মোহনের একদমই ইচ্ছা ছিল না দোকানে বসার । তবুও বসতে হোলো । কি আর করে ? বাবা দুদিন ছাড়া অসুখে পড়ছে ! তবে , এরসাথে তার পড়াশুনার পাঠও চুকলো । মাধ্যমিকটাও দেওয়া হোলো না । যদিও পড়াশুনা নিয়ে তেমন আফশোষ ছিল না তার । পড়াশুনাটা তার কাছে এমন কিছু আহামরি লাগতো না । তবে তার ট্যাক্সি ড্রাইভার হওয়ার ইচ্ছে ছিল ! পাড়ার এক দাদার কাছে কিছুদিন শিখেও ছিল । যদিও তার ইচ্ছে ধোপে টেকেনি ! বাবার মনোহারি দোকানেই বসতে হয়েছে তাকে । কিন্তু মে্যেদের সাজার জিনিস বেচতে মোহনের একদমই মন চাইছিল না ! যদিও বন্ধুরা বলেছিল ' তোর তো কপাল খুলে গেলো রে ! তোর দোকানে মেয়েদের ভিড় লেগে থাকবে ! '
এর কয়েক বছরের মধ্যেই দোকানটা তার সয়ে গেছিল বা সওয়াতে হয়েছিল । তার দোকানটা বেশ ভালো জায়গায় । কাছেই অফিস-পাড়া , স্টেশন , কলেজ । যেতে আসতে অনেক মে্য়েরাই আসে তার দোকানে । তবে মে্য়ে বলে আলাদা কিছু নয় । বাবা বলে দিয়েছে ' কাস্টমার হোলো লক্ষ্মী ! তার অসম্মান যেন না হয় ' ।
সেদিন বিকেলটা যখন সন্ধ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন দোকানে তেমন ভিড় ছিল না । এমন সময় একটা মেয়ে আসল । ' ঐ গোলাপি পাথর দেওয়া দুলটা একটু দেখাবেন ? ' অভ্যেস মতো কাস্টমারের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে তার চোখ আটকে যায় একটা মেয়ের মা্যাভরা দৃষ্টিতে ।
হলুদ সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটার টানা টানা চোখে কি যেন একটা ছিল যে দেখেই ভালো লেগে মোহনের ! এরকমটা আগে কখনো হয়নি । যদিও মুখে সে বললো ' হ্যাঁ ম্যাডাম । এখনি দেখাচ্ছি । ' মেয়েটা মৃদু হাসি মেশানো সুরে বলে ' দূর থেকে ঐ কানেরদুলগুলো দেখেই আপনার দোকানে এলাম । ' সেদিন মেয়েটা কানেরদুলগুলো কেনে ।
পরদিন দোকানে বিকেল থেকে রাত গড়িয়ে যায় পরিচিত দিনের মতোই । রাতে বাড়ি ফিরে মোহনের হঠাৎ মনে হয় ' আচ্ছা , সে মেয়েটা কি আর কোনোদিন আমার দোকানে আসবে ? '
আবার পরের দিন বিকেল হতেই মোহনের চোখটা বার বার রাস্তার দিকে চলে যাচ্ছিল । কারনটা সে নিজেই বুঝতে পারছিল না । সেদিন মেয়েটা এল । চুড়ি কিনল সে । এরপর থেকে প্রায়ই মেয়েটা আসতে থাকলো । কখনো নিজের জন্য , কখনো কাউকে দেওয়ার জন্য জিনিস কিনতে থাকলো । একদিন যেমন বলেছিল ' ভালো কোয়ালিটির জিনিস দেখাবেন । একজনকে গিফট করবো । '
কে জানে কাকে দেবে ! মোহন জানে না । সে তো কিছুই জানে না । মেয়েটার নামটাও জানে না । মেয়েটা কলেজে পড়ে নাকি চাকরী করে সেটাও না । সন্ধ্যার দিকে ফেরার পথে দোকানে আসে । তারমানে সকালেও তো এই পথ দিয়েই কোথাও যায় !
আজকাল সকালের দিকে মোহনের অবাধ্য চোখগুলো মেয়েটাকে খুঁজে ফেরে । কিন্তু মেয়েটাকে দেখা যায় না । মোহন কি মেয়েটাকে জিজ্ঞস করতে পারে যে কেনো তাকে যেতে দেখে না ! কিন্তু এতে যদি মেয়েটা তাকে ভুল বোঝে । সে কি করে বোঝাবে তার কোনো বদ মতলব নেই । শুধু সে রোজ একবার তাকে দেখতে চায় । তাকে দেখলেই মোহনের সবকিছু যেন খুব ভালো লাগে । তবে কি সে বলবে যে তার ঘরে বৌ আছে । রোজগারপাতি ভালো হচ্ছে দেখে তার বাবা তাকে বছরখানেক আগে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে । মনে হচ্ছে এই প্রথম বৌ শব্দটা তার জীবনে কোনো কাজে লাগবে । নাহলে সবার বিয়ে হয় । তারও হয়েছে । এরমধ্যে কোনো বিশেষত্ব ছিল না ।
এদিকে সপ্তাহ খানেক হোলো মেয়েটা আসে না । এমনকি তাকে রাস্তায়ও দেখা যায় না !
একদিন চায়ের দোকানের পিন্টু বলে ' কি রে , তোর চিকনী চামেলী ফুড়ুৎ ? '
মোহন বলে ' কি বলতে চাস ? '
পিন্টু - যা দেখি তাই বলেছি
মোহন রাগত কন্ঠে বলে - কাস্টমার লক্ষ্মী ! ফালতু কথা বলবি না !
পিন্টু - লক্ষ্মী তোর সাথে হেসে হেসে কথা বলে
তখন মোহন পিন্টুর দিকে এগিয়ে চাপা গলায় বলে ' মুখ সামলে কথা বল ! বলছি !
তখন কোথা থেকে আরো কয়েকজন চলে এসে বলে ' ভদ্দরলোকের মেয়ের সাথে মহব্বত করছিস কর ! মস্ত আইটেম আছে ! আমাদেরও একটু দেখার ভাগ দে ! '
এবারে মোহন এগিয়ে এসে পিন্টুকে ধাক্কা দেয় । যদিও ঘড়ির দোকানের রতনকাকা এসে যায় বলে হাতাহাতি আর বেশী দূর এগোয় না । যদিও তারা মোহনকে শাষিয়ে যা্য় । আর হাসতে হাসতে বলে ' তোর চিড়িয়ার বিয়ে গেলো নাকি দেখ ! '
কিন্তু মোহনের মনে মনে ভাবে বিয়ে হলে সে জানতে পারতো ! যদিও তার এমন ভাবনার পিছনে কোনো কারন ছিল না ।
এর কয়েকদিন বাদে , একটা দুপুরবেলা মেয়েটা আসল ।দোকানটা ফাঁকা ছিল । গোলাপি সালোয়ার কামিজ পরেছিল সে । কানে ছিল গোলাপি পাথরের দুল । মোহন দেখে চিনতে পারলো , তার দোকান থেকে কেনা দুলগুলো ।
সেদিনও সে কানের দুল দেখতে চাইল । দেখতে দেখতে সে বলে ' আপনাদের মার্কেটটা শপিংমল হবে শুনছিলাম । '
মোহন বলে ' হ্যাঁ ম্যাডাম । '
ইশ দোকানটা আর থাকবে না ! আপনার দোকানটা ছোটো হলেও চয়েসেবল জিনিস আছে । তাই আসতাম । অনেকদিনের দোকান আপনার ? '
কথাগুলোর জাদুস্পর্শে মোহনের মুখটা উজ্জ্বল লাগে । সে বলে ' আসলে দোকানটা আমার বাবার ছিল। বাবার এখন অসুখে ভোগে । তাই আমি চালাই । '
মেয়েটা বলে তাহলে তো আপনার দোকানটার উপরেই সংসারটা নির্ভর ।
তা বলতে পারেন । তবে দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে । এখন সংসারে আমি , বাবা , মা আর আমার বৌ ।
এবারে মেয়েটা কানের দুল থেকে মুখ না তুলেই বলে ' আপনাদের তো আবার অল্প বয়সে বিয়ে হয় । '
সেদিন ওরা বলেছিল ভদ্দরলোকের মেয়ে । আজ মেয়েটা নিজেই বলছে যে তাদের নাকি তাড়াতাড়ি বিয়ে হয় ! এরমানে কি ? সে কি মেয়েটার থেকে অনেক আলাদা ? কোন অভদ্র কাজটা সে করেছে ? যদিও তার এই চিন্তা এক মুহূর্তেই উড়ে য়া্য় । সে বলে ওঠে ' দোকান ছাড়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই । দেখি আরো কয়েকজনকে সাথে পাই কিনা !
তখন মেয়েটা খুব শান্ত গলায় বলে ' দুনিয়া তার নিজের নিয়মে চলে । কে আর কার ইচ্ছে - অনিচ্ছের কথা জানতে চা্য় ! '
মোহন কথাটার কি অর্থ বোঝে বোঝা যায় না । সে বলে ' দুনিয়াদারি মানে ব্যবসা ম্যাডাম । শুধু লাভ আর লোকসানের হিসেব । '
মেয়েটা একথার কোনো উত্তর দিল না । তার ঠোটের কোনে মৃদু হাসির রেখা এসেই মিলে গেলো । সে একজোড়া কানের দুল হাতে নিয়ে বলে ' এমনিতেও আমার আর আপনার দোকানে আসা হবে না । ' মোহন কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলে ' আমার বিয়ে ঠিক হ্য়ে গেছে । আজ চাকরীটা ছেড়ে দিলাম । এদিকে আর আসা হবে না ।'
হঠাৎ কি একটা শক্তি এসে মোহনের কন্ঠরোধ করতে চায় । অস্পস্ট স্বরে সে বলে ' তাও যদি এদিকে আসেন তবে আসবেন । আর ঐ দুলজোড়ার দাম আজকে আমি নেবো না । '
মেয়েটা বলে ' তা কি করে হয় ? '
মোহন জবাব দেয় ' আপনি আমার দোকানের বাঁধা কাস্টমার ছিলেন । অনেক জিনিস কিনেছেন । অনেক জিনিস কিনলে দোকানির তরফ থেকে একটা ফ্রি গিফট থাকে । সেরকম কিছু একটা ধরে নিন । '
মেয়েটা শান্ত কন্ঠে বলে ' ঠিক আছে দাম দেবো না । '
এরপর মেয়েটা দোকান থেকে বেরিয়ে যায় । মোহনের দৃস্টি তাকে অনুসরণ করে । যতদূর দেখা যায় । যদিও মেয়েটা ফিরে তাকায় না।
আজ মোহন দোকানটা বিক্রি করে দিল । ।
এমনিতে বৃস্টি আসার সম্ভাবনা না থাকলে মোহন আকাশ দেখে না । আজ মাঝরাতে বাইরে বেরিয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে কেনো সে দোকানটা বেচলো ? লোভে ? নাকি মেয়েটা আর আসবে না বলে ? কংক্রিটের দোকানটাকে সে সাজাতো , গোছাতো । তা কি ইচ্ছে করে ? ভালোবেসে ? নাকি নেহাৎই অভ্যাসবশত অনিচ্ছায় ?
অজানার উদ্দেশ্য সে প্রশ্ন করে ' আমি কি কখনো জানতে পারবো মেয়েটা এখন কোথায় ? সেখানে কি নিজের ইচ্ছেতে আছে ? '
মোহনের চোখ থেকে নিঃসাড়ে জলধারা বইতে থাকে । জানা নেই তা তার ইচ্ছায় না অনিচ্ছায় ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৭