দেনার দায়ে ডুবে যাওয়া কবি
পদে পদে অপমানিত হওয়া কবি
বিধির বিধানে হেরে যাওয়া কবি
মনখারাপি মেঘ শোনায় তাঁর কিসসা
সুখ যাঁকে দিতে নারাজ দিতে হিসসা
লোহিত কণিকায় কবিতা ছিল যাঁর
মির্জা গালিব হোলো নাম তাঁর ।
আজ সকালে আকাশটা হাল্কা মেঘের চাদর মুড়িয়ে ছিল । মাঝে মধ্যে কৃষ্ণাভ মেঘ এসে এসরাজে মনখারাপি সুরের টান দিয়েই অদৃশ্য হচ্ছিল । এমন দিনে আমার একমাত্র আশ্রয় সর্বশ্রেষ্ঠ উর্দু কবি মির্জা আসদ-উল্লাহ বেগ খান অর্থাৎ মির্জা গালিব । যিনি সারাজীবন মনখারাপি সুরকে দূরে সরিয়ে রাখে মন-পসন্দ সুর তুলতে পেরেছিলেন ।
ছোটোবেলাতেই বাবা আবদুল্লা বেগ খানকে হারিয়ে ছিলেন । এরপর কাকা নসরুল্লাহ বেগ খানের কাছে তিনি ও তাঁর ভাই বড় হতে থাকেন ।১৩ বছর বয়সে উমরাও বেগমের সাথে তাঁর বিয়ে হ্য় । তারপর তিনি স্ত্রী এবং সিৎজোফ্রেনিক ভাইকে নিয়ে উত্তরপ্রদেশ থেকে দিল্লি চলে আসেন ।
দিল্লি ! শায়র মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের দিল্লি , হয়ে গেল কাসেম গলির গালিবের দিল্লি ।
দিল্লিতে গালিবের হাভেলী
কিন্তু হায় দিল্লি ! যে কবি ১১ বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছলেন , তিনি এখানে এসে স্বীকৃতি পেলেন না ।
১৮৩৫ সালের কোনো এক সময় । গালিবকে তাঁর বন্ধু হাজি মীর বললেন ' মির্জ়া, তুমি দিওয়ান ছাপাচ্ছ না কেন? এমন অসামান্য লেখ তুমি '
উত্তরে গালিব বলেন ' আমার দিওয়ান কে ছাপাবে হাজি সাহেব ? এই যে আপনার বইয়ের দোকানে বসে দু চারটে শের পড়বার গুস্তাখি করি, সে-ই আমার ভাল।'
এর জবাবে হাজি মীর এক গোছা কাগজ তাঁর সামনে তুলে ধরে বললেন ' আর আমি সেই বহুমূল্য গুস্তাখিগুলো লিখে রাখি ! '
আর একদিন এই হাজি মীরের বইয়ের দোকানে বসেই হঠাৎ শুনতে পেলেন এক সুরেলা নারী কন্ঠের গজল । যা ছিল তাঁরই লেখা শের । ' ‘ইয়ে ন থি হমারি কিসমত কে ভিসাল-এ .......................।
( Ye na thee Hamaaree Qismat ke Wisaal-e-Yaar hota
agar aur jeete rehte yaheen Intezaar hota...
Tere Waade par jiye ham to ye Jaan Jhoot jaanaa,
ke Khushi se mar na jaate agar Aetbaar hota... )
রহস্য উন্মোচন করলেন সেই বন্ধু হাজি মীর । গান গাইছিলেন এক সুন্দরী তওয়ায়েফ , নওয়াবজান । গালিবের অন্ধ ভক্ত । তিনি হাজির দোকান থেকে গালিবের শের টুকে নিয়ে যেতেন । শোনা যায় তাঁর কোঠায় যাতায়াতকারী এক কোতোয়াল একবার বলেছিল, ‘‘তুমি যে গালিবের প্রেমে পাগল, সে সারা দিল্লির কাছে দেনায় ডুবে আছে, জানো?’’ সুন্দরী নওয়াবজান উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘জানি। আর এটাও জানি যে একদিন তামাম হিন্দুস্থান তাঁর শায়রীর দেনায় ডুবে থাকবে।’’ তখন কে জানত এক তওয়ায়েফের ভবিষ্যৎবানী এমন অক্ষরে
অক্ষরে মিলে যাবে ।
দিল্লির দরবারে বাহাদুর শাহ জাফরের সভাকবি ইব্রাহিম জ়ওক। তিনিও গুণী । কিন্তু পদ চলে যাওয়ার ভয়ে শায়রীর চেয়ে জি-হুজুরিতেই তাঁর পারদর্শিতা ছিল বেশি। গালিবের শের তখন দিল্লির যুবকদের মুখে মুখে ঘুরছে । কিন্তু একটিও ছাপা হয়নি কোনো বইতে । তাঁকে ডাকা হল মুশায়েরায়। আদত ফারসিতে গজল পড়লেন,কিন্তু তারিফের বদলে জুটল পরিহাস। সম্রাটের অনুমতি না নিয়েই সে দিন দরবার ছেড়েছিলেন মির্জ়া।তবে আবার ডাক পেলেন কয়েক বছর পর । এবারে স্বয়ং জ়ওক তাঁকে মুশায়েরায় আমন্ত্রণ জানালেন।
যদিও গালিব জানতেন জ়ওক-এর উদ্দেশ্য কী ছিল । দিল্লির অলিগলির হাওয়ায় এই যে তাঁর নাম উড়ছে এখন, দরবারের জানলা দিয়ে সে-হাওয়া তো জ়ওক সাহেবের কানেও কথা বলছে। কী এমন লেখে এই গালিব, একবার সেটাই যাচাই করে নিতে চান রাজ কবি ।
মির্জ়ার কিছুই ছিল না। না ধনদৌলত, না শিরোপা, না শাসকের বদান্যতা। বরং বদনামটাই কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু যেটা ছিল, সেটা একজন শায়র হিসেবে মাথা উঁচু করা আত্মবিশ্বাস। তাকে সম্বল করেই বাহাদুর শাহ জাফর-এর মুশায়েরায় আসন গ্রহণ করেছিলেন মির্জা গালিব ।
সেই শম-আ জ্বালানো সন্ধের দরবারি মুশায়েরা দিল্লির কাব্য ইতিহাসে আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে। ‘হর এক বাত পে কহতে হো তুম কে তু ক্যা হ্যায়...’ ( Har eik baat pay kehtay ho tum key ‘toh kya hai’ ?
Tumhi kaho key ye andaaz-e-guftguu kya hai ?
Ragon may daudtay firnay kay ham nahi qayal,
Jab aankh hi say na tapkaa to firr lahoo kya hai ? )
এই একটি গজলেই মুশায়েরা মাত করেছিলেন মির্জা গালিব । রাজ কবি জ়ওকও তারিফ করতে বাধ্য হয়েছিলেন । যদিও শাহি ভেট কিছুই জোটেনি ।
এরপর হাজি মীরের কাছ থেকে নিজের শেরগুলো কুড়িয়ে বাড়িয়ে একটি দিওয়ান খাড়া করেছিলেন গালিব , তাঁর আগরানিবাসী বাল্যবন্ধুবংশীধর সেটা নিয়ে গেছিলেন। কিন্তু দিল্লি, আগরা বা লখনউ-এর কোনও প্রকাশক এই অনামী কবির দিওয়ান ছাপতে রাজি নয়।
এই প্রকাশক নামক জহুরিরা বরাবরই অসফল। আসল হিরেকে তাঁরা চিরকালই বহু দেরিতে চিনেছেন ।ব্যর্থ পান্ডুলিপি হাতে নিয়ে গালিব পা বাড়ালেন আবার কাসেম গলির নুক্করে ।
দিল্লিতে কবিতার চাইতে ধারের জন্য তখন মির্জ়াকে বেশি মানুষ চেনেন। রোজগার বলতে পারিবারিক নবাবি পেনশন । কিন্তু নবাবি আমল তখন অস্তাগামী । ব্রিটিশ সরকার পেনশনেও হস্তক্ষেপ করেছে।নতুন করে পিটিশন করতে হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। শেষমেশ মির্জ়ার উকিল হীরালাল বললেন, কলকাতায় গিয়ে লর্ড মেটক্যাফের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে পারলে কাজটা হলেও হতে পারে।
১৮৪৬ সাল । শিমলা বাজার, কলকাতা ।মানিকতলা গির্জার পিছনে একটা দু কামরার বাসা ভাড়া নিলেন গালিব । . শেষমেশ লর্ড মেটক্যাফে একটা তারিখ দিলেন মির্জাকে। তাঁর কবিতা বাজারে বিকোলেও হাওয়াতে ভেসেই পৌঁছে গেছে এদিক সেদিক । তাই
বাংলার মাটিতেও কয়েকজন সুহৃদ মির্জ়ার সম্মানে এক মুশায়েরার আয়োজন করলেন । তাঁর পড়ে পাওয়া কবিখ্যাতির কিছুটা কলকাতাতেও পৌঁছেছে দেখে বেশ অবাকই হলেনগালিব । রাজি হলেন মুশায়েরায় যেতে। আর সেখানেই ঘটল বিপত্তি। সভায় সংখ্যা গরিষ্ঠরা বলেন “ উর্দু আসলে মুসলমানদের ভাষা।“ বেশ বিরক্ত হয়েই বিরোধিতা করলেন মির্জ়া, ‘‘উর্দুর জন্ম ভারতবর্ষের সেনা ছাউনিগুলোতে। উর্দু শব্দের অর্থই তো ছাউনি। সেই ভাষা আজ কেবল মুসলমানদের সম্পত্তি হয়ে গেল কী করে? ভাষার ওপর ধর্মের মালিকানা হয় কখনও? তাহলে আমীর খসরু অওয়ধি-তে লিখলেন কেন আর ফরিদ কেন লিখলেন পঞ্জাবিতে? উর্দু তামাম হিন্দুস্তানের ভাষা। দয়া করে কেবল ইসলামীদের ভাষা আখ্যা দিয়ে তাকে ছোট করবেন না। হিন্দু আর মুসলমান একই মাটির সন্তান, ভাষার প্রশ্নে তাদের বিরোধ ঘটিয়ে দেশটাকে লুটে নিতে চাইছে সাহেবরা। সেটা কি আপনারা বুঝতে পারছেন না?’’হায় সেদিন কবি এটা জানতেন না , একদিন এই উর্দু ভাষাই জোড় করে চাপিয়ে দেওয়া হবে । যদিও সেদিন গালিব শের পড়লেন না আর। মুশায়েরায় হাজির ছিলেন কয়েকজন ব্রিটিশ। মির্জার বক্তব্য লর্ড মেটক্যাফের কানে পৌঁছতে এক দিনও লাগল না। খারিজ হল মির্জার পেনশনের আর্জি। ব্যর্থ , ক্লান্ত কবি খালি হাতে ফিরে চললেন দিল্লি।
১৮৫৪ বা ৫৫ সাল । দেনা। আরও দেনা। হুমকি। শাসানি। শেষে পাওনাদারদের ডিক্রি জারি। শোধ না করতে পারলে আদালতে জবাবদিহি।কীভাবে সমাধান হবে এই পরিস্থিতির? জানেন না মির্জা ।
সন্ধ্যা নামতেই বেরিয়ে যান সামনের নুক্কড়ের পাকা জুয়াড়িদের আসরে। কোতোয়াল বহুবার তাঁদের গ্রেফতারের হুমকি দিয়েছে, কিন্তু ওই জুয়াই গালিবের শেষ ভরসা। যদি ভাগ্য ফেরে!
এমন সময়ে এক প্রভাবশালী বন্ধুর দৌলতে মোটা বেতনের অধ্যাপনার চাকরি পেলেন দিল্লি কলেজে। ফারসি পড়াতে হবে, পাকা চাকরি।
প্রথম দিন গিয়ে আর গেলেন না তিনি। তদবিরকারী বন্ধুটি খবর পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন এই বিরাগের কারণ। মির্জা জানালেন, প্রথম দিন যখন তিনি টাঙ্গা থেকে কলেজের দরজায় নামেন, তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য কেউ সেখানে ছিলেন না। এই অসম্মান তিনি মেনে নিতে পারেননি।
বন্ধুটি এ সব শুনেও তাঁর অবস্থার কথা মনে করিয়ে দেওয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘দোস্ত, এ বয়সে এসে চাকরি করলে সম্মান অর্জনের জন্য করব। সম্মান খোয়ানোর জন্য নয়।’’এটাকে নিস্ফল কবির অহঙ্কার মনে হতে পারে । কিন্তু এ ছিল এক কবির চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস ।
এর মাস ছয়েক পরের কথা। আদালতে হাজিরা দিতে হল ডিক্রির কারণে। তার পরপরই প্রকাশ্যে জুয়া খেলার অপরাধে ছ’মাসের হাজতবাস। স্বয়ং বাহাদুর শাহ জাফরের হুকুমনামাও তাঁকে মুক্ত করতে পারল না।
এক জীবনে যত রকমের বিপদ হতে পারে, দেখে নিলেন মির্জ়া। ভোগ করে নিলেন সব ধরনের অপমানের মুকুট। ভেঙে গেল শরীর ।আর কবি পরিবারকে এক বেলার জন্যেও সুদিন এনে দিতে পারলেন না ।
তবে হাজতে থাকতেই বন্ধু বংশীধর খবর এনেছিলেন, খোদ লখনউ-এর নামজাদা প্রকাশকের ঘর থেকে বেরিয়েছে গালিবের প্রথম দিওয়ান, কয়েক দিনের মধ্যে তার দ্বিতীয় সংস্করণও ছাপাতে হয়েছে।
প্রতিভা যতই থাকুক , সাফল্য আসলেই বোধহয় তা মর্যাদা পায় ।
হাজতবাস শেষ হবার পরেই তাঁকে আপ্যায়ন করে দরবারে ডেকে ‘দবির-উল-মুলক’ খেতাবে ভূষিত করেন বাহাদুর শাহ, সভাকবি জ়ওক-ও উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গে প্রচুর উপঢৌকন ও বেশ কিছু মুদ্রা। সংসারের অভাব শেষমেশ কিছুটা হলেও মিটল, ধার শোধ করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন গালিব ।
১৮৫৭। সিপাহি বিদ্রোহে গোটা দেশ উত্তাল, দিল্লিতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার আগুন ছড়িয়েছে হু হু করে। কারফিউ চলছে। বসে এ কোন দিল্লি? এ কেমন ভারতবর্ষ? এটা কি সেই দেশ যেখানে এক মুসলিম বন্ধু গালিবের শের সংরক্ষণ করে রাখেন তো আর এক হিন্দু বন্ধু তাঁর পান্ডুলিপি ছাপানোর আশায় এক শহর থেকে আর এক শহরে ঘুরে ঘুরে বেড়ান । যাও বা সংসারে সামান্য টাকা এল, প্রিয় শহরটা ছারখার হয়ে গেল চোখের সামনে।
বেখেয়ালে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়া সিৎজোফ্রেনিক ভাই ইউসুফ নিহত হলেন ব্রিটিশ পেয়াদার গুলিতে। সারাজীবনের বন্ধু হাজি মীরকে হত্যা করে গাছে টাঙিয়ে দিল হিন্দুরা, জ্বালিয়ে দিল তাঁর বইয়ের দোকান। অগুনতি বইয়ের সঙ্গে চিরকালের মতো ছাই হয়ে গেল গালিবের বহু শের, যা হাজি নিজের হাতে লিখে রাখতেন রোজ। লখনউ-এর নবাব, সুকবি ওয়াজিদ আলি শাহকে গৃহবন্দি করে রাখা হল কলকাতার মেটিয়াব্রুজে। দিল্লি ছাড়তে বাধ্য হলেন বাহাদুর শাহ জাফর ।
এ বার অবসানের অপেক্ষায়। ধোঁয়া-ওঠা পুড়ে-যাওয়া দিল্লির রাস্তায় তখন খুব কম পড়ত মির্জ়ার ক্লান্ত দুটো পা। ইয়ার দোস্ত-রা মৃত, গানবাজনা বন্ধ শহরে, মদেও আর তেমন নেশা নেই। ‘নেই’ দিয়ে ঘিরে থাকা সময়ে আছে বলতে ছিল কেবল লেখা।আরও একবার কলম তুলে নিলেন গালিব । লিখলেন, ‘হুই মুদ্দত কে গালিব মর গয়া পর ইয়াদ আতা হ্যায় (Hui muddat ki 'Ghalib' mar gaya par yaad aata hai
Wo har ek baat par kehna ke yun hota to kya hota )
১৮৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী গালিবের জানাজা কাসেম গলির পথে এগিয়ে চলল ।
গালিবের সমাধি
আসলে গালিবের মতো কবির কখনোই মৃত্যু হতে পারে না । আজ যখন দাঙ্গা মানে একটা ইস্যু । তা নিয়ে কে কিভাবে চিৎকার করলে বেশী ফুটেজ পাওয়া যাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় । শিল্পের থেকে শিল্পের ভণিতাটাই এখন বেশী বলে মনে হয় । ঠিক এখন গালিবের মতো কবিই পথ দেখান । তিনিই শেখান কিভাবে রক্তে ভেজা পান্ডুলিপি হাতে নিয়ে নতুন অক্ষর সাজাতে হয় ।
তথ্যঋণ -- Mirza Ghalib: A Biographical Scenario
by Gulzar
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১১:৪৯