somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফেলে আসা পথে

১২ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খুব প্রিয় একজন মানুষের কথা মনে পড়ে গেলো। সুহৃদ মানুষটিকে বহুকাল মনেই পড়তো না। অথচ একসময় দুজনের কি সখ্যতাই না ছিলো। স্কুল থেকে ফিরে তার কাছে চলে যেতাম। বারান্দায় পাতা চৌকির উপর বসে কত কিছু নিয়েই না গল্প করতাম। মানুষটি আমাদের পাড়াতেই থাকতেন। কয়েক বাড়ি পরে। মাটির ঘর, বাঁশের চাঁচের বেড়া, উপড়ে খড়ের ছাউনি। তাদের নিজেদের বাড়ি নয়। নাম মাত্র ভাড়াতেই তারা এই বাড়িতে উঠে আসে গ্রাম ছেড়ে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ও কন্যাকে বিয়ে বাস। প্রথম পক্ষের স্ত্রী ও পূত্রগণ পৈত্রিক বাড়িতে থাকে। তাদের সাথে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। ক্লাস এইটে পড়তাম আমি। স্বামী-স্ত্রীকে আমি দাদু-দিদিমা বলেই ডাকতাম। কি করে যে তারা আমার এত আপন হয়ে গিয়েছিলো তা আমি নিজেই টের পাইনি।

দাদুর ভক্ত ছিলাম বলা যায়। কত বিষয় নিয়েই না আলাপ হতো। জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য। আমার পড়ার পরিধি ছিলো সীমিত। তাই নিয়েই দাদুর সাথে আলাপ করতাম। হয়তো পুঁথিগত জ্ঞানের বাইরে আমার শেখার হাতে খড়ি এখান থেকে। আম্মা বলতেন এটা আমার গর্ত। ইদুরের গর্ত। ইদুর যেমন গর্তে ছুটে যায় আমিও তেমন দাদুর কাছে ছুটে যেতাম। তখন আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। আমার লেখা কবিতার কেউ প্রশংসা করতো না। আমার ধারণা ছিলো পরপর দুটি বাক্যের শেষ শব্দের মিল থাকলেই কবিতা হলো। দাদু আমার কবিতা পড়তেন আর হাসতেন। ভালো হয়েছে বলতেন আবার ভূলও ধরতেন।

দাদু ব্রাম্মন ছিলেন। কয়েক ঘর শিষ্য ছিলো। দূরের কোন গ্রামে। মাঝে মাঝে তারা গুরুকে প্রণাম করতে আসতো। তাদেরকে তিনি উপদেশ দিতেন। তারা ছোট বাচ্চার মত উপদেশ শুনতো। আমিও তাদের সাথে বসে উপদেশ শুনতাম। তত্ত্বকথা শুনতাম। হিন্দু শাস্ত্রের কথা শুনতাম। বিশ্বচরাচরকে জানার আগ্রহ আমার অনেক দিনের। জানার সুযোগ না হলেও শোনার সুযোগ পেলে লুফে নিতাম। মনটা ভার হয়ে আছে। আমি সাজিয়ে লিখতে পারছি না। এক সাথে অনেক কথাই মনে পড়ছে। আবার মাথাটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কিছুই মনে পড়ছে না।

কলেজে পড়ার সময়ে খুলনা শহরে চলে আসি। মাঝে মাঝে বাড়ি যাই। একদিন বাড়ি গেলাম। সব কিছু স্বাভাবিক ছিলো। তখন দাদুর কাছে ছুটে যাওয়ার মাত্রা কমে এসেছে। আম্মা বললেন, একটা কথা শুনেছো? আমি বললাম কি কথা।
আম্মা বললেন, তোমার দাদু মারা গেছে।
তখনো মৃত্যুর সাথে আমি ততটা পরিচিত নই। চারকূলে আমার আত্মীয় পরিজন সবাই জীবিত। মৃত্যুর খবর আসে না বললেই চলে। আমি ঠিক বুঝে উঠে পারলাম না। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ ফেটে কান্না এলো। কাঁদছি। এমন সময়ে আম্মা ঘরে এলেন। হয়তো ভেবে পাচ্ছিলেন না কি সান্তনা দেবেন। কারণ তিনি ভালো করেই জানতেন দাদুর সাথে আমার আন্তরিক সম্পর্কের কথা। আম্মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, পাগল ছেলে! হিন্দু লোক মরে গেলে তাদের আবার কাঁদতে নেই।

আমি জানি আম্মা কিছু মিন করে বলে নি এই কথা। তবু মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে দিন শেষে আমরা হিন্দু মুসলমান হয়ে যাই কেন। আমার স্কুলের বন্ধুরা, যারা একসময় শুধু বন্ধুই ছিলো এখন এলাকায় গেলে দেখি এরা কট্টর হিন্দু হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে আমার উপস্থিতিতেই এরা মুসলমানদের বদনাম করা শুরু করে। ভূলে যায় আমি বন্ধু হলেও যাদের বদনাম করছে আমি তাদেরই একজন। অবাক হয়ে ভাবি, বন্ধুগুলো সব হিন্দু হয়ে গেলো কেন, বন্ধু হয়ে থাকলেই পারতো না। আরো বেশী অবাক হই যখন দেখি বন্ধুদের এসব আলোচনা আমাকে মর্মপীড়া দিচ্ছে। তাহলে আমিও তো ভেতরে ভেতরে মুসলমান হয়ে গেছি।

দাদু মারা যাওয়ার পরে দিদিমা বেশ ক বছর এলাকায় ছিলো। নিদারুন অর্থকষ্ট। পাড়া প্রতিবেশীরা টুকটাক সাহায্য করতো। কিন্তু সে জ্বলন্ত উনুনে এক আঁজলা জল সমতূল্য। আমার কষ্ট হতো। কিন্তু কিইবা করার ছিলো। টাকা পাবো কোথায় সাহায্য করার। আমাদের বারান্দায় দিদিমা এসে বসলে বেশী করে মুড়ি আচার বের করে আনতাম যাতে তিনি পেট পুরে খেতে পারেন। তারা ব্রাম্মন ছিলো বলে ছোঁয়াছুয়ির বাছবিচার ছিলো একদা। দিদিমা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিলেন। ভাত না খেলেও অন্য অনেক কিছুই খাওয়া শুরু করেছিলেন। শেষের দিকে তিনি যবনের ঘরে ভাতও খেয়েছেন। শেষের দিকে বলতে একবার এলাকায় গিয়ে শুনি দিদিমা একমাত্র মেয়েটাকে এক শুদ্রের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে বাপের দেশে চলে গেছেন। বাপের বাড়িতে ভাইপোরা আছে। তারা কি দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে দেবে না! হায়রে ভাত। হায়রে অন্ন। তোর জন্য মানব জনমের এত কষ্ট।

দিদিমা মাঝে মাঝে বলতেন, “দাদু চাকরি পেলে আমাকে একখানা ভালো শাড়ি কিনে দিয়ো”। আজ আমার শাড়ি কিনে দেয়ার সামর্থ্য আছে দিদিমা। কিন্তু কোথায় কোন দূর গ্রামে তুমি আছো নাকি নেই তার সন্ধান তো আমার জানা নেই। অনেককে শুধাইছি। কেউ বলতে পারে না। তোমার নামখানাও তো জানি না। দিদিমা বলেই ডেকে এসেছি পুরোটা সময়। আমি কিভাবে পৌঁছাই বলো তোমার কাছে! খুব বেশী মনে পড়ছে আজ। পোড়া চোখে এখনও দেখি জল আসে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×