সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। থামার নামটি নেই। গতকাল বিকেলে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। সাথে প্রবল বাতাস। হঠাৎ মাথায় ক্ষ্যাপামি চাপলো। ছাতা মাথায় দিয়ে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টির পানি রাস্তায় জমে গেছে। পা ভিজিয়ে হাঁটতে শুরু করলে গা ভিজতে সময় লাগলো না। প্যান্ট গুটিয়ে অনেকটা উপরে তুলেছিলাম। কিন্তু গায়ের গেঞ্জিও অনেকটা ভিজে গেলো। বাতাস আমার ছাতাটিকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। ছাতা সামলানোই শক্ত, কাপড় সামলাবো কি। তাদেরকে ভিজতে দিলাম। কেউ কোথাও নেই। একলা আমি ঝুম বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় হাঁটছি। আশপাশের ভবনগুলো থেকে পরিচিত মুখেরা উঁকি দিচ্ছে। নিশ্চিত ভাববে আমার মাথায় কিছুটা ছিট আছে। ভাবলে ভাবুক। মাঝে মাঝে ভালো লাগাকে পাত্তা দিতে হয়।
স্কুলে পড়ার সময় বর্ষাকালে স্কুল অলিখিত ছুটি হয়ে যেত। আমি নাচতে নাচতে গ্রামের বাড়ি ছুটে যেতাম। মামাবাড়ি দাদাবাড়ি এক গ্রামে হওয়ায় আমার ছিলো ডাবল মজা। গ্রামটা তখন গ্রামই ছিলো। রাস্তায় হাঁটু কাদা। মশার উৎপাত, সন্ধ্যায় কেরোসিনের বাতির আলো। বর্ষাকালে গ্রামে যাওয়ার প্রধান মজা ছিলো বৃষ্টিতে ভিজে পুকুরে সাঁতার কাটা। আমরা সাঁতার কাটা বললেও মুরুব্বিদের দৃষ্টিতে সেটা ছিলো পুকুরে দাপানো। অবশ্য দাপাদাপি করে পুকুরের পানি ঘোলা দই বানানোয় আমাদের জুড়ি ছিলো না।
পুকুর ভরা টলটলে জল। না নেমে পারা যায় বলো। ছোট বড় কয়েক জাতের শ্যাওলায় পুকুর সবুজ হয়ে যেত। মাঝ পুকুরে কলমি হেলেঞ্চার দঙ্গল। আমাদের ঝাঁপাঝাঁপিতে শ্যাওলা দোল খেতো। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে। আমরা পুকুরে ডুব দেই। পানির নিচ থেকে চটরপটর শব্দ শোনা যায়। আমরা বলতাম খই ভাজার শব্দ। দাদী যখন ধান দিয়ে খই ভাজতেন তখন চুলোর উপর রাখা মাটির হাড়িতে ঠিক এরকম শব্দ হতো।
বর্ষাকালে জোঁকের উপদ্রব খুব বৃদ্ধি পেতো। সারা বছর খোঁজ থাকতো না বর্ষাকাল শুরু হলেই জোঁকেরা সব কোথা হতে কিল বিল করে হাজির হতে যেতো। গোছল করার সময় টের পাওয়া যেতো না যে কখন জোঁক তার দুই মুখ লাগিয়ে টুক করে ঝুঁলে পড়েছে। উপরে ওঠার পর দেখতাম রক্তচুষে ফুলে উঠেছে তার চামড়ার শরীর। তখন আমাদের দেখে কে। জোঁক নিয়ে সেকি লাফালাফি। বড়দের কেউ ছাড়িয়ে দিলে বাড়ি থেকে এক মুঠো নুন এনে জোঁকের মুখে ছিটিয়ে দিতাম। লবন হলো জোঁকের বিষ। জোঁকটা রক্ত উগরে দিয়ে চিমটে হয়ে যেতো। কিন্তু তখনি মরতো না। জোঁকের মত শক্ত প্রান আর কোন প্রানীর আছে বলে মনে হয় না। খেঁজুর কাটা দিয়ে মাটিতে গেঁথে রাখার পরেও কয়েকদিন বেঁচে থাকতো জোঁক গুলো।
জোঁকেদের জন্ম ইতিহাস আমাদের ছোটদের মাঝে এক গবেষণার বিষয় ছিলো। বড়দের কাছেও ব্যাপারটা ধোঁয়াশার মত ছিলো। কেউ কখনো স্পষ্ট করে বলতে পারেনি ঠিক কোন কারণে শুধুমাত্র বর্ষার সিজনে জোঁক জন্মায়। আমাদের ধারণা ছিলো রঙধনুর মাধ্যমে আল্লাহ জমিন থেকে পানি আকাশে তুলে নেন। আর সেই পানির সাথে কিছু জোঁকও আকাশে উঠে যায়। আর যখন বৃষ্টি হয় তখন জোঁক আমাদের পুকুরগুলোতে এসে পড়ে। আকাশে রঙধনু দেখা গেলেই আমরা শুধু তাকিয়ে থাকতাম তা কিন্তু নয় ওদিকে কোন নদী কোন খাল থেকে পানি তুলে নেয়া হচ্ছে সেটাই হতো গবেষণার মূল বিষয়। আমরা একেক জন এরিস্টটল, গালিলিও হয়ে গম্ভীর চিন্তায় ডুব দিতাম। কখনো ভাবতাম শিবসা নদী থেকে যদি সব পানি রংধনু তুলে নেয় তবে কি হবে। নদী দিয়ে লঞ্চ চলবে কিভাবে? আমি বাবা মায়ের কাছে ফিরেই বা যাবো কিভাবে!
অবশ্য চিন্তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হতো না। পরক্ষণেই অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। বিকেলে দাদাবাড়ি থেকে মামাবাড়ি যেতাম। অল্প পথ। দাদাদের পুকুর পাড়ে পেয়ারা গাছ ছিলো। পেয়ারার ভারে গাছটা পুকুরের উপর ঝুঁকে থাকতো। পেয়ারা পাকার সুযোগ পেতোই না। বড় দেখে একটা ডাসা পেয়ারা ছিড়ে নিয়ে চিবোতে শুরু করতাম। জিভের উপর পেয়ারার রস, এক হাতে জুতো, আরেক হাতে কাঠের বাটের ছাতা। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। আগে কাঁদার মধ্যে কেউ হেঁটে গেছে। কাদায় পায়ের ছাপকে আমরা খোজ় বলি। খোজে পা রেখে রেখে এগিয়ে চলেছি। খোজে পা রাখলে আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা কমে। নতুন জায়গায় পা দিয়ে পিছলে পড়তে কে চায়। নানাবাড়ি পৌঁছে পইটনের (মাটির সিড়ি) উপর দাঁড়িয়ে বদনার পানি দিয়ে পা ধুয়ে ফেলি। এখানে ওখানে কাদা লেগে থাকে। অপটু হাতে ধোয়ার চেষ্টা করি। নানা বকা দেন। “থির (স্থির) হয়ে এক জাগায় (জায়গায়) বসতি পারো না”! স্থির হয়ে বসার সংকল্প করি। কিছুক্ষণ বসি। তারপর মনে হয় অনন্তকাল এখানে বসে আছি। বাইরে যাওয়ার জন্য মন ছটফট করে। পূবের বিলে নিশ্চয় এতক্ষণে সবাই ফুটবল খেলতে চলে এসেছে। এত বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে। নানী কোন কিছু খাওয়ার লোভ দেখিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিশ্বচরাচরে ডাকে মন কি এই মেঘলা দিনের আলোয় ঘরের কোনে চুপটি করে বসে। বাবা মাকে বলে দেওয়ার মত মহা হুমকি উপেক্ষা করেও আমি কাদায় লাফিয়ে পড়ি। বৃষ্টির মধ্যে শুরু হয় ফুটবল খেলা। দূরে গ্রামের কেউ কেউ গরুতে লাঙল জুড়ে বীজতলা তৈরী করছে। বৃষ্টি অঝোরে ঝরেই চলেছে।
আমি শৈশব পেয়েছিলাম। আমি গ্রাম পেয়েছিলাম। আমি বৃষ্টি দেখেছিলাম। যা আমাকে এখনো বৃষ্টি দিনে স্মৃতিকাতর করে তোলে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:৩২