আজ পহেলা শাওয়াল। পবিত্র ইদ উল ফিতরের দিন। হিজরী ক্যালেন্ডার অনুসারে কেউ যদি জন্মদিন পালন করতো তবে আজ আমার জন্মদিন। আরবী মাসের অনুসারে আমার জন্ম পবিত্র ইদুল ফিতরের ভোরে। গত কয়েকদিন মনটা অবসন্ন হয়ে আছে। সব ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। মোবাইলের এলার্ম ঘড়ি ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। সাড়ে পাঁচটা। সকাল ছয়টায় অফিসে যেতে হবে। ইদের দিন অফিস! তাও বাংলাদেশে! সবাই শুনে অবাক হয়। অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। কি এমন চাকরি যে ইদের দিনেও ছুটি দেয় না। যতদিন চাকরি চেঞ্জ না করতে পারছি না ততদিন না হয় আমি ব্যক্তিগতভাবে এই প্রশ্ন তোলা থেকে বিরত রইলাম। ছোট বেলায় ঘুম ভাঙাতে এলার্ম ঘড়ির দরকার হতো না। মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজানের সুর ভেসে আসার আগেই ঘুম ভেঙে যেত। ঘরের বাইরে বেরোতে চাইলে আম্মার ধমক খেতে হতো। আকাশ ফর্সা হয়ে এলেও বাড়ির আঙিনায় তখনো জমাট অন্ধকার।
ঘুম ভাঙতেই গোছলখানায় ঢুকলাম। ঝটপট দাঁত ব্রাশ করে নিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালাম। বাইরে বোধ হয় বৃষ্টি হচ্ছে। আমার ঘর থেকে বৃষ্টি দেখা যায় না। মুষলধারে বৃষ্টি না হলে শব্দও খুব একটা পাওয়া যায় না। পানিতে বৃষ্টির ছোঁয়া। হিম শীতল পরশ। সাবান মেখে গোছল করলাম। হঠাৎ মনে হলো সাবান খানা নতুন হলে মন্দ হতো না। গতকাল মনে থাকলে ছোট একটা সাবান কেনাই যেতো। ঈদের দিনে কসকো গ্লিসারিন সাবান মাখার অভিজ্ঞতার ফ্লেভার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। এখন কি বাজারে কসকো সাবান পাওয়া যায়? অনেক দিন কেনা হয় না।
গোছল করে বের না হতেই ছয়টা বেজে গেলো। পাঞ্জাবী প্যান্ট সব ইস্ত্রি করে টেবিলে রেখেছিলাম। পরার সময় পেলাম না। অফিসে চলে গেলাম। শিফটমেট আসল আধা ঘন্টা লেট করে। অফিসের কাছেই বাসা। তাকে বসিয়ে রেখে রুমে এসে ইদের সাজ নিলাম। ইদের দিন পাঞ্জাবী না পরলে খুব অড লাগে। হাত ঘড়ি পরলাম। যদিও সারা দিনে ভূলেও একবার সময় দেখতে ঘড়ির দিকে তাকানো হয় না। অভ্যাষবশত পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখি। ডাইনিংয়ে গেলাম। সেমাই এবং পায়েস। ইদানিং পায়েস খেতে বেশ লাগে। আজকের পায়েস রান্নাটা চমৎকার হয়েছে। নানীর কাছে শুনেছি ওনাদের ইয়াং বয়সে গ্রাম দেশে সেমাইয়ের প্রচলন সেভাবে ছিলো না। বাড়িতে বাড়িতে পায়েস রান্না হতো। পিঠা বানানো হতো। আমাদের গ্রামে পায়েসকে বলা হয় গুড়ের খির। আর মিষ্টি ছাড়া রান্না করা পায়েসকে বলা হতো খির। তবে ইদের দিন গুড়ের খিরই রান্না হতো। সেমাইয়ের প্রচলন শুরু হওয়ার পর সবাই সেমাই খাইতে চাইতো। গুড়ের খির অচ্ছ্যুত হয়ে পড়ে রইতো হাড়ির কোনায়। তারপর এক সময় গুড়ের খির হারিয়ে গেলো গ্রাম দেশ থেকে। এখন সেখানে সেমাই, লাচ্ছি, নুডলস, খিঁচুড়ি জায়গা করে নিয়েছে। অনেকে শখ করে ঈদের দিন পায়েস রাঁধে। বেশ লাগে। গরুর দুধ, গাছের নারিকেল দিয়ে রান্না করা সেমাই। খাওয়া দাওয়া করে অফিসে এলাম। এখানে দুই শিফটে ঈদের জামাত হবে। প্রথম শিফটে কলিগ নামাজ পড়তে গেলো। কলিগ তাবলীগ করা হুজুর। ভালো লোক। যাওয়ার আগে আমাকে আতর মাখিয়ে দিয়ে গেলো টুপিতে, কপালে, হাতের তালুর উলটো পিঠে। আমি বসে রইলাম। ফোন বের করলাম। প্রথমে নানীর সাথে ফোন দিলাম। নানী ভাত খাচ্ছেন। ইদের দিন সকালে সেমাই না খেয়ে ভাত খাওয়ার জন্য ছদ্ম বকা দিলাম। এরপর আম্মুকে ফোন দিলাম। আম্মু দুই মিনিট কথা বলে আব্বুকে ধরিয়ে দিলেন। আমি দিব্য চোখে দেখতে পেলাম আম্মু কান্নাকাটি করছেন। আমার গলা ধরে এলো আব্বুর সাথে কথা বলতে গিয়ে। আমি ছোট ভাইকে চাইলাম। ছোট ভাইয়ের আবার এসব আবেগের বেগ টেগ কম। সে আমাকে ভালো করে খাওয়ার, ঘোরার উপদেশ দিলো। অনেক সময় ছোটরা বড় হয়ে যায়। দাদী, ছোট কাকা, মেঝ কাকা, নোয়া কাকা, বড় মামা, ছোট মামা, ফুফু, মেঝ খালা, সেজ খালা, ছোট খালা, ছোঁয়া আপু, রাজ, কিশোর দা, অমুক নানা, তমুক নানা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ফেসবুকের বন্ধুদের সবাইকে একে একে ফোন দিলাম। অন্য অনেককে চেষ্টা করেছি। হয় লাইন ব্যস্ত নয় সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবার অনেক বন্ধুরা ফোন করেছে। আজ সবার সাথে দিল খুলে কথা কইলাম। মন ভালো তো জগৎ ভালো।
শিফটমেট নামাজ থেকে ফিরলো। আমি সেকেন্ড কিস্তিতে খাইতে গেলাম। এবারের মেন্যু খাসির মাংস ভূনা সাথে গরম গরম ভাজা লুচি। খাসির মাংস আমার খুব প্রিয় না। তবে আজকের রান্নাটা ভালো হয়েছে। পাশে আমার রুমমেট খাচ্ছে। সে বললো, এটা খাসি নয় পাঠার মাংস। আমি শুধাইলাম এত পাঠা বিশেষজ্ঞ হলেন কিভাবে?
খেয়েদেয়ে নামাজ পড়তে গেলাম। সাড়ে আটটার জামাত। আমি ঢুকেই দেখি সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। হুজুর সবাইকে নামাজের নিয়ত বলে দিচ্ছেন। সেকেন্ড জামাতে মানুষ কম হয়। তাও তিন কাঁতার লোক। আমি কাতারের অপূর্ণ অংশে গিয়ে দাঁড়ালাম বাচ্চাদের সাইডে সরিয়ে দিয়ে। নামাজ শুরু হয়েছে। আমার পাশে কিউট একটা বাচ্চা দাঁড়িয়েছে। সে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি যা যা করছি তাই করছে। মনসংযোগ বিঘ্ন করছে বলে বিরক্ত লাগলেও মজা লাগছিলো। আমরাও ছোটবেলা হয়তো এদের বয়সে এমনি করতাম। নামাজ শেষ হলো। কোলাকুলির পালা। উফস মাজা ধরে গেলো। এত কোলাকুলি আমি আগে কখনো করিনি। বাংলাদেশের মানুষ সব খাটো হয়ে যাচ্ছে নাকি! ঝুকে ঝুকে কোলাকুলি করতে হয়।
অফিসে দুপুর হয়ে গেলো। লাঞ্চ করতে গেলাম দুটোয়। আশ্চর্য গত মাসে একদিনেও দুপুরে ক্ষুধা লাগেনি। অথচ আজ বেলা বারোটা না বাজতেই পেটে ছুঁচোর কেত্তন শুরু হয়ে গেছে। পোলাও, মুরগীর রোস্ট, খাসির রেজালা, সালাদ, কোল্ডড্রিঙ্কস, আঙুর সমেত জম্পেশ লাঞ্চ হলো। যদিও গোমাংসকে মিস করছিলাম। গোমাংস ছাড়া ইদের ফিস্ট অপূর্ণই রয়ে যায়। খেয়ে দেয়ে রুমে এলাম। ফ্রেন্ড ফোন দিলো তার রূমে যেতে। সে বাড়ি থেকে পিঠা এনেছে। নকশি পিঠা। এই পিঠা আমাদের দিকে হয় না। এমনি ভরপেট খেয়ে এসেছি। ইদের দিন ঠেসে না খেলে কেমন করে হয়! মজা করে পিঠা খেলাম দেড় পিস। আর ভাগের বাকী দেড় পিস পলিথিনে মুড়ে রেখে দিলাম পরে খাওয়া যাবে বলে। বিছানায় শুয়ে কখন ঘুমিয়ে গেলাম টের পাইনি। পাঁচটায় ঘুম ভাঙলো।
সন্ধ্যায় এক বন্ধুর সাথে মেঘনা পারে ঘুরতে বেরুলাম। হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি। ঘুম থেকে উঠে মাথাটা ভার হয়ে আছে। ভালো লাগছিলো না। পরিবেশটাও থমথমে, গুমোট গরম। শ্রাবণের মেঘনা আকাশের সাথে থম মেরে আছে। তবু বন্ধুটি যখন এসেছে তাকে কিছু সময় তো দিতেই হয়। বৃষ্টির ফোঁটার জোর বাড়ছে। এক বয়স্ক লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এক হাতে একটা এলুমিনিয়ামের পাতিল। অন্য হাতে ঢাকনা। ঢাকনা দিয়ে মুরুব্বি বৃষ্টির ফোঁটা থেকে মাথা বাঁচিয়ে পথ চলছেন। ফেরার পথে রিকশা না পেয়ে অনেকটা পথ হেঁটে ফিরতে হলো। বন্ধুটিকে বিদায় দিয়ে রূমে এসে বসলাম। এমন সময়ে তোমাদের টুম্পা ভাবী ফোন দিলো। অজানা এই মেয়েটি সব সময়েই ভালগার কথা বলে। আজকে আমি তাল দিলাম। পুরো চটি আলাপে মেতে উঠলাম দুজন। লাইফে এটাই আমার প্রথম অশ্লীল ফোনালাপ। আজ সব কিছু যেন বাঁধন হারা। তবে আজান পড়ে যাওয়ার আমি লাইন কেটে দিতে বাধ্য হলাম। এখনও মন অতটা শক্ত হয়নি। ল্যাপটপ খুলে সতীনাথের কন্ঠে ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে গানটি ছেড়ে দিয়ে লিখতে বসলাম। লেখাটা লিখতে পুরো বায়ান্ন মিনিট সময় লেগে গেলো। এরই মধ্যে সতীনাথ বহুবার গানটি গেয়ে ফেলেছে। ভাগ্যিস রেকর্ডের গান। না হলে এরই মধ্যে অন্তত সাতবার তাকে গলা ভেজাতে হতো। নটা বাজতে চললো। ডাইনিংয়ে খিচুড়ি আর কি কি খাবারের যেন আয়োজন আছে। যাই খেয়ে আসি! ঈদ মোবারক।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:৫৪