ টাউট নয়। চট্টগ্রাম থেকে আসা লোক গুলো ওরকম। এ এক চিরন্তন ধাঁধা। আমরা খুলনাবাসীরা যেমন মনে করি খুলনার লোক একদম দুধে ধোওয়া। যত দোষ সব সাতক্ষীরার মানুষের।

মাছ ভাজা হতে বেশ দেরী। পাশের দোকানে উচ্চস্বরে গান বাজাচ্ছে। আমাদের পাশে এক দল ছেলে গোল হয়ে বসেছে। তাদের সবাই হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট পরা। অনেকটা টুরিস্ট ভাব। কাঁকড়া ভাজা খাচ্ছে তারা। একবার ভাবলাম একই তেলে কাঁকড়া , চিংড়ি, সুরমা সবই ভাজছে! মনের মধ্যে কুরকুর করতে লাগলো। মনকে বোঝালাম বাইরে এসে এত ভার্জিন মন নিয়ে চললে হয় না। কি হয়েছে একই তেলে কাঁকড়া ভেজেছে তাতে। প্রথম যেবার ছেড়া দ্বীপ যাই। আমরা সবাই ফ্লাইং ফিশ ভাজিয়ে নিয়ে খাচ্ছি। এমনি সময়ে এক সহপাঠি সামুদ্রিক কাকড়া ভাজার অর্ডার দিলো। তাই দেখে অনেকের গা গুলিয়ে উঠলো। এক বান্ধবী তো বমিই করে দিলো। আজকের ছেলেগুলো গোল হয়ে বসে কাকড়ার ঠ্যাং ভেঙে খেতে লাগলো। আমি ওদিকে তাকাতে চাচ্ছিলাম না কিন্তু বেহায়া চোখ বারবার ওদিকে চলে যাচ্ছে। অয়নকে বললাম আর কতক্ষণ? সে বললো সবুর কর। দোকানিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, মামা আর কতক্ষণ?

অবশেষে আমাদের মাছ এলো। বেশ সাইজের মাছ। খেলাম। ভালো লাগলো। খাওয়া দাওয়া শেষে দাম দিতে গিয়ে বিপত্তি। অয়ন মাছের দাম ঠিক করেছিলো একশো টাকা। দোকানি এখন একশোটাকা নিতে রাজি নয়। সে বারবার বলছে, একশো টিয়া!!কি হন ভাই একশ টিয়া!মাছর সাইজ দেইখকনে! এত্তবড় দুওয়া মাছ হনিকায় একশ টিয়া দি দিব নেকি অনরে! ইয়ান কি হন ভাই।

আমরা আর কি বলবো। জীবন হলো একটা উন্মুক্ত শিক্ষাক্ষেত্র। এখানে মানুষ চিনতে হয় বারংবার। আমি অয়নের মুখের দিকে তাকালাম। সে অস্ফুটে বললে, আরো একশো টাকা।

অয়নকে বিদায় জানিয়ে হোটেলের সামনে এলাম। বন্ধুটি রাগে ফেঁটে পড়লো। আসতেছি বলে আমি তাকে এক ঘন্টা বসিয়ে রেখেছি। সন্ধ্যার পরে আমাদের মিশন ছিলো আঁচার কেনা। তাকে গজগজ করার সুযোগ না দিয়ে আমি হাত তুললাম, এই ট্যাক্সি বড় বাজার যাবে?
কক্সবাজারের বড় বাজার এবং বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের বড় বাজারের মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। বৃষ্টির কারনে রাস্তায় প্যাঁচপেঁচে কাঁদা জমে গেছে। সিএঞ্জি চালককে বললাম একটু শুকনো জায়গা দেখে নামিয়ে দিতে। পায়ের আঙুলের চামড়া কেটে যাওয়ায় দুটো ওয়ান টাইমার লাগিয়ে নিলেও পা টেনে টেনে হাটতে হবে। প্রথমে ঢুকলাম কাপড়ের দোকানে। আম্মার জন্য বেডসিট কিনবো। রাঙামাটি গিয়ে চাকমাদের তাঁতে বোনা বিছানার চাদর কিনেছিলাম। আম্মা খুব পছন্দ করেছিলেন। এবার ঘুরে ফিরে দামাদামি করে অবশেষে খাসিয়াদের তৈরী সাদা কালোয় সুতোয় বোনা একটা বিছানার চাদর নিলাম। বেশ ভারী। এই চাদর টা পেয়ে আম্মা বলেছিলেন যে আমি আজ পর্যন্ত যা কিনেছি তার মধ্যে এটাই সব থেকে সেরা জিনিস কেনা হয়েছে। আরো একটা নিয়ে গেলে ভালো হতো। আব্বার অত পছন্দ হয়নি। আম্মার ঝংকার দিয়ে বললেন তুমি চাদরের ভালো মন্দ বোঝো কি! কিছু ক্ষেত্রে আমার আম্মা তোমার আম্মা একই ক্যারেক্টারিস্টিকস বহন করে। ঘর গোছানো, সংসারের জিনিসের ব্যাপারে তাদের একনিষ্ঠ ধারণা যে তাদের মত ভালো আর জগতের কেউই বোঝে না।

এরপরে গেলাম আচার খুঁজতে। বন্ধুটি কয়েক মাস আগে কক্সবাজার ঘুরে গেছে। তারই আলোকে সে আমাকে গাইড করছে। আমি লাস্ট কক্সবাজার এসেছিলাম ২০১০ এ। তখনকার কক্সবাজার আর এখনকার কক্সবাজার অনেক বদলে গেছে। সেই সময়ে বার্মিজ মার্কেটে গিয়ে পুতুলের মত সুন্দর রাখাইন মেয়েদের সাথে অনেক টাংকি মেরেছিলাম। বিশেষ করে এক দোকানি মেয়ের চম্পাকলি আঙুলের কথা আমি আজো ভুলতে পারি না। তার আঙুলগুলো কেন জানিনা বুকের মধ্যে উষ্ণতা জাগিয়েছিলো। কোন একটা ছল ছুতায় আমি সেই আঙুল ছুয়েছিলাম। অভিনয়ে অতটা দক্ষ নই আমি। আমার মনের কথা মেয়েটা পড়েছিলো। সে হেসেছিলো। আমি বিব্রত হয়েছিলাম। সেটুকুই। এই বয়সে এসেও ইচ্ছে করছিলো বার্মিজ মার্কেটে যেতে। বন্ধুটি ঠিক মনে করতে পারলো না বার্মিজ মার্কেট কোথায় আছে। গুগল ম্যাপও আমাকে হেল্প করলো না। সামনের মার্কেটে প্রচুর আচারের দোকান। আমাদের দেখে মধ্যবয়স্ক দোকানি ডাকলেন, আচার লাগবে?

ছোট্ট দোকান। থরে থরে সাজানো। মোটাসোটা হাসি খুশি টাইপের মানুষ। এমন মানুষই দোকানি হিসেবে ভালো। অল্পতেই জমে গেলো আমাদের। আমি দোকানিকে বললাম, মামা আপনি আমাদের ভালো আচার দেবেন, আমি আপনাকে কাস্টমার দেবো। বুঝতেই পারছেন অনলাইনের যুগ। দোকানি কেন জানিনা আমার কথাটি খুব পছন্দ করলো। তেঁতুল, চালতা, আম, বরই, জলপাই বিভিন্ন রকমের আচার কিনলাম। সাথে স্পেশাল চকোলেট। দোকানি মামা তার কথা রেখেছিলেন। ফার্স্ট ক্লাস আচার দিয়েছিলেন। বিশেষ করে আমের আচার। আব্বু পারলে তো সব গুলো প্যাকেট একাই খেয়ে ফেলেন। পরে আমার কক্সবাজার বাসী এক কলিগের কাছে শুনেছি যে দোকানি আমাদের কাছ থেকে ন্যায্য দামই নিয়েছে। একটুও ঠকায়নি। ভাবতেই ভালোই লাগে এখনো কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে ব্যবসা ব্যবসাই, জোচ্চুরি নয়। আফসোস হয় কেন যে দোকানি মামার একটা ছবি তুলে নিয়ে আসলাম না। তবে আমিও আমার কথা রেখেছি। দোকানি মামা আমাকে দশটা কার্ড দিয়েছিলো। কক্সবাজারে বেড়াতে গেছে এমন কলিগদের আমি কার্ডগুলো দিয়েছি। তারা আচার কিনে সন্তুষ্ট হয়েছে। তবে বোকামির এক শেষ। নিজের জন্য একটি কার্ড রেখে দেওয়া উচিত ছিলো আমার। ইচ্ছে আছে আবার যদি কখনো কক্সবাজার যাই তবে আচারের দোকানটি খুঁজে বের করার।

দুই হাতে এক গাদা ব্যাগ নিয়ে আমরা যখন হোটেলে ফিরলাম তখন ঘড়ির কাঁটা এগারো ছুই ছুই করছে। আমার খেতে ইচ্ছে করছিলো না। বন্ধুটি জানালো তার প্রচন্ড খিদে লেগেছে। আমি বললাম, তুই খেয়ে আয়। আর আমাকে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিতে বল।

বন্ধুটি খেতে গেছে। আমি শাওয়ার নিয়ে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে বের হয়েছি এমন সময়ে ডোরবেল বাজলো। দরজা খুলে দেখি মোতালেব হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেতে কফি এবং স্যান্ডুইচ। স্যান্ডুইচ কেন?
- আপনার রুমের জন্য অর্ডার করা হয়েছে।
- ওকে। এখানটায় রেখে যাও।

লিখতে লিখতে এই পর্যায়ে এসে কি বোর্ড থেকে আঙুল তুলে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে হলো। কতটুকু লিখবো? কি লিখবো? কতটুকু বাদ দিবো। অবশেষে সিদ্ধান্তে এলাম। আমি মূলত নিজের জন্যেই লিখছি। আজ থেকে অনেক বছর পরে যখন স্মৃতির ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়বো তখন যেন পড়তে পারি নিজেই নিজের ভ্রমণবিলাস সেজন্যেই লেখা শুরু করেছিলাম। অনেক দিন আগে। ট্যুর থেকে ফিরে আমার অরিজিন্যাল আইডিতে এই ভ্রমন কথা লেখা শুরু করেছিলাম। সেখানে সবাই যেন ব্যস্ত। সাকুল্যে সাতটা লাইক পড়েছিলো আর একটা কমেন্টস। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই লিখেছিলো, আরে তুমি যে দেখছি সাহিত্যিক হয়ে গেছো। আমি লেখার আগ্রহ হারিয়েছিলাম। এখানে দেখছি তোমরা বেশ পড়ছো। অন্তত মন্তব্য করছো। ভাবলাম নিজের জন্য লিখছি তখন সবটুকুই লিখি। একটু পাগলামির কথা লিখি। যদিও এটা আমার এই বয়সের সাথে যায় না। খুব বেশী কি বয়স হয়ে গেছে আমার! নাহ কথা বলার এই তরিকা বদলাতে হবে।

মোতালেব যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে গেলো স্যার বিয়ার লাগবে? আমি পরে জানাবো বলতে সে চলে গেলো। হলিউডের সিনেমায় দেখেছি নায়কেরা ঘুম থেকে উঠে কফি মগ হাতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। পরনে থাকে আন্ডারওয়ার আর গোল গলা গেঞ্জি যাকে আমরা এখন টি শার্ট বলি। আমরা ছেলে বেলায় একে গেঞ্জি নামেই চিনতাম। আমাদের এলাকার এক মহিলা বলতো গঞ্জি। তো যেই ভাবা সেই কাজ। তোয়ালে ছুড়ে ফেলে ব্যাগ থেকে টিশার্ট আর শর্টস বের করে সাজ দিলাম। কেন জানিনা সাজটা পছন্দও হলো। আমি ভাই সেলফিবাজ পাবলিক নই। তাই ছবি টবি কিছু তুলিনি। কফি মগ হাতে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ালাম। ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাপটা দিলো শরীরে। দূরে সমুদ্রকুলে ঝাউ গাছের কালো কালো মাথা দেখা যাচ্ছে। সাগরের স্পষ্ট গর্জন শুনতে পাচ্ছি। আমি সিনেম্যাট্রিক স্টাইলে কফি খাচ্ছি। অন্যরকম ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। কোন একজন মানুষের কথা ভাবছিলাম। দোষ তারও ছিলো। দোষ আমারও ছিলো। দোষ ছিলো ভালোবাসাবাসির। দোষ ছিলো বুঝতে না পারার। কতক্ষণ কেটে গেছে বলতে পারবো না।

হঠাৎ পাশের বেলকনিতে চোখ পড়তে দেখলাম কেউ একজন তাকিয়ে আছে। সোজাই তাকিয়ে আছে। বয়স কত হবে। চল্লিশ কি পঞ্চাশ? ঠিক বোঝা যায় না। কিছু মানুষ আছে বয়স যাদের হার মানাতে পারে না। এ তাদেরই একজন। আমি ভ্রু নাচাতে পারি না। তবু ভ্রু নাচানোর চেষ্টা করলাম। সে ভ্রুক্ষেপ করলো বলে মনে হলো না।

কাপের অবশিষ্ট কফি টুকুতে চুমুক দিয়ে দেখি হিম হয়ে গেছে। হঠাৎ মনে পড়লো আরে আমি যে এখানে এই উদ্ভট ভাবে দাঁড়িয়ে আছি। তাও বেলকনির বাতি জ্বালিয়ে। বলা যায় না কোন বেলকনিতে কার ক্যামেরার রেজুলেশন কেমন? এখন তো আমার ফেসবুক ফটোগ্রাফির যুগ। যে যেখানে যা পায় তাই তুলে এনে ফেসবুকে পোস্টায়। একথা মনে পড়তেই আমি তিড়িং বিড়িং করে রুমে এসে কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেলকনিতে ফিরে এলাম।

এবার পাশের বেলকনি থেকে আওয়াজ এলো। ভরাট গলায়। "আগের দৃশ্যপটটাই তো সুন্দর ছিলো"।

জীবন হলিউডের সিনেমা নয়। পরের দৃশ্যে যা ঘটার যার কিছুই ঘটবে না। কথার পিঠে কথা বলতে পারা আমিও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

বন্ধুটি ফিরে এসে বললো, খেলে তো না। আজকের ভর্তাটি অনেক অসাম হয়েছিলো।
- সাগর পাড়ে যাবা?
- এত রাতে?
- আগামীকাল তো এই সময়ে তো আর সমুদ্র শহরে থাকবো না। তাই যতটুকু পারা যায়।
- মিয়া পানিতে নামলা না। আবার সাগর সাগর করতেছো।
- তুমি না গেলে থাকো আমি একলাই যাই।
- আরে নাহ। রেডি হও। আমি ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি।

সমুদ্র শহরে ২৮ ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছি ইতোমধ্যে। সময় কত দ্রুত বয়ে চলে।

একটু একটু করে রাত বাড়ছে আর সমুদ্র তীরে মানুষের আনাগোনা কমছে। সমুদ্র তখনও একই লয়ে গেয়ে চলেছে সঞ্জীবনী গান। এ যেন আত্মমগ্ন হয়ে গেয়ে চলা। কে শুনলো আর কে শুনলো না তাতে কিছুই আসে যায় না তার। কাকে রেখে কাকে গান শোনাবে সে। তাইতো আপন মনে গান গেয়ে চলে সে। এখনও কিছু লোক জেগে আছে। কেউ মনের তাগিদে, কেউ দেহের তাগিদে আর কেউবা জীবিকার তাগিদে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ কত কিই না করে আবার কিছু কিছু মানুষ বাঁচার মানেই ভুলে যায়। বেঁচে থাকা তাদের জন্য নরক যন্ত্রণা সম। নিস্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম বালুকা বেলায়। রাত দুটো বেজে গেছে। বন্ধুটি বললো, চলো ফিরি। ফেরার পথ ধরলাম। নিত্যদিনের কক্সবাজার ঘুমিয়ে আছে অঘোর ঘুমে। শুধু মাত্র হোটেলের শহর বলে অনিত্যদিনের অতিথিরা জেগে আছে আপন ফ্যান্টাসিতে। কত কত সব হোটেল। নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করছে সব নাম। লাল নীল মরিচ বাতিতে সাজিয়েছে। একদা এখানে জোনাক পোকাদের রাজত্ব ছিলো। বিচ ঘেষা হোটেলের চত্বরে কারা যেন এত রাতে বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছে। সবার মুখে হাসি উপচে পড়ছে। ঢাকা থেকে বান্দরবন হয়ে কক্সবাজার। প্রায় এক সপ্তাহের জার্নিতে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

মেইন রাস্তায় চলে এসেছি। হঠাৎ শুনলাম, এক্সিউজ মি ভাইয়া। আমরা অবাক হয়ে পিছু ফিরলাম। তিনটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ চটকদার পোষাক পরা। মাঝরাতেও কড়া সাজ চোখে পড়ছে। বললাম,
- আমাদের বলছেন?
- হ্যাঁ।
- বলুন।

তারা কিছু বলে না। চুপ করে হাসে। আমাদের বুঝতে একটু দেরী হয়ে গেছে। বললাম, স্যরি, রঙ নাম্বার। তারা আর কিছু বললো না। আমরা চলে এলাম। বন্ধুটি বললো, আরেকটু কথা বললেই হতো। আমি বললাম, চল দাম দর করে আসি। দুজনের জন্য কত নেবে!

আমরা হোটেলেই ফিরে গেছি। মোতালেব এখনও জেগে। আমাদের রুমে স্প্রে করতে এসেছে। ছেলেটিকে সেই সকাল থেকে দেখছি। এ ঘুমায় কখন! মোতালেব হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো স্যার কিছু লাগবে? এই মধ্যরাতেও মানুষ কিভাবে হাসি মুখে কথা বলতে পারে জানিনা। আমি অন্তত আজকাল আর এটা পারি না। মোতালেবকে বললাম, বিয়ার হবে?
- জি স্যার। ভালো বিদেশী বিয়ার আছে?
- দেশী বিয়ার হয় বলে শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না।

মোতালেব হাসে। বন্ধুটি বাগড়া দিলো। না বিয়ার দিতে হবে না এত রাতে। আমার দিকে ফিরে বলে, তোমার কি হয়েছে? হঠাৎ কেন এত হতাশ হয়ে পড়েছো?

মোতালেব তখনও দাঁড়িয়ে। বললাম, কিছু বলবে?
- স্যার যদি কিছু মনে না করেন।
- মনে করবো না। বলে ফেলো।
- আপনারা তো সিংগেল এসেছেন। যদি সেরকম কিছু লাগে। ফোন দিলেই চলে আসবে।
- না ভাই সেরকম কিছু লাগবে না। যাও তুমি। ঘুমাও।

ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। বিছানাটিকে অনেক বেশী নরম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছি বিছানার চোরাবালিতে।

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৬ রাত ৯:১২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×