পৃথিবীতে কোনকিছু ফেলে আসা বা ছেড়ে আসা বড্ড কঠিন কাজ । নিজের চেনা পরিবেশ নিজের চেনা ছায়া, গন্ধ, ছোঁয়া, দুম করে পেছনে ফেলে চলে যাওয়াটা বড্ড কঠিন একটা কাজ। বুকের ভেতর যে প্রচন্ড রক্ত ক্ষরন হয় সেই ক্ষরন যদি দৃশ্যমান হতো তাহলে ছেড়ে চলে যাওয়ার বদলে আইসিউ তে ভর্তি হতে হতো ।
বাবা সরকারী চাকুরে । এই আজ এখানে তো কাল ওখানে । তখনকার সময় যে বদলি কাটিয়ে নেয়া যেতো না তেমন কিন্তু না। কিন্তু বাবা কে কখনই দেখতমা না এই সব ব্যাপারে কথা বলতে । আশে পাশের অনেককেই দেখেছি বছরের পর বছর তারা একই এলাকায় থেকে হাতে পায়ে গাছ পাথর জমিয়ে ফেলেছেন এমন কি ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নাতি পুতির বিয়ের জোর ততবির চালাচ্ছেন । সেইক্ষেত্রে আমাদের এক সেট ব্যাগ গোছানই থাকতো বাবা কোন দিন না এসে বলেন একটু পরে ট্রাক আসবে মালপত্র রেডি করে ফেলো। আমরাও মুখ কালো করে যার যার বিছানাপত্র গোছাতে লেগে যেতাম ।
ময়মানসিং থেকে নওগা বদলি হয়ে যাচ্ছি । বড়দা কিছুক্ষন পরপর চোখ ডলছে সেই সাথে তার তল্পিতল্পা গোছাচ্ছে। চোখ ডলার কারন শিউলি আপা। আমরা ময়মনসিং এসেছি দুই বছর হলো। এর মধ্যেই বড়দার সাথে শিউলি আপার বেশ ভালই দহরম হয়ে গেছে । ছোট হিসাবে আমারো একটা সুবিধা ছিলো । শিউলি আপার বাসার মুলাটা তালটা কলাটার ভাগ পেতাম সেই সাথে চকলেট বিনিময়ে তাদের গোপন পত্রের চালান আমার হাতেই হতো । আমি নিষ্ঠার সাথে আমার দায়ীত্ব পালন করতাম অবশ্যই বিনিময় প্রথায় বিশ্বাস রেখে । শিউলি আপা কে দেখছি বাসার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে । আমাকে দুই তিন বার ইশারাও করেছে , পাত্তা দেই নাই । ছোট হলেও বুঝে গেছি আমরা চলে যাচ্ছি মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই । আমি অবশ্য মনে মনে খুশি পাশের দোকান থেকে বাকিতে চানাচুর আর বিস্কুট এনে খেয়েছিলাম কোন রকমে যদি যেতে পারি তাহলে আর দিতে হবে না কারন বাঁকি সোধ করার ইচ্ছা থাকা সত্বেও উপায় নাই , মা জানতে পারলে ঝাটা দিয়ে প্রথমে ব্রাশ করবে পরে কার্পেট ধোলাই করবে। টাকার পরিমান কম না প্রায় দশ টাকা । অবশ্য দোকাদার ছেলেটা ভিষন ত্যাদর দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার মনে করিয়ে দেয় বাঁকির কথা ।
মা নেয়ে ঘেমে একাকার । ফর্শা মুখ লাল টকটকে হয়ে আছে । কোমরে আঁচল গুজে খাটের নিচ থকে হাজারো ধুলার মাঝখান থেকে জোরাতালি দেয়া সুটকেস টা টেনে বাহির করতেই হাপিয়ে গেছে। আমাকে আড় চোখে একবার দেখে কিছু না বলে অন্যকাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলো । মা এর জন্য আমার খুব দুঃখ হয় শুনেছি মা খুব ধনী বংশের মেয়ে ছিলো । বাবা টিউশানি পড়াতো মা কে , একদিন সন্ধ্যায় বাবা মায়ের হাত ধরে নাকি কেঁদে বললো আমি তোমাকে ছাড়া বাচবো না। এতেই মা গলে গেলেন, তার ধারনা হলো বাবা এখনি গলায় ফাশি দিয়ে মরে যাবে, ওই দিন রাতেই মা বাবার হাত ধরে পালিয়ে গেলো তার মায়ের মানে আমার নানীর বিশ ভড়ি স্বর্ন আর নানার ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে । আমার মাটা কি বোকা । কেউ বললো তাকে ছাড়া বাচবে না ওমনি সে গলে গেলো । আজকাল কেউ এইসব বিশ্বাস করে নাকি । আমার নানার দিকের কেউই আমাদের দেখতে পারেন না । মামারা আমাদের দূর দূর করেন । নানী তার বিশ ভড়ি স্বর্নের দুঃখে নাকি এখনো তার মেয়ের মুখ দেখতে চান না। কেবল নানা মাঝে মধ্যে এসে আমাদের সাথে দুই তিন দিন থাকেন। সেই সময় অনেক মজা হয় । আমাদের বাসায় ঈদের আনন্দ লেগে থাকে । পেটপুরে ওই তিনদিন আমরা খাই । বাবাকে দেখেছি নানা যতোদিন থাকেন ততোদিন একদম বিষহীন সাপের মতো ঘরের কোনায় কোনায় ঘুড়ে বেড়ান মাঝে মাঝে ফনা তোলেন ঠিকি কিন্তু নানা কে দেখে তার ফনা নামিয়ে ঘরের কোন এক গর্তে ঢুকে যান। আমি অবশ্য একটা বিষয় ভেবে পাই না আমরা এতো বদলি হই নানা কি করে জানি ঠিকি আমাদের খোঁজ পেয়ে যান । হঠাত একদিন এসে আমাকে চমকে দেন । নানা আমাকে কালুয়া বলে ডাকে। আমি কালো তো তাই ।
শিউলি আপা জানালায় দাঁড়িয়ে চোখ বড়বড় করে আমাদের গোছগাছ দেখছেন । বড়দা একবার করে জানালায় যাচ্ছে আর চোখ মুছেতে মুছতে ফিরে এসে নিজের ভাঙ্গা ট্রাংক ঠিকঠাক করছে লজ্জিত ভঙ্গিতে । শিউলি আপা খুব উতসাহ নিয়ে তাকিয়ে থেকে চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করছে তোমার কি একটাই ট্রাংক বড়দা মাথা নিচু করে কেবল হুম বললেন । শিউলি আপা জানালা থেকে সরে গেলেন আমাকে আড়াল করে কিন্তু আমি যা দেখার তা ঠিকি দেখে নিলাম। শিউলি আপা মুখ বাকিয়ে ফিরে গেলেন । আমরা আসলে অনেক গরীব । বাবা যে বেতন পান তাতে আমাদের একদম চলে না। সরকারী বাসাও আমরা পাই না। ট্রাকে সব তোলার পরেও আর্ধেকেরও বেশি খালি পরে ছিলো। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড় । কি দরকার ছিলো এত্ত বড় হাতির মতো একটা ট্রাক আনা । আমাদের মালপত্র নাই বললেই চলে, আমরা মাটিতেই শুই, কেবল নানা এলে একটা চার পায়া যার দড়ি গুলো প্রায় ছেড়া ঘড়ের এক কোনে পাতা হয় কিন্তু নানা তাতে শোয় না বলে মাটিতেই নাকি অনেক মজা ঘুমাতে, আমি অবশ্য কোন মজাই পাই না, নান ঘুমিয়ে গেলে আমি চুপিচুপি গিয়ে সেই চারপায়ায় শুতে যেয়ে দেখি বরদা ঠ্যং উচু করে শুয়ে আছে।
থাকার মতো একটা বড় আলনা আছে যা গতো বছর কোরাবনীর ঈদে বাবা মা কে সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট থেকে কিনে দিয়েছিলো। আমরা কোরবানী দিতে পারি না , গরুর মাংসের অনেক দাম চল্লিশ টাকা কেজি, বাবা সর্বসাকুল্লে বেতন পান তিনশো টাকা । প্রথম যেদিন আলনাটা আমাদের বাসায় এলো আমরা আমাদের সকল আকর্ষন ওই আলনায় অনুভব করতে লাগলাম। একটু পরপর দেখে আসতাম আলনা জায়গা মতো আছে কি নাই । বড়দা বলেই ফেললো তার এই আলনার এক পাশে কাপড় রাখার অধিকার চাই । আমি ও ভাবছিলাম আমার হাফ প্যান্ট দুইটা রাখা যায় কি না কিন্তু দাদার ওমন চোটপাট দেখে আমার আর বলার ইচ্ছা হয় নাই । ঘরের মাঝখানে লম্বা করে টানানো রশিতে আমাদের কাপড় ঝুলে থাকতো । আমরা যে যার খুশি মতো যখন ইচ্ছা সেই রশি থেকে কাপড় টেনে নিতাম। আলনাটা আসার পর থেকে আমাদের বাসায় একটা আভিজাত্যের ছোঁয়া পেলাম । মাঝে মাঝে ভেজা কাপড় দিয়ে আলনা টা মুছে দিতাম, যাতে ধুলা না পরে । আসলে মোছার উসিলা ছুয়ে দেখতাম। কি যে ভালো লাগতো ।
আলনাটা ট্রাকের উপর টেনেটুনে তোলা হলো। আমাদের সবার কাপড় ওখানেই বিভিন্ন ভাবে ঝুলে ছিলো । আমার তো ট্রাংক নাই ট্রাংক কেবল বাবার ছিলো আর দাদা কোথা থেকে যেনো একটা ভাংগা ট্রাংক জোগাড় করে নিয়েছিলো । আমার তালি দেয়া হাফপ্যান্টা ঠিকি সবার উপরে দেখা যাচ্ছে। আম্মার আক্কেল দেখো, কেউ কালো প্যান্টে লাল কাপড় দিয়ে তালি দেয়? সুন্দর মতো সেই লাল তালি ওয়ালা প্যান্ট উঁকিঝুঁকি মারছে। বড়দা কিছুদিন আগে আমাদের বাসার পেছনের পচা ডোবা থেকে একটা হেড লাইট কুড়িয়ে পেছিলো। আমরা বাসার সবাই অনেক আগ্রহ নিয়ে ভাবতে বসলাম ওটা কিসের হেড লাইট । দাদা বললো আমি নিশ্চিত ওটা মটর সাইকেলের হেড লাইট এবং বাঁকি অংশ ওই ডোবায় আছে এর পর থেকে সে প্রায় ডোবার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো । সেই হেড লাইটাও ট্রাকের এক কোনে আরাম করে ঝিমাচ্ছে।
কিছুক্ষন পরে বড় ট্রাক ভাড়া করার আসল ঘটনা প্রকাশ পেলো । আমাদেরও এই ট্রাকে করে যেতে হবে । আমাদের সব ভাইবোনদের ঠেলে ঠুলে ট্রাকে তোলা হলো। আমি ট্রাকের এক কোনায় মাথা নিচু করে বসে রইলাম। পাড়ার বন্ধুরা সব দাত দেখিয়ে হাসছে। একজন তো বলেই বসলো কি রে তোরাও কি মালাসামান নাকি ? মায়ের কোলে আমাদের ছোট বোন অঞ্জু। গরমে ভিশন কষ্ট পাচ্ছে। অঞ্জুর গলায় অনেক শক্তি সে ভিষন ভাবে চিৎকার করে যাচ্ছে । মা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেও পারছে না। অসহায় গলায় বললো একটা কিছু দিয়ে বাতাস কররে বিল্টু আজ অনেক গরম পরছে। ট্রাকের কোনা দিয়ে লিটন উঁকি দিয়ে বললো ব্যান্ড পার্টি বাজাচ্ছিস ক্যান । আমি শুনেও না শোনার ভান করলাম। কষ্টে আমার চোখ বেয়ে পানি পরছে কিন্তু দেখানো যাবে না কিন্তু ঠিকি লিটন পাজীটা দেখে ফেললো তার মনে হলো তার কিছু একটা করা উচিৎ সে হাছরে পাছড়ে ট্রাকে উঠে ঘোষণা করলো আমি যাবো বিল্টুর সাথে । বিল্টু আমার জানের দোস্ত আমি আমার দোস্ত কে একা যেতে দিতে পারি না। আমার হাতটা টেনে নিয়ে ধরে বসে পরলো। লিটনের মা ভয়ানক চিৎকার করে কোথা থেকে এসে ওর দাদার হাটার লাঠি দিয়ে বেদম পেটাতে পেটাতে ট্রাক থেকে ছ্যেচরিয়ে টেনে নামিয়ে নিয়ে গেলো একফাকে আমাকে তার বিষ চোখের বিষ দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো। লিটন ছাড়া পাওয়ার জন্য ওর মায়ের চুলের মুঠি ধরে আর দুই পা দিয়ে কোমর ধরে ঝুলে পরলো আমি বিল্টুর সাথে যাবো বলে চ্যাঁচ্যাঁতে লাগলো । লিটনের জন্য মায়া হচ্ছে , মায়া খুব বাজে জিনিস না হওয়াই ভালো , আমি মায়া কে ত্যাগ করলাম।
বড়দা উঁকিঝুঁকি মেরে শিউলি আপাকে দেখার চেষ্টা করছে । শিউলি আপার দেখা নাই । আমি জানি শিউলি আপা আসবে না। কারন শিউলি আপারা আমাদের থেকে বড়লোক তাদের একটা সেলাই মেশিন আছে । বরদা মুখ কালো করে কেবল বললো বাবার আক্কেল টা দেখছিস । এর থেকে পায় হেটে গেলেও পারতাম । আমি নাকের শিকনি আর চোখের পানি মুছে সামনে দিকে তাকিয়ে থাকলাম । বড়দার মাথায় সমস্যা আছে ময়মানসিং থেকে নওগাঁ কেউ হেটে যায় নাকি ।
অবশ্য আমরা নওগাঁ যাবার পরে বড়দা একবার নিজে নিজে লুকিয়ে ময়মানসিং গিয়ে শিউলি আপাকে দেখতে গিয়ে ছিলো । বাড়ি ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে ছিলো আম্মা অনেক বলেও দরজা খোলাতে পারে নাই পরে বাবা এসে দড়জা খুলে কান ধরে রাম ধোলাই দিয়ে বড়দার গায়ে কালসিটে ফেলে দিলো । বড়দার জন্য অনেক দুঃখ হয়। শিউলি আপার কথা জিজ্ঞাসা করতেই চেচিয়ে বললো খবরদার ওই কালনাগীনির কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করবি না। পরে অনেক কষ্টে জেনেছি, বড়দা ময়মানসিং গিয়ে দেখেছে শিউলি আপা বড়দার স্কুলের বন্ধু সুজন ভাইয়ের সাথে এক রিক্সায় বসে হুট তুলে মালাই খেতে । জীবন বড্ড বিচিত্র । আমি তাই ভেবে রেখেছি আমি জীবনে কোনদিন প্রেম করবো না।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০২২ সকাল ৭:৩৯